“it matters not what you think, it matters how you think” — ক্রিস্টোফার হিচেন্স

ব্রেভিক বিষয়ে বিপ্লব পালের চমৎকার লেখাটি পড়তে গিয়ে জর্জ অরওয়েলের Notes on Nationalism (১৯৪৫) প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। প্রবন্ধটি অনুবাদ করা শুরু করলাম। চার বা পাঁচ পর্ব লাগবে। প্রবন্ধে অরওয়েলের নিজের কিছু ফুটনোট আছে, সেগুলি ১, ২, ৩…এভাবে নম্বরীকৃত হবে। নানান কারণে অনুবাদকের কিছু ফুটনোটও দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি, সেগুলির নম্বর হবে ১অ, ২অ, ৩অ …ইত্যাদি।

প্রথম পর্ব

প্রথম পর্বের পরে…
চেস্টারটন-সুলভ রাজনৈতিক ক্যাথলিসিজম ও কমিউনিজমের মধ্যে মিল নিঃসন্দেহে বিস্তর। এদের যেকোনটির সাথে আবার মিল রয়েছে স্কট জাতীয়তাবাদ, জায়নবাদ, ইহুদীবিদ্বেষ অথবা ট্রটস্কিবাদের। সব ধরণের জাতীয়তাবাদ একদম এক, এমন দাবী অবশ্য সরলীকরণ হবে — এমনকি তাদের মানসিক আবহও হুবুহু এক নয়। তারপরও কিছু নিয়ম সব ক্ষেত্রেই খাটে। জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হচ্ছে:

মোহাচ্ছন্নতা: জাতীয়তাবাদী তার চিন্তাশক্তি, লেখনী ও জিহ্বা নিজের গোত্রের শ্রেষ্ঠতা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে খরচ করতে একান্ত অনীহ। গোত্রানুগত্য গোপন রাখা তার পক্ষে অসম্ভব, বা অত্যন্ত কঠিন। নিজ পক্ষের সামান্যতম নিন্দা বা বিরোধী কোন গোত্রের পরোক্ষতম প্রশংসা তার মধ্যে শক্ত মানসিক কোষ্ঠকাঠিন্যের সৃষ্টি করে; তীব্র-প্রতিবাদ নির্গমনের মাধ্যমেই শুধু যা থেকে তার মুক্তি মেলে। এই গোত্র যদি আয়ারল্যাণ্ড বা ভারতের মত একটি আসল দেশ হয়, তাহলে সে ওই দেশের সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বই শুধু নয়, দাবি করবে শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, ভাষার গঠন, লোকজনের রূপমাধূর্য্য, এমনকি আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রন্ধনশিল্পে ওই দেশের সর্বোত্তমতা [৬অ]। তার দেশের খবর কত বড় হেডলাইন দখল করল, সব দেশ তালিকায় কত নম্বরে তার নাম উল্লেখিত হল[], দেশের পতাকা যথেষ্ট শান-শওকত সহ প্রদর্শিত হল কিনা, এসব ব্যাপারে তার মধ্যে উৎকট সংবেদনশীলতা পরিলক্ষিত হবে। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় নাম-ধাম একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে [৭অ]। জাতীয়তাবাদী বিপ্লব বা স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হওয়ার পরে অনেক দেশ তাদের নাম পরিবর্তন করে, এবং যে দেশ বা গোত্রের ব্যাপারে শক্তিশালী আবেগ প্রবহমান, তাদের প্রায়ই একাধিক নাম থাকে, যাদের প্রত্যেকটি ভিন্ন দ্যোতনা বহন করে [৮অ]। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধে দু-পক্ষ মিলিয়ে নয়-দশটি নাম প্রচলিত ছিল, যেগুলি বিভিন্ন মাত্রায় প্রেম ও ঘৃণা প্রকাশ করার কাজে ব্যবহৃত হত। কিছু নাম (যেমন, ফ্রাংকোর সমর্থকদের “প্যাট্রিয়ট” নাম, বা সরকার-সমর্থকদের “লয়ালিস্ট” নাম) স্পষ্টতই প্রশ্নের জন্ম দেয়, এবং এতরকম নামের কোনটার ব্যাপারে দু-পক্ষ একমত হতে পারেনি [৯অ]। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদীর লক্ষ্য বিরোধী দলের ভাষার বদলে নিজের ভাষার প্রচলন ঘটানো। ইংরেজভাষীদের মধ্যে এই সংগ্রাম সূক্ষ্মভাবে আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে সংগ্রাম হিসেবে পরিস্ফুট হয় [১০অ]। ইংরেজবিরোধী মার্কিনীরা যেকোন মূল্যে ব্রিটিশ-জাত প্রকাশভঙ্গি পরিহার করবে। ইংরেজী ভাষায় কেউ কেউ ল্যাটিন প্রভাব বিস্তার করতে উদ্গত, আর অন্য একদল জার্মান প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী — এসব কিছুর পেছনে জাতীয়তাবাদী লক্ষ্য বিদ্যমান [১১অ]। স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা ভাটি অঞ্চলের স্কটিশদের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণা করে থাকে, এবং যেসব সমাজতন্ত্রীর জাতীয়তাবাদ শ্রেণী বিদ্বেষের রূপ নেয় তারা বিবিসি কথনভঙ্গীর বিরূদ্ধে সদা-খড়্গহস্ত। জাতীয়তাবাদীরা sympathetic magic-এও বিশ্বাস করে বলে মাঝে মাঝে বোধ হয় — রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কুশপুত্তলিকা দাহ, বা প্রতিপক্ষের ছবিতে গুলি করার আচার সম্ভবত এই প্রবণতার প্রকাশ।

ভারসাম্যহীনতা: আবেগের তীব্রতা জাতীয়তাবাদী অনুভূতির পরিবর্তনহীনতার গ্যারান্টি নয়। প্রথমত, যেমন আগেই বলেছি, জাতীয়তাবাদের পাত্র হতে পারে একটি বিদেশী রাষ্ট্র। প্রায়ই দেখা যায়, শীর্ষস্থানীয় জাতীয়তাবাদী নেতারা ওই জাতির সদস্যই নয়। কেউ কেউ সরাসরি বিদেশী, বা যেটা আরো বেশি দেখা যায় — এদের অনেকে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত যেখানে জাতি-পরিচয় অপরিষ্কার। এর উদাহরণ স্টালিন, হিটলার, নেপোলিয়ঁ, দ্য ভ্যালেরা, ডিসরেইলী, পঁোকারে, বিভারব্রুকসর্ব-জার্মান জাতীয়তাবাদের জনকদের একজন হচ্ছেন হিউস্টন চেম্বারলেইন (এ লোক ইংরেজ)। বিগত পঞ্চাশ বা একশ বছরে স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে বিদ্যমান। লাফকাদিয়ো হার্নের ক্ষেত্রে জাপান, কার্লাইল ও তার সমসাময়িক অনেকের ক্ষেত্রে জার্মানী, আমাদের নিজেদের সময়ে বহু বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে রাশিয়া এই স্থানান্তরের লক্ষ্য। অদ্ভুত ব্যাপার হল, পুনঃ-স্থানান্তরও আবার সম্ভব। পূজার ঘট হঠাৎ করে হতে পারে বিদ্বেষের পাত্র, এবং শূণ্য মন্দিরে নতুন দেবতার আবাহন শুরু হতে পারে মূহুর্তের মধ্যে। এইচ, জি, ওয়েলসের Outline of History-র প্রথম সংস্করণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বাহু প্রশংসা করেছেন তিনি, তার সাথে বর্তমানের কমিউনিস্টদের সোভিয়েত বন্দনা তুলনীয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে ওয়েলসের সমালোচনামুক্ত স্তুতি রূপান্তরিত হয় কট্টর শত্রুতায়। গোঁড়া কমিউনিস্ট কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক দিনের মধ্যে গোঁড়া ট্রটস্কিবাদীতে রূপান্তরিত হয়েছে, এই খেল আজকাল ডালভাতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে ফ্যাসিস্ট আন্দোলনগুলিতে যারা যোগদান করেছিল তাদের একটা বড় অংশ ছিল কমিউনিস্টরা, এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উল্টো হাওয়া বইতে দেখা গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। জাতীয়তাবাদীর অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মানসিক গঠন, তার আবেগের পাত্র পরিবর্তিত শুধু নয়, এমনকি নিরাকার হয়ে পড়াও অসম্ভব নয়।

একজন বুদ্ধিজীবির জন্য জাতীয়তাবাদী স্থানান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা চেস্টারটন প্রসঙ্গে আমি আগে অল্প উল্লেখ করেছি। এই স্থানান্তর তাকে আরো জাতীয়তাবাদী, আরো অশ্লীল, আরো মূঢ়, আরো অসৎ, আরো ক্ষতিকর হওয়ার টেন্ডার দেয় — তার নিজের দেশ, বা যে গোত্র সম্বন্ধে তার সত্যিকারের জ্ঞান রয়েছে তার ব্যাপারে এতটা তার পক্ষে সম্ভব হতনা [১২অ]। মোটের উপর বুদ্ধিমান ও সংবেদনীশীল লোকজনকে যখন দেখা যায় স্টালিন বা রেড আর্মি সম্বন্ধে দাসমনোভাবান্ন কুৎসিৎ আবর্জনা লিখতে, তখন বোঝা যায় কেবলমাত্র কোন একটা মানসিক স্থানচ্যূতির ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমাদের মত সমাজে বুদ্ধিজীবী বলা চলে এমন কারো পক্ষে নিজ দেশ সম্বন্ধে গভীর আবেগ সাধারণত দেখা যায় না। জনমত — অর্থাৎ যে ধরণের মতের সাথে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে সে পরিচিত — তা এধরণের আবেগের ভাল চারণক্ষেত্র নয়। তার আশপাশের অধিকাংশ লোক সন্দেহবাদী ও আনুগত্যহীন (নিজ দেশের প্রতি): ফলে সে নিজেও একই ধরণের মনোভাব ধারণ করতে পারে স্রেফ অনুকরণপ্রিয়তা বা পাছে-লোকে-কিছু-বলে মনোভাবের কারণে — এর ফলে সে হাতের কাছের জাতীয়তাবাদ পরিত্যাগ করে বটে, কিন্তু সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতা অর্জন করে না। কারণ “মাতৃভূমি”র প্রয়োজন তার ফুরিয়ে যায় নি, কাজেই তার আবেগ বিদেশগামী হয়। বিদেশী কিছু একটা আঁকড়ে ধরে সেই একই ধরণের আবেগে সে গা ভাসায় যা থেকে কিনা সে মুক্তি পেয়েছে বলে কল্পনা করে। ঈশ্বর, রাজা, সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ পতাকা — আস্তাকঁুড়ে আপাত-নিক্ষিপ্ত এসব প্রতিমা ভিন্ন নামে ফিরে আসে, এবং যেহেতু এই মানসিক হাতসাফাই দিয়ে নিজের চোখেই সে ধুলো দিয়েছে — তাই নতুন পূজার ঢাক বাজতে থাকে নির্বিবাদে। কোরবানীর নামে গরু কেটে মাংস খাওয়ার মত, স্থানান্তরিত জাতীয়তাবাদ নিজের ব্যবহারের পরিবর্তন না ঘটিয়ে মুক্তি অর্জনের একটি উপায়।

বাস্তবতার সাথে অসংশ্লিষ্টতা: একই ধরণের একাধিক পরিস্থিতির মধ্যে কোন মিল না দেখতে পাওয়ার ব্যাপারে সব জাতীয়তাবাদী সিদ্ধহস্ত। একজন ব্রিটিশ রক্ষণশীল ইউরোপে স্বরাজ সমর্থন করবে, কিন্তু ভারতে তার বিরোধিতা করবে — পরস্পর-বিরোধিতার কোন অনুভূতি ছাড়াই। জাতীয়তাবাদীর কাছে একটি কাজ তার আত্মগুণে ভাল বা মন্দ নয়, বরং কে সেটা করছে তার উপর নির্ভর করে ভাল বা মন্দ। নির্যাতন, দাসত্ব, জনপদ-কে-জনপদ বাস্তুচ্যুত করা, বিনা বিচারে কারাদন্ড, জালিয়াতি, জিম্মিকরণ, রাজনৈতিক খুন, বেসামরিক জনগণের ওপর বোমা নিক্ষেপ — যত বড় অন্যায়ই হোক, এই কাজগুলি যখন “আমাদের” পক্ষ করে তখন তার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতার অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। Liberal News Chronicle অসহ্য বর্বরতার উদাহরণ হিসেবে জার্মানরা কিভাবে রুশদের ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে তার ছবি ছাপালো, তারপর দু-এক বছরের মধ্যে রুশদের হাতে খুন হওয়া জার্মানদের প্রায় হুবুহু একই ধরনের ছবি ছাপালো উষ্ণ প্রশংসার সাথে []। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। ইতিহাসকে দেখা হয় জাতীয়তাবাদী লেন্স দিয়ে। ইনকুইজিশন, স্টার চেম্বারের নির্যাতন, ব্রিটিশ সরকার সমর্থিত জলদস্যুদের কর্মকাণ্ড (উদাহরণ স্বরূপ স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক এর কথা বলা যায়, স্পেনীয় যুদ্ধবন্দীদের জীবন্ত ডুবিয়ে মারা যার অভ্যাস ছিল), ফরাসী বিপ্লব কালীন সন্ত্রাস, সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতীয় বন্দীদের কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয়া, ক্রমওয়েলের সৈন্যদের আইরিশ নারীদের মুখ ছুরি দিয়ে কেটে ফালাফালা করা — এসবই নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ (এমনকি প্রশংসনীয়) রূপ ধারণ করে যখন “সঠিক” কারণে এগুলো করা হয়।

গত পঁচিশ বছরের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব যে প্রায় বছরই বিশ্বের কোন না কোন দেশ থেকে নির্যাতনের খবর আমাদের কাছে পৌঁেছছে, কিন্তু কোন একটা ঘটনাও — স্পেন, রাশিয়া, চীন, হাঙ্গেরী, মেক্সিকো, অমৃসতর[১৩অ], স্মিরনা — সব বুদ্ধিজীবির কাছে নিন্দাযোগ্য মনে হয়নি। এসব ঘটনা নিন্দনীয় কিনা, বা এমনকি ঘটেছে কিনা, তা নির্ধারিত হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে।
জাতীয়তাবাদী যে শুধু নিজ পক্ষের অত্যাচারের নিন্দা করেনা তাই না, সেই অত্যাচারের কাহিনী আশ্চর্যভাবে তার কর্ণকুহরে প্রবেশ পর্যন্ত করেনা। হিটলারের ব্রিটিশ সমর্থকেরা ছয়-ছয়টি বছর ধরে ডাচাও বা বুকেনওয়ালড কনসেনট্রেশন ক্যামপ সম্বন্ধে কিছুই না জানার বিস্ময়কর পারঙ্গমতা দেখিয়েছিল। আবার যারা জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যামপ-এর ব্যাপারে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে, তাদের অনেকেই জানেনা যে, বা খুব অস্পষ্টভাবে জানে যে, রাশিয়াতেও কনসেনট্রেশন ক্যামপ রয়েছে। বিরাট বিরাট ঘটনা — যেমন উইক্রেনে ১৯৩৩ এর দুর্ভিক্ষে লক্ষ-লক্ষ-লক্ষ মানুষের মৃত্য — কিভাবে যেন ইংরেজ রুশ-সমর্থকদের চোখ এড়িয়ে যায়। বহু ইংরেজ বর্তমান যুদ্ধে জার্মান ও পোলিশ ইহুদীদের উপর চলা গণহত্যা সম্বন্ধে কিসুই জানেনা। নিজেদের ইহুদীবিদ্বেষ এই বিরাট অপরাধকে তাদের বিবেকের পট থেকে মুছে ফেলতে সাহায্য করেছে। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় একটি ঘটনা একই সাথে জানা ও অজানা হতে পারে, একই সাথে সত্য ও মিথ্যা হতে পারে। অসহ্য সত্যকে অভ্যস্ত হাতে মাছি তাড়ানোর মত সরিয়ে ফেলে যৌক্তিক চিন্তার মধ্যে তার প্রবেশাধিকার রূদ্ধ করতে জাতীয়তাবাদী সিদ্ধহস্ত। আবার এমন হতে পারে যে এসব সত্য চিন্তারও অগোচরে ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে, কিন্তু প্রকাশ্যে (এমনকি নিজের কাছেও) তা স্বীকার করা হয় না।

অতীতকে পরিবর্তন করা সম্ভব — এ হল প্রতিটি জাতীয়তাবাদীর স্বপ্নদোষ। দিনের একটা বড় অংশ সে কল্পনার জগতে বিরাজ করে , ‍যেখানে যা হওয়া উচিত তাই ঘটেছে — হয়ত স্প্যানিশ আর্মাডা বিজয়লাভ করেছে, অথবা অক্টোবর বিপ্লব ১৯১৮ সালে পরাজিত হয়েছে — এবং আকাশের এই কুসুমগুলিকে সে সুযোগ পেলেই ইতিহাসের পাতায় পরিয়ে দিতে চায়। আজকের দিনের প্রপাগান্ডার একটা বড় অংশ বিশুদ্ধ জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সত্যি ঘটনাকে গোপন করা হয়, তারিখ বদলানো হয়, উদ্ধৃতির প্রসঙ্গবিকৃত উপস্থাপন করা হয় বা পরিবর্তন করা হয়, যাতে তার অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেসব ঘটনা না ঘটলেই ভাল হত তা অনুল্লেখিত থাকে এবং পরিশেষে অস্বীকার করা হয়[]। ১৯২৭ সালে চাং কাই শেক শত শত কমিউনিস্টকে জীবন্ত সিদ্ধ করে মারল, কিন্তু বছর দশেকের মধ্যে দেখা গেল সে বামপন্থীদের চোখে একজন বিরাট বীর। বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনে সে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী ক্যাম্পে যোগদান করল, কাজেই তখন মনে করা গেল যে কমিউনিস্ট সিদ্ধ করার ব্যাপারটা গুনতির মধ্যে পড়ে না, বা এরকম কিছু ঘটেইনি। প্রপাগান্ডার মূল লক্ষ্য অবশ্যই বর্তমান জনমতকে প্রভাবিত করা, কিন্তু যারা ইতিহাসের পুনর্লিখনে লিপ্ত তারা সম্ভবত মনের একটা অংশ দিয়ে বিশ্বাস করে যে এসব করে তারা সত্যিই অতীতকে পরিবর্তন করছে। রুশ গৃহযুদ্ধে ট্রটস্কির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা[১৪অ] গোপন করার জন্য যে বিস্তৃত জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তা দেখার পরে বিশ্বাস করা কঠিন যে যারা এগুলো করেছে তারা স্রেফ মিথ্যা কথা বলছে। সম্ভবত তাদের মনে এই জাল ইতিহাসটাই আসলে ঘটেছিল, “আসলে”-র কোন ঐশ্বরিক অর্থে, কাজেই রেকর্ড পরিবর্তন করে এই “আসল” সত্যকে বের করে আনায় কোন ক্ষতি নেই।

পৃথিবীর একাংশ থেকে অন্যান্য অংশগুলি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতাকে উস্কে দেয়া হচ্ছে, কারণ আসলে কি ঘটছে তা আজকাল বোঝা মুশকিল। ফলে বিরাট বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত লোক মারা গেছে, তার হিসেব করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব ঘটনার সংবাদ আমরা অনবরত পাচ্ছি ‍‍– যুদ্ধ, গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব — তা সাধারণ একজন লোকের মধ্যে অবাস্তবতার অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। ঘটনা আসলে কি ঘটেছে তা যাচাই করবার কোন উপায় নাই, এমনকি আদৌ ঘটেছে কিনা তাও বোঝার উপায় নেই, এবং বিভিন্ন পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বিশ্লেষণ আসছে। ১৯৪৪ সালের ওয়ারশ উত্থানের সময় কার কি ভাল-মন্দ ভূমিকা ছিল? পোলান্ডে জার্মাদের গ্যাস ওভেনের ব্যাপারটা কি সত্যি? বাংলার দর্ুভিক্ষর জন্য কে আসলে দায়ী? এই প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য সম্ভবত নাগালের বাইরে নয় — কিন্তু প্রায় যেকোন সংবাদপত্রে ঘটনাগুলিকে এমন অসৎভাবে উপস্থাপন করা হয় যে সাধারণ পাঠক হয় এসব মিথ্যা হজম করে, অথবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তাদেরকে দোষও দেয়া যায়না। সত্যি কি ঘটছে সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা উন্মাদ বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সহায়তা করে। যেহেতু কোন কিছুই পুরোপুরি প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা সম্ভব হয়না, কাজেই সবচেয়ে সুনিশ্চিত সত্যকেও ধৃষ্টতার সাথে অস্বীকার করা যায়। তাছাড়া, যদিও জাতীয়তাবাদী সার্বক্ষণিকভাবে ক্ষমতা, জয়, পরাজয়, প্রতিহিংসার ব্যাপারে চিন্তিত, বাস্তবে কি ঘটছে সে ব্যাপারে সে প্রায়ই উদাসীন। তার লক্ষ্য অন্য গোত্রের তুলনায় নিজের গোত্রের শ্রেষ্ঠতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া, এবং এই মনোতৃপ্তি লাভের জন্য জন্য শত্রুর উপর বাক-তাল্লা মেরে টেক্কা দেয়া সহায়প্রদায়ী, বাস্তবতার নির্মোহ নিরীক্ষা তুলনায় গাত্রপ্রদাহী হওয়ার সম্ভাবনা। জাতীয়তাবাদী মতান্তর তাই বিতর্ক-প্রতিযোগিতা পর্যায়ের। এগুলো সবসময়ই সমাধানহীন, কারণ সবারই ধারণা সে নিজেই জিতেছে। কোন কোন জাতীয়তাবাদী বাস্তবতার সাথে সংশ্লিষ্টতা-রহিত এক জগতে ক্ষমতা ও বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর, অর্থাৎ প্রায়-সিজোফ্রেনিক।

চলবে…

ফুটনোট

[] অ্যাংলো-আমেরিকান শব্দটাই কোন কোন মার্কিনীর পছন্দ না। তাঁরা চান এর বদলে অ্যামেরিকো-ব্রিটিশ বলতে।

[] News Chronicle তার পাঠকদের উপদেশ দিয়েছে ফিল্মে পুরো ফাঁসির দৃশ্যটি গিয়ে দেখতে, ক্লোজ-আপ সহ। The Star-এ প্রকাশিত হয়েছে, আপাত অনুমোদনের ভঙ্গিতে, প্যারিসের জনতা কর্তৃক নারী নাজি দালালদের উলঙ্গ করে উপহাস করার ছবি। এই ছবির সাথে অসাধারণ মিল রয়েছে নাজিদের প্রকাশিত ছবির সাথে যেখানে বার্লিনের জনতা ইহুদীদের সাথে একই ধরণের আচরণে লিপ্ত।

[] এর একটা উদাহরণ হচ্ছে রুশ-জার্মান চুক্তি, যা জনস্মৃতি থেকে দ্রুত মুছে ফেলা হচ্ছে। আমার পরিচিত একজন রুশ জানাচ্ছেন যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর রুশ সংকলন থেকে এর মধ্যেই এই ঘটনাটিকে হাপিস করে দেয়া হয়েছে।

[৬অ] হাহ! িইউটিউবে খুঁজে দেখুন “Everything comes from India” শীর্ষক ভিডিওগুলি

[৭অ] বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নামকরণ যুদ্ধ লক্ষণীয়।

[৮অ] কৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনাম বা আল্লাহর ৯৯ রকম নাম লক্ষণীয়।

[৯অ] উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই যুদ্ধে অরওয়েল ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি অ্যানার্কিস্ট গোত্রের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি “লয়ালিস্ট” ছিলেন।

[১০অ] অসাধারণ পর্যবেক্ষন। বাংলাদেশে লক্ষ্য করুন দেশ-নেত্রী বনাম জননেত্রী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্য করুন pro-choice বনাম pro-life। আঞ্চলিক ভাষার প্রশ্নে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চলমান বিবিধ ভাষা বিতর্ক “জাতীয়তাবাদী” রাজনীতির অংশ বলে মনে করার কারণ আছে।

[১১অ] বাংলা ভাষায় সংস্কৃত বনাম আরবী-ফারসী প্রভাবের সূক্ষ্ম (বা স্থুল) জাতীয়তাবাদী (পড়ুন “ধর্মীয়”) প্রতিযোগিতা লক্ষ্যনীয়।

[১২অ] অথবা, বাংলা প্রবাদ মতে — “হিন্দু যখন মুসলমান হয়, গরু খাওয়ার যম হয়”

[১৩অ] অরওয়েল জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা বলছেন।

[১৪অ] “গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা” বললেও আসলে কম বলা হয়। ট্রটস্কি রেড আর্মির মাথা ছিলেন।