অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বই আকারে বেরিয়েছে ২০০৭ সালে। পরের বছর বেরিয়েছে এর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। মুক্তমনায় যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল – তখনই পড়েছিলাম সবগুলো পর্ব। কিন্তু আমার স্বভাব কুঁড়েমির কারণে কোন প্রতিক্রিয়াই লিখে রাখা হয়নি তখন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে গিয়ে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের প্রায় সবগুলো বইয়ের দোকানে খোঁজ করেও বইটা পাইনি। ২০০৯ এবং ২০১০-এও একই অবস্থা। একুশের বইমেলার পরে দরকারি বইগুলো কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। বাংলাদেশের বই-বিপণন ব্যবস্থা এখনো তেমন পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সেমিস্টার শুরু হয়ে যায়- তাই বইমেলায় থাকা হয় না কোন বছরই। সুতরাং বন্ধুরাই ভরসা। তারা আমার টেলিফোন-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বইমেলায় গিয়ে প্রকাশকের কাছ থেকে বই জোগাড় করে পাঠায়। মহাদেশ পাড়ি দিয়ে আমার হাতে এসে পৌঁছোয় ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এসেও এর ভ্রমণ শেষ হয় না। বইটা যখন আবার পড়ে শেষ করলাম তখন আমি লস এঞ্জেলেসের টম ব্রাডলি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তিন নম্বর টার্মিনালে। আর পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখছি মেক্সিকো সিটির একটা হোটেলে বসে।

একটা ভালো বই নাকি অনন্ত যৌবনা। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে জেনেছি এ’কথা। অবশ্য বইয়ের যৌবন পরিমাপ করার মাপকাঠি কী তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না এখন। তবে আমার মনে হয় কোন বইয়ের আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি পাঠক-নির্ভর। আবার বিজ্ঞান-বিষয়ক বইয়ের ‘যৌবন কাল’ পরিমাপ করার জন্য আলাদা একটা মাপকাঠি দরকার হয়। তা হলো- বিষয়বস্তু। আধুনিক বিজ্ঞান এতটাই গতিশীল যে এক সময়ের দুর্দান্ত-যৌবনা বিজ্ঞানের বইগুলো নতুন তত্ত্ব, তথ্য ও প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে দ্রুত ‘বিগত-যৌবনা’ হয়ে যায়। তখন বইগুলোর স্থান হয় বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগে। যেমন ‘আলকেমি’ ‘ফ্লপি-ড্রাইভ’ বা ‘ওয়ার্ড পারফেক্ট’ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের বইগুলো এখন বিগত-যৌবনা। আবার কিছু কিছু বিজ্ঞানের বই আছে যেগুলো ভবিষ্যতের কথা বলে, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দেয়। সে ধরণের বইগুলোর যৌবন অনেক বেশি দীর্ঘায়িত। ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ এমনই একটা বিজ্ঞানের বই।

যাঁরা বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় লেখেন তাঁরা জানেন কী পরিশ্রম সাধ্য কাজ এটা। বাঙালি পাঠক-পাঠিকা যত সহজে কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের প্রতি ভালোবাসা দেখান- বিজ্ঞান-বিষয়ের প্রতি তত সহজে নয়। যতই সহজ সাবলীল ভাষায় লেখা হোক না কেন – বিজ্ঞান লেখকের পাঠক-পাঠিকার সংখ্যা খুবই কম। গল্প-উপন্যাস বা কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁদের অনেক ভক্ত থাকে। পড়তে পড়তে ভালো লাগলে- বিশেষ করে পাঠক-পাঠিকা যখন মনে করতে শুরু করেন যে লেখক তাঁদের মনের কথাই বলে ফেলেছেন তখন লেখকের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়। ভালোবাসা থেকে এক ধরনের অন্ধত্বও তৈরি হতে পারে। লেখক তখন সহজেই পাঠক-পাঠিকার চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। তখন অবস্থা এমন হয় যে প্রিয় লেখক যা-ই লেখেন পাঠকের সবই ভালো লাগে। ভাল-মন্দ বিচারে কিছুটা হলেও পক্ষপাতিত্ব চলে আসে। পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে নগর পরিক্রমা করতে বেরিয়ে পড়া সম্ভব তখন। কিন্তু বিজ্ঞান লেখকদের পক্ষে এরকম নির্ভেজাল অন্ধ ভালোবাসা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ বিজ্ঞানে মিরাকল বা গোঁজামিলের কোন স্থান নেই। কেউ দিতে চেষ্টা করলে ধরা পড়তে সময় লাগে না। বিজ্ঞানে কল্পনার স্থান খুব একটা নেই। ভালো কল্প-বিজ্ঞান লিখতে হলেও বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগুলো মেনেই কল্পনার মেঘে চড়তে হয়। তাই রোমেনা আফাজ যখন দস্যু বনহুরকে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দেন (দ্রষ্টব্যঃ মঙ্গল গ্রহে দস্যু বনহুর) – তখন তা কিছুতেই কল্প-বিজ্ঞান বলে চালানো সম্ভব নয়। তাই বলে কি বিজ্ঞানে কোন ধরণের ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা থাকে না? কল্পনা থাকে না? অবশ্যই থাকে – এবং যেগুলো থাকে তা থেকেই শুরুতে বৈজ্ঞানিক ধারণা- পরে আস্তে আস্তে তত্ত্ব এবং সীমাহীন পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-গ্রহণ-বর্জন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের পর হয়ে ওঠে বিজ্ঞান। বড় দীর্ঘ এ প্রক্রিয়া। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। সাহিত্য একক প্রচেষ্টা আর বিজ্ঞান সমন্বিত প্রচেষ্টা। তাই সাধারণের জন্য বিজ্ঞানের বই যাঁরা লেখেন তাঁদের লেখায় উঠে আসে আরো অনেক বিজ্ঞানীর কথা, বিজ্ঞান-লেখকের কথা। মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজ পাবার জন্য সারা বিশ্বের শত শত বিজ্ঞানী কয়েক দশক ধরে যে কঠোর পরিশ্রম করে বিজ্ঞানের যে বিপুল অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন তা আমাদের মত সাধারণ পাঠককে সহজভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদকে কী কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তা তাঁদের এই বইটির প্রতিটি পাতায় স্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

বহুমাত্রিক লেখক অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের লেখা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে একই সাথে ভাষা ও বিষয়-বস্তুর ওপর কী ঈর্ষণীয় দখল তাঁদের। বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির পর কোটি বছরের প্রাকৃতিক রাসায়নিক ও জীববৈজ্ঞানিক বিক্রিয়ার ফলে প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে এই অসীম বিশ্বব্রহ্মান্ডের অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জেও প্রাণের সম্ভাবনার এত বিশাল ব্যাপ্তির তথ্য ও তত্ত্বকে মাত্র একশ’ পৃষ্ঠায় বলে ফেলার মত দুরুহ কাজটি অবলীলায় করে ফেলেছেন এঁরা। এটা সত্যি যে বিজ্ঞানের বই উপন্যাসের মত একটানে পড়ে ফেলা যায় না। বিজ্ঞানের বই পড়তে পড়তে ভাবতে হয়, নিজের উপলব্ধির সাথে যাচাই করে নিতে হয়- সর্বোপরি বিজ্ঞানের বই পড়ার পর আরো জানার যখন একটা তৃষ্ণা তৈরি হয় – তখনই বিজ্ঞানের বই সার্থক হয়ে ওঠে। সে বিবেচনায় ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ অনায়াসে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেছে।

নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির প্রত্যেকটি অধ্যায় স্বয়ং-সম্পূর্ণ, আবার অন্যান্য অধ্যায়গুলোর সাথেও সম্পৃক্ত। ফলে অধ্যায় থেকে অধ্যায়ান্তরে যাবার সময় প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় না মোটেও। তবুও দুটো প্রধান অংশে ভাগ করা যায় বইটাকে। প্রথম থেকে পঞ্চম অধ্যায় পর্যন্ত আমাদের পরিচিত প্রাণের উৎপত্তির তত্ত্ব ও রসায়ন, আর ষষ্ঠ থেকে নবম অধ্যায়ে পৃথিবীর বাইরের মহাবিশ্বে প্রাণের খোঁজ সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে।

“জীবন কী?”- এই চিরন্তন প্রশ্নটি দিয়েই শুরু হয়েছে প্রথম অধ্যায় ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’। প্রাণের সংজ্ঞার দার্শনিক আলোচনায় রেখাপাত করে লেখক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন প্রাণের জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি। পড়তে পড়তে মনে হয় জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের দেয়ালটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেছে। প্রাণের দাবিদার বৈশিষ্ট্যগুলো – প্রজনন, বিপাক ক্রিয়া, পুষ্টির জোগান, জটিলতা, সংগঠন, বৃদ্ধি ও বিস্তার প্রভৃতি ব্যাখ্যার সাথে সাথে জীবনের মৌলিক উপাদান প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডকে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফ্‌টওয়ার এর সাথে তুলনা অনবদ্য।

“মৃত্যুও বোধহয় সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো একধরনের ‘sexually transmitted disease’ যা আমরা বংশপরম্পরায় সৃষ্টির শুরু থেকে বহন করে চলেছি!” – খুবই মজার একটা উদ্ধৃতি বটে। তবে এর উৎস হিসেবে “এক প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী হালকাচালে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন” (পৃঃ১৭) বলাতে ব্যাপারটা আসলেই হাল্‌কা হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট জীববিজ্ঞানীর পরিচয় ও লেখাটির উৎস উল্লেখ করলে ভালো হতো।

দ্বিতীয় অধ্যায় “জীবনের প্রাণ রাসায়নিক উপাদান”-এ আলোচিত হয়েছে জীবনের প্রাণ রাসায়নিক ভিত্তি। আমাদের পৃথিবীতে জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (‘O’) এবং নাইট্রোজেন (‘N’) এই চারটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে; যাদেরকে একত্রে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘খন’(CHON)। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে অন্যান্য মৌলিক পদার্থগুলোর ভূমিকা জীবন-গঠনে এরকম ভাবে নেই কেন? অন্য কোন গ্রহে যদি প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় – তবে কি সেখানেও খনের ভূমিকা থাকবে? নাকি অন্য কোন পদার্থ সে ভূমিকা নেবে? এ প্রশ্নের অবশ্য সরাসরি উত্তর দেবার মত যৌক্তিক ভিত্তি এখনো আমাদের নেই সেভাবে।

“জীবনের উদ্ভবের সম্ভাব্য ধারণাগুলো” শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ে “কীভাবে, কখন আর কোথায় প্রাণের উৎপত্তি হল?” – জীববিদ্যার এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাঁরা বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান মানেন আবার চেতনার একটা অংশে ঈশ্বরকেও লালন করেন – তাঁরা হোঁচট খাবেন এ অধ্যায়ে। প্রাণের উদ্ভবের সাথে ঈশ্বরের হাতে প্রাণ-সৃষ্টির কোন ভূমিকা নেই। মহাকাশের উল্কাপিন্ডের মধ্যে এমাইনো এসিডের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশ থেকে আসা এমাইনো এসিড ও পৃথিবীতে তৈরি এমাইনো এসিডের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য হলো পৃথিবীর এমাইনো এসিডগুলো সব বামাবর্তী, কিন্তু মহাকাশ থেকে আসা এমাইনো এসিডগুলো বামাবর্তী ও ডানাবর্তীর যে কোনটাই হতে পারে। বামাবর্তী ও ডানাবর্তী ব্যাপারটার কিছুটা ব্যাখ্যা দিলে পাঠকের বুঝতে আরো কিছুটা সুবিধে হতো।

চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় পরস্পরের পরিপূরক। এ অধ্যায় দুটোতে ‘অজৈবজনিঃ জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি’ ও “প্রাণের উৎপত্তির ধাপগুলো” বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বতঃজননবাদের ব্যাপারে বিশ্বাস ছিল অনেকের। কিন্তু ১৮৬০ সালে লুই পাস্তুর প্রমাণ করেন যে অণুজীবের স্বতঃজনন হয় না। অবশ্য এর আগে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত আরো একটা ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস ছিল – তা হলো অজৈব যৌগ থেকে জৈব-যৌগের উৎপত্তি হয় না। জৈব-যৌগ যা প্রাণের ভিত্তি – তা ঈশ্বরের হাতেই তৈরি হয় এরকম একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। ১৮২৮ (বইতে ১৮২০ সাল বলা হয়েছে) সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভুহ্‌লার অজৈব-যৌগ এমোনিয়াম সায়ানাইট থেকে ইউরিয়া তৈরি করে দেখান যে অজৈব-যৌগ থেকে জৈব-যৌগের উৎপত্তি সম্ভব। প্রাকৃতিক নিয়মে জীবনের রসায়ন ব্যাখ্যার সময় জৈবযৌগের উৎপত্তি থেকে শুরু করে জৈববিবর্তনের ধাপসমূহের কোনটাই বাদ যায় নি। এর সাথে উপরি পাওনা ফ্রিম্যান ডাইসন, এলসো স্টেরেনবার্গ, রিচার্ড ডকিন্স সহ আরো অনেকের প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ও প্রকাশনার ব্যাপারে আলোকপাত। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্ভাবনার তত্ত্ব ব্যাখ্যায় কেরন্স-স্মিথের বানরের টাইপ করার উদাহরণটি মোক্ষম। এ অধ্যায়ে লিন মার্গোলিসের প্রসঙ্গ এসেছে। এই বিজ্ঞানীর একটু পরিচিতি দিলে ভালো হতো।

ভিন্‌গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ত্ব নিয়ে মানুষের কৌতূহল ও কল্পনার শেষ নেই। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার খরচ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বইয়ের ষষ্ঠ থেকে নবম অধ্যায়ে। চারশ কোটি থেকে ৩৬০ কোটি বছর আগের পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহের পরিবেশে প্রচুর অণুজীব ও প্রাণ উদ্ভবের অনুকুল পরিবেশের প্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে আছে। সৌরজগতের দূরের প্রান্তের অনেক গ্রহাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায়। এ প্রসঙ্গে সি ও ডি ধরণের গ্রহাণু’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সি’ ও ‘ডি’ ধরণ সম্পর্কে কিছুটা পূর্ব-ধারণা দেয়া থাকলে পাঠকের সুবিধে হতো।

মহাবিশ্বে প্রাণের সম্ভাব্যতার ব্যাপক পরিচিত সমীকরণ হলো ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সমীকরণ। ড্রেকের সমীকরণ ও প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলো আলোচিত হয়েছে অষ্টম অধ্যায়ে। মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভবের নিয়ামকগুলো অনেক বেশি জটিল এবং এদের সংখ্যাও অনেক। সভ্যতার সংখ্যা, সভ্যতার আয়ুষ্কাল, প্রাণের বিকাশ সম্ভব এমন গ্রহ-সমূহের সংখ্যা – এসব সঠিক ভাবে হিসেব করা প্রায় অসম্ভব। কাছাকাছি একটা অনুমান হয়তো সম্ভব। খুব সহজ এবং সাবলিল ভাবে উদাহরণসহ ব্যাপারটা এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। পল ডেভিসের সাম্প্রতিক বই “The Eerie Silence: Renewing Our Search for Alien Intelligence” -এ আলোচিত ড্রেকের সমীকরণের ব্যাখ্যার চেয়ে অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের ব্যাখ্যা আমার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।

সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সংক্ষেপে ‘সেটি’র যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। পঞ্চাশ বছর ধরে আকাশ ছেঁকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে যদি কোন ধরনের বুদ্ধিমত্তার সন্ধান পাওয়া যায় আমাদের গ্রহের বাইরের কোথাও। যদিও এখনো তেমন সুনির্দিষ্টভাবে উত্তেজিত হওয়ার মত কোন ফল পাওয়া যায়নি ‘সেটি’ সম্পর্কে হাল ছেড়ে দেয়ার মত অবস্থাও হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে পল ডেভিস সহ আরো অনেকেই নতুন ‘সেটি’ বিস্তারের পক্ষপাতী। শুধুমাত্র ‘সেটি’ প্রকল্পের পক্ষে ভালো ভালো কথাগুলোই লেখকেরা বলেছেন বললে ভুল বলা হবে। সেটি’ প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার খরচের পরও ‘সো ফার সো ব্যাড’ ফলাফল উল্লেখও তাঁরা করেছেন নির্মোহ ভঙ্গিতে। প্রশ্ন করেছেন এগুলো ‘বিজ্ঞান নাকি অপবিজ্ঞান?’ বা মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার সন্ধান কি এক বর্ণাঢ্য জুয়াখেলা? তারপরও দ্বিতীয় পৃথিবী খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাদের আশা জেগে থাকে।

বাংলায় বিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে ভাষার গতিশীলতা খুবই দরকার। অক্সিজেনকে ‘অম্লজান’, হাইড্রোজেনকে ‘উদ্‌জান’ বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ‘অঙ্গার-দ্বি-অম্লজ’ বললে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। প্রচলিত শব্দগুলোর ভাষান্তর না করেও বাংলায় যে উন্নত মানের বিজ্ঞান রচনা সম্ভব তার অন্যতম প্রমাণ এই বই। ভাষার গতিশীলতার দিকে লেখকদের সচেতনার কথা ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে (পৃঃ৭)। তবে কিছু কিছু শব্দ মনে হয় বদলে দিলে ভালো হতো। যেমন – ‘ভেজিটেশনে চলে যাওয়া’ (পৃঃ১৯), ‘কঙ্কাল পেশি’ (পৃঃ২০), ‘নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয়’ (পৃঃ২২), ‘মাধ্যমিক বিকিরণ’ (secondary radiation) (পৃঃ৮১), ‘বিদ্‌ঘুটে ধরণের’ (পৃঃ ১০৩) ইত্যাদি।

বেশ কিছু আরোপিত অর্থের বাক্যাংশ ব্যবহৃত হয়েছে বইতে। যেমন “ভাগ্য ভালো যে এই চিন্তাভাবনা বা বিশ্বাসনির্ভর তত্ত্বগুলোকে আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা তেমন একটা আমলে নেন না” (পৃঃ ৬)। জানি এখানে ‘ভাগ্য’ শুধুমাত্র কথার কথা। তবুও যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই তা কি আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না? অন্তত বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে?

বইতে তাপমাত্রার একক হিসেবে কখনো ফারেনহাইট (পৃঃ৪৭) আবার কখনো সেলসিয়াস (পৃঃ৭৯) ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয় সব জায়গায় সেলসিয়াস স্কেল রাখলেই সুবিধে হতো। পঞ্চম অধ্যায়ের এক জায়গায় (পৃঃ৪৮) বলা হচ্ছে “আমরা সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে ভাইরাস নিয়ে—” ইত্যাদি। এখানে সিরিজের বদলে ‘অধ্যায়’ হবে। বানান ভুল নেই বললেই চলে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা ভুল বানান চোখে পড়েছেঃ হ৩য় (পৃঃ৭), হচ্ছ (পৃঃ৩১), ‘Since ‘tis certain…’, ‘মুহুমুর্হ’ (পৃঃ৭৮), ‘টেল্‌সা (Telsa)’ (পৃঃ ৯৫)।

ওয়েবসাইট ছাড়াও ষাটের অধিক রেফারেন্স বইয়ের উল্লেখ আছে এই বইতে। তবে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত পল ডেভিসের “Are We Alone?: Philosophical Implications of the Discovery of Extraterrestrial Life” বইটি রেফারেন্স তালিকায় নেই দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। এটা কি লেখকদের ইচ্ছাকৃত?

কবিতা ও বিজ্ঞানের একটা সুন্দর সমন্বয় ঘটিয়েছেন লেখকেরা। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কবিতার লাইন নির্বাচনে লেখকদ্বয়ের শৈল্পিক পরিচয় চাপা থাকে না। কবিতার লাইনগুলো পাঠকের উপরি পাওনা।

“মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে” পড়তে গিয়ে পাঠকের বুদ্ধিতে যে নিজের অজান্তেই শান দেয়া হয়ে যায় – তার সবটুকু কৃতিত্বই লেখকদ্বয়ের। ভূমিকায় যেভাবে উল্লেখিত হয়েছে- “আমাদের এই লেখা পড়ে বাংলাভাষী মাত্র একজন লোকও যদি ছোটবেলা থেকে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তবে সে ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের কষ্টকে সার্থক বলে মনে করব”। এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘রক্তের মধ্যে বিশ্বাস’ থাকলে তাতে চিড় ধরবেই। শুধু বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও যে বিজ্ঞান সচেতনতার দরকার সেই সচেতনতা সৃষ্টিতে বিপুল ভূমিকা রাখবে এই বই। অভিনন্দন অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ। এরকম বই আরো চাই।

[মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে। লেখকঃ অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ। অবসর প্রকাশন সংস্থা, ঢাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১২। মূল্যঃ ১৩০ টাকা]।