অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বই আকারে বেরিয়েছে ২০০৭ সালে। পরের বছর বেরিয়েছে এর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। মুক্তমনায় যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল – তখনই পড়েছিলাম সবগুলো পর্ব। কিন্তু আমার স্বভাব কুঁড়েমির কারণে কোন প্রতিক্রিয়াই লিখে রাখা হয়নি তখন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে গিয়ে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের প্রায় সবগুলো বইয়ের দোকানে খোঁজ করেও বইটা পাইনি। ২০০৯ এবং ২০১০-এও একই অবস্থা। একুশের বইমেলার পরে দরকারি বইগুলো কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। বাংলাদেশের বই-বিপণন ব্যবস্থা এখনো তেমন পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সেমিস্টার শুরু হয়ে যায়- তাই বইমেলায় থাকা হয় না কোন বছরই। সুতরাং বন্ধুরাই ভরসা। তারা আমার টেলিফোন-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বইমেলায় গিয়ে প্রকাশকের কাছ থেকে বই জোগাড় করে পাঠায়। মহাদেশ পাড়ি দিয়ে আমার হাতে এসে পৌঁছোয় ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এসেও এর ভ্রমণ শেষ হয় না। বইটা যখন আবার পড়ে শেষ করলাম তখন আমি লস এঞ্জেলেসের টম ব্রাডলি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তিন নম্বর টার্মিনালে। আর পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখছি মেক্সিকো সিটির একটা হোটেলে বসে।
একটা ভালো বই নাকি অনন্ত যৌবনা। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে জেনেছি এ’কথা। অবশ্য বইয়ের যৌবন পরিমাপ করার মাপকাঠি কী তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না এখন। তবে আমার মনে হয় কোন বইয়ের আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি পাঠক-নির্ভর। আবার বিজ্ঞান-বিষয়ক বইয়ের ‘যৌবন কাল’ পরিমাপ করার জন্য আলাদা একটা মাপকাঠি দরকার হয়। তা হলো- বিষয়বস্তু। আধুনিক বিজ্ঞান এতটাই গতিশীল যে এক সময়ের দুর্দান্ত-যৌবনা বিজ্ঞানের বইগুলো নতুন তত্ত্ব, তথ্য ও প্রযুক্তি আবিষ্কারের সাথে সাথে দ্রুত ‘বিগত-যৌবনা’ হয়ে যায়। তখন বইগুলোর স্থান হয় বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগে। যেমন ‘আলকেমি’ ‘ফ্লপি-ড্রাইভ’ বা ‘ওয়ার্ড পারফেক্ট’ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের বইগুলো এখন বিগত-যৌবনা। আবার কিছু কিছু বিজ্ঞানের বই আছে যেগুলো ভবিষ্যতের কথা বলে, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দেয়। সে ধরণের বইগুলোর যৌবন অনেক বেশি দীর্ঘায়িত। ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ এমনই একটা বিজ্ঞানের বই।
যাঁরা বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় লেখেন তাঁরা জানেন কী পরিশ্রম সাধ্য কাজ এটা। বাঙালি পাঠক-পাঠিকা যত সহজে কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের প্রতি ভালোবাসা দেখান- বিজ্ঞান-বিষয়ের প্রতি তত সহজে নয়। যতই সহজ সাবলীল ভাষায় লেখা হোক না কেন – বিজ্ঞান লেখকের পাঠক-পাঠিকার সংখ্যা খুবই কম। গল্প-উপন্যাস বা কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁদের অনেক ভক্ত থাকে। পড়তে পড়তে ভালো লাগলে- বিশেষ করে পাঠক-পাঠিকা যখন মনে করতে শুরু করেন যে লেখক তাঁদের মনের কথাই বলে ফেলেছেন তখন লেখকের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়। ভালোবাসা থেকে এক ধরনের অন্ধত্বও তৈরি হতে পারে। লেখক তখন সহজেই পাঠক-পাঠিকার চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। তখন অবস্থা এমন হয় যে প্রিয় লেখক যা-ই লেখেন পাঠকের সবই ভালো লাগে। ভাল-মন্দ বিচারে কিছুটা হলেও পক্ষপাতিত্ব চলে আসে। পকেট বিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে নগর পরিক্রমা করতে বেরিয়ে পড়া সম্ভব তখন। কিন্তু বিজ্ঞান লেখকদের পক্ষে এরকম নির্ভেজাল অন্ধ ভালোবাসা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ বিজ্ঞানে মিরাকল বা গোঁজামিলের কোন স্থান নেই। কেউ দিতে চেষ্টা করলে ধরা পড়তে সময় লাগে না। বিজ্ঞানে কল্পনার স্থান খুব একটা নেই। ভালো কল্প-বিজ্ঞান লিখতে হলেও বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগুলো মেনেই কল্পনার মেঘে চড়তে হয়। তাই রোমেনা আফাজ যখন দস্যু বনহুরকে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দেন (দ্রষ্টব্যঃ মঙ্গল গ্রহে দস্যু বনহুর) – তখন তা কিছুতেই কল্প-বিজ্ঞান বলে চালানো সম্ভব নয়। তাই বলে কি বিজ্ঞানে কোন ধরণের ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা থাকে না? কল্পনা থাকে না? অবশ্যই থাকে – এবং যেগুলো থাকে তা থেকেই শুরুতে বৈজ্ঞানিক ধারণা- পরে আস্তে আস্তে তত্ত্ব এবং সীমাহীন পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-গ্রহণ-বর্জন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের পর হয়ে ওঠে বিজ্ঞান। বড় দীর্ঘ এ প্রক্রিয়া। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। সাহিত্য একক প্রচেষ্টা আর বিজ্ঞান সমন্বিত প্রচেষ্টা। তাই সাধারণের জন্য বিজ্ঞানের বই যাঁরা লেখেন তাঁদের লেখায় উঠে আসে আরো অনেক বিজ্ঞানীর কথা, বিজ্ঞান-লেখকের কথা। মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজ পাবার জন্য সারা বিশ্বের শত শত বিজ্ঞানী কয়েক দশক ধরে যে কঠোর পরিশ্রম করে বিজ্ঞানের যে বিপুল অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন তা আমাদের মত সাধারণ পাঠককে সহজভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদকে কী কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তা তাঁদের এই বইটির প্রতিটি পাতায় স্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
বহুমাত্রিক লেখক অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের লেখা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে একই সাথে ভাষা ও বিষয়-বস্তুর ওপর কী ঈর্ষণীয় দখল তাঁদের। বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির পর কোটি বছরের প্রাকৃতিক রাসায়নিক ও জীববৈজ্ঞানিক বিক্রিয়ার ফলে প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে এই অসীম বিশ্বব্রহ্মান্ডের অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জেও প্রাণের সম্ভাবনার এত বিশাল ব্যাপ্তির তথ্য ও তত্ত্বকে মাত্র একশ’ পৃষ্ঠায় বলে ফেলার মত দুরুহ কাজটি অবলীলায় করে ফেলেছেন এঁরা। এটা সত্যি যে বিজ্ঞানের বই উপন্যাসের মত একটানে পড়ে ফেলা যায় না। বিজ্ঞানের বই পড়তে পড়তে ভাবতে হয়, নিজের উপলব্ধির সাথে যাচাই করে নিতে হয়- সর্বোপরি বিজ্ঞানের বই পড়ার পর আরো জানার যখন একটা তৃষ্ণা তৈরি হয় – তখনই বিজ্ঞানের বই সার্থক হয়ে ওঠে। সে বিবেচনায় ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ অনায়াসে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেছে।
নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির প্রত্যেকটি অধ্যায় স্বয়ং-সম্পূর্ণ, আবার অন্যান্য অধ্যায়গুলোর সাথেও সম্পৃক্ত। ফলে অধ্যায় থেকে অধ্যায়ান্তরে যাবার সময় প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় না মোটেও। তবুও দুটো প্রধান অংশে ভাগ করা যায় বইটাকে। প্রথম থেকে পঞ্চম অধ্যায় পর্যন্ত আমাদের পরিচিত প্রাণের উৎপত্তির তত্ত্ব ও রসায়ন, আর ষষ্ঠ থেকে নবম অধ্যায়ে পৃথিবীর বাইরের মহাবিশ্বে প্রাণের খোঁজ সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে।
“জীবন কী?”- এই চিরন্তন প্রশ্নটি দিয়েই শুরু হয়েছে প্রথম অধ্যায় ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’। প্রাণের সংজ্ঞার দার্শনিক আলোচনায় রেখাপাত করে লেখক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন প্রাণের জৈব-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি। পড়তে পড়তে মনে হয় জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের দেয়ালটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেছে। প্রাণের দাবিদার বৈশিষ্ট্যগুলো – প্রজনন, বিপাক ক্রিয়া, পুষ্টির জোগান, জটিলতা, সংগঠন, বৃদ্ধি ও বিস্তার প্রভৃতি ব্যাখ্যার সাথে সাথে জীবনের মৌলিক উপাদান প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডকে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়ার এর সাথে তুলনা অনবদ্য।
“মৃত্যুও বোধহয় সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো একধরনের ‘sexually transmitted disease’ যা আমরা বংশপরম্পরায় সৃষ্টির শুরু থেকে বহন করে চলেছি!” – খুবই মজার একটা উদ্ধৃতি বটে। তবে এর উৎস হিসেবে “এক প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী হালকাচালে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন” (পৃঃ১৭) বলাতে ব্যাপারটা আসলেই হাল্কা হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট জীববিজ্ঞানীর পরিচয় ও লেখাটির উৎস উল্লেখ করলে ভালো হতো।
দ্বিতীয় অধ্যায় “জীবনের প্রাণ রাসায়নিক উপাদান”-এ আলোচিত হয়েছে জীবনের প্রাণ রাসায়নিক ভিত্তি। আমাদের পৃথিবীতে জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (‘O’) এবং নাইট্রোজেন (‘N’) এই চারটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে; যাদেরকে একত্রে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘খন’(CHON)। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে অন্যান্য মৌলিক পদার্থগুলোর ভূমিকা জীবন-গঠনে এরকম ভাবে নেই কেন? অন্য কোন গ্রহে যদি প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় – তবে কি সেখানেও খনের ভূমিকা থাকবে? নাকি অন্য কোন পদার্থ সে ভূমিকা নেবে? এ প্রশ্নের অবশ্য সরাসরি উত্তর দেবার মত যৌক্তিক ভিত্তি এখনো আমাদের নেই সেভাবে।
“জীবনের উদ্ভবের সম্ভাব্য ধারণাগুলো” শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ে “কীভাবে, কখন আর কোথায় প্রাণের উৎপত্তি হল?” – জীববিদ্যার এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাঁরা বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান মানেন আবার চেতনার একটা অংশে ঈশ্বরকেও লালন করেন – তাঁরা হোঁচট খাবেন এ অধ্যায়ে। প্রাণের উদ্ভবের সাথে ঈশ্বরের হাতে প্রাণ-সৃষ্টির কোন ভূমিকা নেই। মহাকাশের উল্কাপিন্ডের মধ্যে এমাইনো এসিডের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশ থেকে আসা এমাইনো এসিড ও পৃথিবীতে তৈরি এমাইনো এসিডের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য হলো পৃথিবীর এমাইনো এসিডগুলো সব বামাবর্তী, কিন্তু মহাকাশ থেকে আসা এমাইনো এসিডগুলো বামাবর্তী ও ডানাবর্তীর যে কোনটাই হতে পারে। বামাবর্তী ও ডানাবর্তী ব্যাপারটার কিছুটা ব্যাখ্যা দিলে পাঠকের বুঝতে আরো কিছুটা সুবিধে হতো।
চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় পরস্পরের পরিপূরক। এ অধ্যায় দুটোতে ‘অজৈবজনিঃ জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি’ ও “প্রাণের উৎপত্তির ধাপগুলো” বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বতঃজননবাদের ব্যাপারে বিশ্বাস ছিল অনেকের। কিন্তু ১৮৬০ সালে লুই পাস্তুর প্রমাণ করেন যে অণুজীবের স্বতঃজনন হয় না। অবশ্য এর আগে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত আরো একটা ব্যাপারে মানুষের বিশ্বাস ছিল – তা হলো অজৈব যৌগ থেকে জৈব-যৌগের উৎপত্তি হয় না। জৈব-যৌগ যা প্রাণের ভিত্তি – তা ঈশ্বরের হাতেই তৈরি হয় এরকম একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। ১৮২৮ (বইতে ১৮২০ সাল বলা হয়েছে) সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভুহ্লার অজৈব-যৌগ এমোনিয়াম সায়ানাইট থেকে ইউরিয়া তৈরি করে দেখান যে অজৈব-যৌগ থেকে জৈব-যৌগের উৎপত্তি সম্ভব। প্রাকৃতিক নিয়মে জীবনের রসায়ন ব্যাখ্যার সময় জৈবযৌগের উৎপত্তি থেকে শুরু করে জৈববিবর্তনের ধাপসমূহের কোনটাই বাদ যায় নি। এর সাথে উপরি পাওনা ফ্রিম্যান ডাইসন, এলসো স্টেরেনবার্গ, রিচার্ড ডকিন্স সহ আরো অনেকের প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ও প্রকাশনার ব্যাপারে আলোকপাত। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্ভাবনার তত্ত্ব ব্যাখ্যায় কেরন্স-স্মিথের বানরের টাইপ করার উদাহরণটি মোক্ষম। এ অধ্যায়ে লিন মার্গোলিসের প্রসঙ্গ এসেছে। এই বিজ্ঞানীর একটু পরিচিতি দিলে ভালো হতো।
ভিন্গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ত্ব নিয়ে মানুষের কৌতূহল ও কল্পনার শেষ নেই। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার খরচ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বইয়ের ষষ্ঠ থেকে নবম অধ্যায়ে। চারশ কোটি থেকে ৩৬০ কোটি বছর আগের পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহের পরিবেশে প্রচুর অণুজীব ও প্রাণ উদ্ভবের অনুকুল পরিবেশের প্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে আছে। সৌরজগতের দূরের প্রান্তের অনেক গ্রহাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায়। এ প্রসঙ্গে সি ও ডি ধরণের গ্রহাণু’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সি’ ও ‘ডি’ ধরণ সম্পর্কে কিছুটা পূর্ব-ধারণা দেয়া থাকলে পাঠকের সুবিধে হতো।
মহাবিশ্বে প্রাণের সম্ভাব্যতার ব্যাপক পরিচিত সমীকরণ হলো ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সমীকরণ। ড্রেকের সমীকরণ ও প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলো আলোচিত হয়েছে অষ্টম অধ্যায়ে। মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভবের নিয়ামকগুলো অনেক বেশি জটিল এবং এদের সংখ্যাও অনেক। সভ্যতার সংখ্যা, সভ্যতার আয়ুষ্কাল, প্রাণের বিকাশ সম্ভব এমন গ্রহ-সমূহের সংখ্যা – এসব সঠিক ভাবে হিসেব করা প্রায় অসম্ভব। কাছাকাছি একটা অনুমান হয়তো সম্ভব। খুব সহজ এবং সাবলিল ভাবে উদাহরণসহ ব্যাপারটা এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। পল ডেভিসের সাম্প্রতিক বই “The Eerie Silence: Renewing Our Search for Alien Intelligence” -এ আলোচিত ড্রেকের সমীকরণের ব্যাখ্যার চেয়ে অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের ব্যাখ্যা আমার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সংক্ষেপে ‘সেটি’র যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। পঞ্চাশ বছর ধরে আকাশ ছেঁকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে যদি কোন ধরনের বুদ্ধিমত্তার সন্ধান পাওয়া যায় আমাদের গ্রহের বাইরের কোথাও। যদিও এখনো তেমন সুনির্দিষ্টভাবে উত্তেজিত হওয়ার মত কোন ফল পাওয়া যায়নি ‘সেটি’ সম্পর্কে হাল ছেড়ে দেয়ার মত অবস্থাও হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে পল ডেভিস সহ আরো অনেকেই নতুন ‘সেটি’ বিস্তারের পক্ষপাতী। শুধুমাত্র ‘সেটি’ প্রকল্পের পক্ষে ভালো ভালো কথাগুলোই লেখকেরা বলেছেন বললে ভুল বলা হবে। সেটি’ প্রকল্পে বিলিয়ন ডলার খরচের পরও ‘সো ফার সো ব্যাড’ ফলাফল উল্লেখও তাঁরা করেছেন নির্মোহ ভঙ্গিতে। প্রশ্ন করেছেন এগুলো ‘বিজ্ঞান নাকি অপবিজ্ঞান?’ বা মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার সন্ধান কি এক বর্ণাঢ্য জুয়াখেলা? তারপরও দ্বিতীয় পৃথিবী খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাদের আশা জেগে থাকে।
বাংলায় বিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে ভাষার গতিশীলতা খুবই দরকার। অক্সিজেনকে ‘অম্লজান’, হাইড্রোজেনকে ‘উদ্জান’ বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ‘অঙ্গার-দ্বি-অম্লজ’ বললে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। প্রচলিত শব্দগুলোর ভাষান্তর না করেও বাংলায় যে উন্নত মানের বিজ্ঞান রচনা সম্ভব তার অন্যতম প্রমাণ এই বই। ভাষার গতিশীলতার দিকে লেখকদের সচেতনার কথা ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে (পৃঃ৭)। তবে কিছু কিছু শব্দ মনে হয় বদলে দিলে ভালো হতো। যেমন – ‘ভেজিটেশনে চলে যাওয়া’ (পৃঃ১৯), ‘কঙ্কাল পেশি’ (পৃঃ২০), ‘নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয়’ (পৃঃ২২), ‘মাধ্যমিক বিকিরণ’ (secondary radiation) (পৃঃ৮১), ‘বিদ্ঘুটে ধরণের’ (পৃঃ ১০৩) ইত্যাদি।
বেশ কিছু আরোপিত অর্থের বাক্যাংশ ব্যবহৃত হয়েছে বইতে। যেমন “ভাগ্য ভালো যে এই চিন্তাভাবনা বা বিশ্বাসনির্ভর তত্ত্বগুলোকে আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা তেমন একটা আমলে নেন না” (পৃঃ ৬)। জানি এখানে ‘ভাগ্য’ শুধুমাত্র কথার কথা। তবুও যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই তা কি আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না? অন্তত বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে?
বইতে তাপমাত্রার একক হিসেবে কখনো ফারেনহাইট (পৃঃ৪৭) আবার কখনো সেলসিয়াস (পৃঃ৭৯) ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয় সব জায়গায় সেলসিয়াস স্কেল রাখলেই সুবিধে হতো। পঞ্চম অধ্যায়ের এক জায়গায় (পৃঃ৪৮) বলা হচ্ছে “আমরা সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে ভাইরাস নিয়ে—” ইত্যাদি। এখানে সিরিজের বদলে ‘অধ্যায়’ হবে। বানান ভুল নেই বললেই চলে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা ভুল বানান চোখে পড়েছেঃ হ৩য় (পৃঃ৭), হচ্ছ (পৃঃ৩১), ‘Since ‘tis certain…’, ‘মুহুমুর্হ’ (পৃঃ৭৮), ‘টেল্সা (Telsa)’ (পৃঃ ৯৫)।
ওয়েবসাইট ছাড়াও ষাটের অধিক রেফারেন্স বইয়ের উল্লেখ আছে এই বইতে। তবে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত পল ডেভিসের “Are We Alone?: Philosophical Implications of the Discovery of Extraterrestrial Life” বইটি রেফারেন্স তালিকায় নেই দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। এটা কি লেখকদের ইচ্ছাকৃত?
কবিতা ও বিজ্ঞানের একটা সুন্দর সমন্বয় ঘটিয়েছেন লেখকেরা। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কবিতার লাইন নির্বাচনে লেখকদ্বয়ের শৈল্পিক পরিচয় চাপা থাকে না। কবিতার লাইনগুলো পাঠকের উপরি পাওনা।
“মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে” পড়তে গিয়ে পাঠকের বুদ্ধিতে যে নিজের অজান্তেই শান দেয়া হয়ে যায় – তার সবটুকু কৃতিত্বই লেখকদ্বয়ের। ভূমিকায় যেভাবে উল্লেখিত হয়েছে- “আমাদের এই লেখা পড়ে বাংলাভাষী মাত্র একজন লোকও যদি ছোটবেলা থেকে রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তবে সে ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের কষ্টকে সার্থক বলে মনে করব”। এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘রক্তের মধ্যে বিশ্বাস’ থাকলে তাতে চিড় ধরবেই। শুধু বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও যে বিজ্ঞান সচেতনতার দরকার সেই সচেতনতা সৃষ্টিতে বিপুল ভূমিকা রাখবে এই বই। অভিনন্দন অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ। এরকম বই আরো চাই।
[মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে। লেখকঃ অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ। অবসর প্রকাশন সংস্থা, ঢাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১২। মূল্যঃ ১৩০ টাকা]।
লেখাটার একটা প্রিন্ট নিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে অজ্ঞান আমার এক ছোট বোনকে দেখাতে ইচ্ছা করছে ।
আপনার দারুন দীর্ঘ মন্তব্য পড়ে সাথে সাথে বইটি হাতে নিয়ে উল্টালাম এবং সত্যিই আন্নার চুল আপনার ডান পাশে বুকের উপর পড়ে আছে।অথচ তা আগে খেয়াল করি নি,অবশ্য দরকারও ছিল না।
আর অভি ও বন্যার ছবি পেয়েছিলাম মনে হয় ৪,৫ বছর আগে,একটি মনে হয় মায়ামি সাগর সৈকত পাড়ের আর অন্যটি বন্যা তার মেয়ে তৃষাসহ।
অজয় স্যার থেকে প্রথম শুনলাম বন্যা নাকি অসুস্থ্য,পরে অভির কাছ থেকেও জানলাম।
বন্যার জন্য খারাপ লাগছে।আশা করি সে তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফেরত আসবে।
(F)
@ ফরিদ ভাই,
অবশ্যই এর লেখক আমি, সে বলে। আমি বাধা দিলে তুমি কি এই বই লিখতে পারতা? তাহলে আমার ছবি থাকবে না কেন এখানে?
:lotpot: :lotpot:
মুক্তমনায় প্রদীপ দেবকে গ্রন্থ-সমালোচক হিসাবে নিয়োগ দানের সময় এসে গিয়েছে (বেতন দিতে পারবো না অবশ্য। ইহুদি নাসারাদের কাছ থেকে যে টাকাটা আসে ওটা অভি একাই মেরে দেয়। মেরে দেয়া সেই টাকা দিয়ে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে ব্যাক-ইয়ার্ডে বারবিকিউ চিকেন খায়)। মুক্তমনার লেখকদের বই বের হলেই প্রদীপ দেবকে দিয়ে একটা সমালোচনা করিয়ে নিতে হবে এখন থেকে।
প্রদীপ দেব যে আমার অন্যতম প্রিয় একজন লেখক, সেটা এমনি এমনিই হন নি। এই রকম দুর্দান্ত সব লেখার কারণেই হয়েছেন।
এই বইটার সৌভাগ্য যে শুধু পাঠকপ্রিয়তাই পায় নি। দুর্দান্ত কিছু বিদগ্ধ ব্যক্তির পাঠ প্রতিক্রিয়া পাবার সুযোগ ঘটেছে। বইটির প্রথম পাঠ পর্যালোচনা লিখেছিল বিপ্লব। তখনও বইটা প্রকাশিত হয় নি এখানে আছে সেটি। সেই সময় বইটার ভিন্ন নাম ছিল।
আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে দ্বিজেন শর্মার মত বিখ্যাত লোকও এই অচেনা এবং অখ্যাত দুই লেখকের বই নিয়ে প্রথম আলোতে কলাম লিখে। তিনি যে আমদের বইটা পড়েছেন এবং তার পর্যালোচনা লিখছেন তা প্রথম আলোতে প্রকাশ হবার আগ পর্যন্ত ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম না আমরা।
বইটা লেখাতে আমার কৃতিত্ব খুবই সামান্য। সবটুকু বলা যায় অভিরই অবদান। আমি বিজ্ঞানের লোক নই। বিজ্ঞানের লোক না হয়ে বিজ্ঞানের বইয়ের লেখক হয়েছেন, এরকম ঘটনা মনে হয় বিরল। আমার এই বিরল সৌভাগ্যের পুরোটাই আসলে অভির দান। ও যে কী কারণে আমাকে সহলেখক হবার প্রস্তাব দিয়েছিল তা আজো আমি জানি না। ওর জায়গায় আমি থাকলে দিতাম না। কৃষক অভিজ্ঞ হলে গাধা দিয়েও যে হালচাষ করাতে পারে, তা প্রমাণ করে দিয়েছে অভি।
এই বইটা নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত নেপথ্য ঘটনা বর্ণনা করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
অভিকে যারা জানেন, তাঁরা জানেন যে, কাউকে দিয়ে কোনো কাজ আদায় করতে হলে ও খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে বলে। ওই বলা শুনলে মনে হবে যে, ও কথার কথা বলছে। এটা ভেবে যদি আপনি গুরুত্ব না দিয়ে বসে থাকেন, তবে বিরাট বিপদে পড়ে যাবেন। যখন আপনি ভাববেন যে, ওর গুরুত্বহীন কথা ও নিজেও ভুলে গেছে, ঠিক তখনই আচমকা একদিন একটা মেইল পাবেন। সে মেইলে কাজের কোনো অগ্রগতি জানতে চাওয়া হবে না। সরাসরি কাজটা চেয়ে বসবে ও। আমার এই অভিজ্ঞতা থাকার কারণে যখন ওর কাছ থেকে নিরীহ একটা মেইল এলো বইটার শেষ চারটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলার। আমি সাথে সাথেই বসে গেলাম সেগুলো লিখতে। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখি। বইটার প্রথম পাঁচটা চ্যাপ্টার লিখেছে অভি। শেষ চারটা চ্যাপ্টার আমি। অভির পাঁচটা চ্যাপ্টারই লেখা হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। আমারগুলো শেষ হলেই অবসরের আলমগীর ভাইয়ের কাছে পাঠানো হবে। আমি চারটা চ্যাপ্টারই লিখেটিখে বসে আছি খুশি মনে। অভির চাহিদা মেইল এলেই পাঠিয়ে দেবো। ঠিকই একদিন প্রত্যাশিতভাবে সেই মেইল এসে হাজির। আমিও খুশি মনে কম্পিউটার খুলে বসেছি চ্যাপ্টারগুলো ওকে পাঠাবো বলে। ফাইলগুলোকে ওপেন করেতো আমার আক্কেলগুড়ুম। সবগুলো ফাইলই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সাদা ফকফকে হয়ে গিয়েছে। একটা লাইনও কোথাও নেই। তন্ন তন্ন করেও কম্পিউটারে কোনো ব্যাক আপ খুঁজে পেলাম না। অভিকে যখন এই দুঃসংবাদ দিয়েছি। ও নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে যে, আবার লিখ্যা ফালান।
তো ওর কথামত আবার লিখ্যা ফালাইতে বসলাম আমি। তখন আমি ক্যালগারিতে মুভ করেছি। স্বল্পমেয়াদী একটা চাকরীও পেয়েছি অনেক কষ্টে। আমার ইমিডিয়েট বস এক খাইস্টা মহিলা। আমার জান বের করে দিচ্ছেন এটা করো সেটা করো বলে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। ফিরেই নাকে মুখে কিছু দিয়েই লিখতে বসে যাই। আমার ছেলে অর্ক আমাকে এরকম ব্যস্ত দেখে মহা ত্যাক্ত বিরক্ত। কেন তাঁর সাথে না খেলে কম্পিউটারে বসে যাই সেই অভিযোগ করে চলেছে তার মায়ের সাথে। আন্না তাকে বলেছে যে, তোমার আব্বু বই লিখছে, সে কারণে ব্যস্ত। অর্ক একথা শুনে আমার কাছে এসে বলে যে, আব্বু, তুমি কি এই বইটা লিখে মানি পাবে? ছেলের কাছে সম্মান বাঁচানোর জন্য হ্যাঁ সূচক মন্তব্য করতে হয় আমাকে। টাকা পাবো শুনে ওর কচি কচি কোমল ডাগর চোখ দুটো খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায়। আব্দারের সুরে বলে যে, তুমি যখন মানি পাবে তখন আমাকে প্লে স্টেশনের গেম কিনে দেবে? আমি ওর কপালের চুলগুলোকে আদর করে এলোমেলো করে দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। সে খুশি হয়ে তার মায়ের কাছে ফিরে যায়। এরপর যে কয়দিন ধরে চ্যাপ্টারগুলো আবারো লিখেছি, সে কোনো নালিশ জানায় নি। আমার আগের লেখাগুলো আর উদ্ধার করতে পারি নি। ওই পাণ্ডুলিপি যেহেতু দেখাতে পারছি না, কাজেই পরের ফরিদ আহমেদ কি আগের ফরিদ আহমেদের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, নাকি মৌলিক লেখা লিখেছে, সেই সিদ্ধান্তে আসাটা রবি ঠাকুরের বিশ্বপরিচয়ের মতই কঠিন কাজ।
তখনও জানি না যে এই বই লিখে সত্যি সত্যি টাকা পাবো। অভি আর বন্যা যখন দেশে গিয়েছে, তখন আলমগীর ভাই পাই পাই করে আমাদের রয়ালটির টাকা অভিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যথারীতি সেই টাকা মেরে দেবার ধান্ধায় অভি আমাকে তা বলতে ভুলে গেছে। বন্যা অভির মত অতিচালাক না। বোকাসোকা একটা বেচারী মেয়ে। কোথায় যে হারিয়ে গেলো কে জানে? মেইল করে উত্তর না পেলেই সরল মনে মেইল দিতো এই বলে যে, আপনি কি মইরা গ্যাছেন? আমি মরেছি সেটা কনফার্ম করলেই সে নিশ্চিন্তে ইন্নানিল্লাহটা পড়তে পারে, এরকমই সাদামাটা ছিল তার অভিব্যক্তি। তো একদিন টেলিফোনে এই সাদাসিধা মেয়েটা সরল বিশাসে টাকার কথাটা বলে ফেলেছে আমাকে। তখনতো অভির আর কোনো উপায় নেই। আমার ভাগের টাকা আমার একাউন্টে জমা দিতেই হয়েছে। এই টাকা যখন পেয়েছি, তখন অর্ক প্লে স্টশন ছেড়ে এক্সবক্স থ্রি সিক্সটিতে প্রমোশন নিয়েছে। প্লে স্টেশনের বদলে শেষতক এক্স বক্সের গেম কিনে দিয়েছিলাম তাকে ওই টাকা দিয়ে।
বইটা প্রকাশের সময় অভি একদিন রাতে মেইল দিলো যে, আপনার পাসপোর্ট ধরনের একটা ছবি পাঠান। প্রকাশক চাইতাছে। বইতে লাগাইবো। আমি বললাম যে আমার ওই রকম কোনো ছবি নাই। ও কয় যে, আমারও নাই। একটা ছবি থেইকা কাইটা মাইটা বানাইছি। আপনেও ওই রকম কইরা দ্যান। আমগো বই কিনবোই বা কেডা, আর ছবিই বা দেখবো কেডা। একটা হইলেই হয়। ওর কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও বসে গেলাম ছবি খুঁজতে। মুশকিল হচ্ছে আমার চেহারা সুরতের প্রতি নিজেরই কোনো ভক্তিশ্রদ্ধা নেই বলে ক্যামেরার চোখকে সবসময় ফাঁকি দিয়ে চলি আমি। অনেক খুঁজে অর্ককে দিয়ে তোলানো রকি মাউনটেইনের এক নীল জলের লেকের মধ্যে পাথরের উপরে বসা আমার আর আন্নার একটা ছবি পেলাম। ওটা থেকেই আন্নাকে কেটেছেটে বাদ দিয়ে নিজেকে আলাদা করলাম আমি। কিন্তু, আন্নার চুলের একটা অংশ থেকেই গেলো আমার ছবির সাথে। ওই ছবিই পাঠিয়ে দিলাম অভিকে। যাঁদের কাছে বইটা আছে, ব্যাক কভার খুলে আমার বক্তব্যকে মিলিয়ে দেখতে পারেন। সত্যি সত্যিই আন্নার চুল দেখতে পাবেন ওখানে।
বই প্রকাশ হবার পরেও দীর্ঘদিন ওই বই আমি দেখি নি। অভিকে একদিন বললাম সে কথা। ও বলে যে, আমার কাছে দুই কপি আছে। একটা কপি আপনারে পাঠায় দেই। (এই স্মৃতিটা ভুল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অভি আমাকে মেইল করেছিল, নাকি ও যখন মায়ামিতে আমার বাসায় এসেছিল তখন সাথে করে এনেছিল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ভুলে যাওয়াটা অবশ্য আমার জন্য নতুন নয়। কপালে চশমা রেখেও প্রায়ই সারা ঘর জুড়ে চশমা খুঁজে বেড়াই আমি। আন্না আবার উলটো। হাতির মত স্মৃতি তার। কোনো কিছুই ভোলে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আজ যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সে-ও কিছুতেই মনে করতে পারছে না ঘটনাটা। এখন অভি-ই ভরসা।)
বই পাবার পরে আন্না নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে আমার ছবিটা দেখে ফেলেছে। সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে গেছে তার। বলে যে, এই ছবিটা যে তুমি পাঠিয়েছো তাতো আমাকে বলো নাই। আমি নিশ্চুপ থাকি। বোবার কোনো শত্রু নেই। আমাকে নিশ্চুপ দেখে কঠিন স্বরে বলে, আমার ছবি কেটে বাদ দিছো কেনো? এবার আর চুপ থাকা যায় না। আমি আমতা আমতা করে বলি যে, ওরা শুধু লেখকের ছবিই চেয়েছে, দুজনের ছবি চায়নি। আমারতো একক কোনো ছবি নাই, তাই কাটতে হয়েছে। সে হুংকার দিয়ে বলে যে, এই বইয়ের আমিওতো একজন লেখক। আমি আকাশ থেকে পড়ি। আশ্চর্য হয়ে বলি, তুমি কীভাবে এর লেখক? অবশ্যই এর লেখক আমি, সে বলে। আমি বাধা দিলে তুমি কি এই বই লিখতে পারতা? তাহলে আমার ছবি থাকবে না কেন এখানে?
এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আজো দিতে পারি নি আমি।
@ফরিদ আহমেদ,
চামে চামে আন্না আপারে হাতি বানায় দিছেন, এইটা সবার নজরে না পড়লেও আমি হাইলাইট কইরা দিলাম। এইবার ঘর সামলান।
বইটা মেইলেই পাঠাইছিলাম বইলা আমার মনে পড়ে। আপনের বাসায় আসনের সময় বিল মারের রিলিজুলাস ছাড়া আর কিছুই আনি নাই। উলটা আপনার বাসায় মজাসে খানাপিনা কইরা (সাথে বোনাস হিসেবে ইরতিশাদ ভাই আর ভাবীর সাথে মোলাকাৎ কইরা) আপনারে যে পয়সা দিছিলাম সেইটা পুরাই উসুল কইরা নিয়া গেছি। আর আপনে ভাবতাছেন বই লিখা কী না জানি উদ্ধার করছেন!
আর বাই দ্য ওয়ে, আপনে যেমনে রয়ালিটির পয়সার কথা কইলেন, পাবলিকে ভাববো বই লিখা না জানি কত পয়সা কামাইতেছি আমরা। আসলে বাংলাদেশের পাঠকের জন্য বাংলায় বই লিখা যে পয়সা পাওয়া যায় তা দিয়া আম্রিকা/কানাডায় ছেলের লাইগা ঐ এক্স-বক্স ছাড়া আর কিছুই কেনা যায় না। তারপরেও অবসরের আলমগীর সাহেব বইয়ের লেখকদের পয়সা দেন, সেটা স্বীকার করতেই হইব। আমি আর কোন প্রকাশককেই এইরকম চরিত্রের পাই নাই।
@অভিজিৎ,
কই কী আর সাধে? পাবলিকের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো দরকার। তুমি আর আমি যে জামাতের কাছ থেইকা টাকা খাইয়া রবীন্দ্রনাথের গুষ্ঠি উদ্ধার করছি, সেই খবর ফেসবুকে ফাঁস কইরা দিছে এক ফাটা বাঁশ। হে বলে হরলিক্স খাইয়া মোটাতাজা হইয়া উইকিলিক্সের মত অভি-ফরিদ বধের মহাকাব্য লিখবো। 🙁
@ফরিদ আহমেদ,
হাঃ হাঃ আমরা এতোদিন ইহুদি নাসারাদের থেইক্যা ট্যাকা খাইতাম, এখন যে জামাতও আমাদের টেকা দেয় সেইটা জাইনা সবিশেষ প্রীত হইলাম। আসলে এই ফাঁটা বাশেরা মাইকার চিপায় পড়ছে। হেরা উদ্দেশ্য ছাড়া কোন কিছু দেখতে পায় না। হেদের নীতি বুশের মতোই – ‘আইদার উইথ মি, অর উইথ দেম’! হয় রবি কাকারে মাথায় রাখবা, নাইলে তুমি রাজাকার হইবা। মাঝামাঝি কিছু নাই। তাই – রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা, আম্বালীগের কোন সমালোচনা সব কিছুই তাগো চোখে হইয়া যায় জামাতকেন্দ্রিক। এই বাশাঁলুরা ভাবে কোন ভাবে জামাতের ট্যাগ লাগায় দিতে পারলেই রবিবাবু আসমানে থাইকা জাইবেন আর উহাদের উপ্রে পুস্পবৃষ্টি ঝড়াইবেন। ঝড়ুক বৃষ্টি, কী আর করা।
ছোটমনিদের ধর্মবিশ্বাস বা ছোটমনিদের প্রভু নামে কোন বই লিখা যায় না?… যেখানে শিশুদের জন্য প্রভুর ধারনা দেয়া যাবে। তাহলে শিশুদের মনের উপর দোজখ ভিতী কমবে । মৃত্যুর ভয় হতে মুক্তি পাওয়ার উপায় একটি ই … যুক্তি সহকারে অবিশ্বাসী হওয়া । অযৌক্তিক ধর্মকে বাতিল করা । ধর্মের সাথে নিতি নৈতিকতার কন সম্পর্ক নেই তা বুঝা। ফরিদ , অভিজিত লিখুন না অমন একটা বই শিশুদের জন্য । অভিজিত ত ভাগ্যবান অমন একজন বাবা পেয়েছেন , কিন্তু আমরা ত বনহুর,মাসুদ রানা, হুমায়ুন এর হাত ধরে স্টিফেন হকিং এ পৌঁছেছি । আমরা দুর্ভাগা । আমাদের শিশুরা একটু ভাগ্যবান হক না …।
@সপ্তক,
বাচ্চাদের জন্য বই লেখা অনেক কষ্টের কাজ। তাঁদের মনস্তত্ত্ব ভালো করে না বুঝলে তাদের জন্য আকর্ষণীয় বই লেখাটা প্রায় দুঃসাধ্য।
আপনার প্রস্তাবটা অত্যন্ত চমৎকার এবং চিন্তা-জাগানিয়া। সবাই মিলে এগিয়ে এলে অদূর ভবিষ্যতে এরকম একটা প্রজেক্ট মুক্তমনা থেকে দাঁড় করানো যায় হয়তো।
বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে বেশ ভালো লাগলো । বইটি পড়ার জন্য মন আমার ব্যকুল হয়ে উঠেছে ।আচ্ছা বইটা কি ইন্টারনেটে পাওয়া যায় ?নাকি এখানে i mean London এ কোথাও পাওয়া যায় কি না কেউ জানলে বলবেন প্লীজ ,সবাই ভালো থাকুন সুন্দর থাকুন আর ভালো বই পড়ুন ,ধন্যবাদ সবাইকে।
@মহাশূন্য,
বইটি অবসর প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। মার্কেটে খুঁজলে হয়তো পাবেন। বইটার একটা ইন্টারনেট ভার্শন আছে:
http://www.mukto-mona.com/Articles/life/index.htm
যদিও ছাপার বইটাতে অনেক কিছুই সংশোধিত আর পরিবর্ধিত করে ছাপানো হয়েছে। সেটা সংগ্রহ করলেই ভাল হয়।
@অভিজিৎ,প্রথমেই ধন্যবাদ স্যার আপনাকে হয়ত বলবেন স্যার বললাম কেন ?কেননা আমি এই মুক্তমনারি একজন নিয়মিত সদস্য রাজেশ দার কাছ থেকে পরিচয় জেনেছি বাকিটা এই মুক্তমনাই জলন্ত সাক্ষী ।তাই বললাম আর কি ।দয়াকরে সেই অধিকারটুকু দেবেন। আমদেরকে মুক্ত চিন্তা করার সুযোগ দেয়ার জন্য।আমি একটা মন্তব্য করছিলাম কপিল ভাইর লেখায় জানিনা পড়ছেন কি না ।যদি পড়ে থাকেন তাহলে ভেবে দেখবেন ।ধন্যবাদ ভালো থাকবেন ,বেশি বেশি করে লিখবেন প্লীজ। (F) [img]httov://[/img]
…একেই বলে সমালোচনা (সমান ভাবে আলোচনা)…bRaVo! (Y)
ধন্যবাদ প্রদীপ দা বইটির সুন্দর একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার জন্য। সত্যি বলতে কি বইটি পড়ছি পড়ব করতে করতে দিন পার করেছি কিন্তু পড়া হয়ে উঠেনি এখনো। আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে নিজেরি লজ্জা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এত দিন আলসেমী করে কেন বইটা পড়া হয়ে উঠেনি এই চিন্তা করে। অভিজিৎ দা এবং ফরিদ ভাই দু’জনের লেখার মান অসাধারন, ভাষা শৈলী ও চমৎকার, শব্দ বিন্যাস মন কাড়া, প্রকাশ ভঙ্গিতেও থাকে অভিনবত্ব। এক কথায় দু জনি বেশ ওজনদার লেখক। দু’জনের লেখার আমি খুব ভক্ত, অনুরাগী। যদিও বেশির ভাগ সময় সেই একি আলসেমী জনিত ছুতোয় মন্তব্য করা হয়ে উঠেনা উনাদের লেখায়। দু’জনেই প্রবাসে থাকেন। প্রবাসে থেকে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সময় বের করে লেখালেখি করা কত যে কঠিন তা বেশ বুঝতে পারি।
উনাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আমার পক্ষ থেকে রইল দু’টি (F) (F)
অনাগত দিন গুলোতে উনাদের কাছ থেকে আরো কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
প্রদীপ, অনেক ধন্যবাদ বইটি কষ্ট করে যোগাড় করে পড়বার এবং প্রতিক্রিয়া লিখবার জন্য।
আপনার গ্রন্থ সমালোচনার সবচেয়ে বড় একটি গুণ হল – এতে শুধু ভাল ভাল কথাই থাকে না, সেই সাথে থাকে যৌক্তিক সমালোচনাও। এটা আপনার গ্রন্থ পর্যালোচনার খুব বড় একটা দিক।
সহ লেখক হিসেবে ফরিদ ভাইকে পাওয়া সব সময়ই গর্বের। অসম্ভব সৃষ্টিশীল এ মানুষটির সাহিত্যে যেমন দখল, তেমনি অনুরাগ বিজ্ঞানেও। আমাদের বইটা খুব একটা বড় নয় – সব মিলিয়ে ১১২ পৃষ্ঠার। কিন্তু আমি আনন্দিত যে ছোট বইটি বেশ ভাল প্রভাব ফেলেছে অনেক পাঠকদের মধ্যেই। যেমন রায়হানের একটি ফেসবুক পোস্টের উত্তর Fahad Wajed লিখেছেন –
এ ধরণের মন্তব্যগুলো লেখক হিসেবে আমার পরম পাওয়া। বইয়ের স্বার্থকতা এখানেই। কেরন্স-স্মিথের বানরের টাইপ করার উদাহরণটির আরেকটু বড় করে বিস্তৃতি ঘটিয়েছি (ডকিন্সের প্রোগ্রাম সহ) আমার আর রায়হানের সাম্প্রতিক বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন‘-এ।
প্রদীপদেবকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ বইটির রিভিউ করার জন্য ।
আপনার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই আসলেই এরকম বই আমাদের আরো আরো বেশী করে চাই।”মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে।” বইটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এক মাইলফলক সংযোজন যা আজ ও ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য একান্ত অবধারিত।
আর আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষন দারুন অনবদ্য।
(F)