সব সাগরই গর্জায়। এটাই স্বাভাবিক। তবে এই সাগরটার গোঙানী একেবারেই আলাদা। হয়তো মানুষ এর চারদিকটা মাটির দেয়ালে ঘিরে রেখেছে, তাই। মানুষের স্পর্শে এর গলার স্বরই পাল্টে গেছে। তাই এত সব বিশেষত্ব নিয়ে এর নাম হয়েছে ভূ-মধ্য সাগর। শব্দে আর বর্ণে চেহারায় এই জলধি অন্য মাত্রার বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে যেন। উদ্যাম স্রোত আর দুরন্ত ঢেউয়ের দাপাদাপি, ভয়ংকর গর্জন শ্রবনে চপেটাঘাত করে চমকে দেয় ক্ষণে ক্ষণে। গলায় ছুরি চালানো কোরবাণীর পশুর শেষ চিৎকারের মত হঠাৎ করে সব মনোযোগ কেড়ে নেয় এই দুবৃত্ত সাগর তার অদ্ভুত গোঙানীর শব্দে। এমনই এক কালো সমূদ্রের ভেতর দিয়ে পানি কেটে কেটে সোজা উত্তর দিকে মুখ করে এগিয়ে চলেছে মাঝারী আকারের এক দুঃসাহসী জাহাজ। কাগজের নৌকা অথবা কলার মোচার একখন্ড ছিন্ন পাতার মত দুলে দুলে পানি খেয়ে খেয়ে এগুচ্ছে জাহাজখানা, কিন্তু ডুবছে না। পাটাতনের যাত্রিরা সবাই শ্রমজীবি। চোখে তাদের অসহায় শূন্য দৃষ্টি। সাগরের সাথে সাক্ষাৎ করার কোন কথা ছিল না তাদের, অথচ তাই করতে হচ্ছে। তারা মরু জনপদে এসেছিল শ্রম বিক্রি করতে। এসেছিল আরও পূবের দেশগুলো হতে দারিদ্রের তাড়া খেয়ে খেয়ে। সবই ভাগ্য। যে মজুরী পাবার কথা ছিল তারা কেউ তা পায়নি। কত লোকের হাত বদল হয়েছে তারা! সবাই ব্যবসা করেছে তাদের মজুরী নিয়ে- ফুলে ফেপে উঠেছে মুনাফায় চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে। মজদুরগুলো হয়েছে রক্তশূন্য। তারপরেও তাদের কাজ তো ছিল। এ এক বড় সান্তনাই।
হঠাৎ করে কী যে হলো কেউ বলতে পারে না। মরুভুমিতে যুদ্ধ লেগে গেল। বাতাসে গেল আগুন ধরে। তা ধরে ধরুক তাতে মজদুরদের কিছু যায় আসেনা। কাজের শেষে, শরীরের ঘাম শুকানোর আগে মজুরীটা দিয়ে দিলেই হলো- তাদের আর কচ্ছিু চাই না। কিন্তু কেউ কখনও কথা রাখে না। স্বার্থের ব্যাপারে ধর্ম কাজ করে না। তাইতো বকেয়া মজুরী পাওনা থেকে যায় মাসের পর মাস। তার উপরে এখন এক নতুন কেয়ামত। কাজ থেকে তাদরে তুলে নেয়া হলো জাহাজে। শুনাযাচ্ছে মজদুর গুলোরে বেধে ছেদে লিবিয়া থেকে গ্রীসে নিয়ে যাওয়া হবে। এত এক মহা গজব নাজিল হলো! মাটির শরীর আর কত তাপ সইবে? সব পুড়ে যে খাক হয়ে গেল। কারও রক্ষা নেই। এই আগুনে সবাই পুড়ছে। পুড়ছে সবার মতন সেলিমও।
সেলিম সাহ্জাদা নয়, তারপরেও নাম ওর সেলিম। দিনমজুরী পৈত্রিক পেশা, তবুও খেটে খাওয়া পিতা সখ করে ছেলের নাম রেখেছিল সেলিম। হয়তো যুবরাজের মত চেহারা নিয়ে জন্মেছিল তাই। তবে এখন তার ক্ষুধা ছাড়া আর কোন বোধ নেই। এখন সে পোড়া কাঠ। পোড়া কাঠের মাথায় একবার যা ঢোকে তা আর বের হয় না। জাহাজে চড়ার পর থেকে তার মগজে সেটে আছে যে কথা, তাহলো-সব জাগায় যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দেশে ফেরা যাবে না, কখনই না। কিন্তু কেন ফেরা যাবে না? জন্তুর মত মনেমনে বুঝতে পারে তা দিন মজুর সেলিম, কিন্তু বলার মত দক্ষতা নেই তার। শুধু ক্ষুধা বোধের চর্চায় এমনই হয়- সবাই জন্তু হয়ে যায়। অত কিছু বোঝে না মজুর। শুধু বোঝে- দেশে ফেরা যাবে না।
জীবনে এটা প্রথম সাগর দেখা সেলিমের- দিনমজুর সেলিমের। সমূদ্রের রূপ-রস-গন্ধে তার কোন আগ্রহ নেই। ভূ-মধ্য সাগরের উৎকট গোঙানী তার কানের পাশদিয়ে চলে যায়, ভেতরে ঢুকতে পারেনা। কারণ তার মাথার ভেতরে বিদঘুটে সব শব্দ তৈরী হয়েই আছে, অনেক আগে থেকে। দেশের থেকে সেসব গর্জন বয়ে নিয়ে এসেছে সে। সমূদ্রের গর্জন তার কাছে কিছুই না। সেখানে আছে অপমান আর ক্ষুধার মিলিত গর্জন। কিছুই ভোলে নাই সেলিম। মনে আছে-ঠিকই মনে আছে সব- রাহেলারে বিয়ে করতে চাওয়ায় কি অপমানটা করেছিল তার বাপ আর ভাই মিলে। কী এমন করেছিল সে? বিয়া করতে চাইলেই কি পাপ হয়? সেই অপরাধে তারে গবরে নাকে খৎ দিতে হইছিল। রাহেলার বাপ হারেছ মিঞা জুতা দিয়া সবার সামনে গুনে গুনে এগারোটা ঘা মেরেছিল। তার পরেও শেষ হয় না বাপ-বেটার ক্রোধ। সবশেষে গলায় গামছা পেঁচিয়ে তারে সারা গ্রামে ঘুরানি দিয়েছিল ইজ্জতদারেরা। হায়রে ইজ্জত! সেলিম কি আর জানেনা- কেমন করে হারিছ ঘরামী থেকে হারিছ কন্ট্রাকটর হলো? কিভাবে দিনে দিনে হারিস মিঞা থেকে হলো হারিছ সাহেব? তার বাপের সাথে কতদিন দিনমজুরী করছে হারিছ মিঞা। সেই হারিস মিঞা তারে মাটির সাথে মিশায়ে দেয় অপমানে! একবার মনে হয়ছিল তখন সেলিমের, ‘জীবন ডারে রাইখা আর কি হইবো। বিলাই কুত্তা হইয়া বাইচা থাকনে কোন লাভ নাই।’ ছি: সেলিম ছি- কানে ধরেছিল সে। ঐ কাজ কাপুরুষে করে। হারিস মিঞার কথাগুলো এখনও শব্দ তোলে মাথার ভেতরে, “বামনের সাধ কত! আকাশের চান্দে থাবা মারে। দিনমজুর আবার পোলাও খাওনের স্বপ্ন দেহে।” অপমানের সেসব গর্জন ঐ সাগরের গোঙানীর থেকে অনেক বেশী। অপমানের আর লজ্জার সাগর সাতরে পার হবার যে শক্তি নিয়ে সে এই মরুভূমিতে এসে পড়েছে তার থেকে খুব সামান্য শক্তি খরচ করে সে এই ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিতে পারবে। সে নিশ্চিত পাড়ি দিবে এই সমূদ্র। তার সমস্ত শরীরে দিনমজুরের ছাপ্পর মারা। এই ছাপ্পর নিয়ে দেশে ফেরা যায় না। বাঁচার মত বাঁচতে হবে তাকে। মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে দেশে। দিনমজুররা একধরনের নামানুষ। হয়তো মারা যাবে সাগরের কামড়ে, তবুও এ মরা তার বাচার জন্য মরা। বাঁচতেও তো পারে! এই জুয়াটা তার খলেতেই হবে।
অদ্ভুত জুয়া খেলাটার জন্য আরও খেলোড়ার খুজে পেয়েছে সেলিম। সবাই তার দেশী সহকর্মী সর্তীর্থ। তাদের সবার মনের ভেতরেও এক একটা ভয়াবহ উৎকট গর্জনের শব্দ। ওরা সবাই খুবই আপন-সহদর ভাইয়ের মতন। ওরা একসময় আপনি করে কথা বলতো এখন বলে তুই করে। ওরা সবাই খুব আপন। কারণ ওরা ঠিক একই ভাবে ক্ষুধাটারে অনুভব করেছে। গতরাতে সেলিমের দলবল পাটাতনে এক হয়েছে। মাথা জড় করে কানে কানে ফিসফিস করেছে, প্রতিজ্ঞাও করেছে একটা। সাতরে আবার লিবিয়া ফিরতে হবে, কিন্তু দেশে ফেরা যাবে না। কারণ দেশে গর্জন ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের জন্য। মাঝে মধ্যে চৈনিক সুপারভাইজার এসে হাক মেরেছে, “এই, তোমরা কি করছো এখানে?”
চেচিয়ে উত্তর দিয়েছে সেলিম, “আমরা একটা দেশী খেলা খেলতাছি।”
সুপারভাইজার খুশি হয়ে চলে গেছে। দেশী খেলাটা খেলতেই হবে সেলিম গংদের। কোন পথ নেই এটা ছাড়া।
নামানুষ সেলিম এখন নেতা, বড় নেতা-কয়েক ঘন্টার নেতা। মায়ের পেটের ভেতর থেকে সন্তান যেভাবে প্রকৃতির নিয়মে বেরিয়ে আসে আলো দেখবে বলে। তেমনিকরে নেতা বনে গেছে সেলিম সাথি মজদুরদের আলো দেখাবে বলে। এই হয়তো সেই সত্য নেতার সরূপ। এরা মরে বাঁচে একসাথে-সবার সাথে। এদের ভেতরে আগুন থাকে ছাই চাপা। এরা ভুল হলেও নেতা, ঠিক হলেও নেতা। নেতার কানে কানে একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “আমারা লিবিয়া ফিরা গিয়া করমুটা কি”? মুহুর্তে নেতার উত্তর পৌছে গেল সবার কানে কানে। নেতার উত্তরে সবাই খুশি, আশান্বিত। সাগরের পাড় বরাবর বাগানের পর বাগান, জয়তুন গাছের সারি। ওখানে ঢুকে পড়বে ওরা সবাই। মালিকের হাতে পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বলবে, “আমাগো বেতন দেওন লাগবো না, দানাপানি দিলেই চলবো।” তারপরে আস্তে ধীরে ওরা ঠিকই একটা কাজ জোগাড় করে নেবে- নিতে হবে। যত কষ্টই হোক দেশে ফেরা যাবে না।
-তাইলে তোরা সব রাজী? এক সাথে ঝাপ দিতে হইবো কইলাম, ঠিক দুপুর বারটা এক মিনিটে খাওনের ঘন্টাটা বাজার লগে লগে।
নেতা ফিসফিসায় আবার। দলের সবার মাথা এক করে নির্দেশ দেয় গোপনে সতর্কে। সবার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত গুলো এক হয়ে একে অপরকে স্পর্শ করে হাতে হাতে। ওরা সাবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- এ জুয়া তারা খেলবে- বাচার জন্য খেলবে। শান্তির জন্য যুদ্ধ করা গেলে বাচার জন্য মরাও যায়।
আবার কোথা থেকে উদয় হয় চৈনিক সর্দার। চেচিয়ে বলে, “তোমরা করছটাকি”?
এবার আর শুধু নেতা নয় একমাথে সবগুলো দেশী কন্ঠ বেজে ওঠে, “আমরা একটা দেশী খেলা খেলতাছি।” সর্দার হেসে দিল, আরও বেশী খুশী হয়ে চলে গেল নিজের কাজে।
বারটা এক মিনিট। খাবার ঘন্টা বেজে গেল সাগর কাপিয়ে, দুনিয়া কাঁপিয়ে। মজদুরদের ক্ষুধার উচ্চতা ছুয়ে গেল সে শব্দ। অনেকগুলো বাদামী মানুষ একসাথে চলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে লাফ দিল। সবাই হা করে দেখলো সে খেলা- দেশী খেলা। কিন্তু কেউ বুঝলো না, কেন? কেউ কেউ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, “একসাথে এত আত্নহনন? কিন্তু কেন?” থেমে গেল জাহাজ। সাগর কাউকে ক্ষমা করলো না- কাউকে না। অল্প কিছু মানুষ উদ্ধার হলো জীবিত। কিছু গেল একে বারে তলিয়ে, কিছু উদ্ধার হলো মৃত। নেতা সেলিমও এখন মৃত। এসবে সাগরের কিচ্ছু যায় আসে না। শুধু একটা প্রশ্ন থেকে থেকে দুবৃত্ত সাগরকে কাঁটার খোচায় আরও বেশী অশান্ত করে তুললো- শান্তির জন্য যুদ্ধে মারা গিয়ে মানুষ শহীদ হয়, আবার বেচে থেকে কেউ হয় গাজী। এই দেশী লোকগুলো মরেছে বাচার জন্য- ওরাও কি তবে শহীদ? অথবা যারা বেচে আছে তারা কি তবে গাজী? কে জানে এসব? ওদের দেশই বলতে পারে তা।
[সেই সমস্ত বঙ্গ সন্তান যারা মরুভূমির দেশে দিবা রাত্র নিদারুন শ্রমে স্বদেশের জন্য সৌভাগ্য কুড়াত, তাদের একটা কাফেলা ভয়াবহ কর্ম অনিশ্চয়তার মুখে লিবিয়া থেকে জাহাজে গ্রীস যাবার পথে ভূমধ্য সাগরে ঝাপ দিয়েছিল- এই ক্ষুদ্র লেখাটা সেই সব অসম সাহসী মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে]
আপনার গল্প লেখায় হাত বেশ পাকা বুঝতে পারছি। (Y)
নিয়মিত লিখতে থাকুন। যদিও মানছি কোন কিছু লেখা বেশ জটিল ও শ্রমসাধ্য একটি কাজ। তার পরেও আশা করছি নিয়মিত হবেন।
@রাজেশ তালুকদার,
লিখে আনন্দ পাই। লিখব আরো। লেখা দেবার প্রেরনা পাচ্ছি। আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটা ভালো লেগেছে।
ফ্লোরিডা উপকুলে এটি রোজকার ঘটনা । বিশেষ করে হেইতির মানুষ নিরাপত্তা আর আর্থিক সুবিধের জন্যে ভাগ্যের ভেলা ভাসিয়ে উপকুলের কাছাকাছি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্রের লোনা জলে। যদি মাটির ছোঁয়া পেয়ে যায় এ আশায়। ১৯৬৩ এর এই সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ২৩ জন ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ ঝাঁপ দিয়েছিলো উত্তাল সাগরে। না, স্বপ্ন বন্দর আমেরিকায় তাদের ঠাঁই হয় নি। ফিরে যেতে হয়েছিলো। আজো সমুদ্র প্রাচীরের বেড়াজাল ভেঙ্গে মানুষ উঠে আসতে চায় ডাঙ্গায়। সমুদ্রের অথৈ জলে কোথায় ভেসে যায় তাদের খড় কুটোর মত শরীর। যারা অকারনে দৈবাৎ বেঁচে যায় ইউ এস কোস্টাল গার্ড মরণ বাজী রেখে তাদের উদ্ধার করে, সারিয়ে তোলে তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা বৈরী পরিবেশে যুদ্ধ করে টিকে থাকা শরীর , আর সেই সুস্থ শরীরের ওপর সব শেষে আশার সমাধি গাঁথা হয়। ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় এদের জন্মভুমি তে।
তবুও এ ভাবেই জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়া স্বপ্ন বণিক আজো আসে, কেউ কেউ হয়ত পেয়েও যায় রিফিউজির পোষাকি পরিচয়। তবে কিসের মুল্যে এই বাণিজ্য তা’ জানি না।
আচ্ছা , শাখা নির্ভানা ( এই ছদ্ম নামে কিছু আলোচনা করতে বড়ই অস্বস্তি হচ্ছে, যা হোক!) ধরুন সে দিন মানুষ গুলো লাফিয়ে পড়ে নি জলে তাহলে তাদের পরিণতি আজ কি হোত বলে আপনার ধারনা? এক মৃত্যু থেকে আরেক মৃত্যুর মাহাত্ম আলোচনা করতাম আমরা?
বেশ পুরোন তবু লিঙ্ক টা দিলাম ।
http://www.migrationinformation.org/Feature/display.cfm?ID=80
@কেয়া রোজারিও,
বৃক্ষ তোর নাম কি? ফলে পরিচয়। নামে কিবা আসে যায়। আপনার প্রতিকৃয়া ভাল লেগেছে। লিংকটাও দেখলাম। ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। অনেক দিন ধরে এগুলো নাড়াচাড়া করছি। বানান টানান বা ঐ জাতীয় কিছু সমালোচনা নয়। লেখাটার শিল্পমান সম্পর্কে যদি কেউ টুকিটাকি উপদেশ বা সমালোচনা করতো তাহলে খুব উপকার হতো। পড়ার জন্য অসংখ্যা ধন্যবাদ।
@শাখা নির্ভানা,
লেখক তো নই-ই, বিদগ্ধ কথাটাও খাটে না, আমি অত্যন্ত সাধারন একজন পাঠক, আপনার লেখা নিয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে শোভন নয় তবু যেহেতু জানতে চাইলেন তাই আপনার অনুমতি নিয়েই আমার কিছু উপলব্ধি সহভাগীতা করি।
“স্বার্থের ব্যাপারে ধর্ম কাজে আসে না ” কথাটা বেশ শক্তিশালী , এই বাক্যের সঙ্গে আরো ক’টা ব্যাখা মুলক বাক্য জুড়ে দিলে মন্দ হোত না। ঠিক এ ভাবে ছোট ছোট কিছু বাক্য আপনি তৈরী করেছেন খানিকটা স্বগোতক্তির মত, ধারনা করি এ গুলো আপনার অনেক বোধের সারসংক্ষেপ , যেমন ধরুন “পোড়া কাঠের মাথায় একবার যা ঢোকে তা’ আর বের হয় না, “শান্তির জন্যে যুদ্ধ করা গেলেও বাঁচার জন্যে মরাও যায় ” । কেনো যেন মনে হোল বাক্য গুলো একাকী বড় বেশী উজ্জ্বল ভাবে উঠে এসেছে গল্পকে ছাপিয়ে। বলতে চাইছিলাম এর সঙ্গে দু একটা বাক্য জুড়ে দিলে গল্পের সঙ্গে মিশতো ভাল। ব্লেন্ডিং টা যথার্থ হোলে আমার মত আম পাঠকের পড়তে আরো আয়েশ হোত।
আমি পাঠক হিসেবে আপনার কলম যে ভাবে আমাকে ভাবায় সেই ভাবেই ভাববো, এটাই স্বাভাবিক্ কিন্তু আমি কেয়া রোজারীও আপনার বোধকে সম্পুর্ন মেনে নেব তার নিঃশ্চয়তা নেই। নেই বলেই যখন লিখছেন “জন্তুর মত মনে মনে বুঝতে পারে দিন মজুর সেলিম…।। সবাই জন্তু হয়ে যায়, অথবা দিন মজুর রা একধরনের নামানুষ” – বলছিলাম একেবারে সিধান্ত না দিয়ে কোথাও কি একটু পাঠকের ভাবনার সুযোগ রাখা যায়। বলা কি যায় কখনো কখনো জন্তু হয়ে যায়। কেউ কেউ জন্তু হয়ে যায়? ভাবছিলাম আমি কেয়া হতেও তো পারি ভাগ্য বিড়ম্বনায় মরুর কোন দেশের এক মজুর, আপনার এই লেখা পড়ছি সারদিনের ক্লান্তি ভুলতে? মেনে কি নেব আমিও জন্তু?
লেখার গাঁথুনীর কথা বলি ? মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো পাঠের চলমানতা ,গতিময়তা রোধ হচ্ছে পরে বুঝলাম খেই হারাচ্ছি ওখানে ই যেখানে সেলিমের উপস্থাপনায় বলা হচ্ছে ” বিয়া করতে চাইলে…… ওখানে শব্দচয়ন খানিক ভিন্ন।
হয়ত ইচ্ছে করেই করেছেন কিন্তু প্যারা টাকে ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়?
কিছু আঞ্চলিক প্রকাশ নান্দনিকতায় ধাক্কা দিয়েছে যেমন মজদুর গুলোরে , ক্ষুধাটারে… তারে…। হয়তো বা ওটা আপনার লেখার ধরন খটকা লাগাটা আমার সীমাবদ্ধতা।
আর হ্যাঁ ভালো কথা , তিনটে বাক্যে পর পর “ওরা” ব্যাবহার করা, বানান, চন্দ্রবিন্দু , দুটো শব্দ এক হয়ে যাওয়া, টাইপের বিভ্রাট এগুলো এত মামুলী যে গল্পের শ্রীবৃদ্ধিতে তেমন একটা ছাপ ফেলতে পারে নি অন্তত আমার মত “ঝাঁকের কই” পাঠকের কাছে।
ম্যালা বলে ফেললাম। শেষ কথা ।। আপনার কথাই ধার করে বলছি , আমি স্বল্প বুদ্ধির মানুষ আমার মত করেই লিখলাম তাতে ” লেখকের কিচ্ছু যায় আসে না”।
@কেয়া রোজারিও,
“জন্তুর মত মনে মনে বুঝতে পারে দিন মজুর সেলিম। সবাই জন্তু হয়ে যায়, অথবা দিন মজুররা এক ধরনের নামানুষ।”
এটা আসলে আমার সিদ্ধান্ত নয়। এটা একান্তভাবে বাংলাদেশীয় শ্রেনী চরিত্রগত অবস্থা। আমরা সবাই এই ধারনার অবসান চাই। এটাকে এক ধরনের নেগেটিভ এপ্রোচ বলা যায়। উদাহরন সরূপ, একজন সত লোক একজন ঘুষখোরকে বললো, ঘুষ দেশ ও জাতির জন্য উপকারী, মহাপুরুষেরাও বলে গেছেন বেশী বেশী ঘুষ খেতে। আসুন আমরা সবাই মিলে ঘুষ খেতে লেগে পড়ি। এই কথার উদ্দেশ্য অসত লোকটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে।
আবার ‘কখনও কখনও’ বা ‘কেউ কেউ’ লিখি নাই বিষয়টার উপ র আর ও বেশী ইম্ফেসিস দেবার জন্য। এটা একান্তভাবে আমাদের দেশীয় শ্রেনী চরিত্র। এর খারাপ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে নেগেটিভ এপ্রচের কোন বিকল্প নেই।
আমাদের দেশী দোকানীরা বলে- খরিদ্দার হইলো লক্ষি। একই ভাবে পাঠক হচ্ছে লেখকের লক্ষি। আপনার আলোচলা ও সমালোচলা সুন্দর হয়েছে। এগুলো আমি অবশ্যি মাথায় রাখবো।
আবার আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছি ঘটনার মূল্যায়নে, কারন এটা আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট বা স্টাইল। লেখকের চেয়ে পাত্র পাত্রীর প্রভাব যেন গল্পের উপর বেশী থাকে। মনে হয় যেন গল্পের তরী চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাত্র পাত্রীরা- লেখক নয়।
@শাখা নির্ভানা,
মূক্তম নার চার আথবা পাঁচ পাতায় আমার আরো একটা গল্প আছে। ওটার নাম ‘খোয়াব’, ভাল লাগলে পড়তে পারেন। সেখানেও আপনাদের মতামত ওয়েলকামড। ধন্যবাদ।
মুক্তমনায় গল্পকারের অভাব রয়েছে।। আপনার কারণে সেই অভাববোধ বেশ কিছুটা কমবে।
@ফরিদ আহমেদ,
গল্পকার সেতো অনেক বড় ব্যপার। অবসরে কিছু লেখার চেষ্টা করি আর কি। আপনার লেখা আমি পড়েছি। নিঃসন্দেহে উত্তম। যদি সম্ভব হয় একটু লেখাটার সমালোচনা করবেন কি, যাতে লেখার শিল্পমান আরও উন্নয়ন করতে পারি। ধন্যবাদ।
@শাখা নির্ভানা,
ভালো লোককেই জিজ্ঞেস করেছেন। 🙁
আমি সাহিত্যিক নই। খুব একটা ভালো বুঝিও না সাহিত্য। ফলে, আপনার গল্পের শিল্পমান বিচার করার সাধ্য আমার নেই। মুক্তমনায় অনেক সাহিত্যিক আছেন তাঁরা হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
ছোটগল্পের বিষয়ে আমার আগ্রহ এবং পছন্দ টানটান উত্তেজনার রোমাঞ্চকর (থ্রিলিং) এবং শেষ মুহুর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে বড় ধরনের মোড় ঘোরানো (টুইস্টেড) গল্পগুলোর প্রতি। এই ধরনের গল্পগুলোকে সাহিত্য হিসাবে বেশিরভাগই লোকই কোনো মূল্য দেয় না। কিন্তু ওই যে বললাম আমার পছন্দ। পছন্দের উপরেতো আর কারো হাত নেই। সে কারণেই আমি যে দু চারটা গল্প লিখেছি, তার সবগুলোই ওই ক্যাটাগরিতে পড়ে। বিষয়বস্তুহীন হালকা মানের। পাঠককে আনন্দ দেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
আপনার এই গল্পের সমালোচনা হিসাবে আমি শুধু এইটুকুই বলবো যে, আপনার গল্পের বিষয়বস্তু, বক্তব্য, এগুলো দারুণ। এর উপস্থাপনাকে শুধু আরেকটু আকর্ষণীয় করতে হবে। যাতে করে প্রথম লাইন থেকেই পাঠক আটকে যায়। যে কোনো অনাকর্ষণীয় লেখার বেশিরভাগ পাঠক ছুটে যায় প্রথম প্যারার পরেই। আর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী এর শেষটা, পাঞ্চ লাইনটা। এখানে পাঠককে কল্পনার স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিতে হবে। লেখককে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে দেবার কিছু নেই। আমি হলে আপনার এই গল্পের পাঞ্চ লাইন হিসাবে বাংলাদেশিদের জাহাজ থেকে ঝাপিয়ে পড়াকেই ব্যবহার করতাম। এর পরে আর কোনো বর্ণনায় যেতাম না। ওতেই পাঠক সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেতো।
@ফরিদ আহমেদ,
খুব সুন্দর একটা সমালোচনা পেলাম। মাথায় রাখবো লেখার সময়। এই গল্পে একটু হাইলাইট করেছি নেতার সরুপ এবং দেশের দায়িত্বের কথা।
আপনার নির্বাচন ও আলোচনা যথার্থ হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ।
গল্পটি গল্প হলেও এ যে আমাদের হত দরিদ্র বাংগালীদের বিদেশে বাস্তব জীবনের করুন কাহিনি,জীবন যুদ্ধের কাহিনি।কত হাজার হাজার তরুন আমাদের দেশের নষ্ট,ভষ্ট,ভন্ড রাজনীতির সিস্টেমের কষাতলে জর্জরিত হয়ে দালালের মাধ্যমে বিদেশগামী হয়ে সর্বশান্ত ও নিঃস্ব হয়েছে তার প্রকৃত নজির কি আমরা জানি!!জানি না।যদি বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটে তখন হয়ত আমরা মাঝেমাঝে পত্রিকা বা মিডিয়ার মাধ্যমে কিছুটা জানতে পারি।
গল্পটির ভাষা প্রয়োগ ও বর্ননা চমৎকার।
চলুক।(Y)
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
Politics does matter. এইটা হলো আসল কথা। রাজনীতি ঠিক তো সব ঠিক। যে প্রানীর মাথা পচে যায় তা চলে যায় মর্গে। সবাই মিলে আসল জায়গায় ঘা দিতে হবে। তা না হলে মূক্তি নেই। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না, তবুও এমন কিছু লেখা, যা এখনো সেই বালক-বেলার মত কাঁদায়।
আমাদের বোধ-বুদ্ধির জগৎ কত কিছুতে ডুবে থাকে, অথচ মানুষের লাগামহীন সন্তান উৎপাদন এবং অবাঞ্ছিত মৃত্যু নিয়ে লেখা, দু’টোই যেন আমাদের কাছে বটতলার উপন্যাস।
আমার কেন জানি মনে হয়,আমরা কাঁদতেও ভুলে গেছি।
@স্বপন মাঝি,
আপনার অনুভুতি ও আবেগকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
বাংলার মাটি ও খুব সাধারণ মানুষকে যেভাবে কষ্ট মেখে একযোগে ছুঁয়েছেন, দেখে অদ্ভুত লাগলো। মাটিমাখা মনছোঁয়া গতিশীল লেখা।
মুক্তমনায় স্বাগতম (D)
@কাজী রহমান,
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। মানুষ গুলোর জন্য মনের খুব গহীনে ব্যথা অনুভব করি। আপনার অনুভুতি জেনে ভাল লাগলো।
@শাখা নির্ভানা,
গল্পের পটভূমি, আবহ ও চরিত্র মনোনয়ন ও সৃষ্টিতে আপনার আবেগ ও সৃষ্টিশীলতাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। প্রবাসী শ্রমজীবীদের নিয়ে লেখা তেমন নেই বললেই চলে। আপনার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
@গীতা দাস,
যদি এতটুকু ভাল লাগে এবং মন জেগে যায় মজলুমের ব্যথায় তবেই এই সব লেখা সার্থক হবে। ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মন ছুঁয়ে গেল গল্পটি।কিছু টাইপো ভুল আছে ঠিক করে দিলে ভাল হয়।
@তামান্না ঝুমু,
সাধ্যমত এডিট করলাম। ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
আপনার লেখা বোধহয় এই প্রথম পড়লাম। পড়ে আরো আরো পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। শুভকামনা রইল।
@মোজাফফর হোসেন,
কষ্ট করে গল্পটা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এতটুকু ভাল লাগলে খুশি হবো খুব।
প্রাচীন রোমানরা লাতিন ভাষায় ভুমধ্যসাগরকে বলতেন ‘মারে নস্ত্রোম (mare nostrum) অর্থাৎ আমাদের সাগর। সাগর ঘিরে চারপাশের ভূখন্ড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এমনটা উনারা বলতেই পারেন। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই আকাশ এবং সাগরের এমন ঘন নীল মিতালী কিভাবে সম্ভব। সাগরের নিচে ডুব দিলেও সেই মিতালী যে অটুট বোঝা যায়।
এরকম মন মাতাল করা আবহে যে নরকের দরজা খুলে যেতে পারে কিছু ভাগ্যান্বেষী বঙ্গীয় আদমের সামনে তা ভাবলে মনটা দূঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। ধন্যবাদ সুন্দর গল্পটার জন্য।
@সংশপ্তক,
ধৈর্য ধরে পড়েছেন এজন্য ধন্যবাদ। কিছু তথ্য অবগত হলাম আপনার থেকে। লোকগুলো সত্যিই হতভাগ্য। তাদের জন্য মন কাঁদে। তাই লেখা। আর তেমন কিছু করার ক্ষমতা নেই।