সব সাগরই গর্জায়। এটাই স্বাভাবিক। তবে এই সাগরটার গোঙানী একেবারেই আলাদা। হয়তো মানুষ এর চারদিকটা মাটির দেয়ালে ঘিরে রেখেছে, তাই। মানুষের স্পর্শে এর গলার স্বরই পাল্টে গেছে। তাই এত সব বিশেষত্ব নিয়ে এর নাম হয়েছে ভূ-মধ্য সাগর। শব্দে আর বর্ণে চেহারায় এই জলধি অন্য মাত্রার বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে যেন। উদ্যাম স্রোত আর দুরন্ত ঢেউয়ের দাপাদাপি, ভয়ংকর গর্জন শ্রবনে চপেটাঘাত করে চমকে দেয় ক্ষণে ক্ষণে। গলায় ছুরি চালানো কোরবাণীর পশুর শেষ চিৎকারের মত হঠাৎ করে সব মনোযোগ কেড়ে নেয় এই দুবৃত্ত সাগর তার অদ্ভুত গোঙানীর শব্দে। এমনই এক কালো সমূদ্রের ভেতর দিয়ে পানি কেটে কেটে সোজা উত্তর দিকে মুখ করে এগিয়ে চলেছে মাঝারী আকারের এক দুঃসাহসী জাহাজ। কাগজের নৌকা অথবা কলার মোচার একখন্ড ছিন্ন পাতার মত দুলে দুলে পানি খেয়ে খেয়ে এগুচ্ছে জাহাজখানা, কিন্তু ডুবছে না। পাটাতনের যাত্রিরা সবাই শ্রমজীবি। চোখে তাদের অসহায় শূন্য দৃষ্টি। সাগরের সাথে সাক্ষাৎ করার কোন কথা ছিল না তাদের, অথচ তাই করতে হচ্ছে। তারা মরু জনপদে এসেছিল শ্রম বিক্রি করতে। এসেছিল আরও পূবের দেশগুলো হতে দারিদ্রের তাড়া খেয়ে খেয়ে। সবই ভাগ্য। যে মজুরী পাবার কথা ছিল তারা কেউ তা পায়নি। কত লোকের হাত বদল হয়েছে তারা! সবাই ব্যবসা করেছে তাদের মজুরী নিয়ে- ফুলে ফেপে উঠেছে মুনাফায় চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে। মজদুরগুলো হয়েছে রক্তশূন্য। তারপরেও তাদের কাজ তো ছিল। এ এক বড় সান্তনাই।

হঠাৎ করে কী যে হলো কেউ বলতে পারে না। মরুভুমিতে যুদ্ধ লেগে গেল। বাতাসে গেল আগুন ধরে। তা ধরে ধরুক তাতে মজদুরদের কিছু যায় আসেনা। কাজের শেষে, শরীরের ঘাম শুকানোর আগে মজুরীটা দিয়ে দিলেই হলো- তাদের আর কচ্ছিু চাই না। কিন্তু কেউ কখনও কথা রাখে না। স্বার্থের ব্যাপারে ধর্ম কাজ করে না। তাইতো বকেয়া মজুরী পাওনা থেকে যায় মাসের পর মাস। তার উপরে এখন এক নতুন কেয়ামত। কাজ থেকে তাদরে তুলে নেয়া হলো জাহাজে। শুনাযাচ্ছে মজদুর গুলোরে বেধে ছেদে লিবিয়া থেকে গ্রীসে নিয়ে যাওয়া হবে। এত এক মহা গজব নাজিল হলো! মাটির শরীর আর কত তাপ সইবে? সব পুড়ে যে খাক হয়ে গেল। কারও রক্ষা নেই। এই আগুনে সবাই পুড়ছে। পুড়ছে সবার মতন সেলিমও।
সেলিম সাহ্জাদা নয়, তারপরেও নাম ওর সেলিম। দিনমজুরী পৈত্রিক পেশা, তবুও খেটে খাওয়া পিতা সখ করে ছেলের নাম রেখেছিল সেলিম। হয়তো যুবরাজের মত চেহারা নিয়ে জন্মেছিল তাই। তবে এখন তার ক্ষুধা ছাড়া আর কোন বোধ নেই। এখন সে পোড়া কাঠ। পোড়া কাঠের মাথায় একবার যা ঢোকে তা আর বের হয় না। জাহাজে চড়ার পর থেকে তার মগজে সেটে আছে যে কথা, তাহলো-সব জাগায় যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দেশে ফেরা যাবে না, কখনই না। কিন্তু কেন ফেরা যাবে না? জন্তুর মত মনেমনে বুঝতে পারে তা দিন মজুর সেলিম, কিন্তু বলার মত দক্ষতা নেই তার। শুধু ক্ষুধা বোধের চর্চায় এমনই হয়- সবাই জন্তু হয়ে যায়। অত কিছু বোঝে না মজুর। শুধু বোঝে- দেশে ফেরা যাবে না।

জীবনে এটা প্রথম সাগর দেখা সেলিমের- দিনমজুর সেলিমের। সমূদ্রের রূপ-রস-গন্ধে তার কোন আগ্রহ নেই। ভূ-মধ্য সাগরের উৎকট গোঙানী তার কানের পাশদিয়ে চলে যায়, ভেতরে ঢুকতে পারেনা। কারণ তার মাথার ভেতরে বিদঘুটে সব শব্দ তৈরী হয়েই আছে, অনেক আগে থেকে। দেশের থেকে সেসব গর্জন বয়ে নিয়ে এসেছে সে। সমূদ্রের গর্জন তার কাছে কিছুই না। সেখানে আছে অপমান আর ক্ষুধার মিলিত গর্জন। কিছুই ভোলে নাই সেলিম। মনে আছে-ঠিকই মনে আছে সব- রাহেলারে বিয়ে করতে চাওয়ায় কি অপমানটা করেছিল তার বাপ আর ভাই মিলে। কী এমন করেছিল সে? বিয়া করতে চাইলেই কি পাপ হয়? সেই অপরাধে তারে গবরে নাকে খৎ দিতে হইছিল। রাহেলার বাপ হারেছ মিঞা জুতা দিয়া সবার সামনে গুনে গুনে এগারোটা ঘা মেরেছিল। তার পরেও শেষ হয় না বাপ-বেটার ক্রোধ। সবশেষে গলায় গামছা পেঁচিয়ে তারে সারা গ্রামে ঘুরানি দিয়েছিল ইজ্জতদারেরা। হায়রে ইজ্জত! সেলিম কি আর জানেনা- কেমন করে হারিছ ঘরামী থেকে হারিছ কন্ট্রাকটর হলো? কিভাবে দিনে দিনে হারিস মিঞা থেকে হলো হারিছ সাহেব? তার বাপের সাথে কতদিন দিনমজুরী করছে হারিছ মিঞা। সেই হারিস মিঞা তারে মাটির সাথে মিশায়ে দেয় অপমানে! একবার মনে হয়ছিল তখন সেলিমের, ‘জীবন ডারে রাইখা আর কি হইবো। বিলাই কুত্তা হইয়া বাইচা থাকনে কোন লাভ নাই।’ ছি: সেলিম ছি- কানে ধরেছিল সে। ঐ কাজ কাপুরুষে করে। হারিস মিঞার কথাগুলো এখনও শব্দ তোলে মাথার ভেতরে, “বামনের সাধ কত! আকাশের চান্দে থাবা মারে। দিনমজুর আবার পোলাও খাওনের স্বপ্ন দেহে।” অপমানের সেসব গর্জন ঐ সাগরের গোঙানীর থেকে অনেক বেশী। অপমানের আর লজ্জার সাগর সাতরে পার হবার যে শক্তি নিয়ে সে এই মরুভূমিতে এসে পড়েছে তার থেকে খুব সামান্য শক্তি খরচ করে সে এই ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিতে পারবে। সে নিশ্চিত পাড়ি দিবে এই সমূদ্র। তার সমস্ত শরীরে দিনমজুরের ছাপ্পর মারা। এই ছাপ্পর নিয়ে দেশে ফেরা যায় না। বাঁচার মত বাঁচতে হবে তাকে। মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে দেশে। দিনমজুররা একধরনের নামানুষ। হয়তো মারা যাবে সাগরের কামড়ে, তবুও এ মরা তার বাচার জন্য মরা। বাঁচতেও তো পারে! এই জুয়াটা তার খলেতেই হবে।
অদ্ভুত জুয়া খেলাটার জন্য আরও খেলোড়ার খুজে পেয়েছে সেলিম। সবাই তার দেশী সহকর্মী সর্তীর্থ। তাদের সবার মনের ভেতরেও এক একটা ভয়াবহ উৎকট গর্জনের শব্দ। ওরা সবাই খুবই আপন-সহদর ভাইয়ের মতন। ওরা একসময় আপনি করে কথা বলতো এখন বলে তুই করে। ওরা সবাই খুব আপন। কারণ ওরা ঠিক একই ভাবে ক্ষুধাটারে অনুভব করেছে। গতরাতে সেলিমের দলবল পাটাতনে এক হয়েছে। মাথা জড় করে কানে কানে ফিসফিস করেছে, প্রতিজ্ঞাও করেছে একটা। সাতরে আবার লিবিয়া ফিরতে হবে, কিন্তু দেশে ফেরা যাবে না। কারণ দেশে গর্জন ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের জন্য। মাঝে মধ্যে চৈনিক সুপারভাইজার এসে হাক মেরেছে, “এই, তোমরা কি করছো এখানে?”
চেচিয়ে উত্তর দিয়েছে সেলিম, “আমরা একটা দেশী খেলা খেলতাছি।”
সুপারভাইজার খুশি হয়ে চলে গেছে। দেশী খেলাটা খেলতেই হবে সেলিম গংদের। কোন পথ নেই এটা ছাড়া।
নামানুষ সেলিম এখন নেতা, বড় নেতা-কয়েক ঘন্টার নেতা। মায়ের পেটের ভেতর থেকে সন্তান যেভাবে প্রকৃতির নিয়মে বেরিয়ে আসে আলো দেখবে বলে। তেমনিকরে নেতা বনে গেছে সেলিম সাথি মজদুরদের আলো দেখাবে বলে। এই হয়তো সেই সত্য নেতার সরূপ। এরা মরে বাঁচে একসাথে-সবার সাথে। এদের ভেতরে আগুন থাকে ছাই চাপা। এরা ভুল হলেও নেতা, ঠিক হলেও নেতা। নেতার কানে কানে একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “আমারা লিবিয়া ফিরা গিয়া করমুটা কি”? মুহুর্তে নেতার উত্তর পৌছে গেল সবার কানে কানে। নেতার উত্তরে সবাই খুশি, আশান্বিত। সাগরের পাড় বরাবর বাগানের পর বাগান, জয়তুন গাছের সারি। ওখানে ঢুকে পড়বে ওরা সবাই। মালিকের হাতে পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বলবে, “আমাগো বেতন দেওন লাগবো না, দানাপানি দিলেই চলবো।” তারপরে আস্তে ধীরে ওরা ঠিকই একটা কাজ জোগাড় করে নেবে- নিতে হবে। যত কষ্টই হোক দেশে ফেরা যাবে না।
-তাইলে তোরা সব রাজী? এক সাথে ঝাপ দিতে হইবো কইলাম, ঠিক দুপুর বারটা এক মিনিটে খাওনের ঘন্টাটা বাজার লগে লগে।
নেতা ফিসফিসায় আবার। দলের সবার মাথা এক করে নির্দেশ দেয় গোপনে সতর্কে। সবার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত গুলো এক হয়ে একে অপরকে স্পর্শ করে হাতে হাতে। ওরা সাবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- এ জুয়া তারা খেলবে- বাচার জন্য খেলবে। শান্তির জন্য যুদ্ধ করা গেলে বাচার জন্য মরাও যায়।
আবার কোথা থেকে উদয় হয় চৈনিক সর্দার। চেচিয়ে বলে, “তোমরা করছটাকি”?
এবার আর শুধু নেতা নয় একমাথে সবগুলো দেশী কন্ঠ বেজে ওঠে, “আমরা একটা দেশী খেলা খেলতাছি।” সর্দার হেসে দিল, আরও বেশী খুশী হয়ে চলে গেল নিজের কাজে।

বারটা এক মিনিট। খাবার ঘন্টা বেজে গেল সাগর কাপিয়ে, দুনিয়া কাঁপিয়ে। মজদুরদের ক্ষুধার উচ্চতা ছুয়ে গেল সে শব্দ। অনেকগুলো বাদামী মানুষ একসাথে চলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে লাফ দিল। সবাই হা করে দেখলো সে খেলা- দেশী খেলা। কিন্তু কেউ বুঝলো না, কেন? কেউ কেউ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, “একসাথে এত আত্নহনন? কিন্তু কেন?” থেমে গেল জাহাজ। সাগর কাউকে ক্ষমা করলো না- কাউকে না। অল্প কিছু মানুষ উদ্ধার হলো জীবিত। কিছু গেল একে বারে তলিয়ে, কিছু উদ্ধার হলো মৃত। নেতা সেলিমও এখন মৃত। এসবে সাগরের কিচ্ছু যায় আসে না। শুধু একটা প্রশ্ন থেকে থেকে দুবৃত্ত সাগরকে কাঁটার খোচায় আরও বেশী অশান্ত করে তুললো- শান্তির জন্য যুদ্ধে মারা গিয়ে মানুষ শহীদ হয়, আবার বেচে থেকে কেউ হয় গাজী। এই দেশী লোকগুলো মরেছে বাচার জন্য- ওরাও কি তবে শহীদ? অথবা যারা বেচে আছে তারা কি তবে গাজী? কে জানে এসব? ওদের দেশই বলতে পারে তা।

[সেই সমস্ত বঙ্গ সন্তান যারা মরুভূমির দেশে দিবা রাত্র নিদারুন শ্রমে স্বদেশের জন্য সৌভাগ্য কুড়াত, তাদের একটা কাফেলা ভয়াবহ কর্ম অনিশ্চয়তার মুখে লিবিয়া থেকে জাহাজে গ্রীস যাবার পথে ভূমধ্য সাগরে ঝাপ দিয়েছিল- এই ক্ষুদ্র লেখাটা সেই সব অসম সাহসী মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে]