লিখেছেনঃ অরণ্য

আমি যে পরিবারের সদস্য সেখানে কেউ কখনও জন্মগ্রহণ করেনি। আমার গর্ভধারিণী নেই, গর্ভধারিণীর সন্তান নেই, জন্মদাতার স্ত্রী নেই, আর ভাই-বোনগুলো সহোদরহীন বেড়ে উঠতে উঠতে আমার মতই জানলো, আমাদের হয়ত সত্যিকার অর্থেই কোনো পরিবার নেই। তাহলে আমি বা আমরা কীসের সদস্য? পরিবার যখন অস্তিত্বহীন, তখন নিশ্চিতরূপেই বলা যেতে পারে, না আমরা এই সমাজের, না এই দেশ, পৃথিবী, এমনকী, না এই মহাবিশ্বের সদস্য। তবে আমরা কোথাকার সদস্য? এই প্রশ্নের উত্থান থেকেই আমি নিশ্চিত হয়েছি, আমি বা আমাদের কখনও জন্মই হয়নি। আসলে আমরা জন্মহীন একটি কাল্পনিক পরিবারের সদস্য, যেখানে কল্পনা দিয়ে একেকটি পরিবার ও তার সদস্যদের সম্পর্ক গঠিত হয়, আবার কল্পনাতেই ঘটে তার সমাপ্তি। এভাবেই চলছে বহুবছর, বহুকাল; আর ক্রমশঃ এমন পরিবারে বেড়ে উঠতে উঠতে এক সময় এও জানতে পারি, আসলে আমাদের কোনো কল্পনাও নেই। ঠিক এখানে এসেই আমি মুখ থুবড়ে পড়ি, কেন না আমিও তখন কল্পনার সাথে মিলিয়ে যেতে যেতে নিরাকার হয়ে পড়ি, এবং এইসব ভাবনা বা বোধ শুন্যে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে আপন মনে সুর মেলাতে থাকে কোনো এক সুন্দর গানের তালে।
আমার জন্মদাতার কোনো নাম ছিল না, আর আমার জন্মদাত্রী সন্তান পেটে নিয়ে বার বার মরতে মরতেই কাটিয়ে দিল হাজার হাজার বছর, ফলে আমাদের ভূমিষ্ট হবার সফল সম্ভাবনা প্রতিবারই নষ্ট হতে হতেই শেষ হয়ে গেল। তারপরও আমি বা আমরা কীভাবে আছি, কেন আছি বলতে পারব না, শুধু জানি আছি, এবং হয়ত থেকেও যাব আরও কিছু বছর। হয়ত এই থাকাটাই খুব কাছ থেকে দেখেছি বহু বছর, ফলে অন্যসব বাস্তবতা থেকে আমার সরে আসা ঘটেছে খুব অজান্তে, আর যখন নিজেকে খুঁজতে গেছি; যখন মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, কেন এই থেকে যাওয়া, এভাবে নিরন্তর, ভিন্নরূপে, ভিনদেশে, যেনবা একটিমাত্র অখন্ড সময়ে অগুনিত ভগ্নাংশের একটিমাত্র ছায়া হয়ে? দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুধু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে মরিয়া হয়েছি, মানুষের এত যে মৃতু্য, তার আনুপাতিক হারে জন্ম ঘটে না কেন? জন্মশূন্য এই মৃতু্যকে সংজ্ঞায়িত করার আমার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ক্রমশঃ আমাকে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে সহায়তা করেছে যে, শুধু আমার পরিবারই নয়, বরঞ্চ এই পুরো বিশ্বেই কেউ কখনও জন্মগ্রহণ করেনি। অবিশ্বাস্য হলেও আমি তা খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আর আমার এই বিশ্বাসই হয়ত আমাকে এভাবে থেকে যেতে সহায়তা করেছে এতটা বছর।

আমার পরিবারের জন্মহীনতা তখনই হয়ত শুরু, যখন আমার দুধের দাঁত পড়ে যাওয়া সত্বেও দুধের প্রতিই নতুন করে আকৃষ্ট হলাম, এবং নারীকে মা-বোন হতে পৃথক করতে শিখলাম। এর ফল যে খুব শুভ হয়েছিল তা নয়, আবার অশুভ ফলের যে পরিণতি তাই আমাকে এভাবে আজ লিখতে সহায়তা করছে, যখন আমি সত্যিকার অর্থেই জন্মহীন একটি পরিবারে বসবাস করছি ও তার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছি, এভাবে।

একটি পরিবার আমার কাছে একটি সুদৃশ্য খাঁচা, যার দরজা ঢোকার জন্য আজীবন খোলা থাকলেও বেরুবার জন্য পুুনরায় উন্মুক্ত হয় একবারই। তারপরও আমি সেই সুদৃশ্য খাঁচাটিকেই ভালবেসেছি। মা-বোন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া নারীরা আমার সেই প্রিয় খাঁচাটি দেখে লোভী হলেও শেষ অব্দি জানিয়েছে, এটাকে দেখতে যতটা সুদৃশ্য মনে হয়, আসলে ততোটা সুন্দর করে সাজানো হয়ে ওঠে না কখনই। এর চমক যত বেশি, প্রকৃত অর্থে এর গ্রহণযোগ্যতা সে অনুপাতে বড় কম। আসলে তারা যা বলতে চায়, আমি অনেক আগেই বুঝেছি, কিন্তু না বোঝার ভান করে তাদের জানাতে থাকি, ‘এই খাঁচাটি অনেক পুরোনো আমলের, এবং আমাদের সময়ে এমন খাঁচা আর দ্বিতীয়টি হয়নি। এখানে সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, কেন না এইখানে কেউ কখনও জন্ম গ্রহণ করেনি।’
তারা তাজ্জজ হয়, মুগ্ধও হয়ত, কিন্তু শেষ অব্দি খাঁচার পরিমন্ডল ছেড়ে যেতে যেতে আমাকে জানিয়ে যায়, ‘এমন কোনো খাঁচা আমারও ছিল। তোমার বয়স কম, আরেকটু সময় গেলেই বুঝবে, পৃথিবীর সব খাঁচারই বৈশিষ্ট্যই এক, আর তা হলো আবদ্ধ।’ আমি চুপ করে থাকি, আর তারা ফিরে যেতে থাকলে একটিমাত্র খাঁচার একটিমাত্র সদস্য হয়ে পুনরায় নিশ্চিন্ত হতে পারি, আমার বা আমাদের পরিবারে সত্যিই কেউ কখনও জন্মগ্রহণ করেনি, যে যার মতো যার যার খাঁচাতে আটকে আছি অনন্তকাল, আর সমস্ত খাঁচা মিলে একটি বৃহদ খাঁচার যে আকার তৈরী করে রেখেছে, তার মধ্যেই আর বেশি ঢুকে যাবার অজানা প্রয়াসে রোজ একটু একটু করে জন্মগ্রহণে লোভী হয়ে উঠি। এভাবেই আমি রোজ একটু একটু করে আরও বেশি খাঁচার সহচর্যে বসবাস শুরু করি, যেখানে নিজের জন্মহীনতার ক্ষোভ সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে সাজাই, আর নিজের মতো বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিতে থাকি সারাটা সময়, যখন আমি ও আমার খাঁচা সত্যিকার অর্থেই একে অপরকে চিনতে পারি, ভালবাসি।

ভালবাসা থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি, মানুষ জন্ম নিতে পারলেই বেঁচে যায়, নতুবা যে কোনো মৃতু্য তাকে খাঁচার নিরেট কাঠমো হয়ে খাঁচাতেই আবদ্ধ রাখে চিরকাল। ‘আমার জন্ম কবে হবে হবে’, এই বিশাল আক্ষেপ নিয়েই আমি এতটা বছর এভাবে অপেক্ষায় অপেক্ষায় নিজের সাথে সঙ্গম করি, গর্ভধারণ করি, আর নিত্য-নতুন স্বপ্নে বিভোর হতে হতে নতুন এমন পরিমন্ডল তৈরী করি, যেখানে কোনো খাঁচা নেই, নেই মানুষের চিরকালীন ভয় ও হতাশার দাপট। অথচ প্রতিবারই গর্ভপাত শেষে আমার করুণ কান্না আমারই নিঃশ্বাস ভারী করে তোলে, আর যতবার শরীরের মধ্যে সেই ভারী বাতাস ঢুকে পড়ে, ততবারই মনে হয়, নিজেকে হত্যা করি।

জন্মহীন একটি পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি শুধু এই বলতে পারি, যতটা বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলে মানুষ তার প্রাণের সবচেয়ে দুর্বল ও অবিশ্বাসী অংশকে জয় করতে পারে, আমি তার কাছাকাছি বহুবার গিয়েছি, আর প্রতিবারই জেনেছি, এমন বিশ্বাসকেই কেবল বলা যেতে পারে ‘জীবন’, যেখানে জন্মহীনতার বিন্দুমাত্র দায়ভার ছাড়াই যে কোনো প্রাণ মহাবিশ্বের দারুণ সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠতে পারে সেই সুন্দরতম গান, ‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ…’