রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে দুটি বিতর্কে (“রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দঃ” ও “রবীন্দ্রনাথ মানবই ছিলেন, তবে মহামানব !! “রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ” – প্রবন্ধের পাঠ প্রতিক্রিয়া। “) অনেক ব্যান্ডউইড্‌থ্‌ ও সময় ব্যয় হল। তিক্ত Ad Hominem মন্তব্যও অনেক বিনিময় হল । এবার আসা যাক বিতর্ককে ব্যক্তি আক্রমণ থেকে ঘুরিয়ে আকাডেমিক দিকে নেয়া যায় কি না সেই চেষ্টায়। যুক্তিবাদী ফোরামে যুক্তিবাদের আলোকেই সব কিছু বিচার বিবেচনা করাটা বাঞ্ছনীয়। সেই চেষ্টাই করব। সেই সাথে আমার কিছু ভাবনা ও কিছু প্রশ্নও থাকবে। আগেই বলে নেই আমার আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আমার দেয়া কোন তথ্য বা সূত্র থাকবে না। কারণ এটা রবীন্দ্র বিতর্ক নিয়ে আমার যুক্তিভিত্তিক এক সাধারণ বিশ্লেষণ, এটা অনেকটা মুক্তমনা গ্রুপে বেশ আগে বন্যার দেয়া রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এক পোস্ট নিয়ে কিছু উত্তপ্ত বিতর্ক সৃষ্টি হবার পর বিতর্ক নিয়ে আমার একটা যুক্তি ভিত্তিক বিশ্লেষণের চেষ্টার মত । একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই সেটা হল, যেসব কর্ম বা আচরণের ন্যায় অন্যায় বা দোষগুণ বিচারের জন্য আইনগত বা ঘোষিত কোন সার্বজনীন মানদণ্ড নেই সেই ব্যাপারে যে কোন ব্যক্তিগত মত বা অনুভূতি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না। হতে পারে ভিন্নমতের আদানপ্রদান । তবে বিতর্ক হতে পারে যে তথ্য বা উপাত্তের ভিত্তিতে সেই ব্যক্তিগত মত বা অনুভূতি প্রকাশ করা হচ্ছে তার সত্যতা নিয়ে। আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অনুকরণীয় দিক হল “You are entitled to your opinions, not to your facts” বা “We can agree to disagree” এই ধরণের আপ্তবাক্যের উপর ভিত্তি করে এক সহনশীল সংস্কৃতির গঠন। এটা আমরা এখনো পুরোপুরি রপ্ত করতে পারিনি। রবীন্দ্রবিতর্কে তথ্য উপাত্তে দ্বিমত না থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত অনুভূতি বা মতের পার্থক্যের কারণে পাল্টাপাল্টি যুক্তি দেয়া আর ব্যক্তিগত তিক্ততার সৃষ্টি হওয়াটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ত্ত্থ্য বা উপাত্তের সত্যতার ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকলে পালটা পালটি মত দেয়া নয় ,পালটাপাল্টি সূত্র উল্লেখ্ করে সত্যমিথ্যা যাচাই করাটা অর্থবহ। আর ব্যক্তিভিত্তিক বিশেষণ বিনিময় তো একেবারেই অবাঞ্ছনীয়। আসলে সমস্যার মূল হল এখানে যুক্তি বলতে দুই পক্ষই তাঁদের তথ্যভিত্তিক মত বা অনুভূতিকেই বোঝাচ্ছেন। তথ্যের ব্যাপারে দ্বিমত না হয়েও তারা দুরকম মত দেয়াতে তর্ক হচ্ছে। একই তথ্য আর মতকে বারেবারে দুপক্ষ দ্বিরুক্তি করে যাচ্ছেন। এতে সত্যিকার কোন যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা বা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, হচ্ছে ব্যক্তিগত মতপার্থক্য হেতু তিক্ততা প্রকাশ যার কোন যৌক্তিক নিষ্পত্তি হতে পারে না। যে তিনটি মূল বিষয় বা ইস্যু নিয়ে বিতর্ক সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা করি।

(১) রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” আর গগন হরকরার ‘”কোথায় পাব তারে” ইস্যু

এটা দুপক্ষই স্বীকার করছেন যে “আমার সোনার বাংলা” এর সুর ‘”কোথায় পাব তারে” থেকে নেয়া। দুপক্ষই স্বীকার করছেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সুরকার যে গগন হরকরা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেননি। দুপক্ষই স্বীকার করছেন যে “আমার সোনার বাংলা” এর সুর বাউল গানের সুর থেকে নেয়া। দুপক্ষই স্বীকার করছেন যে গগন হরকরার “কোথায় পাব তারে” তার সুরও বাউল গান ভিত্তিক। তাহলে তথ্য উপাত্তে দুপক্ষের মতপার্থক্য নেই। অভিজিৎ/ফরিদ এই স্বীকৃতি না দেয়াকে চৌর্য্যবৃত্তি বলছে যেটা অপরপক্ষ মানতে নারাজ। তার মানে চৌর্য্যবৃত্তির সংজ্ঞা দুপক্ষের কাছে আলাদা। সংজ্ঞা আলাদা হলে সিদ্ধান্ত আলাদা হতে বাধ্য। সেখানে বিতর্কের প্রশ্ন উঠেনা। এখন প্রশ্ন হল চৌর্য্যবৃত্তির সর্বস্বীকৃত বা সার্বজনীন সংজ্ঞা যদি থেকে থাকে তাহলে রবীন্দ্রনাথ/গগন হরকরার ব্যাপারটা সেই সর্বস্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী চৌর্য্যবৃত্তি কিনা সেটা যাচাই করা। সে বিচারে এক পক্ষ ঠিক আর অপরপক্ষ বেঠিক হবে অবশ্যই। আরেকটা বিবেচ্য ব্যাপার হল আইনের চোখে চৌর্য্যবৃত্তি বনাম সঙ্খ্যাগরিষ্ঠের বিচারে চৌর্য্যবৃত্তি। যেমন বিবাহিত হয়ে দ্বিচারিতা করা আইনের চো্খে (ধর্মনিরপক্ষে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়) অপরাধ না হলেও বেশিরভাগ লোকের বিচারে তা অনৈতিক। সঙ্খ্যাগরিষ্ঠের বিচারে চৌর্য্যবৃত্তি কিনা সেটাও বিবেচ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ঘটনাটি আইন বা সঙ্খাগরিষ্ঠের বিবেক, যেটার বিচারেই যাই হোক না কেন তার পরও ব্যক্তিগতভাবে নিজের মানদন্ড অনুসরণ করে যে কেউ যে কোন রায় দিতে পারে, যেটা অভিজিৎ/ফরিদ/বিপ্লব করেছে। প্রত্যেকটা রায়কেই ব্যক্তিগত মত হিসেবে মেনে নিয়ে “Lets agree to disagree” বলে ইতি টানাটাই যৌক্তিক পথ হত। তাই বলে ব্যক্তিগত মতামত বিনিময় করাটা (ব্যক্তি আক্রমণ না করে) অপ্রাসঙ্গিক বা অবাঞ্ছনীয় নয়। তাতে ইস্যুর চেয়ে মানুষের চিন্তার বিভিন্নতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়। আরেক পক্ষ আছেন যারা এটা টেকনিকালি চুরি বলে মেনে নিলেও রবীন্দ্রনাথের মত বিশাল ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে সেটা উল্লেখ করার বিরোধী। তাদের কারও যুক্তি যারা এখনো রবীন্দ্রনাথের বিশাল ও মহৎ সাহিত্যকর্ম সমাজহিতৈষী কর্মকান্ড নিয়ে পড়াশুনা করেনি বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের যারা, তারা এই নেতিবাচক ঘটনাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ইন্টারেস্ট ও শ্রদ্ধা হারিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানতে আর এগুতেই চাইবে না,তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের বিশাল ও মহৎ সাহিত্যকর্ম সমাজহিতৈষী কর্মকান্ড অজানাই থেকে যাবে, এটাই তাদের ভয়। হতেও পারে, বা নাও হতে পারে। এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব কি? অনেকটা টিভি তে সহিংস্রতা দেখালে সমাজেও সহিংস্রতা আসতে পারে এরকম ধারণার মত। যাই হোক এই ক্ষেত্রেও তিক্ত ব্যক্তিভিত্তিক বিতর্ক নয়, মতামত বিনিময়ই কাম্য। কারও কারো মত হল, রবীন্দ্রনাথের মত বিরাট ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে দু একটি নেতিবাচক কর্মকে উপেক্ষাই করা উচিত। বড় হবার মূল্য যেমন দিতে হয় আবার পুরস্কারও আছে। প্রথম পক্ষের পালটা মত হল যে যদু মদুর ক্ষেত্রে সেটা যদি উপেক্ষা করা না হয় তাহলে তো এটা double standard হয়ে গেল। কথাটা ঠিক। তবে উপেক্ষা করার সমর্থকেরা যদু মধুর ক্ষেত্রে এই কাজকে চুরি বলে উপেক্ষ না করা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে এটাকে উপেক্ষ করাকে একটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে এটা আর double standard হবে না। এই স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিলে তাদের অবস্থান consistent হবে। প্রাচীন গ্রীসে সাধারণ লোকদের জন্য একরকম মানদন্ড ও শিক্ষিত বা দার্শনিক শ্রেণীর জন্য আরেক মানদন্ডের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কোন এক দার্শনিক। শ্রেণী বিন্যাস/শ্রেনীপার্থক্য অনেক সমাজেই স্বীকৃত ছিল বা কিছু কিছু আছে অলিখিতভাবে। বর্ণাশ্রম যেমন । আরেক দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায় বিশাল ব্যক্তিত্ব, যাদের অনেক ভক্ত আছে, যারা অনেককে প্রভাবিত করতে পারেন, তাদের জন্য তো মানদন্ড আরও উঁচুই হওয়া উচিত। এই মতও গ্রহণযোগ্য। ধর্মীয় সমালোচনায় ইশ্বর বা তার কথিত প্রেরিত পুরুষের বেলায় যেটা করা হয়। একটা তফাত হল, রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্ত থাকলেও রবীন্দ্রনাথকে কে কিন্তু নৈতিকতার আদর্শ বলে প্রচার করা হচ্ছে না বা সব ব্যাপারেই আদর্শ পুরুষ বলে দাবী করা হচ্ছে না ঘোষিতভাবে, সমষ্টিগতভাবে(ব্যক্তিপর্যায়ে অবশ্য কেউ তা ভাবতেই পারে, যাদের প্রতি মূল লেখাটা টার্গেট করা), যেটা ধর্মীয় প্রেরিত পুরুষদের বেলায় করা হয়। যে যেটার কথিত প্রচারক বা দাবীদার তার সাথে তাদের কোন কর্মের কোন অসঙ্গতি দেখা দিলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বেশি অর্থবহ। রবীন্দ্রনাথের বেলায় খুঁত ধরার একমাত্র কারণ হল তিনি যে সব ব্যাপারেই নিখুত না সেটা প্রমাণ করা (তাদের জন্য যারা সত্যই এরকমটি ভাবে। তাদের সংখ্যা কত তার বিচারে নাই বা গেলাম)।

কিন্তু যে কারণই এই পক্ষ দেখান না কেন, তবু শেষ কথা হল এটা যে চুরি সেটা উল্লেখ করার বাকস্বাধীনতা যে কারও থাকা উচিত সেটাও মেনে নেয়া। এই ব্যাপারে Evelyn Beatrice Hall এর সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই “আমি তোমার মতের সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে দরকার হলে জীবন দেব”

অনেকে অভিজিৎ/ফরিদ এর চুরি উল্লেখ করায় যতটা না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যে ভাষায় সেটা বলা হয়েছে বা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কি সেই ইস্যুতে। এটা ঠিকই যে লেকাটি একটু সেন্সেশানালিস্ট স্টাইলে লেখা। কিছুটা উত্তেজিত ভাব আছে লেখায়। তবে যুক্তিবাদী পাঠকের দৃষ্টিতে বক্তার প্রকাশভঙ্গী, ভাষার বা অনুমিত অঘোষিত উদ্দেশ্যের চেয়ে বক্তব্যের সত্যতাই মুখ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। বক্তার কন্ঠ,ভাষা বা অনুমান করা অঘোষিত উদ্দেশ্য বিচার করে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার বিষয় নয়। অন্যদিকে মুদ্রার ওপিঠের মত এটাও ঠিক যে যুক্তিবাদী কোন লেখকের বেলায়ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় আবেগময় ভাষা, প্রকাশভঙ্গী বা ঢালাও সিদ্ধান্ত/মত অবাঞ্ছনীয়। তবে এগুলি সাধারণ পয়েন্ট, রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য কোন পয়েন্ট নয়। অভিজিৎ/ফরিদ এর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল যারা রবীন্দ্রনাথকে ত্রুটিমুক্ত, নিখুঁত এক ব্যক্তি বলে মনে করে তাদের ভুল ভাঙ্গা। সেই লক্ষ্যে “আমার সোনার বাংলা” এর সুরের জন্য রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরাকে কৃতিত্ব না দেয়ার ঘটনাকে উল্লেখ করলেই যথেষ্ঠ, চুরি শব্দটা না উক্ত করে। পেশাদার সমালোচক বা ইতিহাসবেত্তারা যা করেন। কিন্তু এখানে সেরকম পেশাদারিত্ব সব সময় আশা করাও বাস্তব হবে না।

২। রবীন্দ্রনাথের “বিশ্বপরিচয়” আর প্রমথনাথ ইস্যু: এখানেও আমার উপরের অধিকাংশ বিশ্লেষণই প্রযোজ্য। এখানে প্রমথনাথকে সহলেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কি কি বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ড মেটাতে হবে সেটা দুপক্ষ লিখে তার ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতে পারে। দুপক্ষের দেয়া তথ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। অভিজিৎ/ফরিদ বলছে যে বইএর বিষয়বস্তু পুরোটাই প্রমথনাথের, রবীন্দ্রনাথ শুধু সেটাকে সহজ ভাষায় লিখেছিলেন। বিপ্লব বলছেন যে না বিষয়বস্তুও রবীন্দ্রনাথ নিজেই দাঁড় করিয়েছিলেন, শুধু অধ্যায়গুলো বিজ্ঞানের দিক থেকে শুদ্ধ কিনা এক এক করে সেটা প্রমথনাথ কে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিতেন। কার তথ্য সঠিক সেটা সর্বসম্মতিক্রমে যাচাই না করে বিতর্ক করা যায় না এ ব্যাপারে। অভিজিৎ/ফরিদ বেশ কিছু তথ্যসূত্র দিয়েছে এ ব্যাপারে। কিন্তু বিপ্লব তার বক্তব্যের সপক্ষে এখনও কোন সূত্রের উল্লেখ করেনি। আর প্রমথনাথের মূল পান্ডুলিপি পেলে এ ব্যাপারে আরো ভ্রান্তহীন কোন মত দেয়া যেত সেটাও অনেকে বলেছেন। কেউ একজন বলেছেন বিশ্বপরিচয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের নাম উল্লেখ করেছেন। এটা যদি সত্যি হয় আর কে বলেছেন সেটা যদি কেউ উদ্ধৃত করেন তাহলেও সুবিধা হয় বিচার বিশ্লেষণে। তবে একটা কথা ঠিক যে প্রকশিত বই এ প্রমথনাথকে সহলেখক এর নাম উল্লেখ না করার ঘটনায় রবীন্দ্রনাথকে যারা মহানুভব মনে করেন তাদের ধারণা যে ভুল সেটাই প্রমাণ করে। আধুনিক বিশেষ করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আরেকটা ইতিবাচক দিক হল যথার্থ স্বীকৃতি দান, যত নগন্যই হোক। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপকের (তা তিনি যদি নোবেল বিজয়ীও হন)। প্রকাশিত পেপারে নগন্য অবদানকারী গ্রায়জুয়েট ছাত্রেরও নাম উল্লেখ করতে দেখেছি। এটা বিনয়ের একটা অংশ। আমরা বাংগালীরা এ ব্যাপারে কার্পণ্য করি। রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারে গড়ের উর্ধে উঠতে পারেননি। বিপ্লবের বক্তব্য হল রবীন্দ্রনাথ নোবেল বিজয়ী হওয়াতে সহলেখক নির্বাচনের মানদন্ডও উঁচু হতে বাধ্য। কিন্তু সহলেখক নির্বাচনে হবু সহলেখকের অবদানের পরিমাণটাই কি একমাত্র বিচার্য্য হয়া উচিত নয়? নোবেল বিজয়ী হওয়াতে যদি সহলেখকের অবদান এর গুরুত্ব কমে যায় সেটা তো রবীন্দ্রনাথের আত্মনিষ্ঠ একটা মাপকাঠি হল (যদিও এটা বিপ্লবেরই ভাষ্য। আমরা জানিনা আসলেই সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথেক সহলেখক করেন নি কি না)। প্রমথনাথের অবদান নিয়ে অভিজিৎ/ফরিদ এর তথ্য যদি সঠিক হয় আর বিপ্লবের ভাষ্য ভুল হয় তাহলে প্রমথনাথকে সহলেখক হিসেবে না নেয়াটা রবীন্দ্রনাথের তরফে মহানুভবতার সুস্পষ্ট অভাব নির্দেশ করে। অন্য দিকে বিপ্লবের ভাষ্য সঠিক হলে আর যদি ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে থাকেন তাহলে অবশ্য প্রমথনাথকে সহলেখক হিসেবে না নেয়াটা অন্যায় কিছু নয়। কাজেই সঠিক তথ্য জানাটাই এখন জরুরী তর্কের অবসানের জন্য । যাহোক তিনি প্রমথনাথকে যথাযথ স্বীকৃতি দিলে তাতে তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার স্বীকৃতি বা উপলব্ধিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না। কিছু পাশ্চাত্যের মনীষীও এই অতীতে এই বিনয়ের অভাব দেখিয়েছেন। নিউটনের কথা মনে আসছে। কিন্তু শেষ কথা হল তিনি মূলত এক মহান সাহিত্যিক, সার্বিক আদর্শের প্রতীক নন। যারা তাঁকে সার্বিক আদর্শের প্রতীক ভাবেন তাদের ভুল প্রমাণ করার জন্য এটার উল্লেখ করাটা ঠিক আছে। এটা উল্লেখ করলেই যে সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রতিভার উপলব্ধি স্বীকৃতিতে ভাটা পড়বে তা তো নয়, বা অভিজিৎ/ফরিদ ও যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যপ্রতিভাকে ছোট করছে তাও নয়। যেহেতু ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথের ভাল মন্দ দিক তার সাহিত্যপ্রতিভার ব্যাপারে অপ্রাসঙ্গিক তাই ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথের মন্দ দিক নিয়ে কেউ লিখলেই সঙ্গে সঙ্গে সে সাহত্যিক রবীন্দ্রনাথকে ছোট করছে বলে দাবী করলে সেটা অযৌক্তিক হবে।

৩। রবীন্দ্রনাথ একজন প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন ইস্যু।

এখানে কেউ কেউ (ফরিদ ছাড়াও) বলেছেন যে জমিদার মানেই প্রজা নিপীড়ক, শোষক। এই মত মেনে নিলে রবীন্দ্রনাথ একজন প্রজাপীড়ক না প্রজাহিতৈষী জমিদার ছিলেন সেই ব্যাপারে তাত্বিক তর্কের আর কোন অবকাশ নেই। কেউ যদি বলে যে মুসলমান হলেই হিন্দুবিদ্বেষী হতে হবে (কারণ কুরাণে পৌত্তলিকদের ঘৃণা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে) তাহলে সব মুসলমানেরি তাত্বিকভাবে হিন্দুবিদ্বেষী হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটা সত্যি নয়। অনেকে বলবেন যে মুসলমান হিন্দুবিদ্বেষী নয় সে প্রকৃত মুসলমান নয় কারণ সে কুরাণের বাণীকে আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করছে না। সেভাবে এটাও বলা যায় কোন জমিদারও প্রকৃত জমিদার নাও হতে পারেন প্রজাপীড়ক না হবার কারণে। মালিক হলেই কি শোষক হতে হবে ? এটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। সেরকম জমিদার হলেই যে শোষক হতে হবে সেটাও বিতর্কিত ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তিনি শোষক ছিলেন কিনা সেটা নিয়ে অনেক তথ্য প্রমাণ দিয়ে একটা ধারণা হয়ত করা যাবে। তবুও প্রতিটি ঘটনার পেছনে কি কি প্রাসঙ্গিক বিবেচ্য বিষয় ছিল তা আমাদের পক্ষে জানা বা বিচার করা খুব সহজ নয়। তা ছাড়া এই ধরণের ঢালাও বিচার অভ্রান্তভাবে করতে হলে রবীন্দ্রনাথের মনের ভেতর প্রবেশ করতে হবে। কিছু উদাহরণ দেই। যেমন সারা বছর যে পরের সুখের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করল, ঈদ বা বিশেষ কোন দিন উপলক্ষে কাউকে ব্যয়বহুল কোন উপহার না দেয়াতে কৃপণ বলে অনেকের কাছে আখ্যায়িত হওয়াটা সঠিক মূল্যায়ন হবে না। কোন মানুষের একটি কর্ম থেকে তাকে কৃপণ বলে রায় দেয়া যেতে পারে আবার অন্য আর এক কর্মে থেকে তাকে দরাজদিল বলে মনে করা যেতে পারে। একজন মিতব্যয়ী লোককে কৃপণ বলেও ভুল করা যেতে পারে। কাজেই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ শোষক বা নিপীড়ক ছিলেন নাকি প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন সে ব্যাপারে ঢালাও রায় ব্যক্তিগত মতের পর্যায়ই থাকবে। হয়ত এটাই ঠিক যে তিনি কোন চরম প্রান্তেই ছিলেন না। মাঝামাঝি কোন এক বিন্দুতে। তাই তাকে এই দুই বিশেষণের (প্রজানিপীড়ক বা প্রজাহিতৈষী) কোনটাতেই ভূষিত করা সম্ভব না না বস্তূনিষ্ঠভাবে । ঢালাও মত দেয়া বা দিলেও সেটা নিয়ে ব্যক্তি আক্রমণভিত্তিক বিতর্ক করা সমীচীন নয়। শুধু ঢালাও বিচারের কারণ হিসেবে বিবৃত ঘটনাগুলি সত্য না মিথ্যা সেটা যাচাই করাটাই অর্থবহ।

আরেকটা ব্যাপার হল, নিজের স্বার্থ রক্ষা করা একটা বিবর্তনীয় তাগিদ বা প্রবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথও তার উর্ধে নন। আবার জনহিতৈষী কাজ করাও এক বিবর্তনীয় প্রবৃত্তি। এ দুই প্রবৃত্তিই একই ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথ এক বিচিত্র মনের মানুষ ছিলেন। এ জন্যই তাঁকে “Myriad Minded Man” বলে উলেখ করেছেন কৃষ্ণ দত্ত আর আন্ড্র্যু রবিনসন তাঁদের ঐ নামের বই এ। এক বা গুটি কয়েক ঘটনা দিয়ে কাউকে সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় না। এটা অবশ্য অনেকের বেলায়ও সত্য। আমি এ নিয়ে মুক্তমনা গ্রুপে ২০০৫ এর মে তে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম (ইংরেজীতে অবশ্য)।

রবীন্দ্রনাথ পৈত্রিক উত্তরাধিকার সুত্রে জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন, যতটুকু মনে পড়ে অন্য ভাইদের চেয়ে তাঁরই এই এই জমিদারিত্বের দায়িত্ব নেয়াটা বাস্তবসম্মত ছিল। এমন নয় যে তিনি জমিদারিত্বকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ।

কিন্তু এটা নিশ্চয় বলা যায় যে তিনি জমিদার হিসেবে মহানুভবতার পরাকাষ্ঠা দেখাননি। আবারও তাতে কিন্তু সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ছোট হয়ে যাচ্ছেন না। এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক বিচারে সেটা অপ্রসঙ্গিকও। কিন্ত যে সকল রবীন্দ্রভক্তরা মনে করেন যে রবীন্দ্রনাথ সব ব্যাপারেই (কাজেই জমিদার হিসেবেও) সর্বশ্রেষ্ঠ, নিখুঁত তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে তার জমিদারকালীন এই ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক।

আরেকটা বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই কিছু মন্তব্যকারী বলছেন যে রবীন্দ্রনাথকে জানতে বুঝতে হলে অনেক পড়াশুনা করা দরকার, বিপ্লব বলছে প্রয়োজনে শান্তিনিকেতনে বেশ কিছুদিন কাটিয়েও আসা দরকার। এটা ঠিকই যে কোন একজন মানূষ, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মত Myriad Minded Man এর মত মানুষকে সম্পূর্ণভাবে (বা ভাল ভাবে ) জানতে হলে অনেক কিছুই জানতে হবে। রবীন্দ্র সাহিত্যও যেহেতু বিশাল, তাই রবীন্দ্র সাহিত্যের সাথে সম্যক পরিচিতি লাভ করতেও অনেক পড়তে হবে। কিন্তু ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ “কি ছিলেন” সেটা জানতে যেটুকু পড়তে হবে, কি ছিলেন না সেটা প্রমাণ করেত অত বেশি পড়ার দরকার নেই। একটা উদাহরণই যথেষ্ঠ। এটা অনেকটা বিজ্ঞানের ভেরিফিচাতিওন/ফলসিফিকেশনের মত ব্যাপার। প্রথমটা অনেক কঠিন, দ্বিতীয়টা নয়। অভিজিত/ফরিদের লেখা ফলসিফিকেশনের মত, ভেরিফিকেশন নয়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য। কেঊ দাবী করল যে এই বাড়ীতে একটা সোনার তৈরী সূচ লুকান আছে কোথাও, কিন্তু জানেনা কোথায়। এটা যে আদৌ আছে সেটা তাকে প্রমাণ করতে বললে তাকে পুরো বাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রতিটি কোণা খুপরী পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পাওয়া গেলে তার কথা প্রমাণিত হবে। কিন্তু এর জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হল। কিন্তু কেউ(“ক”) যদি দাবী করে এই বাড়ীর কোথাও সোনার তৈরী কোন সূচ নেই আর অন্য কেউ (“খ”) ঘটনাক্রমে বাড়ীর কোন এক কোণায় একটা সোনার তৈরী সূচ খুঁজে পেল তাহলে “খ” বলতে পারবে যে “ক” এর দাবী ভুল। কিন্তু “খ” এর খুব কষ্ট করতে হল না। আরেকটা ব্যাপার এখানে বিবেচ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে “খ” কি “ক” কে ভুল প্রমাণ করার জন্যই (ক এর প্রতি বিদ্বেষ হেতু) আসলে সারা বাড়ী কষ্ট করে খুজেছিল সোনার সূচ আছে কিনা ?। নাকি হঠাৎ করেই তার নজরে এসেছিল সূচটা টা আর তাই স্বভাবতই “ক” যে ভুল সেটা ধরিয়ে দিল (ক এর প্রতি বিদ্বেষ হেতু নয়) ? এটা “ক” এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে অভ্রান্তভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি অনেকে রবীন্দ্রনাথের খুতঁ ধরার ব্যাপারে মনে করেন যে রবীন্দ্র সমালোচকেরা অনেক খুজে খুজে ভুল বের করছেন, কারণ তারা রবীন্দ্রবিদ্বেষী। যাই হোক এটাও একটা আত্মনিষ্ঠ মত বলে বিতর্কের বিষয় হতে পারে না।

কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্য “বুঝতে” হলে… এই ধরণের বাক্যের কোন বস্তুনিষ্ঠ অর্থ নেই। সাহিত্য অনুভব, উপলব্ধি বা appreciate করার ব্যাপার। এখানে বোঝার (understand/comprehend) ব্যাপার কোথায়। যারা রবীন্দ্রনাথের লেখার স্টাইল বা বিষয় উপভোগ করেন তারা তার একটি বা কয়েকটি গান শুনে,ঙ্কবিতা/গল্প/উপন্যাস পড়েই আসক্ত হয়ে যেতে পারেন। এটা অন্তরের ব্যাপার,আত্মনিষ্ঠ। অনেক বেশী সংখ্যায় পড়ে জোর করে আসক্তি সৃষ্টি করা যায় না। করলেও সেটা একটা কৃত্রিম আসক্তি হবে, বাহ্যিক প্রভাবের কারণে। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু বক্তব্যের এখানে দ্বিরুক্তি না করে আমার এক লেখা ““শিল্পানুরাগে আত্মনিষ্ঠতার বিষয়ে কিছু ভাবনা” ” পড়ার অনুরোধ করব।

এটা বলা ভুল হবে না যে রবীন্দ্রনাথের কালো দিক নিয়ে লেখার তেমন সনির্বন্ধ কারণ নেই যেমনটি আছে রাজনৈতিক/ধর্মীয় নেতার ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ তো একজন শিল্পী মাত্র। এবং একজন উদার ও সার্বজনীন শিল্পী। তাঁর ভক্তরা যদি তাঁকে ত্রুটিমুক্ত কোন মহামানব মনেও করে তাতেও খুব বিরাট কোন ক্ষতি বা ঝুঁকি নেই সাধারণ মানুষের। তাঁর নামে তো সন্ত্রাস করতে পারবে না কেউ। তার ছবি দেয়ালে টাঙ্গান বাধ্যতামূলক করা, বা তাঁকে কবিগগুরু না বললে দন্ডণীয় অপরাধ বলে আইন জারী করা এগুলির কোনটাই হবে না, রবীন্দ্রভক্ত কেঊ ক্ষমতায় আসলেও। এটা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতার ক্ষেত্রেই সম্ভব । কারণ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুসারীদের উদ্দেশ্যই হল মানুষকে ডগমা ভিত্তিক আইনের আওয়াতায় এনে একত্রিত করে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নিজেদের আর্থিক বা সামাজিক স্বার্থ হাসিল করা। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতার সমালোচনার জন্য তাদের অনুসারীদের যেরকম অসহনশীল সহিংস্র হুমকি প্রদর্শন দেখা যায় (এবং বাস্তবেও তা ঘটা) সেটা রবীন্দ্র ভক্তদের কাছ থেকে আশা বা ভয় করার নেই। কেবল রবীন্দ্র ভক্তদের মোহ ভাঙ্গানই যদি লেখার কারণ হয়ে থাকে তাহলে লেখাতে এতটা সনির্বন্ধ বা urgent সুর বা উত্তেজনার ভাব থাকাটা অনাবশ্যক। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মত।
%