পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন কমবেশি সবাই ধারণ করে। কারণ, এখনও পর্যন্ত জীবন ধারণের উপযোগী আর কোনো গ্রহের সন্ধান জানা যায়নি। তবু থেমে নেই অনুসন্ধান। কেপলার ছুটে চলেছে। কিসের সন্ধানে? এটা চিঠির আকারে লেখা। এক ধরনের ব্যাক্তিগত পরিভ্রমণও হয়তো

গায়া,
তোমার কথা শুনে একটা গল্প মনে আসছে। অনেকদিন আগের। কৈশোরের। দিনগুলো ছিল ছুটে বেড়ানোর। কোনো এক দুপুর। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। রোদের আসা যাওয়া। তীরিবীনি খাল। ইংরেজদের পুরনো বাড়ি। এরইমধ্য দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা কিশোর দাঁড়ালো এক নগরের দোকানে। কাদামাটিতে ভরা কিশোরটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো, নোংরা হওয়ার ভয়ে। সে আবার বের হয়ে পড়ল বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে। হাঁটতে শুরু করলো শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ধরে। একাকী নিঃসঙ্গ এক পথ। সেই পথেই দেখেছিলাম অন্য এক পৃথিবীর আলো।

অনেকদিন পরে জেনেছিলাম কেনিয়ার ওমা নদীর তীরে পাওয়া এক কিশোরের পদচিহ্নের কথা। জেনেছিলাম মানবজাতির এক দীর্ঘপথ অতিক্রমকে। যা আমাদের পেঁৗছে দিয়েছিল ২৩০০০০ মাইল দূরের চাঁদে। এটা ছিল ৩৭ লাখ বছরের দীর্ঘসময়। আমি যখন তোমার কাছে এই চিঠি লিখছি, তখন কেপলার মহাকাশযান ছুটে চলেছে গ্রহানুসন্ধানী নভোযান। পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ আছে কি-না তাই খোঁজা তার অন্যতম কাজ। ফ্লোরিডার কোকা সমুদ্র উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করা কেপলার আলোর ঝড় তুলে এগিয়ে যাচ্ছে অনির্দিষ্টের পথে।

কাকে খুঁজবে জানো? তোমাকে! স্থির এক নারী- গায়া। আর গায়া হলো পৃথিবী। এমন এক পৃথিবী, শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও মনগুলো একীভূত হয়ে ভাবতে পারে। আবার নিউরনের তীব্র কম্পন; কিন্তু শান্ত। বুঝতে পারছ গায়া? এটা হলো তোমার মন। মাঝে মাঝে মনে হয় মানবিক বোধের সর্বোচ্চ রূপান্তর হচ্ছে গায়া। একীভূত, শান্ত নদীর ছোট ছোট হালকা ঢেউয়ের মতো। অথবা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের সেই স্থিরতা_ ভারতবর্ষের বিশাল অর্জন।

গায়া, আমি তো তোমার অংশ। অংশ কি কখনও সমগ্রের সন্ধান পায়? তাই নিজেকে কখনও মনে হয় নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রের বেলাভূমিতে ছুটে বেড়ানো কৃষক। যার কাজই হচ্ছে বিরামহীন মনের সন্ধান আর সম্ভাবনার বীজ বোনা_ এক নক্ষত্র-কৃষক_ একাকী হেঁটে যাওয়া সেই কিশোরের মন নিয়ে। যে ঝড়ো দুপুরে নিঃসঙ্গ পথচলা আর বেদনার অর্থ উদঘাটনে মগ্ন_ গভীরতর উৎসস্থল আর মুক্তির সন্ধানে।

গায়া, বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রহের সন্ধান কি পাবে কেপলার? যদি পায় তারা কি বুঝতে পারবে পৃথিবীর বার্তা বহন করা এই মহাকাশযানকে। জানতে পারবে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের কত সর্পিল পথ বেয়ে সে এখানে? কী আশ্চর্য! ইউক্লিডীয় নিখুঁত বৃত্ত থেকে উপবৃত্তাকার পথের ধারণায় পেঁৗছতে মানুষের সাধারণ জীবনযাপন প্রভাবিত করেছিল! আর এরই মধ্যে নিহীত ছিল গ্রহ গতিবিদ্যার রহস্য। যা আবিষ্কারের পথ ধরেই ২০টি বছর ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে কেপলারকে কাটাতে হয়েছিল। এই রহস্য উন্মোচনই মহাকাশযানগুলোকে পেঁৗছে দিল গ্রহ-গ্রহান্তরে, কেপলারও এভাবে ছুটে চলেছে। অথচ তার মাকে মাটির তলে লোহার গারদে রাখা হয়েছিল ডাইনি অপবাদে। গণিতের রাজকীয় পদ ছেড়ে ৪০০ নারীকে ডাইনি অপবাদ থেকে বাঁচাতে গ্রহগতিবিদ্যার জনক- কেপলারের বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছিল। তিনি তার স্বপ্ন আর যুক্তি দিয়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখেছিলেন। ওই হলো পৃথিবী, নীলাভ সাদা, তোমার মতো গায়া। মানুষের জীবনটা আসলে অদ্ভুত? নিজেকে বুঝতে লাগিয়ে দেয় কতটা সময়!

গায়া, আমি যখন এ চিঠিটি লিখছি, আমার সমস্ত অস্তিত্ব তোমাকে ছুঁতে চাইছে। আলো-আঁধারের অন্ধকার ভেদ করে স্পষ্টভাবে দেখতে চাইছে। জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি ধূসর কুয়াশায় হামাগুড়ি দিয়ে আমি খুঁজছি আমার কৈশোরকে_ এক হারানো পৃথিবীকে। যেন চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান টারমোয়েলে দাঁড়িয়ে, ধসে যাওয়া নগরী থেকে বের হতে চাইছে। গায়া, আমি এখন একদৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে। আমার মনকে স্থাপন করতে চাইছি ক্রিস্টালের স্বচ্ছতায়। এ যেন দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধান_ একীভূত অস্তিত্ব! যে অস্তিত্ব সময়ের ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে মুক্তি দেয়। মন ও শরীরের দ্বন্দ্বের আবর্ত থেকে বের হতে বলে। কারও কাছে কিছু চাইবার নেই, এক স্বাভাবিক প্রাপ্তি। তবে লক্ষ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

আমার বাঁশির শব্দ শুনতে পাচ্ছ? ওটা বাঁশি নয়। ওই শব্দ বলছে লাপলাতার উপকূলে একাকী পাথরে বসে ইৎথিয়ান্ডর শাঁখ বাজাচ্ছে_ আলেক্সান্ডার বেলায়েভের ‘উভচর মানুষ’ গ্রন্থের সেই চরিত্র। ঢেউগুলো কেমন আছড়ে পড়ছে কোনো খাঁড়ির মধ্যে। শুনতে পাচ্ছ গায়া, ৪০ হাজার প্রজন্মের বহমান কান্নার শব্দ? কখনও মেঘনার অববাহিকায় অথবা অস্থির যমুনার স্রোতেও সেই শব্দ শোনা যায়।

গায়া সেজেছে। আমার জন্য সেজেছে। গায়া, এখন আমি কাঁদছি। কোনো এক সন্ধ্যায় হ্রদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়ালাম। স্থিরভাবে তাকালাম। হেঁটে যাওয়া সেই ছোট্ট কিশোরের অবয়বে গায়াকে দেখছিলাম। আর বিলীন হচ্ছিলাম। সমগ্রের প্রতি অংশের ভালোবাসা। মনই শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি তাই না!

রচনাকাল- ২০০৮ সাল ২২ অক্টোবর