বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা পড়া বন্ধ করে দিয়েছি আমি মোটামুটি। অথচ একটা সময় ছিল যখন দুপুরের পর থেকেই অস্থির হয়ে যেতাম অনলাইনে পত্রিকাগুলো পড়ার জন্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কোনো খবর জানার আগেই সে খবর জানা হয়ে যেতো আমার। দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে দীর্ঘদিন দেশের নাড়ির খবর রাখতে রাখতে এই উপলব্ধি হয়েছে যে, এই দেশটার কোনো ভালো খবর নেই, নেই কোনো আশার খবর। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকে শুধু নিরাশার আর নিরানন্দের খবর। মৃত্যু আর আহাজারির খবর। অতল তলে তলিয়ে যাবার দীর্ঘশ্বাসই শুধু শুনতে পাই। আমি নৈরাশ্যবাদী নই, কিন্তু তারপরেও কোনো আশা দেখি না দেশটাকে ঘিরে। একটা দেশ কীভাবে চোরাবালিতে আটকে পড়ে দ্রুত তলিয়ে যেতে পারে পাতালের দিকে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ।

এই দেশটা আমার জন্মভূমি। বুকের ভিতরে মাকে ভালবাসার সমপরিমাণ ভালবাসা নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরি আমি এই দেশটার প্রতি। ফলে, এই সব হতাশা, নিরাশা, মৃত্যুর বিভীষিকা বুকের ভিতরে শুধু রক্তক্ষরণই বাড়ায়। প্রতিটা দিন আহত হই আমি এই সব রক্তাক্ত খবরে।

ছোট্ট একটা জীবন। এই জীবনে এতো রক্তক্ষরণ মেনে নেওয়া যায় না। সে কারণেই নিজের চারিদিকে শক্ত দেয়াল তুলে দিচ্ছি আমি। কানের ভিতরে তুলো গুঁজে দিয়ে সমস্ত কিছু থেকে আড়াল করার চেষ্টা নিয়েছি। সদর দরজায় খিল তুলে দিয়ে পাষাণপুরীতে একা বসবাস এখন আমার। তারপরেও ঠিকই কোনো না কোনো অসতর্ক বাতায়নের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে কোনো না কোনো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ, কোনো না কোনো আহাজারির করুণ আর্তনাদ।

আজকেও ঠিক সেরকমই ঘটনা ঘটেছে। দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। টেবিলের উপরেই ল্যাপটপটা রাখা। নিত্যকার অভ্যাস বশে বা হাত দিয়ে ব্রাউজ করে চলেছি। কী খেয়ালে জানি না, হুট করেই খুলে ফেলেছি প্রথম আলো। প্রথম আলোর প্রথম পাতার প্রথম সংবাদটা দেখেই গা হিম হয়ে গেছে আমার। তারেক মাসুদ নেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতাটি মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। খবরটা পড়ার পরে আর খাবার মুখে রোচে নি। নিজেকে নিজে অভিশাপ দিয়েছি প্রথম আলো খোলার জন্য। পত্রিকা না পড়লে এরকম একটা খবর জানতে হতো না আমার। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে সারাটা দিন কাটাতে হতো না আমার।

তারেক মাসুদকে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি না। তাকে সামনাসামনি বা টেলিভিশনে, কিংবা পত্রিকার পাতায় তাঁর ছবি, কোনো কিছুই আমি দেখি নি। অথচ তারপরেও কেন যেন অসম্ভব আপন একজন বলে মনে হতো তাঁকে। এর কারণ বোধহয় এই যে ভদ্রলোকের বুকের ভিতরে বাংলাদেশের প্রতি অসম্ভব মমতা এবং ভালবাসা বসানো ছিল। বাংলাদেশের প্রতি মমতা আছে এমন যে কোনো লোকই আমার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে। তারেক মাসুদও সেরকমই ছিলেন।

তাঁর কথা প্রথম আমি জানতে পারি হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ট্রাভেলগ থেকে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে। হাসনাত আব্দুল হাই তাঁর এই ভ্রমণকাহিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতেন ভোরের কাগজে। ট্রাভেলগেরই কোনো এক পর্বে আমেরিকা ভ্রমণের কথা ছিল। তাঁরেক মাসুদ তখন আমেরিকায়। হাসনাত আব্দুল হাই কাকে যেন বলেছিলেন তারেক মাসুদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের ইচ্ছা। (অনেকদিন আগের ঘটনা। স্মৃতি থেকে লিখছি। তথ্য বিভ্রাট হওয়াটা অমূলক নয়। ট্রাভেলগের চারটা খণ্ডই আমার কাছে আছে। একটু খুঁজলেই সঠিক তথ্যটা জানা সম্ভব। কিন্তু এই মুহুর্তে ইচ্ছা করছে না। বিষয়টা জরুরীও নয়।)

নব্বই এর গণ আন্দোলনের এরশাদের পতনের পর এক বা দেড় মিনিটের একটা চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন তিনি আমেরিকাতে বসেই। ওতেই তুলে এনেছিলেন আমাদের পুরো ইতিহাসকে। এ সমস্ত খবর ভাসা ভাসাভাবে বিভিন্ন মিডিয়াতে আসতো। এটুকুই বলতে গেলে তারেক মাসুদ সম্পর্কে আমার জ্ঞান। আমাদের চলচ্চিত্রের প্রধান পুরুষ একদিন তিনি হবেন, সেরকম কোনো ভাবনাই কাজ করে নি তখন আমার মনে।

সড়ক দুর্ঘটনায় আলমগীর কবিরের দুঃখজনক মৃত্যুর পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে, সেই শূন্যতা ঢাকতে এগিয়ে এসেছিলেন মোর্শেদুল ইসলাম এবং তানভীর মোকাম্মেল। এদের দুজনকে নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম প্রচুর। দুজনই মেধাবী ছিলেন। ভাল কিছু চলচ্চিত্রও তৈরি করেছেন তাঁরা। এখনও করছেন। কিন্তু একটা সময়ের পরেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম যে, এদের মেধার মানটা দেশজ পর্যায়ের। বাংলাদেশের সীমানা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন কাঁপানোর মত ক্ষমতা তাঁদের নেই। সেই ক্ষমতাটা জহির রায়হান এবং আলমগীর কবিরের পরে বাংলাদেশে মাত্র একজনেরই ছিল। তিনি তারেক মাসুদ। এই মুহুর্তে যেখানে কোলকাতায় অন্তত আধ ডজন চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন যারা আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র বানাতে সক্ষম, সেখানে আমাদের সবেধন নীলমণি ছিলেন ওই এক তারেক মাসুদই। সে কারণে তারেক মাসুদকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্ন দেখতাম যে তিনি একদিন পথের পাঁচালীর মত অসাধারণ কোনো চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলবেন আমাদের জন্য। তাঁর মেধার উপর এরকমই অটল অটুট বিশ্বাস ছিল আমার।

১৯৭১ সালে লিয়ার লেভিন নামের একজন আমেরিকান মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য প্রায় বিশ ঘন্টার ফুটেজ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই চলচ্চিত্র আর করা হয় নি। তারেক মাসুদ বহু কষ্টে লিয়ার লেভিনের কাছ থেকে অমূল্য সেই ফুটেজগুলো উদ্ধার করেন। তারপর তিনি এবং তাঁর আমেরিকান স্ত্রী ক্যাথেরীন মিলে সেখান থেকে কেটেছেঁটে তৈরি করেন মুক্তির গান নামের অসাধারণ একটি চলচ্চিত্র। একদল সাংস্কৃতিক কর্মী একটি ট্রাকে করে এক রণাঙ্গন থেকে অন্য রণাঙ্গনে ছুটে চলেছে, গান গেয়ে গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষদের উদ্দীপ্ত করে চলেছে। এই চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরা ধরতে হয় নি তারেক মাসুদকে, শুটিং করতে হয় নি, তারপরেও অবিস্মরণীয় এই কাজে তাঁর অবদান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে মুক্তি পায় মুক্তির গান। মুক্তির গান শুধু একটা চলচ্চিত্র ছিল না, ছিল অন্য ধরনের অনুভূতির নাম, একটা আন্দোলন। সেই সময়ে বাংলাদেশে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। বিএনপি এবং জামাতের ক্ষমতার দাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রায় মরণাপন্ন দশা। প্রগতিশীল যে কোনো সংগঠন রাস্তায় মিছিল নিয়ে বের হলেই যুবকমান্ডের (ফারুক-রশীদের কুখ্যাত ফ্রিডম পার্টির অঙ্গসংগঠন) নামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তো ছাত্রদল এবং শিবিরের গুণ্ডাপাণ্ডারা। ওই রকম বৈরী পরিবেশে দুটো চলচ্চিত্র মানুষকে সাহস দিয়েছে। একটি এই মুক্তির গান, অন্যটি ছিল নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর একাত্তরের যীশু। এই দুটো চলচ্চিত্র শুধু চলচ্চিত্র ছিল না, ছিল প্রেরণারও উৎস।

মুক্তির গানের পরপরই বোধহয় তারেক এবং ক্যাথেরীন মাসুদ সিদ্ধান্ত নেন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাসের।  আর আমার অবস্থা হয় উল্টো। দেশ ছেড়ে পরবাসী হবার আয়োজন সম্পন্ন হতে থাকে আমার।

২০০২ সালের দিকে মুক্তি পায় তারেক মাসুদের করা সেরা ছবি মাটির ময়না। ছবিটা শুধু আমি নিজেই দেখি নি, আরো অনেকেকেই দেখিয়ে ছেড়েছিলাম। আমার সহপাঠী বন্ধু ছিল কোলকাতার একটা মেয়ে, নাম পরাগ। পরাগকেও ছবিটার অনেক গুণগান করে দেখার জন্য ক্যাসেটটা গছিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে।

তারেক মাসুদ আর নেই। ভারতীয় আর কোনো বাঙালিকে গছিয়ে দিতে পারবো না কারো ছবি। বলতে পারবো না, দেখো আমাদের সত্যজিৎ রায় হয়তো নেই, নেই কোনো অপর্ণা সেন বা ঋতুপর্ণ ঘোষ, কিন্তু আমাদের তারেক মাসুদ আছে। দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা নিয়ে অসাধারণ সব ছবি বানায় সে।

এই গর্ব আর করা যাবে না। তিনি নেই। অকালে চলে গেছেন। তিনি শুধু একা নন, আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে মেধাবী তিনজন চলচ্চিত্র নির্মাতাই চলে গেছেন অকালে, তাঁদের সৃষ্টিশীলতার সেরা সময়ে, অপঘাতে মৃত্যুর কঠিন শাস্তি মাথায় নিয়ে।

হতদরিদ্র আমরা। শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নয়। বাকি বিশ্বের সাথে তুলনায় পিছিয়ে আছি আমরা সব দিক থেকে। আমাদের আকাশে কোনো চাঁদ নেই, নেই কোনো নক্ষত্রও। হুটহাট করে কোনো এক সময় দেখা দেয় কোনো এক সূর্য, তারপর পরিণতি পাবার আগেই অকালে গোধূলির শোক রাঙিয়ে ডুব দেয় অস্ত আকাশে।

সূর্য বিরলতাময় আমাদের আকাশ থেকে যে কোনো সূর্যের অকস্মাৎ অস্তগামিতায় আমরা হতবিহবল হই। গভীর শোকে বুকের ভিতরে নির্বাক  অশ্রুধারা জমাট বেঁধে থাকে, মন কাঁদে আমাদের।

মন কাঁদে সূর্যের বিদায়ে।