সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান পত্রিকায় বেশ কিছুকাল আগে প্রকাশিত একটি লেখার সূত্রে এই পোস্টের অবতারণা। এই লেখাটা শুরু করার আগেই একজন বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে একটা কথা সবাইকে মনে করিয়ে দি – কোরিলেশন ডাজ নট ইক্যুয়েট অর সিগনিফাই কজেশন, অর্থাৎ দুটি ঘটনার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে বা সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকলেও একে অন্যের কারণ বা নিদান হবেই সে কথা ধ্রুবসত্য নয়। এই ব্যাপারে অবশ্য সংখ্যাতত্ত্ববিদরা অনেক ভাল বোঝাতে পারবেন, কিন্তু এই মৌলিক ধারণাটি আমরা যারা যুক্তিবাদী এবং প্রমাণ-নির্ভর চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা করে থাকি, তাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

আইচ্ছা যাউকগা। আসল গল্পটা আমার এই জ্ঞানদানের থেকে অনেক বেশী উৎসাহবর্দ্ধক। মানুষের মস্তিষ্ক এবং ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন ধর্মাচরণ সংক্রান্ত কাজ, যেমন ধ্যান এবং প্রার্থনা, তার আপাত ফলাফল বা অ্যাকিউট এফেক্ট নিয়ে, আবার কিছু কাজ হয়েছে ধর্মের দীর্ঘসাময়িক বা ক্রনিক ফলাফল নিয়ে। সাধারণ ভাবে এই কাজগুলো তে যারা ধার্মিক ক্রিয়াকল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাদের মস্তিষ্কের আয়তন বা কার্যকুশলতার তুলনা করা হয়েছে নির্ধার্মিক-দের বা যারা ধার্মিক হলেও ততটা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করেনা তাদের সঙ্গে। আবার কিছু পরীক্ষা হয়েছে একই লোকেদের নিয়ে, দুটো সময়বিন্দুতে – যখন তারা ধর্মের চর্চা করতনা, এবং যখন সেই একই লোক অতোঃপর ধ্যান-প্রার্থনা-ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদিতে সময় দিয়েছে।

অনেক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, অতি উদ্বেগ বা অ্যাংজায়েটি, মানসিক অবনমন বা দৌর্মনস্য বা ডিপ্রেশন-এর ওপর ধর্মের ফলাফল সুখকর। আবার প্রচুর পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ধর্মের ফলাফল হানিকারক। বিশেষত, যারা ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘু বা ধর্মের কারণে অত্যাচারিত, তাদের জীবনে অনেক বেশী স্ট্রেস এবং উদ্বেগের উপস্থিতি থাকে। আবার অনেক সময়ে, এই উদ্বেগের কারণ হয় ধর্মবিশ্বাস, যখন লোকে মনে করে বা তাদের বলা হয় যে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিচ্ছে, অথবা তাদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তাদের ধর্মমতের মিল হচ্ছে না। মূল কথাটি এখানে বলা যেতে পারে, যে যেহেতু ধর্মের পুরোটাই মন গড়া, তাই কার ওপরে তার কিরকম এফেক্ট হবে সেটা অনেকাংশেই তাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার ওপর নির্ভর করে।

আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এমি ওয়েন এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন, তাতে একটি আশ্চর্য জিনিষ জানা গেছে। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যেখানের একটি অংশের নাম হল হিপ্পোক্যাম্পাস। এই অংশটি মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের একটা অঙ্গ, এবং এর কাজ হল আবেগ-এর নিয়ন্ত্রণ আর স্মৃতি তৈরী করা। এই গবেষণাতে অংশগ্রহণ করেছে ৫৮-বছর বা ততোধিক বয়েসের মোট ২৬৮ জন মহিলা ও পুরুষ, এবং এতে তুলনা করা হয়েছে নির্ধার্মিক লোকদের সঙ্গে ধর্মপালনকারী মানুষের। ধার্মিক লোকেদের আবার একাংশ হল সেই সব মানুষকে নিয়ে যাদের কোন জীবন-পরিবর্তনকারী ধার্মিক অভিজ্ঞতা (লাইফ চেঞ্জিং রিলিজিয়াস এক্সপীরিয়েন্স) ঘটেছে, বা যারা নিজেদের আত্মশনাক্ত করে বর্ন-এগেইন বা পুনর্জাত খ্রীষ্টান হিসেবে। খ্রীষ্টধর্মে এই পুনর্জন্মের অর্থ হল আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ, যা সেই সব মানুষের হয় যারা জীবনের কোন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছে যীশুকে মুক্তিদাতা হিসেবে মেনে নেয়। উইকিপিডিয়া-তে এর ওপর আর্টিকলটি বেশ জ্ঞানগর্ভ।

এই গবেষণায় ওয়েন-এর দল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এম আর আই ব্যবহার করেন হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন মাপতে। তাতে দেখা গেছে, যে যে সমস্ত লোকেদের কোন জীবন-পরিবর্তনকারী বা লাইফ চেঞ্জিং ধার্মিক অভিজ্ঞতা ঘটেছে, তাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন অনেক গুণে ছোট। শুধু তাই নয়, প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিক-দের মধ্যে যারা পুনর্জাত খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী তাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন সাধারণ খ্রীষ্টানদের থেকে ছোট, এবং এই পরিবর্তন তাদের ঐ অংশের ডান এবং বাঁ দুই ভাগেই দেখা গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা গেছে যে যারা নির্ধার্মিক, তাদেরও হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন বেশ ছোট। গবেষকদল এই ফলাফলের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যাদের ধার্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, বা যারা কোন অতি-সংকটের পরিস্থিতির মধ্যে ধর্ম খুঁজে পায়, তাদের অনেক বেশী স্ট্রেস থাকে, এবং এটা জানা আছে যে স্ট্রেস-সংক্রান্ত হরমোন, কর্টিসল-এর প্রভাবে সময়কালে হিপ্পোক্যাম্পাস-এর সংকোচন ঘটে থাকে।

কিন্তু এটাও তাহলে হয়ত সত্যি যে এখনকার সমাজে, বিশেষত যেই সব সমাজব্যবস্থায় ধর্মোন্মাদনা বর্তমান, সেই সমাজে যারা নাস্তিক বা নির্ধার্মিক, তারাও অত্যন্ত মানসিক ক্লেশের মধ্যে থাকেন, এবং সেই কারণেই তাদেরও মস্তিষ্কের ওই অংশের সংকোচন ঘটে।

ওয়েন-এর স্টাডিটিতে যে প্রকল্প (হাইপোথিসিস)-টি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, তার ফলাফলকে একটি সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা যেতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তনের হ্রাসপ্রাপ্তির ঘটনা অজানা নয়। সেক্ষেত্রে, এটা হতেই পারে যে নাস্তিক বা নির্ধার্মিকদের ওই আয়তনের পরিমাপ তাদের বয়স-হিসেবে নর্মাল; মনে রাখা দরকার যে ওই স্টাডিতে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিল ৫৮ এবং উর্দ্ধে। অল্প বয়সে ধর্মের সঙ্গে পরিচিতি, মনে অল্প অল্প ভক্তিভাব জাগা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ইত্যাদির ফলে প্রভূত আবেগের উদ্রেক হতে পারে – এবং আবেগ-এর সঙ্গে হিপ্পোক্যাম্পাসের যোগাযোগ সুজ্ঞাত। বিশেষত, বিপরীতধর্মী আবেগ সমূহ, ধর্মের বৈপরীত্য সম্পর্কে ধারণা, সিলেক্টিভ মেমোরী এবং কগ্নিটিভ ডিজোনেন্স (বৈপরীত্যের ধারণা কে জ্ঞানতঃ আলাদা করে রাখা) – তার মানসিক চাপ, চারপাশের বিভিন্ন ধ্যানধারণার সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা, ইত্যাদির ফলে হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তনের অতিবৃদ্ধি (হাইপারট্রোফি) ঘটা হয়ত খুবই সম্ভব, যার ফলে ধর্মবিশ্বাসীদের ওই আয়তন বড় হয়। কিন্তু যাদের তথাকথিত ধার্মিক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, বা যারা কোন অতি-সংকটের পরিস্থিতির মধ্যে ধর্ম খুঁজে পায় – একবার ধর্মীয় মৌলবাদ মাথায় ঢুকে গেলে তখন পুরোটাই বিশ্বাসনির্ভর, তখন আর কোন দ্বন্দ্ব নেই, দ্বিধা নেই, এবং সেই কারণেই আর কোন দীর্ঘসাময়িক বা ক্রনিক আবেগে উত্তালতার প্রশ্ন থাকে না – তাই তখন আবার হিপ্পোক্যাম্পাস ছোট হয়ে ধর্মপ্রাপ্তির আগের নর্মাল আয়তনে ফিরে আসে।

আমি জানিনা আমার এই লাইনের চিন্তাটি একটা বিচারযোগ্য হাইপোথিসিস কিনা, কারণ মস্তিষ্ক প্রত্যঙ্গ এবং মনোবিদ্যার কার্যকরী সম্পর্কের বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত। এইখানেই আবার করে সেই শুরুর আপ্তবাক্যটি মনে রাখা দরকার। মস্তিষ্কের গঠন বা কাজের সঙ্গে ধর্মের কার্য-কারণ সম্পর্ক বা কজাল রিলেশনশিপ স্থাপন করা খুবই দুরুহ। এই বর্তমান ফলাফলের আরো অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন লাইফ চেঞ্জিং ঘটনার থেকে বেশী জরুরী হতে পারে সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি যা থেকে সেই ঘটনার উৎপত্তি ঘটে। আবার, যদিও গবেষকরা মনে করছেন যে স্ট্রেসের কারণে এরকম হয়, বর্তমান স্টাডিতে স্ট্রেসের সঙ্গে সরাসরি কোন সম্পর্ক পাওয়া যায় নি, কারণ শুধুমাত্র আপাতকালীন বা অ্যাকিউট স্ট্রেস-ই মাপা হয়েছে, দীর্ঘসাময়িক স্ট্রেস নয়। কিছু কিছু ধরণের মৃগীরোগী, যাদের হিপ্পোক্যাম্পাসের আয়তন ছোট হয়, তারা অতি-ধার্মিক বা হাইপার-রিলিজিয়াস হয়ে পড়ে বিনা স্ট্রেস-এই। আবার এটাও হতে পারে, যে যারা অতি-ধার্মিক তারা সহজেই স্ট্রেস-এ আক্রান্ত হয় জীবনে, যার একটা কারণ হতে পারে যে বেশীরভাগ ধর্মেই পার্সোনাল রেস্পন্সিবিলিটি বা নিজস্ব দায়িত্বের শিক্ষা দেওয়া হয় না – সব ঈশ্বরে-সমাপন বা পরিপূর্ণ-নিবেদন গোত্রীয় বিশ্বাসধর্মী ধারণার ওপরে জোর দেওয়া হয়।

ক্রিয়া-পরিমাপক বা ফাংশনাল এম আর আই-র প্রযুক্তি এখনও শৈশবস্থায় আছে। ধীরে ধীরে আমরা মস্তিষ্কের কাজ এবং তার ওপর ধর্মের প্রভাবের কথা আরও জানতে পারব নিশ্চয়।