ফলসিফায়েবিলিটি, পপারীয় ভাববাদ এবং বাতিলযোগ্যতার কল্পকথা

লিখেছেন –  রবিউল ইসলাম

পপার কাণ্টের ভাববাদী দর্শনকে অনুসরণ করেছেন । বলার অপেক্ষা রাখেনা, যে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ভাববাদের স্থান নেই-বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও বিজ্ঞানচর্চা আপন বৈশিষ্ট্যে বস্তুবাদী, কারণ বস্তুনিষ্ঠতা বিজ্ঞানচর্চার প্রধান শর্ত । একজন বিজ্ঞানী আদর্শের দিক দিয়ে ভাববাদী হলেও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই বস্তুবাদী পথ অবলম্বন করেন । পপার ভাববাদের ক্ষেত্রে কান্টের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে একমত ছিলেনঃ “It is our ideas which give form to reality, not reality which gives form to our ideas.” পপারের ভাববাদী চিন্তাধারার প্রমাণ হচ্ছে- তিনি নিজেকে একজন ‘অগতানুগতিক কান্টবাদী’ বলে বর্ণনা করেছেন; অর্থাৎ তিনি কান্টের জ্ঞানতত্ত্বকে আংশিকভাবে গ্রহণ করেছেনঃ “ কান্ট এব্যাপারে সঠিক ছিলেন যখন বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি যা এর বিধানগুলিকে-এর ধারণাগুলিকে, এর নিয়মগুলিকে আমাদের ইন্দ্রীয়বোধের অপরিস্ফুট স্তুপের উপর আরোপ করে । এবং এর মাধ্যমে সেগুলিতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসে । যে ব্যাপারটিতে তিনি ভুল করেছেন তা হলো, তিনি দেখতে পাননি যে, আমরা আমাদের এই আরোপ করার ক্ষেত্রে কমই সাফল্য লাভ করি । আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ভাববাদী হয়ে তিনি মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার অধিকার চর্চা করেন কি করে ।

পপারের ‘ত্রিজগৎ তত্ত্ব’ রচিত হয়েছে ভাববাদকে নিয়ে । পপার ভাববাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বাহ্যিকভাবে ও স্থূলভাবেঃ “To me idealism appears absurd” (Objective Knowledge, p.41); “I was thoroughly opposed to every idealism” (Objective Knowledge, p. 323). তারপরও কেউ যখন পপারের ‘ত্রিগজৎ তত্ত্ব’ পরীক্ষা করে দেখেন, ভাববাদী সুরটি গোপন থাকেনা । উদাহরণস্বরুপ, জগত ১, ২ এবং ৩ সম্পর্কিত বেশকিছু আলোচনার একটিতে তিনি লিখেছেনঃ “আমি জগত তিনকে অবশ্যম্ভাবীরুপেই মানবমনের সৃষ্টি বলেই গণ্য করি । আমরাই জগত-৩ এর বস্তুগুলিকে সৃষ্টি করি………এই বস্তুগুলির নিজস্ব সহজাত অথবা স্বায়ত্ত্বশাসিত আইন রয়েছে যেগুলো উদ্দ্যেশ্যবিহীন এবং অচিন্তিতপূর্ব ফলাফল রয়েছে……… আমাদের উপর এই পালটা প্রতিধ্বনি বা প্রতিক্রিয়া আমাদের পারিপার্শ্বিক বস্তুগত  পরিবেশের প্রতিধ্বনির চাইতেও শ্রেষ্ঠতর” (Unended Quest, p. 186) । অন্যত্র তিনি ‘বস্তুগত মন’ বা ‘আত্মা’ নিয়ে লিখেছেন (Objective Knowledge, p. 149) । তিনি এও লিখেছেন যে, “তৃতীয় জগত হচ্ছে……অতিমানব”, এটা “তার সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়িয়ে যায়” (Objective Knowledge, p. 159). কিন্তু, নিশ্চিতভাবেই সীমাতিক্রমী মন বা আত্মার ধারণা যা(পপারের ভাষায়) ‘মানবসত্ত্বাগুলোকে প্রভাবিত করে  তাদের বস্তুগত পরিবেশের চাইতে বেশী’, তা সহজবোধ্যভাবে ভাববাদেরই উদাহরণ ।

পপারের সমালোচনামূলক যুক্তিবাদ(Critical Rationalism) বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলির খন্ডনযোগ্যতা দিয়ে বিজ্ঞানকে অবিজ্ঞান থেকে পৃথক করেছে । পপারের আদর্শ উদাহরণ ছিল নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা যা মূলগতভাবে আইন্‌ষ্টাইন কর্তৃক প্রতিস্থাপিত হয়।  তুলনামূলক বিচারে কম দার্শনিকই একে বরণ করেছেন । টম সেট্‌ল্‌ (Tom Settle), যিনি The Philosophy of Karl Popper এর একজন অন্যতম প্রধান অবদানকারী, ১৯৭২ সালে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেনঃ বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের মধ্যে সীমারেখা টানার বিচারিক মানদন্ড হিসাবে ফলসিফায়েবিলিটি এবং সমালোচনামূলক নীতি(যুক্তিশাস্ত্র) একই সাথে কাজ করেনা ।১৪ অন্য যারা অবদান রেখেছেন তাঁরা এতে একমত । এদের মধ্যে রয়েছেন এ যে আইয়্যার, উইলিয়াম সি নীল, ইম্‌র্‌ লাকাটোস, গ্রোভার মেক্সোয়েল, এবং হিলারী পুটনাম ।

গ্রোভার মেক্সোয়েল যুক্তিনির্দেশ করে দেখান যে, “সব মানুষ মরণশীল”-বাক্যটি নিখুঁতভাবেই একটি বৈজ্ঞানিক বিবৃতি যা বাতিলযোগ্য (Falsifiable) নয় ।১৫ গণিতশাস্ত্রের স্বতঃসিদ্ধগুলি (Axioms) খন্ডন করা যায় না(বাতিলযোগ্যতার শর্ত)। সুতরাং, ডিমার্কেশন তত্ত্ব অনুযায়ী গণিতশাস্ত্র বিজ্ঞান নয় । কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্র অবিচ্ছেদ্য । উদাহরণস্বরুপ, গণিতশাস্ত্র ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে প্রকাশ করা কঠিনই বটে ।

বিবর্তনবাদের মত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি কি বাতিলযোগ্য (Falsifiable) ? বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীগণ সেইসব তত্ত্বগুলিকে কি পরিত্যাগ করেন যখন একটি প্রেডিক্‌শন মিথ্যা প্রমাণিত হয় ? অন্য কথায়, ফলসিফায়েবিলিটি কি বিজ্ঞানকে অবিজ্ঞান থেকে পৃথক করে ? অবশ্যই না । একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা যায় যে, তত্ত্বের শাঁস বা কেন্দ্রীয় অনুমানগুলিকে সত্য ও প্রশ্নাতীত বলে মেনে নেয়া হয়, কিন্তু কিছু পারিপার্শ্বিক বা প্রান্তিক অনুমানকে পরিবর্তিত করা হয় যাতে সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী নজীরের সংগে মেলে । আলবার্ট আইন্‌ষ্টাইনের জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটির প্রাথমিক সূত্রায়ন নির্দেশ করে যে ‘মহাবিশ্ব অবশ্যই সম্প্রসারিত হচ্ছে’ । এমন একটা ঘটনা যা তখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হয়নি । তিনি তত্ত্বের সঙ্গে একটি মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করেন তত্ত্বকে পর্যবেক্ষণের সংগে নির্ভুলভাবে মেলানোর জন্য । পরবর্তীকালে, মহাবিশ্বের আপাত সম্প্রসারণ আবিষ্কৃত হয় এবং মহাজাগতিক ধ্রুবক নীরবে ঝরে পড়ে ।

(মহাবিশ্বের) সম্প্রসারণ আবিষ্কার এবং মহাবিস্ফোরণের প্রমাণকে (বা নজীর) জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্বের পাকাপাকি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে । কেউ সহজেই দেখতে পাবেন যে, যদি (মহাবিশ্বের) সম্প্রসারণ ধরা(আবিষ্কার) না পড়তো, মহাজাগতিক ধ্রুবক থেকে যেতো এবং তত্ত্বটি পাকাপাকিভাবে নিশ্চিত হতো পর্যবেক্ষণ দ্বারা ।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলিকে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলানোর জন্য সেগুলোর পরিবর্তন সাধন আজও চলছে । ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ জীবাষ্ম রেকর্ডে বিরাট সংখ্যক মধ্যম পর্যায়ের বা স্তরের জীবের গাঠনিক রুপ সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল । ঐসবের কোনটাই ডারউইনের সময়ে আবিষ্কৃত হয়নি । কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া জীবাষ্ম রেকর্ড দীর্ঘ ব্যাপ্তির স্থবিরতা প্রদর্শন করে চলেছে । প্রদর্শন করে চলেছে প্রজাতিগুলির আকষ্মিক আবির্ভাব ও আকষ্মিক অন্তর্ধান । মিসিং লিংক (Missing Lingk) কোন সমাধানহীন অবস্থায়ই রয়ে গেছে । তারপরও বেশিরভাগ বিজ্ঞানী বিবর্তন তত্ত্বকে পরিত্যাগ করেননি । বিবর্তনবাদের প্রখ্যাত জনপ্রিয়তা সৃষ্টিকারী স্টিফেন যে গোল্ড “Punctuated Equillibrium”-এর প্রস্তাব করেন, যাতে বিবর্তন বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে অত্যন্ত দ্রুত ঘটে, যা কদাচিতই জিবাষ্মরুপে রেকর্ড রেখে যায় জীবাষ্মরেকর্ডের সঙ্গে বিবর্তন তত্ত্বের সমন্বয় ঘটানোর জন্য । বিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণ বা নজীরের অভাবই বিবর্তনের প্রমাণ হয়ে উঠেছে । জটিল প্রাণীর শরীরতন্ত্রগুলি যে, নতুন অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদির দরুন শারীরিক গঠনের পরিবর্তন থেকে জাত-এই  মূল অনুমানটি সংরক্ষিত রাখা হয় তত্ত্বের কম গুরুত্বপূর্ণ বিশদ বিষয়গুলির পরিবর্তনের মাধ্যমে ।

ফলসিফায়েবিলিটি একটি কল্পকথা । পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের বিশৃঙ্খল বাস্তব জগতে তত্ত্বগুলিকে প্রায়শই পরিবর্তন করতে হয় নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে মেলানোর উদ্দ্যেশ্যে । যেহেতু কোন তত্ত্বকে, স্ববিরোধী পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণ ফলাফলের সঙ্গে মেলানোর উদ্দ্যেশ্যে, Ad Hoc অনুমান দিয়ে পরিবর্তন করা যায়, কোন তত্ত্বই কড়াকড়িভাবে বাতিলযোগ্য (Falsifiable) নয়-সেটাকে বিজ্ঞান বলা হোক আর না-ই হোক ।

বিচারের মানদন্ড হিসেবে বাতিলযোগ্যতা (Falsifiability) প্রায়ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক । বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয়, অগতানুগতিক, অথবা নতুন তত্ত্বগুলির ক্ষেত্রে ফলসিফায়েবিলিটির গুনটি কড়াকড়িভাবে দাবী করা হয় । স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলিকে বলে বাতিলযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয় এমনকি যদিও স্ববিরোধী ঊপাত্ত বা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সেগুলিকে প্রায়ই পরিবর্তন করা হয়ে থাকে । একটা তত্ত্বের পরিমার্জন বা পরিবর্তনকে বাতিল করার মানদন্ডের যে প্রয়োজনীয়তা সেটা হয় প্রত্যাখ্যান করা হয়, নতুবা উল্লেখই করা হয়না-একটা নিশ্চয়তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে । (তত্ত্ব) বাতিলের মানদন্ড যে উল্লেখ করা হয়না তার কারণ, সেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই ভ্রমপ্রবণ ব্যাক্তিগত বিচার বা মতামতের ব্যাপার । বিজ্ঞানকে অবিজ্ঞান থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে ফলসিফায়েবিলিটি ডক্‌ট্রিন কেবলমাত্র নিশ্চয়তার একটি মরীচিকাই সৃষ্ট করে আর কিছু নয় ।

তথ্যসূত্র –

১.  Unended Quest, p. 82.

২.   Objective KnowledgeConjectures and Refutations, VII; London: Routledge, 1989.

৩.   Realism and the Aim of Science; London: Routledge, 1992.

৪.   এই প্রস্তাবটি ভিত্তিবাক্য হিসেবে প্রথম জ্যান্‌ সি লেস্টার কর্তৃক ব্যবহৃত হয় নিম্নোক্ত গ্রন্থেঃ ‘Liberty, Welfare  and Anarchy Reconciled’; London, McMillan, 2000. যেসব প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পপারের প্রভাবকে      স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জ্যাকব ব্রনৌস্কি (Jacob Bronowski), জন ইক্লেস (John Eclles), পিটার মেডাওয়ার (Peter Medawar) এবং জন মেয়নার্ড স্মীথ (John Maynard Smith).

৫.   The Open Society and Its Enemies; Vol. 2, London, Routledge and Kegan Paul, 5th ;   Edition, 1966; Ch. 2, p. 13.

৬.  The Open Society and Its Enemies; Vol. 2, p.375.

৭.   Unended Quest ; London: Fontana/Collins, 1976; p. 24.

৮. Objective Knowledge, London : Oxford, 1972 ; p. 360.

৯.   Unended Quest ; p. 24.

১০.  The Philosophy of Karl Popper; Book 2, p. 1019.

১১.   Unended Quest, p. 52.

১২.   Objective knowledge, P. 96.

১৩.   Unended Quest, p. 146-7.

১৪.    The Philosophy of Karl Popper; Book 2; p. 719