বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে স্বাধীনতা-উত্তর কালে রচিত বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ফিরিয়ে দিয়েছে। বহু বিলম্বে হলেও আমাদের উচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। দু’যুগের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে সকল চেতনা বা মূল্যবোধ, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসাবে সদ্য-স্বাধীন দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল, পঁচাত্তরের ১৫ ই আগস্টের অভূত্থানের পর ক্ষমতাসীন খন্দকার মোস্তাক এর উত্তরসুরী সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে একে একে সে সকল মূলনীতি সংবিধান থেকে মুছে ফেলেছিলেন। সামরিক শাসকের এ সকল অবৈধ ও অসাংবিধানিক অপকর্মগুলোকে অক্টোবর, ১৯৭৯ ইং সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে যেহেতু পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে, সেহেতু ঐ সমস্ত মূলনীতিগুলো আবার সংবিধানে স্বাভাবিক ভাবেই সন্নিবেশিত হওয়ার কথা। সরকারের করণীয় ছিল তা কেবল পুণ:মুদ্রন করে দেওয়া।
কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আদালতের রায় অনুসারে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি সংবিধান সংশোধন উপকমিটি গঠন করেন এবং সে উপ-কমিটি প্রায় ১০/১১ মাস ব্যাপী দেশের বিভিন্ন সংগঠন, বুদ্ধিজীবি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথে লোকদেখানো মতবিনিময় করে, তাদের কারো মতের বিন্দুমাত্র প্রতিফলন না ঘটিয়ে, তাদের দলনেত্রীর মতামতকে চুড়ান্ত ধরে, তাদের প্রণীত সংশোধনীর খসড়া বিরোধী দলবিহীন সংসদে উত্থাপনের ৪ দিনের মাথায় পাশ করে ফেলেন। সংশোধিত সংবিধানে মূলনীতি হিসাবে যেমন রাখা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, তেমনি রাখা হয়েছে বিসমিল্লাহ্, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানও বাতিল করা হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আর বিসমিল্লাহের এ স্ববিরোধী জগাখিচুড়ী নি:সন্দেহে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সে পুরানো কৌশল। অবশ্য প্রশ্ন এটাও করা যায় যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ কি আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে? ২০০৭ ইং সালে খেলাফতে মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগের ৫ দফা চুক্তির কথা কি জনগণ ভুলে গেছে? সংবিধানের প্রস্তাবিত সংশোধনী কেবিনেট মিটিং এ পাশ হওয়ার প্রাক্কালে শেখ হাসিনা পরিস্কার উচ্চারণ করেছেন, “আমি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামে বিশ্বাস করি”। আওয়ামী লীগ যদি আর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাস না করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এ বিশ্বাস করে এবং তা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেয়, তাহলে কারো কিছু বলার থাকে না। আর যদি নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসাবে এটা করে, তাহলে বলতে হয়, আওয়ামী লীগ জাতিকে সে রকম একটি বাঘের পিঠে সওয়ার করে দিয়েছে, আজ থেকে প্রায় ষাটাধিক বছর পূর্বে সদ্য-স্বাধীন পাকিস্তানের নেতারা যে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছিল; যারই চুড়ান্ত পরিণতি একটি স্বৈরতান্ত্রিক-ধর্মভিত্তিক-প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র আজকের পাকিস্তান।
নির্বাচনী কৌশল বা রাজনৈতিক কৌশল, যাই বলা হউক না কেন, সংবিধানের এ অবিমৃষ্যকারী সংশোধনী জাতিকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যেতে পারে, পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকালে তা সহজে উপলব্ধি করা যাবে।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যালঘূ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দাবী করলেও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বস্তুতঃ কোন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রবক্তা ছিলেন না। বরং অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিতে তাকে হিন্দু-মুসলমানের মিলন-দূত হিসাবে আখ্যায়িত করা হত। তবে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়নে তিনি সবশেষে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্টের প্রবক্তায় পরিণত হন। তিনি সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানকে মূলতঃ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে (১১ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং) তার প্রদত্ত প্রথম ভাষণে, যেখানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন-
“আমরা একটি রাষ্ট্রের নাগরিক এই প্রতিপাদ্য থেকেই আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত। এটিকেই আমাদের আদর্শ হিসাবে সামনে রাখা প্রয়োজন এবং আপনারা দেখবেন সময়ের ব্যবধানে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমানেরাও মুসলমান থাকবে না। ধর্মীয় অর্থে নয়। কারণ ধর্ম হলো মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্র । একটি জাতির নাগরিক হিসাবে তথা রাজনৈতিক অর্থে পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে” । একইভাবে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খানও ছিলেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থক। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করলেও তারা কখনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন নি। ধর্মভিত্তিক দলগুলো, বিশেষভাবে ’জামায়াতে ইসলাম’ ও ’মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ পাকিস্তান আন্দোলনেরই বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান জন্মের অব্যবহিত পর তারা কিভাবে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে নিজেদের স্থান করে নেয়, সে ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও চমকপ্রদ। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধীতার কারণে ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ প্রভৃতি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান জন্মের পর অত্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার জন্য তাদের কোন ধর্মীয় নতুন ইস্যুর প্রয়োজন ছিল। এমতাবস্থায় তারা ‘কাদিয়ানীরা মুসলমান নহে’ এবং ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে’ -এরকম একটি অবান্তর, সদ্যস্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন-হাস্যস্পদ ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৪৯ সালে কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণার দাবী করে ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার আহবান করে। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশিষ্ট ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তাত্ত্বিক গুরু মৌলানা মওদুদী। তাদের প্রত্যক্ষ উস্কানীতে পাঞ্জাবে কাদিয়ানী বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । দ্রুত লাহোরেও ছড়িয়ে পড়ে এ দাঙ্গা এবং তা ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে। দীর্ঘ চার বছর ব্যাপী চলার পর ১৯৫৩ সালে দাঙ্গা এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, পাকিস্তান সরকার লাহোরে সামরিক শাসন জারী করতে বাধ্য হয়। এ দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। দাঙ্গার বিষয়ে তদন্তের জন্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়। আদালত দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ উস্কানী প্রদানের জন্য মৌলানা মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন, যা তার প্রাণভিক্ষা আবেদনের কারনে মওকুফ করা হয়েছিল। সৌদী প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খান পাকিস্তানের সংবিধানে ”অবজেকটিভ রেজুলেশন” যুক্ত করলেন, যাতে বলা হল, পাকিস্তানের সংবিধানে কুরআন ও সুন্নাহের পরিপন্থী কোন ধারা থাকতে পারবে না। পাকিস্তানের সংবিধানে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি যোগ করা হল এবং সংবিধানে কুরআন ও সুন্নাহের পরিপন্থী কোন ধারা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আলেমদের নিয়ে একটি ওলেমা পরিষ্দ গঠন করা হল। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খান মৌলবাদীদের সাথে এভাবে আপোষ করলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্ম এভাবে নিজের স্থান করে নিল এবং মৌলবাদী ধর্মভিত্তিক দলগুলো এটাকে তাদের প্রাথমিক বিজয় ভেবে উল্লসিত হল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করেও লিয়াকত আলী খান ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না। অধিকন্তু আততায়ীর নির্মম গুলির আঘাতে তাকে জীবনও দিতে হল। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অতঃপর যা চলতে লাগল, তাহলো প্রাসাদ রাজনীতি-ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র পর্দার অন্তরালে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও কিছু ক্ষমতান্ধ রাজনীতিকের ক্ষমতার হিস্যা নিয়ে কামড়া-কামড়ি। ইস্কান্দর মীর্জা প্রেসিডেন্ট, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খান প্রধানমন্ত্রী, অতঃপর মাত্র ৩০ মাসের মাথায় ইস্কান্দর মীর্জাকে তাড়িয়ে আইউব খানের মতা অধিগ্রহণ, এসব পরিবর্তনের সাথে পাকিস্তানের আমজনগণের কোন সম্পর্ক ছিল না, ছিল না কোন আদর্শিক দ্বন্দ্ব । এসব নিছক ক্ষমতার লড়াই। এমনকি জনগণ বুঝতেও পারত না, কোত্থেকে কি হচ্ছে। সব কিছু ঘটছিল পর্দার অন্তরালে। অন্দর মহলের মল্লযুদ্ধে সর্বশেষ বিজয়ী নটেরগুরু জেনারেল আইয়ুব খান, পাকিস্তানে ভাগ্যবিধাতা হিসাবে আবির্ভূত হলেন, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে। ক্ষমতা গ্রহণের পর বৃটিশ ভাবধারায় প্রশিক্ষিত জেনারেল আইয়ুব ১৯৬২ সালে তার ঘোষিত সংবিধানে পাকিস্তানের নাম থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি বাদ দিলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন করলেন, গোঁড়া মোল্লাদের কট্টর বিরোধীতা সত্ত্বেও মুসলিম পারিবারিক আইনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। কিন্তু তার এ ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানও বেশী দিন টিকল না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারও সস্তা জনপ্রিয়তার প্রয়োজন অনুভূত হল এবং সে লক্ষে কিছু দিনের মধ্যেই ১৯৬২ সালের সংবিধানে আবারো সংশোধনী এনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি যোগ করল। সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ বিষয় হলো, ১৯৬৫ ইং সালে ফাতেমা জিন্নাহের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে গিয়ে একশত আলেম থেকে ফতোয়া আদায় করল, ইসলামী রাষ্ট্রে কোন মহিলা রাষ্ট্র-প্রধান হতে পারে না। সকল বিরোধী দলের সমর্থন ও প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও মৌলিক গনতন্ত্রীদের ভূঁয়া চেক প্রদান সহ নানা কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হলো আইয়ুব খান। তার এ বিজয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মোল্লাদের অবস্থান আরো সুসংহত হল। অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল সেদিনের পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানী শাসকেরা বরাবরই ধর্মকেই ব্যবহার করেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকাতে গিয়ে যে গণহত্যা-নারী ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ইত্যাকার সকল অপকর্মও তারা করেছে ধর্ম রক্ষার নামে। মাত্র ২৪ বৎসরের মধ্যে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার বিপদ সম্পর্কে কি পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ, কি পাকিস্তানী সামরিকজান্তা, কেহই আদৌ কোন শিক্ষা নেয় নি। বরং সে বিপজ্জনক পথেই পাকিস্তানের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকল। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে নির্বাচনে জিতলেও জুলফিকার আলী ভূট্টোর স্বৈরাচারী অপশাসন ও নির্বাচনে প্রচণ্ড কারচুপির বিরুদ্ধে বিরোধী জোটবদ্ধ আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন ধর্মীয় দলগুলোকে হাতে নেওয়ার জন্য এবং আমজনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষে ভূট্টো কিছু শরীয়া আইন প্রণয়ন করলেন। ভুট্টোই প্রথমবারের মত জামায়তের দাবী মোতাবেক কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে ঘোষণা করলেন।এতদিন ধরে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা তিলে তিলে যে কাজটি করছিলেন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা, ভূট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে জেনারেল জিয়া তার ষোলকলা পূর্ণ করল। ভূট্টো কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘূ ঘোষণা করেছিলেন, জিয়াউল হক তাদের অমুসলিম ঘোষণা করলেন। তাদের সরকারী চাকুরী থেকে অপসারণ করলেন। কাদিয়ানীদের মসজিদগুলো বন্ধ করে দিলেন। কাদিয়ানীদের আলাদা পরিচয়পত্র, তাদের জন্য আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা করা এবং দেশে হুদুদ আইন চালু করে শরীয়া আদালত গঠন করলেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহের স্বপ্নের বিপরীতে তার উত্তরসুরীরা পাকিস্তানকে একটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করল। চুরি করলে হাত কেটে ফেলা, যৌন ব্যভিচারের জন্য মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারা, একজন পুরুষ সাক্ষীর বিপরীতে দু’জন নারী সাক্ষী হাজির করা, হুদুদ আইনের নামে সকল মধ্যযুগীয় আইন আজ পাকিস্তানে বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জিয়াউল হকের পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা ভাবধারায় প্রশিক্ষিত বেনজির ভূট্টো মতাসীন হলেও জিয়াউল হকের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে কোন সংস্কার পদক্ষেপই নেন নি। তৎপরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন নেওয়াজ শরীফ এর আমলেই পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায় তালেবানদের উত্থান-যারা আজ ফ্রাঙ্কস্টাইনের দৈত্যের মত পাকিস্তানের জন্যই প্রচণ্ড হুমকী হয়ে ওঠেছে। আজকের নির্বাচিত পিপল্স পার্টির সরকার মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে. যেখানে রাষ্ট্রই মৌলবাদী, সেখানে মৌলবাদী জঙ্গীদের কিভাবে রুখবেন, তা আদৌ বোধগম্য নয়। বরং অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে মৌলবাদ আজ পাকিস্তানে অনেক শক্তিশালী। আজ আফগানিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন একটি জেলায় বস্তুতঃ তালেবানদের শাসন চলছে । পাকিস্তানের প্রশাসন সেখানে মূলতঃ নিষ্ক্রিয় (নিউইয়র্কস টাইম)। মৌলবাদের চুড়ান্ত বিকৃতি জঙ্গীবাদ আজ পাকিস্তান রাষ্ট্রেই ভিত্তিভূমিই কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রায় সাত দশকেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতেতো পারলইনা বরং ধর্মীয় গোঁড়ামী আক্রান্ত, জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্য পাকিস্তান ক্রমে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী : পাকিস্তানের পথ ধরেই বাংলাদেশের অভিযাত্রা
ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের জাতিগত শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এর ফলশ্র“তি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র আমাদের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে সংবিধানে গৃহীত হয়। একটি স্বল্প-শিক্ষিত, দারিদ্রকিষ্ট জনগোষ্ঠির এ অর্জন, রাষ্ট্র পরিচালনায় উপরোক্ত আদর্শগুলোকে নীতিমালা হিসাবে গ্রহণ, যা পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতির পর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল-তা সত্যই ছিল এক যুগান্তকারী অর্জন! কিন্তু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বল্প-শিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর এ অর্জনের তাৎপর্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তাই আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে ল্ক্ষ্য করি, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করেন। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছে রাজাকার-আলবদর বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের নব্বই শতাংশের উপরে ছিল মাদ্রসার ছাত্র ও শিক্ষক। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসার ছাত্র শিকদের একাধিক সভা-সমাবেশে দুঃখের সাথে কথাটি উল্লেখ করলেও তার সরকার ইসলামী ফাউণ্ডেশন সৃষ্টি করলেন, যা পরবর্তীতে মৌলবাদীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। তারপরও ১৯৭৫ ইং সাল পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসাবে বহাল ছিল । ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ অবারিত ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যূত করে যারা ক্ষমতাসীন হল, তারা সর্বাগ্রে তাদের এ অপকর্মের বৈধতা দিতে জনগণের সামনে আবির্ভূত হলো ধর্মের আলখাল্লা পড়ে। এতবড় একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মাথায় কালোটুপি ও মুখে আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হল খুনী মোস্তাক, প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিভূ হিসাবে; ক্ষমতাসীন হয়েই যে তার পরিহিত কালো টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করেছিল। এ প্রতিবিপ্লবের সুবিধাভোগী হিসাবে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র মুছে দিলেন। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে নিয়ে আসলেন বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ। অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে অধনবাদী বিকাশের পথ-যা সমকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলেতে সঠিক উন্নয়ন কৌশল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিল, পরিহার করে ধনবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাত্তুরের যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় ছিল, তাদেরও ক্ষমা করে দেওয়া হল। জামাতে ইসলামী সহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার লাইসেন্স ফিরিয়ে দেওয়া হল। জামাতের আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে দেশে এনে রাজেনীতিতে পূনর্বাসিত করা হল। কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ, বিশেষভাবে সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্রতর করল, যার মূল ল্ক্ষ্য ছিল বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল প্রমাণ করা এবং বাঙলাদেশকে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা। পচাঁত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও আমজনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। মেজর জিয়া তার সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন। জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন খলনায়ক, তুলনাহীন দুশ্চরিত্র হোসেন মোঃ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষে্য, েল্তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন । ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে নতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গণ্ডমুর্খ ও ভণ্ড পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতেন। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে এরশাদ এমন এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তিনি প্রতি শুক্রবারে কোন না কোন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন। মসজিদে গিয়ে তিনি পূর্বরাত্রে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন বলে ডাহা মিথ্যা অবলীলায় বলে যেতেন; অথচ মানুষ জানত, এরশাদ আসবেন বলে দু’তিন দিন পূর্ব থেকেই সরকারী লোকেরা ঐ মসজিদ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিল। এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তারা এতটুকু গেল যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলু ধ্বনি হবে দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে ইত্যাকার কথা জোরেশোরে বলে বেড়াতে লাগল । বলাবাহুল্য, তারা এ অপকৌশলে সফল হয়ে নির্বাচনে জিতেছিল এবং মতাসীন হয়ে তারাও রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিল। মুক্তিযুদ্ধের পরে বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে তাদের রাজনৈতিক আচার আচরণেও ধার্মিকতা প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। জয় বাঙলা শ্লোগানের সাথে তারা ও “লা-ইলাহা ইল্লা লাহ-নৌকার মালিক তুই আল্লাহ প্রভৃতি শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগল। বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিএনপির সীমাহীন কারচুপি একটি দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল। সে আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যুগপৎ সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পটভূমিতে আবারো রাষ্ট্রীয় মতার পটপরিবর্তন হল। সুদীর্ঘদিন পর এবার মতায় এল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলন করতে গিয়ে জামায়াতের সাথে অঘোষিত ঐক্য করে ধর্মনিরপে রাজনীতির কী তিটা আওয়ামী লীগ করেছে সে উপলব্ধি আওয়ামী নেতৃত্বের এখনো হয়েছে কিনা জানি না। শুধু তা নয়, আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন আনল যা প্রকারান্তরে ধর্মীয় রাজনীতিকেই উৎসাহিত করল। দীর্ঘদিন পর মতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনর্বাসনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগত গ্রহণ করলই না, বরং তাদের দলীয় কর্মসূচী এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসুচীতে তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। সংসদে প্রত্যেক সাংসদদের মাথায় টুপি পরে বসা এবং যে কোন বক্তব্যের শুরুতেই জোর গলায় “বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহিম” বলা, কোন কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থ্পান করতে গিয়ে মোনাজাত করা, যে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলোয়াত করা, নেতা-নেত্রীর ফি বছর হজ্জ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণের সাথে রাজনৈতিক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের সাথে আওয়ামী লীগের আচরণের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল, যা বস্তুতঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বৈধতা প্রদান করছিল। মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপিতো নয়ই, আওয়ামী লীগও এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার কথা চিন্তাও করল না। কিন্তু এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারল না, তেমনি যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মন জয় করার জন্য আওয়ামী লীগ এতকিছু করল, তাদের মন থেকেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মুছে ফেলতে সক্ষম হল না। বরং জাতীয়তাবাদী দল আরো এক ধাপ এগিয়ে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নামক দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করে আসীন হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো-রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতার লোভে যে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে নিজেদের সুবিধামত রাজনীতিতে ব্যবহার করছে, শেষ পর্যন্ত তারা কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বরং তাদের এ রাজনৈতিক আচরণ মৌলবাদীদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে দিবে। ক্ষমতাসীন হয়ে জোট সরকার ধর্মপালনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে দিল। ক্ষমতান্ধ হয়ে এ সামান্য বোধটুকু আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা হারিয়ে ফেলল যে, রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন, কোন সংগঠনের কোন ধর্ম থাকে না । ধর্ম, তথা উপসনা-ধর্ম (Worship Religion) থাকে মানুষের; কোন বস্তু বা সংগঠনের নয়। বস্তু বা সংগঠনের ইহকাল পরকাল নেই। তারা স্বর্গ-নরকে যাবে না।, তাই তাদের ধর্মের প্রয়োজনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম পালনের ফলে প্রকারান্তরে বৈধতা পেল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এভাবে সেক্যুলার রাজনীতির শিকড় কাটা হতে লাগল একে একে।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বিশেষভাবে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতাকারী জামাতে ইসলামীর সাথে জোট করে এবং ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সকল প্রকার কায়দাকানুন করে, কথায় কথায় বিসমিল্লাহ বলে ক্ষমতাসীন হলেও ৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশে বস্তুুত লুটপাটতন্ত্রই কায়েম করল। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হল দেশ। বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে প্রথম হওয়ার কলঙ্ক তিলক দেশের কপালে শোভা পেল। মন্ত্রী পরিষদের বিভিন্ন সদস্য, তাদের বীর সন্তান-সন্ততি সহ প্রধানমন্ত্রীর দুই সন্তানের সীমাহীন দুর্নীতি দেশকে এক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিল। তারপরও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ২০০৬ ইং সালে এসে তত্ত্বাবধায়ন সরকার নিয়ে বহু নাটক করেও আখেরে সফল হল না তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান নিয়ে বিতর্ক, রাষ্ট্রপতি এয়াজ উদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসাবে শপথ গ্রহণ, দেশে গৃহযুদ্ধসম পরিস্থিতির জন্ম, ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তন, নতুন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ, রাজনীতিবিদ ও তাদের প্রিয় সন্তান-সন্ততিদের পুকুর চুরির ইতিহাস উম্মোচন, ভূয়া ভোটার তালিকা বাতিল করে নতুন ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, অত:পর ২০০৮ এর ডিসেম্বর এ জাতীয় নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে কতিপয় ইসলামী দল, পতিত স্বৈরাচার এরশাদে ও কতিপয় বাম রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মহাজোটের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় । নির্বাচনের পূর্বে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সহ দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের এ অঙ্গীকারে আকৃষ্ট হয়ে নতুন প্রজন্মের ভোটার এবার বিপুলভাবে মহাজোটকে ভোট দেয়। বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সিক্ত সংবিধানে তার আজ সংযোজন করেছে দুই সামরিক শাসকের রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ। আদালত যা বাতিল করল, আওয়ামী লীগ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে তা সংবিধানে পুণ:সংযোজন করল। এতকিছু করেও মৌলবাদীদের কিন্তু খুশী করা যায় নি। এখন ২০০৭ ইং সালে খেলাফত মজলিসের সাথে যে ৫ দফা চুক্তি করেছিল আওয়ামী লীগ, যেখানে ছিল-ব্লাসফেমী আইন প্রণয়ন, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে স্বীকৃতি প্রদান, মোল্লাদের ফতোয়া প্রদানের ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি-সেগুলো বাস্তবায়ন ঘোষণা দিলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে এবং তখন দেশ একটি সত্যিকার মধ্যযুগীয় ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হবে। উত্তর আধুনিক যুগগ থেকে জাতি যাত্রা শুরু করবে মধ্যযুগে । বলাবাহুল্য, সংবিধানের এ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাই করল আওয়ামী লীগ, উদ্দেশ্য এবং একমাত্র উদ্দেশ্য কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া।

তথ্যসূত্রঃ
*ইসলাম, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র-পাকিস্তান অভিজ্ঞতা-সম্পাদনা আসগর খান
•General in Politics- By-Asgar Khan
•Religion in Global Politics- Jeff Haynes
•Pakistan: Nationalism without a Nation—Edited by- Christophe Jaffrelot
•Will Baluchistan Break Out of Pakistan ?
Frédéric Grare– January 31, 2006—Source –internet
•Politics of History—Imtiaz Gul