গান শোনার ক্ষেত্রে আমি মোটামুটি একটা সর্বভুক প্রাণী। তবে, এই সর্বভুকতা কাজ করে শুধু বাংলা গানের ক্ষেত্রে। এর কারণটা অবশ্য সহজবোধ্য। পৃথিবীতে এই একটা ভাষাই মোটামুটি জানি আমি। কাজেই, আমার সব নির্ভরতা, সব আনন্দের উৎস যে এই এক ভাষাকেন্দ্রিক এতে কোনো বিস্ময় নেই। সেকারণেই বাংলা গানের ক্ষেত্রে বাছ-বিচারটাও করা হয় না তেমন করে। একমাত্র ব্যতিক্রম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই উচ্চ ধরনের ভীতি আছে আমার। সেই উচ্চ ধরনের ভীতি এখনো উবে যায় নি আমার মন থেকে। বরং বহুলাংশে বর্ধিত হয়েছে তা বর্তমান কালে এসে। এর বাইরে যেখানে যা পাই, তার সবই শ্রবণেন্দ্রীয়ের সুক্ষ্ণ ছিদ্র দিয়ে মস্তিষ্কের নিউরনে পাচার করে দেই। তারপর সেটা হয়ে দাঁড়ায় মস্তিষ্কের দায়িত্ব। ওই গান দ্বিতীয়বার শুনবে কী শুনবে না সেটা তাঁর ব্যাপার। আমার হাতে অত সময় নেই বাছবিচার করার। কত কত অসংখ্য গান পড়ে রয়েছে শোনার জন্য। অথচ সময় বড় অল্প। সোনাঝরা রোদেলা দিনগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নুয়ে পড়া সূর্যের নতজানু রোদ্দুর ত্রস্ত হরিণীর মত দ্রুতপায়ে পালাচ্ছে দিনশেষের অতল অন্ধকারের দিকে।

গান শোনার এই বাছবিচারহীনতা দেশ-কালের সীমানাও অতিক্রম করে গিয়েছে আমার। বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের গান বলে আমার কাছে আলাদা কিছু নেই। যেমন নেই এই দশকের গানের সাথে গত শতাব্দীর তিরিশ বা চল্লিশের দশকের গানের। অবশ্য সেটা থাকলে ক্ষতিটা  হতো আমারই। কোলকাতা বাংলা গানকে যা দিয়েছে তার ধারে কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা ঢাকার কখনোই ছিল না। এখনও নেই বললেই চলে। ভবিষ্যতের কথা অবশ্য জানি না। যদিও ঢাকাইয়া ফিল্মের গানও আমার অসম্ভব প্রিয়। তারপরেও আমি বলবো যে, যত বাংলা গান আমি শুনেছি তার বেশিরভাগই মূলত কোলকাতার। তবে, এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ব্যান্ডের গান। কোনো এক অজানা কারণে ভূমি, চন্দ্রবিন্দু বা ক্যাকটাসের মত দুই একটা ব্যান্ডের দুই চারটা গান বাদে অন্য ব্যান্ডগুলোর গান শোনাই হয় নি আমার।

অজানা কারণ বলাটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। খুঁজে খুঁজে একটা কারণকে বের করেছি আমি। আমার কৈশোর এবং তারুণ্যের সময়ে ঢাকায় ব্যান্ড সঙ্গীতের জোয়ার এসেছিল। বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলো নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় সব গান সৃষ্টি করে চলেছিল সেই সময়।  সোলস, মাইলস, ফিডব্যাক, এলআরবি, নগরবাউলেই মগ্ন ছিলাম আমি তখন। এদের চৌকষ চাকচিক্য, মনোমুগ্ধকর মঞ্চপরিবেশনা, প্রবল প্রতিভা এবং সীমাহীন সৃষ্টিশীলতার কাছে কোলকাতার ব্যান্ডগুলোকে একেবারেই নিস্প্রভ মনে হতো আমার। সে কারণেই হয়তো খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয় নি তাদের প্রতি আমার। অনাগ্রহের একটা অনাবশ্যক বাধা গড়ে উঠেছিল এদেরকে ঘিরে।

তবে, এই নিস্প্রভ পানসে ব্যান্ডগুলো মধ্যে একটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। লিলিপুটদের মধ্যে গালিভার যেমন আকাশছোঁয়া উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।  ঠিক সেরকম আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে একেবারে তারাদের রাজ্যের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেটি। টগবগে ঘোড়া যেমন কোনো বাধা মানে না। যে কোনো বাধাকেই গ্রীবা বাকিয়ে কেশর দুলিয়ে টপকে যায় অনায়াস দক্ষতায়, মহীনের ঘোড়াগুলিও তেমনি আমার অনাগ্রহের বাধাকে টগবগিয়ে টপকে চলে এসেছিল বুকের একেবারে কাছাকাছি। ঠিক সেখানটায়, যেখানে লুকিয়ে রেখেছি আমি সুগভীর ভালবাসার এক স্বপ্নময় সুনীল সরোবর। ভালবাসার সেই সুনীল সরোবরে হাত পা ছুড়ে সাঁতার কেটেছে জীবনানন্দের কবিতা থেকে উঠে আসা মহীনের ঘোড়াগুলি, নিজ সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একদল অসম্ভব প্রতিভাবান গানপাগল তরুণের দল।

মন খারাপ আপনার। বিষন্নতায় ছেয়ে আছে কোনো বৃষ্টিমুখর বাদলা দিন। তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, ক্রমশ তারচেয়েও দূরে সরে যাচ্ছে প্রিয়তম কোনো মানুষ। ভাবনার কিছু নেই। এক্ষুনি মন ভাল হয়ে যাবে আপনার। মহীনের ঘোড়াগুলি শুনুন।

মন খারাপ হওয়া একজন মানুষের মন ভালো করে দেবার বিস্ময়কর মায়াবী মন্ত্র নিয়ে মর্তধামে জন্মেছিল এরা।

httpv://www.youtube.com/watch?v=5oBY-XTFt4c&feature=related