গল্পটা এত বড় করব বলে আদিতে ভাবি নি। বড় গল্প বা উপন্যাস ক্রমশঃ দেয়ার মধ্যে কিছুটা risk আছে। তবে একবার যা শুরু হয়েছে সেটা শেষ করাই ভাল।

পূর্বের অধ্যায়গুলো

ষষ্ঠ অধ্যায় (চলছে)

ম্যানেজারের এখনো দেখা নেই। চার তলার ফ্ল্যাট বাড়ি আমার মাথার ওপর বোঝার মত বসে থাকে। জেনেরেটর ঘট ঘট শব্দে চলছে। আমি সিঁড়ির ওপর পা রাখি, ওপরের দিকে তাকাই। মাঝের ফাঁক দিয়ে চারতলা পর্যন্ত দেখা যায়, কেউ নেই, সিঁড়ির রেলিংএর সরলরেখা যেন আধুনিক চিত্রকলা। ক্যামেরাটা মুখের দিকে ধরে ধীরে ধীরে উঠতে থাকি। সেই সময় মনে হয় দেয়ালটা যেন জ্বলছে। জ্বলছে বলা ঠিক হবে না, বরং বলা উচিত দেয়ালটা একটা অদ্ভুত রঙ্গে কাঁপছে। এমন একটা রঙ যার নাম আমি জানি না, রঙটা যে আগে কখনো দেখি নি সেটা সম্বন্ধে আমি কেন যেন নিশ্চিত ছিলাম।

আমার প্রমাতামহী নাকি রংপুরের এক জমিদার কর্ত্রী ছিলেন। সুধাময়ী দেবী। লোকজন তাকে কর্তামা বলে ডাকত। তিনি নাকি আকাশে এমন একটি তারা চিনতেন যেটার রঙ মানুষের কাছে অজানা ছিল। রংপুরের রঙ। আমি কথাটা আমার মা’র কাছ থেকে শুনেছি। আমি আকাশে তারাটি বহু বছর হল খুঁজেছি, তারপর ভেবেছি শুধুমাত্র রংপুরের আকাশ থেকে বুঝি সেটা দেখা যায়। কিন্তু রংপুর গিয়ে আমি সেই জমিদার বাড়ি খুঁজে পাই নি, ততদিনে আমার মাতামহী, আমার মা সবাই বিগতা হয়েছেন, আমাকে রাস্তা চিনিয়ে দেবার কেউ ছিল না। রংপুর বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমি খুব অসহায় বোধ করছিলাম। এখন সেই অসহায়ত্ব আবার যেন পুরো দমে ফিরে এল। একটা অজানা রঙের সঙ্গে ভীতিবোধের কি সম্পর্ক?

পরে আমি অবশ্য বুঝেছি ঢাকার আকাশ ও রংপুরের আকাশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, রংপুরের তারাটি ঢাকার আকাশ থেকেও দেখা যাবার কথা। আমার প্রমাতামহীকে আমি দেখি নি, আর আমার মাতামহীও আমি ছোট থাকতে মারা যান, তবে ওনার কাছ থেকে এই তারার গল্পটি আমি শুনেছি। মা’র কাছ থেকেও। সেই তারাটি আমার কাছে ছিল কিংবদন্তীর এক নক্ষত্র। বড় হয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি কি ধরণের রঙের কথা সুধাময়ী দেবী বলার চেষ্টা করেছিলেন। তারাদের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা কম হলে সেই তারাদের লাল দেখা যায়। আর তাপমাত্রা যত কম হয়, তুলনামূলক ভাবে তত বেশী অবলোহিত তরঙ্গ সেই নক্ষত্রের পৃষ্ঠদেশ থেকে বিকিরিত হয়। কিন্তু মানুষ অবলোহিত রঙ দেখতে পায় না। এখন আমার মনে হয় সুধাময়ী দেবী হয়তো আর্দ্রার কথা বলতে চেয়েছেন, অথবা জ্যেষ্ঠা। কালপুরুষের কোণায় আর্দ্রা, বৃশ্চিকের মাথায় জ্যেষ্ঠা। নাকি বৃষের রোহিণী? এই লাল দানবগুলোর দিন শেষ হয়ে আসছে। সূর্যের থেকে বহুগুণ বড় M টাইপ এই নক্ষত্রগুলি বেশ লাল, সেগুলি অবলোহিত তরঙ্গে প্রচুর আলো বিকিরণ করে। সুধাময়ী কি অবলোহিত দেখতে পেতেন?

সিঁড়ির দেয়াল কি অবলোহিত তরঙ্গে কাঁপছে? আমি কি অবলোহিত তরঙ্গের রঙ দেখতে পাচ্ছি? এমন একটা রঙ যাকে আমি বর্ণনা করতে পারব না, কম্পিউটারের লক্ষ লক্ষ রঙের কৃত্রিম বিন্যাসের মধ্যেও তাকে পাওয়া যাবে না। আমি হাত বাড়িয়ে সেই রঙ্গকে স্পর্শ করতে চাই, কিন্তু আমার আঙ্গুল দেয়ালকে ছোঁয়। কিন্তু সেখানে আঙ্গুলগুলো থেমে থাকে না, দেয়ালের পলেস্তরা পার হয়ে তারা ইঁটের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকে। অনেকটা জলের মধ্যে হাত যেরকম ডুবে যায়। আমার হাত কোন বাধা পায় না। এরকমই কি হবার কথা? না, এরকম তো হবার কথা নয়। সেই মুহূর্তেই মনে হয় আমার পা সিঁড়ির পাদানিতে ডুবে যাচ্ছে। ক্যামেরা? ক্যামেরা কি আমাকে দেখছে না? আমি দ্রুত ডান হাতে ধরা ক্যামেরার দিকে তাকাই। ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা নয়, ক্যামেরার মুখ আমার দিকে ঘোরাই, কিন্তু তার আগে হাত দেয়াল থেকে সড়িয়ে আনি। দেয়ালের অদ্ভুত রঙ চলে যায়। পায়ের নিচে সিঁড়ি যেন শক্ত হয়ে ওঠে। আমার হাত যে দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে নি তাতে নিশ্চিন্ত হই।

এই বাড়ি কি আমাকে গ্রাস করতে চায়? এগুলোর কোনটা আমার কল্পনা এর কোনটা বাস্তব বুঝতে পারি না। কেউ যেন ওঁত পেতে বসে আছে, কখন আমি অন্যমনস্ক হব। সেই জিনিস, তা যাই হোক না কেন, প্রকৃতি-সৃষ্ট কোন তরঙ্গ বা বুদ্ধিমান কোন অশরীরী, সেটা অথবা সে কেমন করে জানে আমি কি ভাবছি? মস্তিষ্কের মাঝে জটিল নিউরন সংকেতে স্বজ্ঞার উদ্ভব – সেই পাঠোদ্ধার পৃথিবীর বিজ্ঞানে এখনো হয় নি। তার মানে যতক্ষণ আমি সচেতন ভাবে নিজেকে অবলোকন করছি, পর্যবেক্ষণ করছি, ততক্ষণ আমার কিছু হবে না। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমি আনমনা হব, রংপুরের সুধাময়ী দেবীর কথা ভাবব, আর্দ্রা নক্ষত্রের কথা ভাবব, তখনই সে বা সেটা আঘাত হানবে, আমাকে এই মহাবিশ্ব থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে। শুধুমাত্র যখন আমি ক্যামেরার দৃষ্টিপথে থাকব শুধু তখনই, শুধুমাত্র তখনই, মনকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হবে। আমি ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসি।

কিন্তু ওপরে উঠে যে ঘরে ঢুকি সেই ঘর আমার পরিচিত ছিল না। বুঝলাম অন্য ফ্ল্যাটে ঢুকেছি। বাইরে যেয়ে দরজায় নাম পড়ি। ডঃ বিকাশ কাইয়ুম। কিসের ঘোরে তিনতলার বদলে চারতলায় উঠে এসেছি। আমার ওপর তলায় থাকেন বর্ষীয়ান কাইয়ুম সাহেব, ওনার বয়েস ৮৫ হয়তো ছাড়াচ্ছে। একাই থাকেন, স্ত্রী মারা গেছেন অনেক বছর, ছেলেমেয়েরা বিদেশে। নিজে নামকরা ডাক্তার ছিলেন, নিউরোসার্জান, মস্তিষ্কের বিজ্ঞানী। বিদেশেও বহুবছর কাজ করেছেন। আমি মাঝেমধ্যে ওনার সাথে দাবা খেলতে আসতাম। মস্তিষ্কের নানান রহস্যের কথা শুনতাম। উনি বলতেন, আমরা আমাদের মস্তিষ্ক দিয়ে বাস্তবকে গড়ে তুলি, এটা একটা পরিসংখ্যানের পদ্ধতি। আমরা সেকেন্ডে মাত্র কয়েকবার, দৃষ্টি শব্দ ইত্যাদি দিয়ে আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতকে স্যাম্পেল করতে পারি। সেই কয়েকটি মাত্র স্যাম্পেলের ওপর ভিত্তি করে আমরা বাস্তবকে ইন্টারপলেট বা এক্সট্রাপলেট করি। এখন ওনার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা কেন বুঝলাম না। “হ্যালো, কাইয়ুম ভাই,” বলে আমি বসার ঘরে ঢুকি। উনি দেখি সোফার ওপর লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছেন। এতক্ষণে একজনকে – তার ওপর পরিচিত একজনকে – দেখে আমার প্রাণ যেন ফিরল। আমি এখনো পাগল হই নি।

“কাইয়ুম ভাই,” ওনাকে কাঁধে হাত দিয়ে জাগাই। “কে, কে,” বিকাশ কাইয়ুম ধড়মড় করে উঠে বসেন।

“আমি অমল।”

“ওঃ অমল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

“কাইয়ুম ভাই, আপনাকে দেখে প্রাণে বল পেলাম। আপনার বাইরের দরজা খোলা ছিল।”

“ওঃ স্নিগ্ধা তো আছে বাসায়। দেখলে না?”

স্নিগ্ধা সকাল কি দুপুর বেলা এসে রান্না করে, বাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।

“স্নিগ্ধাকে তো দেখছি না,” এই বলে রান্নাঘরে ঢুকি। স্টোভে একটা বড় পাত্রে কি যেন গরম হচ্ছে, তার থেকে বাষ্প বার হচ্ছে। কাছে গিয়ে, ঢাকনা সড়িয়ে দেখি ডাল। একটা চায়ের চামচ দিয়ে ফুটন্ত জলের মধ্যে থেকে কিছু ডাল তুলে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করি, মুখে দিই, একেবারেই সিদ্ধ হয় নি। দশ মিনিটও হয় নি ডাল আগুনে চড়ানো হয়েছে। মাইক্রোওয়েভে দেখি একটা মাছের রান্না। হাত দিয়ে ধরে দেখি এখনো গরম। স্নিগ্ধা রান্না শুরু করে কোথায় গেল? সিঁড়িতে ওঠার সময় স্নিগ্ধাকে নামতে দেখি নি। ছাদে যেতে পারে অথবা সামনের ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটের বাইরে এসে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যেতে চাই। কিন্তু ছাদের দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। সামনের ফ্ল্যাটের বেল বাজাই। এই ফ্ল্যাটের লোকদের আমি চিনি না, তবে জানি এখানে একটা বড় পরিবার বাস করে, অনেক কটি ছেলেমেয়ে, ভাগ্নি, ভাইঝি, ইত্যাদি। এতগুলো লোক, কিন্তু ভেতরে কোন শব্দ নেই। দরজার কড়া নাড়ি, কেউ সাড়া দেয় না। ফিরে আসি।

বসার ঘরে ঢুকে দেখ কাইয়ুম ভাই কি যেন খুজছেন।

“আমি চশমাটা খুঁজছি, অমল। ঐ চশমা ছাড়া আমি প্রায় অন্ধ।”

সেটা আমিও জানি। আমি হাতের ক্যামেরা টেবিলের ওপর এমন ভাবে রাখি যাতে ঘরের একটা বড় অংশের ছবি ওঠে। দুজনে মিলে অনেকক্ষণ সারা ফ্ল্যাট খুঁজলাম। চশমা পাওয়া গেল না।

“কাইয়ুম ভাই, স্নিগ্ধাকে পেলাম না। অনেক কিছু হচ্ছে আজ সকাল থেকে, সে সব কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার মোবাইল, ইন্টারনেট, টেলিভিশন এগুলো কি কাজ করছে?”

এক এক করে সব কটা যন্ত্র চেষ্টা করা হল, কিন্তু বাইরের সঙ্গে যোগাযোগে আমরা সমর্থ হলাম না। কাইয়ুম সাহেবকে সকাল থেকে যা যা হয়েছে সব বিস্তারিত বললাম। উনি চুপ করে শুনলেন। উত্তরের জানলা দিয়ে দেখলাম একটা বিমান বহু ওপর দিয়ে, বায়ুমণ্ডলের ঠাণ্ডা স্তর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। দুটি ইঞ্জিনের পেছনে ঘনীভুত সাদা ধোঁয়া বর্তুলাকার নীল আকাশে সমান্তরাল দুটি রেখা টেনে যায়। কোথায় যাচ্ছে সেই বিমান, আমি ভাবি। সিঙ্গাপুর থেকে নিউ ইয়র্ক? তারা কি জানে পৃথিবীর বুকে কি হচ্ছে? নাকি আমাদের এই রাস্তাটা ছাড়া বাদবাকি পৃথিবীর যেমন থাকার কথা তেমনই আছে। আহা, আমি যদি এখন থাকতে পারতাম ঐ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিমানের মাঝে! খুব ঈর্ষা হয় আমার সেই অজানা বিমানযাত্রীদের কথা ভেবে। ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হয় আমি সেই সুন্দর আধুনিক উজ্জ্বল বিমানের এক যাত্রী। বহু ওপর থেকে আমি নিচে এক এলোপাতাড়ি গড়ে ওঠা শহর দেখি।

কাইয়ুম ভাই বললেন, “অমল, সকাল থেকে কিছু খেয়েছ। বোধহয় খাও নি। আমার সাথে বসে খাও। পেটে কিছু পড়লে মাথাটা ঠাণ্ডা হবে।”

আমি প্রতিবাদ করলাম না। এই মুহূর্তে স্নিগ্ধার কি হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে চাইলাম না। কাইয়ুম ভাইএর সাথে থাকলে আপাততঃ ক্যামেরাটা বন্ধ করে রাখলেও চলবে। অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রের মত অবস্থা। এক অজানা শত্রু আমাদের এক অদৃশ্য জগতে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। সেই শত্রুর বিরুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তবে প্রতিরোধ সম্ভব। কিন্তু তার জন্য সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। ডালটা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।

কাইয়ুম ভাই বললেন, “অমল, ফেইনম্যান নামে এক বিজ্ঞানী ছিলেন, জানো বোধহয়। তিনি বলেছিলেন, যা হওয়া সম্ভব তা অবশ্যই ঘটবে। এইরকম একটা কিছু। এক সীমাহীন মহাবিশ্বে অসীম সময় ধরে অপেক্ষা করলে অবশ্য সবই হবে। এমন কি এর জন্য কোন সমান্তরাল মহাবিশ্বে যেতে হবে না। কিন্তু অমল এর একটা সম্ভাবনা তোমার মাথায় এসেছে কি?” কাইয়ুম ভাইএর ঘন ভুরুর নিচে উজ্জ্বল চোখ, কিন্তু সেই চোখ কি আমাকে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে?

“কি সম্ভাবনা, কাইয়ুম ভাই?”

“একটা দীর্ঘ স্বপ্নের কথা ভেবেছ কি? আর আমি যখন স্বপ্নের কথা বলেই ফেললাম তখন এই স্বপ্নটা হয়ে গেল সচেতন স্বপ্ন। lucid dreaming। সেই স্বপ্নে আমরা জানি যা ঘটছে তা বাস্তব নয়, স্বপ্ন মাত্র। নামখাই নরবু নামে একজন তিব্বতী যোগীর স্বপ্নযোগ ও প্রাকৃতিক আলোর অনুশীলন নামে একটা বই পড়ে আমি সচেতন স্বপ্ন সম্বন্ধে কৌতূহলী হই। আমার অনেক রোগীর সাথে আমি লুসিড স্বপ্নের অনুশীলন করেছি। সেই ধরণের স্বপ্নে তুমি তোমার পরিবেশকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পার। যেমন ধর তুমি উড়তে চাও, পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, সমুদ্রের ওপর, যেখানে ইচ্ছা। আজকের স্বপ্নে কি তোমার উড়তে ইচ্ছা করছিল?”

“কি যে বলছেন, কাইয়ুম ভাই!” এটুকু বলেই আমার মনে পড়ে উঁচু বায়ুমণ্ডলের জেট বিমানের কথা। আমি তো উড়তে চেয়েছি সেই বিমানে বসে। সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি আমি স্বপ্ন দেখছি? এর মধ্যে ডালটা ফুটতে দেখি।

“তাহলে ডালটা কেমন হল দেখি, কাইয়ুম ভাই। খুব গরম। না, ঠিক আছে, চলবে। কাইয়ুম ভাই, এটা স্বপ্ন হলে স্বপ্ন। আসুন খেয়ে নিই।”

স্নিগ্ধা ভাত করে রেখেছিল। ডাল, মাছ এর ভাত নিয়ে রান্নাঘরের টেবিলে বসলাম। আমি ক্লান্ত ছিলাম, দুজনে অনেকক্ষণ নীরবে খেতে থাকলাম। তারপর কাইয়ুম ভাই বললেন, “অনেক সময় তুমি জাগ্রত অবস্থা থেকে সরাসরি লুসিড স্বপ্নে চলে যেতে পার। তবে সেইজন্য বহু বছরের অনুশীলন লাগবে। কিন্তু অমল, ধরা যাক আমরা লুসিড স্বপ্নের মধ্যে নেই। আর তুমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলে তখন তুমি সচেতনই ছিলে। তুমি বললে তখন তোমার হাত দেয়ালে ঢুকে যাচ্ছিল? তুমি জানো, অমল, বস্তুর নিরেট বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে পাউলির এক্সক্লুশান বা পরিবর্জন নীতি কাজ করে। দুটি ইলেকট্রন একই কোয়ান্টাম স্টেট বা দশায় থাকতে পারবে না। তাই পরমাণু মূলতঃ ফাঁকা হলেও একটি পরমাণু এর একটি পরমাণুর মধ্য দিয়ে গলে যেতে পারে না। কারণ পরমাণুগুলির ইলেকট্রনগুলিকে খুব কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব নয়। সেইজন্য তুমি যখন দেয়ালে চাপ দাও তোমার হাত দেয়ালে ঢুকে যায় না। যে সমস্ত মৌলিক পদার্থের স্পিন পূর্ণ-সংখ্যক নয় তারা সবাই এই পরিবর্জন নীতি মেনে চলে। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, এমন কি প্রোটন-নিউট্রনের ভেতরের কোয়ার্কও এই নীতিতে চলে। আমাদের মহাবিশ্বই তৈরি হয়েছে এই কণিকাদের দিয়ে, তাই মহাবিশ্বকে আমরা কিছুটা হলেও নিরেট হিসেবেই দেখি। কিন্তু কোন কণার স্পিন যদি পূর্ণ সংখ্যা হয়, যেমন ফোটোনের, তাকে পাউলির নীতি মানতে হবে না। মহাবিশ্বের অন্যতম উপাদান ডার্ক ম্যাটার হয়তো সাধারণ তড়িৎ-চুম্বকীয় ইত্যাদি বল-বিক্রিয়া থেকে মুক্ত। ডার্ক ম্যাটার যদি কোন মৌলিক কণা হয়, তবে তার স্পিন কি কে জানে! কোন কণা যদি অন্য একটি কণার সাথে বিক্রিয়া না করে, তবে তাদের একে অপরের মধ্য দিয়ে যেতে বাধা নেই। তাই ডার্ক ম্যাটার আমাদের সাধারণ ডিটেকটরদের সাথে বিক্রিয়া করে না, তাই সে অদৃশ্য থাকে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, অমল, মুহূর্তের জন্য হলেও ঐ দেয়াল বা সিঁড়ি হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের সাধারণ বস্তুর থেকে ভিন্ন রূপে ছিল, তাই তোমার হাত ঐ দেয়ালের ভেতরে অনায়াসে ঢুকছিল।”

আমি চুপ করে থাকি। মহাবিশ্ব বিশাল। তাতে সব কিছুই ঘটা সম্ভব, শুধু তাকে সময় দিতে হবে। প্রকৃতির অসীম সংখ্যক সম্ভাবনার বিচারে কোন এক সময়ে এই ধরণের ঘটনা হওয়াই স্বাভাবিক। নাকি? নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। ঢাকার এক অখ্যাত রাস্তায় একটা সাধারণ বাড়ির ফ্ল্যাটে প্রকৃতির এই খেলায় বন্দী হয়ে থাকি।

খাওয়া শেষে কাইয়ুম ভাই বললেন, আমার কিছু বই বহুদিন হল বাক্স বন্দী হয়ে আছে। দেখ দেখি সেই বইগুলো দিয়ে কোন কাজ হয় কিনা। আর একটি ঘরের এক কোণায় একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স দড়ি-বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। দেখে মনে হল অনেক বছর হল বাক্সটি এই অবস্থায় আছে। কাইয়ুম ভাই বললেন, “অমল, তুমি এটা নিচে নিয়ে যাও। এর মধ্যে খুঁজে দেখ কোন উত্তর পাও কিনা।”

“আপনাকে একা রেখে আমি নিচে যাব না। এক কাজ করুন, আমার সাথে চলুন।”

“তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি। স্নিগ্ধা ফিরে আসতে পারে।”

কাইয়ুম ভাইএর জন্য একটা ক্যামেরার বন্দোবস্ত করে বাক্সটা আমার ফ্ল্যাটে টানতে টানতে নিয়ে এলাম। কানু এতক্ষণ পর আমাকে দেখে খুব খুশী। বিকেল হয়ে আসছে। গরমটা একটু কম মনে হয়। নিচে এখনো জেনেরেটর চলছে। ম্যানেজার তাহলে ফেরে নি। বাইরে একটা বড় শহর আছে। সেখানে হয়তো আজ সব দোকান খোলা, প্রতিদিনের মত সব রাস্তায় জ্যাম, লক্ষ লক্ষ লোকে ফুটপাথ ভরা, প্রতিদিনের মত রাজনীতিবিদরা ভাবছে দেশটা শুধু তাদের। আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এই শহরের একটা রাস্তায় একটা বাড়ি আছে যা কিনা সেই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। একটা অদৃশ্য ঢাকনা এই বাড়িকে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই বাড়িকে আলাদা করার জন্য কোন দেয়াল দিতে হয় নি, কোন প্রহরী বসাতে হয় নি। তুমি যদি চাও এখনি এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে পার। কোন বাধা নেই। শুধু তুমি জানো এক সময় ঐ ক্যামেরার ব্যাটারী ফুরাবে, তারপর যেই মুহূর্তে তোমার মন অন্যমনস্ক হবে তোমাকে এই বিশ্ব থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে। বিকেলের আলোয় আমার এই ছোট পৃথিবী যেন আরো বিষণ্ন হয়ে ওঠে।

সকাল থেকে আরো একটা কি যেন হয়েছে। জিনিসটা ঠিক ধরতে পারি না। বসার ঘরে সোফায় বসে একটা কাগজ নিয়ে ছক কাটি।

১. যাদের সঙ্গে আজ সামনা-সামনি কথা হয়েছেঃ
নওশাদ, বিকাশ কাইয়ুম

২. যাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছেঃ
নওশাদ, নমিতা

৩. ফোন ছাড়া যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, কিন্ত দেখা হয় নিঃ
ফারহানা

পাশের ফ্ল্যাটের ফারহানা দরজা খোলে নি, দরজার ওপাশ থেকে কথা বলেছে। তারপর কি যেন ভেবে এক নম্বর সারিতে ফিরে যাই, কানুর নামটা ঢুকাই –

১. যাদের সঙ্গে আজ সামনা-সামনি কথা হয়েছেঃ
নওশাদ, কানু, বিকাশ কাইয়ুম

কানু আজ মানুষের পর্যায়ে। হাসি নিজের মনে। তারপর এর একটা সারি বানাই।

৪. যাদের অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি –
স্নিগ্ধা
নিচের ম্যানেজার বা দারওয়ানকে কোথায় ঢুকাব বুঝতে পারি না।
.
ছকটা করে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এর মধ্যে কিছু একটা আছে যা আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। কোন একটা সূত্র যা ১, ২ এর ৩ নং সারিকে একত্রিত করেছে। কি মনে করে যেন আমি আবার ১ নং সারিতে ফিরে যাই। নওশাদের নামটা কেটে দিই।

১. যাদের সঙ্গে আজ সামনা-সামনি কথা হয়েছেঃ
কানু, বিকাশ কাইয়ুম

আমার কেন জানি মনে হয় আজ সকালে নওশাদ চলে যাবার পর কিছু একটা হয়েছে। কি হতে পারে? তিন নম্বর সারিতে ফারহানার নামের ওপর একটা উপবৃত্ত আঁকি। ফারহানা কেন দরজা খুলল না। ফারহানার ব্যবহার আমাকে কি বলছে? এর তখনই বুঝলাম প্রথম তিনটি সারির মধ্যে যোগসূত্রটা কি। আজ সকালে নওশাদ চলে যাবার পর কেউই আমার মুখ দেখে নি। ফোনের ক্যামেরা কাজ করছিল না, তাই নওশাদ আর নমিতা আমাকে দেখে নি। কাইয়ুম ভাইএর চশমা পাওয়া গেল না, তাই উনিও আমাকে দেখেন নি। বাকি রইল ফারহানা এর কানু। ফারহানা আমাকে দেখেছে কিন্তু দরজা খোলে নি। কেন খোলে নি? কানু আমাকে দেখেছে এবং প্রথমে ঘেউ-ঘেউ করেছে। কানু আর ফারহানা কি আমাকে চিনতে পারে নি। চিনতে পারে নি? আমি এখন কে?

শেষ অংশ