বেশ কিছু দিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্যের আওয়াজ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এই জাতীয় ঐক্য মানে পাহাড়ের দুই বৈরী রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইনেটড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মধ্যে একটি ঐক্যের মেলবন্ধন তৈরী করা। আপাতদৃষ্টিতে এবং সাদা চোখে বিষয়টি খুবই ভাল উদ্যোগ । তা নিয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করাটা বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। কারণ দুই বৈরী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যদি ঐক্যের মেলবন্ধন তৈরী হয়, তাহলে জুম্ম জনগণের পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। এই বাস্তবতা থেকে অনেকেই ঐক্যের হাঁক-ডাক দিচ্ছেন। তবে এই ঐক্যের শোরগোলটা বেশী বেশী করে শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক ও কেন্দ্রীয় নেতা অনিমেষ চাকমা রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং এলাকায় একটি অতর্কিত আক্রমণে নিহত হওয়ার পর থেকে। অনিমেষ চাকমার সাথে দলটির আরও ৪ জন নেতা কর্মী প্রাণ হারান। তারপর থেকে এই জাতীয় ঐক্যের পালে হাওয়া বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। হাল নাগাদ ফেইস বুক খুললে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নানান সব গ্র“প চোখে পড়ে। পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ে এই গ্র“পগুলোতে নামে-বেনামে-ভূয়া নামে অনেকেই লিখছেন, পাণ্ডিত্য জাহির করে চলেছেন। তবে কোনো না কোনো ভাবে এই সব ফেইসবুক গ্র“পগুলোতে ইউপিডিএফ-এর বেনামী সমর্থকদের সংখ্যাধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এই গ্র“পগুলিতে অনেক সময় যৌক্তিক বিতর্কের চেয়ে ব্যক্তিগত কুৎসা ও কাঁদা ছোঁড়া-ছুঁড়ি’টাই বেশী হয়। অবশ্য সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাটা চলতি রচনার লক্ষ্য নয়। এই সব গ্র“পগুলোতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর দ্বন্দ্ব সংঘাত অবসান নিয়েও নানান কিসিমের মতামত দেয়া হয়। ফেইস বুকের ইউপিডিএফ সমর্থকরা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে তারা ঐক্যের দরজা খুলে বসে আসে, কিন্তু জেএসএস ঐক্য করতে আগ্রহী নয়। কাজেই পাহাড়ের যে দ্বন্দ্ব সংঘাত জিইয়ে আছে তার জন্য জনসংহতি সমিতিই দায়ী। তাদের প্রচারণার ধরন দেখে মনে হয় দলটি একদম ধোয়া-তুলসী পাতা। গান্ধী কিংবা গৌতম বুদ্ধের মত তারা অহিংসার নতুন অবতার হিসেবে পার্বত্য রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছেন। তাদের এই স্ব-ঘোষিত অহিংস পন্থার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে পাহাড়ে হালানাগাদ কিছু শান্তিবাদীর পয়দা হয়েছে। এই নব্য শান্তিবাদীরা নিজেদেরকে সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবি পবিচয় দিতে অনেক ভালবাসেন। তাদের সবার মুখে একটাই রব, সেটা হচ্ছে পহাড়ের রাজনীতিতে সংঘাত বন্ধ করে সহ-অবস্থানের পরিবেশ তৈরী করা। তারা আবার এই দাবিটি উত্থাপন করেন জনসংহতি সমিতির নিকট। তারা এটাও বলে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা উদ্যোগ নিলেই পাহাড়ের রাজনৈতিক সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। অর্থাৎ প্রকারান্তরে এই ঐক্যের প্রবক্তারা এবং ইউপিডিএফ দলটির মধ্যে একটি মিল রয়েছে। সেটি হচ্ছে দুই মহলই বিশ্বাস করে জনসংহতি সমিতি এবং দলটির নেতা সন্তু লারমার উদ্যোগহীনতার কারণে পাহাড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। এই ঐক্যের ধ্বজাধারীদের কাছে কিছু বিষয় অবতারণা এবং তাদের দৃষ্টিগোচরের জন্য এই রচনা।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি সম্প্রতি ইউপিডিএফ নেতা অনিমেষ চাকমা সহ ৪জন নেতা কর্মী নিহত হওয়ার পর দলটি জনসংহতি সমিতির সাথে ঐক্যের বিষয়ে নানা প্রচারণা শুরু করেছে। কিন্তু যাদের সাথে তারা ঐক্য চায় তাদের কাছে অর্থাৎ জনসংহতি সমিতির কাছে তারা কোনরূপ আনুষ্ঠানিক ঐক্যের প্রস্তাব দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। যতদূর জানি ইউপিডিএফ-এর কাছ থেকে জনসংহতি সমিতি এই রকম কোনো প্রস্তাব পায়নি। তারপরও ইউপিডিএফ প্রচারণা চালাচ্ছে জনসংহতি সমিতি এবং দলটির নেতা সন্তু লারমার কারণে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেনা। আর অনিমেষ চাকমা নিহত হওয়ার পর কথিত শান্তিবাদীরা বলতে শুরু করেছে এইভাবে সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকলে, রক্তক্ষয় হতে থাকলে জুম্ম জনগণের জন্য সমূহ বিপদ। এই রক্তক্ষয় থামাতে হবে—-ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যখন ভোর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় বাসা ঘেরাও করে ২-৩ বছরের শিশু সন্তান ও স্ত্রীর সামনে নিরস্ত্র অভিলাষকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন এই শান্তিবাদীরা নিশ্চুপ থাকেন। যখন রাজস্থলী বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে একের পর এক পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নিরস্ত্র কর্মীদেরকে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন এই শান্তিবাদীরা আরও বেশী শান্তিতে দিনাতিপাত করছিলেন। তখন এই অহিংসবাদীদেরকে ইউপিডিএফ কিংবা দলটির প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসার কাছে সংঘর্ষ এবং রক্তপাত বন্ধের জন্য কোনরূপ আবেদন নিবেদন করতে শোনা যায়নি। ধারনা করা যায় সেই সময়ে জাতীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়না বরং সুদৃঢ় হয়। কাজেই যারা অনিমেষ চাকমা মারা যাওয়ার পর গেল গেল বলে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করছে, তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন থাকে অভিলাষ চাকমার মৃত্যুর পর আপনাদের জাতীয় চেতনা কেন কুম্ভকর্ণের মত অচেতন থাকে ?? আবার যখন ইউপিডিএফ আক্রান্ত হয় তখন মাঝে মাঝে আপনাদের ঘুম ভাঙতে দেখা যায়।

আসলে যখন ইউপিডিএফ আক্রান্ত হয়, তখন তাদেরকে বাঁচানোর জন্য একশ্রেণীর অহিংসবাদী কথিত বুদ্বিজীবীরা জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তারা জনসংহতি সংহতি সমিতিকে এই ফ্রন্ট্রে ব্যতিব্যস্ত রেখে ইউপিডিএফকে পুনরায় সংগঠিত হতে সাহায্য করেন। লক্ষ্যণীয় যদি জাতীয় ঐক্যই এই অহিংসবাদীদের কাংখিত হয় তাহলে তারা কেন ইউপিডিএফ এবং দলটির প্রধান প্রসিত খীসার কাছে সংঘাত-সংঘর্ষ অবসানের দাবী করেনা। তারা আবার নিজেদেরকে নিরপেক্ষ বলেও জাহির করে থাকেন। এই কথিত অহিংসবাদীরা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রচার চালায় ইউপিডিএফ-তো ঐক্য চায়, দলটি এখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে সুতরাং ঐক্যের বাঁধা অপসারিত হয়েছে। কথিত অহিংসবাদীরা এই রকম নানান সব গল্প বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। এরা জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করছে প্রসিত খীসা আর ইউপিডিএফ কত সাধু, যত দোষ হচ্ছে জনসংহতি সমিতি আর সন্তু লারমার। আমরা একই রকম প্রচারণা সরকারের কাছ থেকেও পরিলক্ষিত করি। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীবর্গও প্রায় বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে তারা খুবই আন্তরিক, কিন্তু সন্তু লারমা আর জনসংহতি সমিতি সহযোগিতা করছেনা সেই কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগুনো যাচ্ছেনা। যেন মনে হবে সরকার নয় চুক্তি বাস্তবায়নে জনসংহতি সমিতিই প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রেখেছে।

‘হিপোক্রেসি’-বলে একটা কথা বাজারে প্রচলিত আছে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই ‘হিপোক্রেট‘ হতে পারেন। ব্যক্তিগত ‘হিপোক্রেসি’ও ক্ষতিকর। তবে তা সমাজ জীবনে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পেলেনা। কিন্তু রাজনৈতিক হিপোক্রেসি খুবই বিপদজনক। তা সমাজ জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে, জন জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে। ইউপিডিএফ দলটি রাজনৈতিক হিপোক্রেসির এক অনন্য নিদর্শন। দলটি চুক্তি বাস্তবায়নে বিশ্বাস করেনা, কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী জানায়। সন্তু লারমাকে জাতীয় বেঈমান মনে করে, তাঁকে হত্যা করতে গাড়ি বহরে গুলি চালায়। আবার অন্যদিকে বলে, তারা সন্তু লারমার সাথে আলোচনায় বসতে চায়। জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস বা নির্মূল করতে না পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে ইউপিডিএফ বিশ্বাস করে। আবার তারাই প্রচার করে পাহাড়ের সংঘাত সংঘর্ষ অবসানে ইউপিডিএফ খুবই আন্তরিক। তাদের তাত্ত্বিক গুরু বদরউদ্দিন উমরের সাথে সুর মিলিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য ইউপিডিএফ দলটি দেশের বামপন্থীদের প্রায়ই গালমন্দ করে থাকে। কিন্তু জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন এলেই দলটি নির্বচানে অংশগ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। শুধু তা নয় দলটি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসমূহে ইউপিডিএফ ছাড়া অন্যদের অংশ নেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারা নিজেদেরকে মার্কসবাদী হিসেবে পরিচয় দেয়, আবার ধর্মীয়গুরুর চরণে সমর্পণ করার প্রতিযোগিতায়ও তারাই এগিয়ে থাকে। দলীয় বুলেটিনে তারা এমনভাবে সেনা সদস্যদের বকাবকি করে যেন মনে হবে দলটি পাহাড়ের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে। অথচ দলটির প্রধান প্রসিত খীসার সাথে সেনাকর্তাদের বৈঠকের অন্তরঙ্গ ছবির বিষয়টিও মানুষের কাছে গোপন থাকেনা। এই রকম এক হিপোক্রেট দলের সাথে সুর মিলিয়ে যারা অহিংসবাদ প্রচার করেন, নিরপেক্ষতার ভাব ধরেন তারাও হিপোক্রেট হবেন তাতে সন্দেহ থাকতে পারেনা। এই অহিংসবাদীদের প্রচারণা প্রোপাগাণ্ডার জবাবে বলতে হয় যদি সত্যিই পার্বত্য অঞ্চলের রাজনীতিতে ঐক্য চান তা হলে হিপোক্রেসী পরিত্যাগ করুন। জনসংহতি সমিতি দীর্ঘ ২যুগের অধিক সময় ধরে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অভিশপ্ত কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করেছে, জুম্ম জনগণের মধ্যে স্বাধীকারের চেতনা ও জাতীয়তার উন্মেষ ঘটিয়েছে। ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের সংগ্রামকে একটি উচ্চতায় আসীন করেছে। চুক্তি পরবর্তী সময়ে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনসহ জুম্ম জনগণের সকল প্রকার প্রতিরোধ সংগ্রামে জনসংহতি সমিতি নিষ্ঠার সাথে লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। কাজেই জনসংহতি সমিতি পাহাড়ের রাজনীতিতে অভিভাবকের মতই দায়িত্বশীল থাকবে তাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারেনা।
অনৈক্যের বীজ জনসংহতি সমিতি রোপণ করেনি। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে খাগড়াছড়ির দুদকছড়াতে জুম্ম জনগণের বিভিন্ন পেশাজীবি, ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী ও আদিবাসী বাঙালিসহ সর্বস্তরের জনগণের সাথে জেএসএস শীর্ষ নেতৃত্ব দফায় দফায় মতবিনিময় করেন। জনগণকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রেখে চুক্তি স্বাক্ষরের পথে জেএসএস অগ্রসর হয়। যে সামন্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জেএসএস প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিল, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তির প্রাক্কালে সেই সামন্তীয় সামাজিক নেতৃত্বকেও দলটি আস্থায় নিতে সক্ষম হয়। জেএসএস যখন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছিল, সেই সময় প্রসিত খীসা চুক্তি স্বাক্ষরকে সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ ও জুম্ম জনগণের সাথে বেঈমানি আখ্যা দিয়ে অনৈক্যের বীজ রোপণ করে। শুধু তাই নয় তখন প্রসিত খীসারা জনসমাগমের স্থান সমূহে প্রতীকি শ্মশান ও চিতা তৈরী করে সন্তু লারমা এবং জেএসএসকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করে। জনসংহতি সমিতির সদস্যদেরকে আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণের সময় কালো পতাকা প্রদর্শন এবং ট্রানজিস্ট ক্যাম্পে আসার সময় ঢিল ছোঁড়া, পিনন প্রদর্শন ইত্যাদি বৈরী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। চাকমাদের প্রচলিত সামাজিক নিয়মে ছেলেদেরকে মেয়েদের পরিধেয় পোশাক পিনন প্রদর্শন করা হলে সর্বোচ্চ অবমাননা হিসেবে দেখা হয়। এইভাবে প্রসিত খীসা জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাহড়ের রাজনীতিতে সহ-অবস্থানের সকল পরিবেশ নিজেই ধবংস করে সম্পূর্ণ বৈরী ও শত্র“ভাবাপন্ন পরিবেশ তৈরী করার ভিত রচনা করে। অবশ্য তারা এইগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ হিসেবে প্রচার করে থাকে। প্রতিবাদ করা, ভিন্নমত প্রকাশ করা আর আক্রোশ নিয়ে ঘৃণার উদ্রেক করা এই পার্থক্যটুকু যারা অনুধাবন করতে পারেননা তাদের দ্বারা আর যাই হোক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ডাক শোভা পায়না। অনবরত অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ চলতে থাকবে, আর প্রচার করা হবে ‘না না আমরাতো বন্ধুই হতে চায়—-’ এটাও এক ধরনের ছেলে খেলা। যারা এখনও সাবালক হয়ে উঠেনি, তাদের মুখে জাতীয় ঐক্যের বিষয়টাও আসলে শিশু বয়সের আবদার ছাড়া অন্য কিছু নয়।

ইউপিডিএফ-এই শিশুতোষ আবদারে অনেকের মন ভিজেও যায়। তাদের মনে উদয় হয়, এখনি জাতীয় ঐক্য তৈরী হবে। সন্তু লারমাকে ঐক্যের বিষয়ে রাজী করাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে বিষয়টি সন্তু লারমার রাজী হওয়ার বা না হওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টি হচ্ছে দায়িত্বশীলতা এবং সাবালক হয়ে পরিপূর্ণ মানুষের মত আচরণ করা। অনেকেই বলেন ইউপিডিএফ চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। অবশ্য দলটি এরও আগে অনেকবার এই ধরণের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কোনো সময় কোনো কালে দলটি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে শরীক ছিলনা। মহাজোট নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের প্রারম্ভে ইউপিডিএফ কর্তৃক চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়াটা একটা বড় রকমের রাজনৈতিক শঠতা বা কূটচাল ছাড়া কিছু নয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ৪দলীয় জোট সরকারের সময় ওযাদুদ ভুইঞা আর সম-অধিকারের সাথে ইউপিডিএফ-এর যে মাখামাখি ছিল, সেটা থেকে সরকারের দৃষ্টি অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া। ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুম্ম জনগণ যে অধিকার অর্জন করেছিল, সে অর্জনকে প্রত্যখান এবং বাতিলের দাবী জানিয়ে ইউপিডিএফ পাহাড়ের জনজীবনে যে বিভেদ ও হিংসার পরিবেশ তৈরী করেছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে অবশ্যই দলটিকে আনুষ্ঠানিক ভুল স্বীকার করতে হবে। চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জুম্ম জনগণের জাতীয় ঐক্যর মধ্যে কৃত্রিম বিভেদ সৃষ্টি করে শাসকগোষ্ঠীকে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার কাজে দলটি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। তাই ষড়যন্ত্র পরিহার করে ঐক্যের পথে আসতে চাইলে জুম্ম জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে ইউপিডিএফ’কেই। যদি দলটি তা করে তাহলে তাদেরকে কিছু রাজনৈতিক পরিভাষাও আয়ত্ব করতে হবে। শুধু শিশুদের মত আধাবোলে জাতীয় বেঈমান, খুনী, সরকারের দালাল, চুক্তি বাতিল ইত্যাদি শব্দগুলো আওড়িয়ে গেলেই দলটি চিরকাল নাবালকই থেকে যাবে। কে আগে কাকে মেরেছে এটা নিয়ে আলোচনা করা বা বায়না ধরা শিশুতোষ মনেরই পরিচয়। কারণ মারামারি, হানাহানি এইগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। যেমন জেএসএস নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে পূর্ণস্বায়ত্বশাসন অর্জিত হবেনা এই ভ্রান্ত ও বিনাশী কর্মসূচী দিয়ে কি আর সংঘাত সংঘর্ষ বন্ধ করা যায়?? অহিংসপন্থী কথিত নিরপেক্ষবাদীরা বিষয়টি ভাববেন কি??

আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারি চুক্তিকে সূচক ধরে জুম্ম জনগণ অনেক আগে থেকেই ঐক্যবদ্ধ। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এগিয়ে নিতে জুম্ম জনগণের মধ্যে ভিন্নমত থাকার কথা নয়। ইউপিডিএফ যদি অতীতের ভুল স্বীকার করে এই আন্দোলনে শরীক হতে চায় তা হলে তাদেরকে আন্দোলন থেকে বাদ দেয়া হবে এমনটা নিশ্চয় কেউ করবেনা।। তাই নতুন শান্তিবাদীরা যারা অনিমেষ চাকমার মৃত্যুর পর থেকে জাতীয় ঐক্য – জাতীয় ঐক্য বলে বাজারে হাঁক-ডাক ছাড়ছেন, তাদেরকে বলছি আপনাদেয় প্রিয় ভাইদের যেন আর রক্ত না ঝরে, যেন আপনারা শান্তিতে ঘুমাতে পারেন তার জন্য ইউপিডিএফ-কে বালখিল্যতা পরিহার করে সঠিক কক্ষপথে নিয়ে আসুন। জনসংহতি সমিতি বহু আগে থেকেই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি তৈরী করে রেখেছে। কাজেই আপনাদের কথিত যে প্রচারণা তার সম্পূর্ণ অসার এবং রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত। জনসংহতি সমিতি এবং দলটির নেতা সন্তু লারমা দায়িত্বশীলতার সাথে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এখন আপনাদেরই দায়িত্ব হিপোক্রেট থাকবেন, নাকি চিরকাল নাবালক থাকবেন. নাকি জুম্ম জনগণের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদ তৈরী করে, নিজেরাই আবার ঐক্য ঐক্য বলে গলা ফাটাবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনারাই দিবেন। বল আপনাদের কোর্টেই দিয়ে দিলাম।