বিভিন্ন জায়গা থেকে এই পর্বগুলো পোস্ট করছি। অনেক জায়গাতেই ইন্টারনেট সংযোগ নেই। কিছু বানান ও বাক্য সংগঠন জোরাল হতে পারত, কিন্তু গল্পের ধারাটা ধরে রাখতে পোস্টগুলি দিচ্ছি। পাঠক আশা করি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।

পূর্বের অধ্যায়গুলো

নওশাদ বলে, “গত বারো ঘন্টায় ঢাকা থেকে অনেক লোক উধাও হয়ে গেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে এরকম ঘটনার খবর আসছে। কিন্তু সব জায়গায় যে হচ্ছে সেরকম নয়। যা মনে হচ্ছে তাতে এশিয়ার কিছু অংশ ও দক্ষিণ আমেরিকায় এটা আপাততঃ সীমাবদ্ধ। আমাদের চিঠির মত অনেক চিঠি বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে গেছে, অনেক বিজ্ঞানীই লিখেছেন। জাতিসংঘে এখনই একটা জরুরী অধিবেশন হবে।”

“এই সব কটা ঘটনাই কি দীপ্তি আহমেদের মত উবে যাবার মত? এ বিষয়ে কি তুমি নিশ্চিত?”

“নিশ্চিত আমি এখনও নই। কিন্তু ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটবে ভেবেছিলাম সেভাবেই ঘটছে। অমল, তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, তোমার ফোনের ক্যামারাটা ঠিক কর।”

নওশাদ ফোন ছেড়ে দেয়। আমি ভেতরের ঘর থেকে কুঁই কুঁই শব্দ শুনি। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার পোষ্য কুকুর কানু ঐ ঘরে সকাল থেকে আটকে আছে। দরজা খুলে দিতেই কানু ছুটে এসে আমার হাত চাটে। তারপর ওপরে আমার মুখের দিকে তাকায়, ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। “কি রে, কানু, তোর আবার কি হল,” বলি আমি, “আমাকে যেন চিনতে পারছিস না!”

কানুকে প্রায় তিন বছর আগে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। দেশী দোঁ-আশলা বাদামী কুকুর, খুব খারাপ অবস্থা ছিল তার তখন, গত কয়েক বছরের যত্নে গায়ের লোম মসৃণ হয়েছে। কানুকে সকালের জল-খাবার দিই। তারপর ঘরের একদম মাঝখানে বসতে বলি। সে বাধ্য ছেলের মত বসে।

আমি বলি, “কানু, তুই কি বুঝিস কে জানে? মানুষের পৃথিবী আর কুকুরের পৃথিবী কি এক? তবু তুই তো আমাকে ঠিকই চিনিস, আমাকে দেখে খুশী হোস। অন্ততঃ কিছুটা হলেও তোর আমার মতের মিল আছে। নাকি?”

কানু ল্যাজ নাড়ায়। সামনের একটা পা আমার দিকে তুলে দেয়। আমি সেটা ধরে বলি, “শোন কানু, আমি কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ঠিক মত লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকিস।”

কথাটা বলতে বলতে মনে হয় এই ঘটনার প্রভাব প্রাণীজগতে আছে কিনা তা আমরা জানি না। যদি সত্যিই কোন অদৃশ্য তরঙ্গ মানুষের স্বজ্ঞার সঙ্গে বিক্রিয়া করে কুকুরের স্বজ্ঞার সঙ্গে তা কি বিক্রিয়া করতে পারে না? কুকুরের স্বজ্ঞা আমাদের থেকে কত ভিন্ন হতে পারে? কানুর কালো চোখের পিছনে তার মস্তিষ্কের নিউরনরা কি ধরনের চেতনা সৃষ্টি করে? কুকুরের চেতনা বানর-প্রজাতি জাতীয় প্রাণীর থেকে কতটুকু ভিন্ন? ইলেকট্রনের সংকেতে যে স্বজ্ঞার সৃষ্টি তা বাস্তবতাকে কতভাবে রূপ দেয়, স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস্তবতা সরীসৃপ থেকে কতখানি ভিন্ন? অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের যে সময় ধারা আমরা সৃষ্টি করি কানুর মত প্রাণীরা কি অন্তত কিছুটা হলেও কি সেই সময়-নদীর বহমানতা বুঝতে পারে?

এই সব ভাবতে ভাবতে মনে হয় গত বছর কুড়ি ধরে আমার কাছে পাঁচ-ছ’খানা ভিডিও ক্যাম জাতীয় ক্যামেরা জমেছে। ক্যামেরাগুলো দিয়ে প্রতিটি ঘর (দুটি ঘর, একটি রান্নাঘর, একটি বাথরুম) দেখা সম্ভব। অন্ততঃ রেকর্ড করা সম্ভব। আমি বা কানু যদি এই জগৎ থেকে অপসৃত হতে থাকি, তবে সেই প্রক্রিয়াটা নিশ্চয় ঐ ক্যামেরার ছবিগুলোতে উঠবে। আমি হারিয়ে গেলেও সেই ক্যামেরার ছবি দেখে কেউ বুঝতে পারবে অদৃশ্য হওয়াটা কি তাৎক্ষণিক নাকি কয়েক সেকেন্ডের প্রক্রিয়া। কিন্তু রেকর্ডকৃত ঘটনা আর সরাসরি পর্যবেক্ষণের মধ্যে কি তফাৎ? রেকর্ড হওয়া মানেই কি সম্যক অবলোকন নয়? কাজেই ভিডিও ক্যামেরার ছবি তোলার সময় কাউকে বসে দেখতে হবে না, যতক্ষণ সেটা রেকর্ড হবে ততক্ষণ সেটাকে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য বলেই ধরে নিতে হবে। আমি শুনেছি দুই সমান্তরাল ফাটল নিয়ে বিলম্বিত সিদ্ধান্ত নামক যে পরীক্ষা আছে তাতে ফোটন, ভবিষ্যতে পরীক্ষক যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যবহার করে। যদি সত্যিই কোন তরঙ্গ আমাদের সাথে বিক্রিয়া করছে তবে সেই তরঙ্গ ভবিষ্যতে কি হচ্ছে তা দেখতে পাবে। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে ক্যামকর্ডারে রেকর্ড হবার সময় কেউ অদৃশ্য হবে না। সেই তরঙ্গ দেখবে ভবিষ্যতে একজন পর্যবেক্ষক মানুষের উবে যাবার ঘটনাটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে। তাই ঐ তরঙ্গ (বা অন্যকিছু) মানুষের সাথে বিক্রিয়া করবে না। আমরা যদি সবসময় নিজেদের রেকর্ড করতে পারি তাহলে কি এই ভয়াবহ অদৃশ্যকরণ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচা যাবে?

আমি দ্রুত প্রতিটি ঘরের ছাদের কোণায় ক্যামেরা লাগাই। তারগুলো সব বসার ঘরের কম্পিউটারে যুক্ত করি, সেখানেই সব কটা ক্যামেরার চিত্র রেকর্ড করা হবে।

এর মধ্যেই আবার নওশাদের ফোন আসে।

নওশাদের মুখ উদ্বিগ্ন, “অমল, তুমি ঠিক আছ তো?”

“তুমি কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“আমি এখন অফিসে।” নওশাদের অফিস মহাবিশ্ব স্টেশনের কাছেই, “অমল তোমাকে এখনও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না।”

“ফোনের ক্যামেরাটা ঠিকমত কাজ করছে না বোধহয়। আগে নতুন কি খবর আছে বল, তারপর তোমাকে আমার একটা আইডিয়ার কথা বলব।”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে, অমল। গত ১২ ঘন্টায় মনে হচ্ছে ঢাকা থেকে কয়েক জন লোক অদৃশ্য হয়েছে। অন্ততঃ হারিয়ে গেছে। কে আসলেই অদৃশ্য হয়েছে আর কে হয় নি সেটা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তোমার বাসা থেকে মহাবিশ্ব স্টেশন পর্যন্ত একটা সরলরেখা টানলে সেই রেখার তিনটি বিন্দু থেকে তিনজন হারিয়েছে। আমি জানি না এখন তোমার বাসা থেকে বার হওয়া নিরাপদ কিনা।”

আমার মনে হয় নওশাদ আরো যেন কি বলতে চাচ্ছে, কিন্তু ইতঃস্তত করছে। আমি মুখ ভঙ্গী করে ও হাত নেড়ে নওশাদকে কথা বলতে উৎসাহিত করি।

“অমল, আমি জানি না কি হচ্ছে, কিন্তু সরকার তাদের সমালোচনাকারীদের জেলে ঢোকাচ্ছে।”

“আজকে? এখন কেন?”

“আমাদের ইমেইল লিস্টে কয়েকজন মন্ত্রীর নাম ছিল।”

“ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে জেলের সম্পর্ক কি?” আমি বলি।

“ভয়াবহ সম্পর্ক, অমল। আমার সূত্র বলছে সরকারী অপছন্দের লোকদের একক ভাবে আলাদা আলাদা কামরায় রাখা হচ্ছে। সেখানে তাদের দেখার জন্য কেউ থাকছে না। দু-একদিনের মধ্যে তারা যদি উধাও হয়ে যায় তবে কারুর কিছু বলার নেই, এটা এক প্রাকৃতিক ঘটনা, সরকারের কোন দায়-দায়িত্ব নেই।”

আমার রক্ত হিম হয়ে আসে, কিন্তু কপালে ঘাম ফোটে। ফোনের স্ক্রিনটা যেন ঝাপসা হয়ে।

আমি বলি, “কিন্তু কর্তৃপক্ষ এত তাড়াতাড়ি এই ঘটনার প্রকৃত রূপ ধরতে পারল কেমন করে? আমাদের চিঠি থেকে?”

“বোধহয়, তাই তোমাকে বলছিলাম, আমাদের চিঠি অন্ততঃ দুজন মন্ত্রীর কাছে গিয়েছে। তারা এটা নিয়ে আলোচনা করেছে, মনে হয় তাদের নেতারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে।”

“কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা সমগ্র মানব সমাজের জন্য বিপদের সময়, সেই সময় ক্ষুদ্র পার্টি চিন্তা কেমন করে আসে? আগামীকাল আমরা কেউই হয়তো থাকব না।”

“সেটুকু বুঝলে কি দেশের এই দশা হয়? চিঠিটা পাঠানোর আগে আমাদের হয়তো আর একটু ভাবা উচিত ছিল। অর্বাচীন মানুষের হাতে এ এক ভয়ানক অস্ত্র।”

নওশাদ হাসে, কিন্তু সাথে সাথে ফোনের স্ক্রিনটা ঝাপসা হয়ে ওঠে।

“শোন নওশাদ,” নওশাদকে আমার ভিডিও সিস্টেমের কথা বলতে চাই, কিন্তু নওশাদের মুখ হারিয়ে যেতে থাকে, এক সেকেন্ড পরে লাইন কেটে যায়। আমি চেষ্টা করি লাইনটা ফিরে পেতে, মাইক্রোফোনে চিৎকার করি, “নওশাদ, নওশাদ,” কিন্তু লাইন পাই না। নওশাদের লাইন কি কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ করছে? অথবা আমার লাইন? কিন্তু ইন্টারেনেট ইত্যাদি দেখে তো মনে হয় সামগ্রিক ভাবে সার্ভিস চালু আছে। আমি লাইন পরীক্ষা করতে নমিতাকে ফোন করি। নমিতা ফোন ধরে। দেখলাম সে কাজে যাবার জন্য তৈরি।

“কাজে যাচ্ছেন?” প্রশ্ন করি আমি।

“হ্যাঁ, কেন বলুন তো?” নমিতা বলে।

“আজ কাজে যাবেন না।”

“আপনার হুকুম নাকি?”

“গতকাল দীপ্তি রহমানের অদৃশ্য হবার ঘটনা জানেন তো?”

“বাঃ বাঃ, কি ভয়ানক ব্যাপার। খুব রহস্যজনক বলতে হবে।”

“খুবই রহস্যজনক,” আমি সায় দিই। তারপর বলি, “শুনুন, নমিতা, সব কিছু খুলে এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আপনার বাড়িতে সবাই আছে তো?”

“সবাই আছে।”

“তাহলে আজ সবাই মিলে বাড়িতে বনভোজন করুন।”

“আর আমার জন্য কাজে যারা বসে আছে?”

“তাদের ফোন করে দিন। আমি ঠাট্টা করছি না। আমি নিজে বের হচ্ছি না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। অমল, আপনাকে ফোনে দেখা যাচ্ছে না কেন? ক্যমারাটা ঠিক করে নিন।”

“আচ্ছা,” বলে আমি দ্রুত ফোন ছেড়ে দিই। নওশাদকে আবার ফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার লাইন পাওয়া যায় না।

নওশাদকে ইমেইল করার চেষ্টা করি। কিন্তু ততক্ষণে ইন্টারনেট লাইনও কাজ করছিল না। টেলিভিশনটা খুলি। প্রতিটি চ্যানেলেই ঝিরিঝিরি রঙ্গীন বিন্দু, কোন চ্যানেলই কাজ করছে না। আমার টেলিভিশনের ক্যাবল সংযোগ স্থানীয়। সেখানে মাঝে মধ্যেই ঝামেলা হয়। আজ কি সেখানে কেউ কাজে আসে নি? হঠাৎ একসাথে কি শুরু হল? গরমটা যেন আরো চেপে বসছে। ঘামে আমার জামা পুরো ভিজে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে উষ্ণায়ণ? উষ্ণায়ণ কি ঠেকানো যাবে?

আমি উঠে সব ক্যামেরায় ঠিক মত ছবি রেকর্ড হচ্ছে কিনা সেটা দেখি। কানু রাস্তার পাশে জানালায় গিয়ে ঘেউ ঘেউ করে। এতক্ষণে আমার খেয়াল হয়। অন্যদিন সকাল থেকে সামনের রাস্তায় শব্দে টেঁকাই দায়। কোটি কোটি মানুষের ভীড়ে শহরের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অথচ আজ সকাল থেকে কোন গাড়ির হর্ন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। জানালার কাছে গিয়ে দেখি রাস্তায় কেউ নেই। হরতালের দিনের মত। সামনে একটা মুদির দোকান আছে, সেটা সকাল আটটা থেকে খুলে যায়। এখন দশটা বাজে। অথচ দোকান এখনও খোলে নি। সূর্য অনেক খানি উঠে এসেছে, তার আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। হঠাৎ একটি ছেলেকে দৌড়ে চলে যেতে দেখি। তার পেছনে একটি মেয়ে জোরে হেঁটে যায়। ব্যস, রাস্তায় আর কেউ যায় না।

কাকাদের ফোন করার চেষ্টা করি। লাইন পাই না। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন ফারহানা ও আনিস। দুজনেই চাকুরীজীবী। সকাল সকাল বেড়িয়ে যায় দুজনেই। আমি ভাবি একটু খবর নিই। কিন্তু সদর দরজার বাইরে কোন ভিডিও ক্যামেরা নেই। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাকে একটা সুযোগ নিতে হবে। আমি দরজা খুলে পাশে ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা দিই। ওপাশ থেকে ফারহানার গলা শোনা যায়, “কে?”

“আমি অমল, আপনারা ঠিক আছেন তো?”

“হ্যাঁ,” বলে ফারহানা। কিন্তু দরজা খোলে না। আমার মনে হয় তার চোখ দরজার ওপর লেন্স-লাগানো ছোট ফুটোটা দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি আরো সেকেন্ড দশেক অপেক্ষা করি, কিন্ত ফারহানা দরজা খুলল না। আমি ফারহানা ও আনিসের খুব ঘনিষ্ঠ লোক না হলেও প্রতিবেশী হিসেবে সুপ্রভাত ইত্যাদি সৌজন্য রীতি আমাদের মধ্যে বহাল ছিল। একবার কোন কারণে তাদের বাসার ভেতরও গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন ফারহানার ব্যবহার আমার কাছে অদ্ভুত মনে হল। সে আমাকে জিজ্ঞেসও করল না আমি কেন তারা ঠিক আছে কিনা জানতে এসেছি।

আমি আমার ফ্ল্যাটে ফিরে আসলাম। ঘরে ঢোকা মাত্র বিদ্যুৎ চলে গেল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ক্যামকর্ডারগুলো বিদ্যুতের লাইনে লাগানো, তবে বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাটারী ব্যাবহার করে। তবে ব্যাটারীই বা কতক্ষণ চলবে? বিদ্যুৎ চলে গেলে নিচে জেনেরেটর আপনা-আপনি চালু হয়ে যাবার কথা। সেটা না হলে ম্যানাজার আছে।

দশ মিনিট কেটে গেল। জেনেরেটর চালু হল না। নিচে যেয়ে কি হচ্ছে দেখে ওপরে উঠতে উঠতে অন্ততঃ পাঁচ মিনিট লাগবে। হঠাৎ মনে হল ছোট ক্যামারাটার ভিডিও মোড চালু করে এক হাতে ক্যামারাটা মুখের দিকে তাক করে হাঁটা যেতে পারে। ভাবলাম ইংরেজীতে একে ডাইনামিক সেলফ-অবজার্ভেশন নাম দেয়া যায়। অথবা কাইনেটিক, নাকি? বাংলায় গতিময় আত্ম-পর্যবেক্ষণ। নিজের ছেলেমানুষীতে হাসলাম। ওদিকে কানু অস্থির হয়ে পাইচারি করে। আমি বললাম, “আমি নিচে যাচ্ছি। এক জায়গায় চুপ করে বসে থাক।” কানুকে দেখিয়ে দিই কোথায় বসে থাকতে হবে। সেখানে সে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে।

ষষ্ঠ অধ্যায়

ক্যামেরাতে নিজের ছবি তুলতে তুলতে নিচে নামি। প্রতিদিন এই সময় হৈ হট্টগোলে টেঁকা দায়। কিন্তু আজ কেমন যেন এক অস্থির নিরবতা বাড়িটাকে গ্রাস করে আছে। আমার ফ্ল্যাট তিন তলায়। সিঁড়ির দেয়ালটায় রঙ পড়ে নি বহুদিন, তাতে মাঝে মধ্যে কালো রঙ্গে বাচ্চারা আবার আঁকিবুকি করে রেখেছে। আমি দোতলায় যেয়ে আধ মিনিট দাঁড়াই। দুদিকের ফ্ল্যাট দুটো থেকে কি কোন আওয়াজ আসছে? না, কোন শব্দ নেই, ওরা কি আমাকে দরজার ফুটো দিয়ে দেখছে? দেখলেও আমি কিছু টের পাই না। আমি “হ্যালো” বলতে গিয়ে থেমে যাই। নিচে নেমে আসি। ম্যানেজার নেই। মাঝে মধ্যে একজন দারোয়ান দেখি, তাকেও দেখলাম না। এরা থাকবে না বলেই আশঙ্কা করছিলাম। জেনারেটরের ঘরের দরজা খোলা। আমি ঢুকে দেখি একটা দেয়ালে বোতামের প্যানেল, তাতে “চালু” ও “বন্ধ” নামে দুটো লাল ও কালো বোতাম আছে। আমি লাল বোতামটায় চাপ দিই। সাথে সাথে ঘট ঘট শব্দ করে জেনেরেটর জেগে ওঠে। প্রাথমিকভাবে কিছুটা ধোঁয়া বের হয়। আমি পরীক্ষা করার জন্য ঘরের বাতিটা জ্বালাই। ঐ ঘর থেকে বেড়িয়ে আসি।

একটা গ্রিলের দরজা খুলে রাস্তায় বার হতে হয়। দরজায় সাধারণতঃ তালা ঝোলে। আমাদের কাছে চাবি আছে। দেখলাম তালাটা নেই। গ্রিলের কাছে এসে রাস্তায় উঁকি দিলাম। কেউ নেই। কিন্তু যেই আমি পিছন ফিরলাম মনে হল কে যেন দৌড়ে গেল রাস্তায়। চমকে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখলাম একটি লোকের পিছন দিক। দ্রুত গ্রিলটা টান দিয়ে সড়িয়ে রাস্তায় নামলাম। কিন্তু মানুষটা ততক্ষণে যেন হাওয়ায় উবে গেছে। পূব-পশ্চিমে চলে গেছে রাস্তা, এর মধ্যে অনেক গলি এসে পড়েছে, কিন্তু পরের গলিটা পর্যন্ত যাবার সময় সেই লোকের পাবার কথা নয়। কিন্তু তার থেকে বড় কথা এই ছোট গলি-ঘুঁজির পাড়ায় কম করে হলেও কয়েক লাখ লোক বাস করে, তারা কোথায় গেল? আমি ভাল করে, চোখ কুঁচকে দূরে দেখার চেষ্টা করি। অনেক দূরে রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে মনে হল মানুষজন হাঁটছে। গাড়ি চলছে। সত্যিই কি তাই? সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো দূরের দৃশ্যটাকে একটা বিচ্ছুরিত আবরণে ঢেকে রেখে দেয়। আমার মতিভ্রম হচ্ছে না তো? আর তখনই খেয়াল হল আমি গ্রিলের দরজা খোলার সময় ক্যামেরাটা পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। এতক্ষণে যে আমি উবে যাই নি এই ভাল। ক্যামেরাটা দ্রুত পকেট থেকে বার করে আবার চালু করি।

রাস্তার মাঝে একা দাঁড়িয়ে আমার মনে হয় দুপাশের প্রতিটি বাড়ির লোক জানালা দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি মাথা তুলে তাদের দেখতে চাই, কিন্তু কাউকে দেখি না। আমার কপাল থেকে ঘাম চুঁইয়ে চোখের ওপর পড়ে। চোখ জ্বালা করে। আমি একটু স্থির হয়ে শুনতে চাই অন্য বাড়ির জেনেরেটরের আওয়াজ। অন্য জেনেরেটরের শব্দ কি শোনা যাচ্ছে? শুধু আমার বাসারটার শব্দ শুনি। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি না। কোথাও থেকে যেন একটা গান ভেসে আসে। পরিচিত গান। আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে? তিন তলায় কানুর ঘেউ ঘেউ ডাক শুনি। কানু কি কিছু দেখেছে? আমি গ্রিলের দরজা পার হয়ে আবার ভেতরে ঢুকি।

চলবে…৬ষ্ঠ পর্ব