১ম পর্ব / ২য় পর্ব / ৩য় পর্ব

মুক্তমনাতে ইতোপুর্বে কোরানিক বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক লেখা-লেখি হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে ইসলামী পন্ডিতদের মিথ্যাচার। শুধু কোরান নয়, অন্যান্য ধর্মবাদীরাও এপ্রসংগে কম যান না। কোরান নিয়ে পড়া-শোনা করে এযাবৎ কেউ ডাক্তার, প্রকৌশলী কিংবা বৈজ্ঞানিক হতে পারে নি এবং তা সম্ভবও না। বড়জোর, ফতোয়াবাজ মোল্লা হওয়া যায়। আবার কিছু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কোরান রিসার্চ করে চলছেন কোরানে বিজ্ঞান খুঁজার জন্য। মজার বিষয় হচ্ছে, কোরান পড়ে ডাক্তার হতে না পারলে কি হবে, তারা ঠিকই কোরানে চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি খুঁজে বের করে ফেলছেন। কোরানে যদি এতই বিজ্ঞান পেয়ে থাকেন, তাহলে হাতের কাছে কোরান ফেলে শিক্ষাঙ্গনে বিজ্ঞান শিখতে যাওয়ার অর্থ কি? কোরানবাদীরা কেন সক্ষম হলেন না কোরানের সূত্র ধরে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে? মুক্তমনার লেখকদের বিভিন্ন আলোচনায় এসব প্রশ্নগুলো বার বার উঠে এসেছে। আমার এই প্রয়াশটাও নতুন কিছু না। বলতে পারেন, সংযোজন মাত্র।

বর্তমান ইসলামী দুনিয়ায় একটা নামকে রীতিমত কিম্বদন্তিতে পরিনত করা হচ্ছে। তিনি হচ্ছেন ডঃ জাকির নায়েক। কোন মুমিন বান্দার সাথে যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় প্রায় সময় একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আপনি কি জাকির নায়েকের লেকচার শুনেছেন? বুঝাই যাচ্ছে জাকির নায়েক যেন বতর্মান মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নূহ (আঃ) এর নৌকা। যেন তাদেরকে উদ্ধার করেছেন। অথচ এই ব্লগেই জাকির নায়েক এর বক্তব্যকে খন্ডন করে অনেক লেখা আছে। প্রথমে আসা যাক, মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে কোরানে কি বলা হয়েছে। কোন জায়গায় বলেছেন মানুষকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন কখনো বা বলেছেন পানি থেকে। নিচের আয়াতগুলো দেখা যাকঃ

(৬:২) তিনিই তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করিয়াছেন (আংশিক)।
(৩৭:১১) উহাদের আমি সৃষ্টি করিয়াছি আঠাল মৃত্তিকা হইতে (আংশিক)।
(৫৫:১৪) মানুষকে তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন পোড়া মাটির মত শুষ্ক মৃত্তিকা হইতে ।
(২২:৫) আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি মৃত্তিকা হইতে (আংশিক)।
(২৩:১২) আমি মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি মৃত্তিকার উপাদান হইতে (আংশিক)
(৩২:৭) --কর্দম হইতে মানব সৃষ্টির সূচনা করিয়াছেন।
(৪০:৬৭) তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে (আংশিক)


আমরা সবাই খুব ভাল করে জানি যে, মানুষ নামক প্রাণিটি সরাসরি পুর্ণাঙ্গ মানুষের আকারে সৃষ্টি হয়নি। এটি জীব বিবর্তনের ফল। মাটি, পোড়া মাটি, আঠাল মাটি, শুষ্ক মাটি ইত্যাদি দ্বারা মাটির পুতুল বানানো সম্ভব। তৎকালীন আরবে মুর্তি পূজার প্রচলন ছিল যা, তারা নিজেরাই তৈরী করত। পরে তা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়। মুহাম্মদের ধারনা আল্লাহও হয়ত মাটি দিয়ে আদমের মুর্তি তৈরী করেছেন। সৃষ্টিকর্তার বিশিষ্টতা প্রমানের জন্য বা অন্য কোন কারনে মুহাম্মদ মাটির মুর্তিতে আত্মা ঢুকিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি যুক্ত করেন। এব্যাপারে ৩২:৭-৯ আয়াতে বলা হয়েছে, উহাতে ফুঁকিয়া দিয়াছেন তাঁহার রূহ হইতে। বুঝাই যাচ্ছে এই আয়াতগুলো এসেছে মুহাম্মদের কমন সেন্স থেকে তিনি যতটুকু ধারনা করতে পেরেছেন তা থেকে। কোন বৈজ্ঞানিক চেতনা বা বিশ্লেষন থেকে নয়।

আবার একই বিষয়ে ভিন্ন জায়গায় আল্লাহ কি বলেছেনঃ

৭৭:২০-২২ আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি হইতে সৃষ্টি করি নাই? অতঃপর আমি উহা রাখিয়াছি নিরাপদ আধারে, এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত।
২৫:৫৪ তিনি মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন পানি হইতে, অতঃপর তিনি তাহার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছেন (আংশিক)।
৫৬:৫৮-৫৯ তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ তোমাদের বীয্যর্পাত সম্বন্ধে? উহা কি তোমরা সৃষ্টি কর, না আমি সৃষ্টি করি?
২১:৩০ এবং প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিলাম পানি হইতে (আংশিক)।

এব্যাপারে জাকির নায়েকের যুক্তি হচ্ছে, জীব কোষের সাইটোপ্লাজম যাতে শতকরা ৮০ ভাগ পানি থাকে। জীবের গঠনে শতকরা ৫০-৯০ ভাগ পানি এবং প্রত্যেক জীবের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পানি অপরিহার্য। প্রত্যেক প্রাণী যে পানি থেকে সৃষ্টি তা ১৪ শতাব্দি পূর্বে কোন মানুষের পক্ষে কী অনুমান করা সম্ভবপর ছিল?

একটি জীব কোষের ৮০ ভাগ সাইটোপ্লাজম থাকলেই কি আমরা বলতে পারি সাইটোপ্লাজম বা পানি থেকে জীব সৃষ্টি হয়েছে? সাইটোপ্লাজম কি কোষ গঠনের মূল উপাদান? পানি থেকে যে জীব সৃষ্টির কথা বলেছেন আর জাকির নায়েকের দাবী ১৪ শতাব্দির পূর্বে কেউ এরকম বলেন নি। কিন্তু আল্লাহ বলার প্রায় বার শত বছর পূর্বে দর্শনশাস্ত্রের প্রথম প্রবর্তক ও আদি জনক আইওনীয় দার্শনিক থেলিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪-৫৫০ অব্দ) বলেছিলেন, পানিই সৃষ্টির মূল উপাদান, বস্তুর উৎপত্তি, উৎস, দ্রব্যের মূল ও আদি উপাদান। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোরানে আল্লাহ পানি থেকে জীব তথা মানুষ সৃষ্টির বিষয়টি নতুন বলেননি। যদিও কোরানের পানি তত্বের মত এই তত্বটিরও বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। কারণ, প্রাণ উৎপত্তির জন্য সাইটোপ্লাজমই একমাত্র বা আদি কারণ নয়। পানি বা তুচ্ছ পানি বা তরল পদার্থের নির্যাস বা বীর্য যাই বলেন, মুহাম্মদ মনে করেছিলেন যেহেতু পুরুষের বীর্য যোনি পথ দিয়ে প্রবেশের মধ্যদিয়ে গর্ভধারণ ঘটে (অন্তত তাই দৃশ্যমান) সেহেতু এটিই মানুষ সৃষ্টির মূল কারণ। আর এটুকু বুঝার জন্য কাউকে বৈজ্ঞানিক হওয়া লাগে না। জীবনে বিজ্ঞান না পড়া যে কোন মানুষরাই তাই মনে করে। আর দেখুন এটা বলতে পেরে কিনা মুহাম্মদ বা আল্লাহ রীতিমত বৈজ্ঞানিক হয়ে গেলেন। এই পানি প্রসংগে কোরানের ৩২:৮ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ

অতঃপর তিনি তাহার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ পানির (তরল পদার্থের) নির্যাস হইতে।

এ আয়াতের ব্যাখ্যা কি রকম হবে? সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে ব্যাখ্যা করলে আয়াতটির অর্থ বের করা সম্ভব। তুচ্ছ পানি বলতে ধরে নিলাম পুরুষের বীর্য যা নির্গত হবার পর দেখা যায় স্ত্রী যোনি থেকে বেশির ভাগ পরিমানে বেরিয়ে আসে। তারপরও সন্তান ধারণ সম্ভব হয়। তাতে বুঝা যায় সন্তান ধারণে প্রয়োজনীয় অংশটুকু ঠিকই মাতৃগর্ভে থেকে যাচ্ছে। যাকে কিনা কোরানে নির্যাস বলা হয়েছে। তাছাড়া নির্যাস বলে রস বা সার বুঝায়। অর্থাৎ বীর্যের ঐ প্রয়োজনীয় অংশটুকু যা থেকে গর্ভধারণ হয়। এটি সাধারণ পর্যবেক্ষণের সাধারণ জ্ঞান বা ধারণা। কোরানের এ আয়াতটিতে ঠিক তাই বুঝা যাচ্ছে। এইটুকু বুঝতে বিজ্ঞানের কখনোই প্রয়োজন ছিলনা। বিজ্ঞান প্রয়োজন মিলিয়ন শুক্রানু হতে একটি মাত্র শুক্রানু এবং হাজার হাজার ডিম্বানু থেকে একটি ডিম্বানু নিষিক্ত হবার প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট নীরিক্ষা এবং প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা। বিজ্ঞান তাই করেছে। সাথে সাথে জাকির নায়েকরা কিনা দেখতে পেলেন নির্যাস বলতে এই একটি মাত্র শুক্রানু কিংবা ডিম্বানুকে বুঝাচ্ছেন। এ আয়াতের কোথায় উল্লেখ অাছে যে, পুরুষের কয়েক মিলিয়ন শুক্রানু আর নারীর দশ হাজার ডিম্বানুর কথা এবং একটি শুক্রানু ও একটি ডিম্বানু নিষিক্ত হবার ঘটনায় একটি সন্তানের ভ্রুণ জন্মের কথা? বিজ্ঞান কি তরল পদার্থের নির্যাস বলে দায় এড়াতে পেরেছে? কোরান যদি বিজ্ঞান হয়ে থাকে তাহলে কোরান কিভাবে তা পারল? এই আয়াতের জন্য আমার ঐ অবৈজ্ঞানিক সাধারণ ব্যাখ্যাটিই বেশি প্রযোজ্য নয় কি? আজকের এই সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভাষাটি কি সে সময় আল্লাহর জানা ছিল না? শুক্রানু বা ডিম্বানুর সংখ্যা নির্ণয় করতে তিনি অক্ষম বলেই কি নির্যাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন?

যদি প্রশ্ন করা হয় কোথা থেকে মানুষের সৃষ্টি (যদিও সৃষ্টি শব্দটি এখানে যুক্তিযুক্ত নয়)? কারো পক্ষেই এককথায় এর উত্তর প্রদান করা সম্ভব নয়। এই প্রশ্নে যদি উপাদানকে ইঙ্গিত করা হয় তাহলেও অসম্ভব। কারন একটি মাত্র উপাদান দ্বারা আমাদের দেহ গঠিত নয়। নির্দিষ্ট একটা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে এটি ঘটে থাকে যা সংক্ষেপে বলতে গেলেও একটি বড়সড় ব্যাখ্যার প্রয়োজন। মায়ের জরায়ুতে মেসিউর ওভামটি ফার্টিলাইজ্ড হবার পর থেকে তা ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুরুপে পরিনত হবার প্রক্রিয়াকে শুধুমাত্র একটি কারণ বা শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। অন্ততঃ বিজ্ঞান এধরনের দৃষ্টতা দেখায়নি। কেউ যদি বলে মানুষ জমাট রক্ত (বা জোঁক) বা মাটি বা পানি থেকে তৈরী তাহলে কি ভ্রুণতত্ব বা এম্ব্রিউলজীকে সমর্থন করা হয়? ভ্রুণতত্বের কোথাও কি এই শব্দগুলোকে কারণ বা উপাদান হিসাবে দেখানো হয়েছে? না। কোরানে আল্লাহ নিচের আয়াতগুলোতে মানুষকে তিনি জমাট রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন বলে দাবী করেছেন। তাহলে দেখা যাক আয়াতগুলোঃ

(২২:৫) আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি -------তাহার পর আলাক হইতে, (আংশিক)।
(২৩:১৪) অতঃপর অামি উহাকে শুক্রবিন্দুকে পরিনত করি আলাক-এ, অতঃপর আলাক্কে পরিনত করি পিন্ডে এবং(আংশিক)।
(৪০:৬৭) তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে, পরে শুক্রবিন্দু হইতে, তারপর আলাকা হইতে, তারপর তোমাদেরকে বাহির করেন শিশুরুপে (আংশিক)।
(৯৬:২) সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত (আলাক) থেকে।

লক্ষ্যণীয় কোরান স্পষ্টভাবে মানুষ সৃষ্টির জন্য মাটি, পানি এবং জমাট রক্তের কথা বলেছে। আল্লাহ এধরনের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? মুহাম্মদের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে এ্যারিস্টটল মানব প্রজনন সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন যে মহিলাদের রজঃস্রাবের রক্তের উপর পূরুষের বীর্যের ক্রিয়ার ফলে মাতৃগর্ভে শিশুর জন্ম হয়। তখন দুনিয়া জুড়ে এ্যারিস্টটলের মতবাদ সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করত। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় কোরানের জমাট রক্তের উপাখ্যানটি এ্যারিস্টটলের কাছ থেকে ধার করা, যা পরে ভ্রান্ত ধারনা হিসাবে বাতিল হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া অনেক সময় গর্ভধারণের কয়েকমাস পরে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়ে ভ্রুণ নষ্ট হতে দেখা যায়। তা থেকেও মুহাম্মদের ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, আসলে মাতৃগর্ভে জমাট বেধে থাকা রক্ত থেকে বুঝি মানুষ সৃষ্টি। মাতৃগর্ভে সব যদি রক্তই না হত তাহলে এত রক্ত আসে কোথা থেকে? বাস কোরানে ওহী হিসাবে যুক্ত হয়ে গেল। তর্কের খাতিরেও যদি বলতে হয় তাহলেও, প্রাণ রাসায়নিক ব্যাখ্যায় রক্তের জমাট বাধার যে প্রক্রিয়া বা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তাতে ভ্রুণ বৃদ্ধির কোন পর্যায়ের সাথেই এর মিল নেই। ভ্রুণ কি? জমাট রক্ত কি? এই দুই প্রশ্নের উত্তর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় গঠন, প্রক্রিয়া বা উপাদানগত দিক দিয়ে ভ্রুণ কখনোই জমাট রক্ত নয়।

সে জন্যই বোধয় জাকির নায়েক আলাক্ব শব্দের অর্থ করতে গিয়ে জমাট রক্ত দিয়ে বিজ্ঞান প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি। আয়াতের অনুবাদে আলাক্ব শব্দের অর্থ জমাট রক্ত বললেও তিনি কৌশলে আলাক্ব শব্দের অর্থ করেছেন এই ভাবেঃ

আরবী শব্দ আলাক্ব এর অর্থ জমাট রক্ত ছাড়াও আরেকটি অর্থ রয়েছে, তা হল, জোঁকের মত এক প্রকার বস্তু যা দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে।

উনার কথা হচ্ছে, বস্তুটা জোঁক না কিন্তু জোঁকের মত। যা আল্লাহও নাম জানেন না হয়ত। আলাক্ব শব্দের অর্থ কখনোই সরাসরি ভ্রুণ করা যাচ্ছে না বলেই এত অপকৌশলের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রায় সব কোরানের বাংলা অনুবাদেই আলাক্ব শব্দটিকে আলাক্ব বা জমাট রক্তই লেখা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে অভিধানগুলোতে আলাক্ব শব্দের অর্থ পেয়েছি জমাট রক্ত এবং জোঁক। সুতরাং আল্লাহর এই আয়াতটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কারন, জোঁক বা জমাট রক্ত থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তা নিতান্তই হাস্যকর। অথচ জাকির নায়েকরা বিজ্ঞান প্রমানের জন্য কোরানের অর্থ পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছেন। জোঁককে বানিয়েছেন জোঁকের মত বস্তু। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান তো আর পরিবর্তন করা যায় না। তাছাড়া কেবলমাত্র জোঁকের মত বা আটকে থাকলেই ভ্রুণ হয় না। ভ্রুণে সুনির্দিষ্ট গঠন, বৈশিষ্ট, উপাদান ইত্যাদি রয়েছে। রয়েছে এর বিকাশজনিত প্রক্রিয়া এবং স্তর। ডুবে যাওয়া মানুষ যেমন খড়-খুঠো ধরে বাচতে চাই, সে রকমই ইসলামী চিন্তাবিধরা কোরানের বাণীকে টিকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন অসহায় ভাবে। জোঁক বা আটকে থাকার মাঝে বিজ্ঞান খুঁজার ব্যপারটি আল্লাহর বাণীকে (!) আরো সস্তা এবং ঠুনকো করেছে। যা ইসলামী চিন্তাবিধগনের অবদান।

একটি ভ্রুণ কিভাবে তার অংপ্রত্যঙ্গগুলো বিকশিত করে? কোরানের নিচের আয়াতটি দ্বারা আমরা কি বুঝতে পারি দেখা যাকঃ

২৩:১৪ পিন্ডকে পরিনত করি অস্থি-পঞ্জরে, অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢাকিয়া দেই গোশ্ত দ্বারা, অবশেষে উহাকে গড়িয়া তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে (আংশিক)।

মোট কথা হলো, মানুষের কঙ্কালটি তৈরী হবার পর কিনা সেই কঙ্কালকে মাংস দ্বারা ঢেকে দেয়া হয়। এই সোজা হিসাবটাকে বিজ্ঞান মেনে নেয় না। একটি মিলিত সেল তার বিভাজন প্রক্রিয়ায় এত বেশি কোষে ভাগ হয় যে তা একটি বিরাট সংখ্যক কোষ সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় মরুলা (Morula)। এ সেল ফার্টিলাইজেশন থেকে সব প্রক্রিয়া হয়ে মরুলা পর্যন্ত ঘটনা ঘটে মাত্র ৭২ ঘন্টা সময়ের মধ্যে। তখন কিন্তু এ অস্থি-পঞ্জরের কোন অস্তিত্বই থাকে না। এটা মোটেও হাড়ের উপর মাংসের প্রলেপ দেয়ার মতো কোন ঘটনা নয়। কারণ, সারা দেহের গঠনের মূলে তিনটি প্রধান অংশ কাজ করে, যাকে কিনা বলা হয়, এক্টোর্ডাম, এন্টোর্ডাম ও মেজোর্ডাম। মূলতঃ এই তিনটি টিস্যুর মধ্যে নিহিত থাকে মসিতষ্ক, মেরুদন্ড, হাড়, হৃদপিন্ড, পেশী, রক্তের কোষ পরবর্তীতে এ টিস্যুগুলো থেকে বিভিন্ন টিস্যুর রূপান্তর ঘটে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এক্টোর্ডাম থেকে বিকশিত হয় বিভিন্ন তন্ত্র যার মধ্যে মস্তিষ্ক, মেরুদন্ড, স্নায়ু, চামড়া, নখ এবং চুল ইত্যাদি। এন্টোডার্ম থেকে বিকশিত হয় শ্বসনতন্ত্র ও পাচনতন্ত্রের আস্তরণ, যকৃত ও অগ্ণ্যাশয় ইত্যাদি। আর মেজোডার্ম থেকে বিকশিত হয় হৃদপিন্ড, মূত্রগ্রন্থি, হাড়, কোমল অস্থি, পেশী, রক্তের কোষ ইত্যাদি। অংগ-প্রত্যঙ্গ বিকাশের জন্য ভ্রুণ কখনো মরুলা কখনো ব্লাস্টোসিস্ট কখনো বডিটিউব ইত্যাদি স্তরগুলো পার করে। হাত-পা বিকাশের ক্ষেত্রে যা ঘটে, প্রথমে বডিটিউব থেকে দুজোড়া লিম্ব বাড্ সৃষ্টি হয়। সামনের দুটি হচ্ছে, এন্টিরিয়ার লিম্ব বাড যা পরে হাতের বহিপ্রকাশ ঘটায় এবং পিছনের দুটি হচ্ছে পোষ্টিরিয়ার লিম্ব বাড যা পায়ের বিকাশ ঘটায়। হাত বা পায়ে একটি ধমনী ও একটি শিরা থাকে। তা ক্রমে মুল প্রবাহ বা আর্টারী ও ভেনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তা থেকে ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখার বিকাশ ঘটে থাকে। এটি হচ্ছে অত্যন্ত সংক্ষেপে হাত-পা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়। এরকম বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ, তন্ত্র ইত্যাদির বিকাশ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে। তারপর গঠিত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ। কখনো এপ্রক্রিয়াকে হাড়ের উপর মাংসের প্রলেপের অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করা যায় না, কেবল মাত্র অবৈজ্ঞানিকভাবে এটি সম্ভব।

ধর্মগ্রন্থগুলোকে বিজ্ঞান প্রমানের প্রচলন অনেক বেশি মাত্রায় শুরু হয়েছে। কারণ কি? ধর্মগ্রন্থগুলোকে সার্টিফাই করার জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি থেকে এর প্রয়াশ। এক সময় এই ধর্মগ্রন্থগুলোই বিজ্ঞানের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। হাইশেপিয়া, ব্রুণো, গ্যালিলিও এরা সবাই ধর্মানুসারীদের স্বীকার। অথচ আজকে তাদের প্রয়োজনেই বিজ্ঞানকে ঐশীবাণীর সাথে সমাঞ্জস্যতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যদিও বৈজ্ঞানিক থিওরীর পাশে এসমস্ত ঐশীবাণীগুলোকে খুবই অসহায় দেখায়।

সূত্রঃ

টেক্সট বুক অফ এ্যানাটমি (ডাঃ এস. এন. পান্ডে)
http://www.ehd.org/resources_bpd_illustrated.php
গ্রীক দর্শনঃ প্রজ্ঞা ও প্রসার (মোহাম্মাদ আবদুল হালিম)
জাকির নায়েকের লেকচার (আল-কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান)
স্বতন্ত্র ভাবনা