প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়

২০৩০

ঢাকার নতুন টেলিভিশন স্টেশন মহাবিশ্ব এক বছর হল চালু হয়েছে। প্রথম থেকেই মহাবিশ্ব নতুন আঙ্গিকে সংবাদ, বিভিন্ন পর্যালোচনা ও বিনোদন অনুষ্ঠান এমন ভাবে পরিবেশ করেছে যে ইতিমধ্যেই এই স্টেশনের জনপ্রিয়তা পুরোনো স্টেশনগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। মহাবিশ্বের একজন স্টার হচ্ছেন দীপ্তি আহমেদ। দীপ্তি একাধারে একশো – সংবাদ পর্যালোচনা, নামকরা ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার, মাঝে মধ্যে খবর পড়া সবই করেন। আগে নাটক করতেন, এখন নতুন ইমেজের জন্য কিছুদিন অভিনয় বন্ধ রেখেছেন। কলেজ পর্যন্ত তাঁর নাম ছিল জ্যোৎস্না আহমেদ। হয়তো নিজের ভবিষ্যৎ স্টার ক্ষমতার সম্ভাবনা বুঝতে পেরে আভিনয়ের শুরুতে জ্যোৎস্না বদলে নাম রাখলেন দীপ্তি। অনেকে মনে করে তাঁর এই বিচক্ষণতা কাজে এসেছে। দীপ্তিকে দেশের আজ কে না চেনে? আর মহাবিশ্ব স্টেশনের জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে পৌঁছে দিতে দীপ্তির ব্যক্তিত্ব একক ভাবে কাজ করেছে।

আজকে দীপ্তি সাক্ষাৎ নিচ্ছেন একজন নাট্যপ্রতিভার, একটি ঢেউ খেলানো ডেস্ক-টেবিলের একদিকে দীপ্তি অপরদিকে উঠতি নায়ক খালেক। সাক্ষাৎকার ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে। দুজনের সামনে একটা করে কাপ, তাতে জল রাখা আছে। কাপের গায়ে মহাবিশ্ব স্টেশনের নাম লেখা। দীপ্তির প্রশ্নে খালেক তাঁর অভিনয় জীবন কেমন ভাবে কিছু কাকতালীয় ঘটনার ফলশ্রুতি হিসেবে শুরু হয়েছিল তাই বললেন। সেই সূত্র ধরে দীপ্তিও বেশ হাত নেড়ে তাঁর মিডিয়ার চাকরী কেমন করে শুরু হয়েছিল তাই বলা শুরু করলেন। অসাবধানে হঠাৎ করেই তাঁর হাতটা সামনে রাখা কফি কাপটাকে ধাক্কা দিল। কাপটা নিচে পড়ল, দীপ্তির দিকেই, কিন্তু ভাঙ্গল না। কিছু জল দীপ্তির গায়ে পড়ল। দীপ্তি একটা অস্ফুট শব্দ করে কিছুটা অভ্যাসবশঃতই নিচু হয়ে কাপটা তুলতে গেলেন। ডেস্কের ওপাশ থেকে খালেক বললেন, “আহা!” ক্যামেরা চালু ছিল, সবাই ভাবল বেশ মজার ব্যাপারই হল, দর্শকদের জন্য এটা আকর্ষণীয় হবে আর প্রযোজক যদি না চায় তো এডিট করে দেয়া যাবে। সবাই ভাবল দীপ্তি সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই ডেস্কের ওপাশ থেকে কাপ হাতে নিয়ে উঠবেন। ডেস্কের অন্যপাশে দীপ্তিকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু সেকেন্ড পাঁচ-সাত কেটে যাবার পরও দীপ্তি উঠল না দেখে ক্যামেরাম্যানসহ স্টুডিওর দু-তিনজন লোক ছুটে গেল। কিন্তু ডেস্কের অপর পাশে কেউ ছিল না।

দীপ্তি আহমেদ সেই ছোট বদ্ধ স্টুডিও থেকে প্রায় সবার সামনে উধাও হয়ে গেলেন। কিন্তু উধাও হবার মুহূর্তটি কেউ ধরে রাখতে পারে নি। ক্যামেরা চালু ছিল, কিন্তু উধাও হবার সময় দীপ্তি ডেস্কের নিরেট কাঠের পেছনে ছিলেন। ক্যামেরার লেন্সে ডেস্ক পেড়িয়ে আলো পৌঁছায় নি। খালেক দীপ্তির মাত্র তিন ফুট দূরে বসে ছিল, কাপটি তোলার সময় দীপ্তি তাঁরও চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল।

দীপ্তি আহমেদের অদৃশ্য হবার কাহিনী এই সময়ের ঘটনা। প্রকৌশল আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইচ্ছা করলেই ধরে রাখা যায়। তবুও দীপ্তি আহমেদের অদৃশ্য হবার মুহূর্তটি ধরে রাখা যায় নি।

চতুর্থ অধ্যায়

আমি দীপ্তি আহমদের সাক্ষাৎকার প্রোগ্রামটি দেখতাম না, শুধুমাত্র পরদিন সকালে ইন্টারেনেটের খবরে ব্যাপারটা জানলাম। খবরে দীপ্তির শেষ ফুটেজটি বারে বারে দেখাচ্ছিল, কিন্তু অদৃশ্য হবার সময়ের কোন ধারণা সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যেই আমার এক সাংবাদিক বন্ধু নওশাদ টেলিফোন করল। স্ক্রীনে দেখি তার চোখ লাল, ফোলা, চুল উস্কোখুস্কো। আমাকে বলল, কাল সারারাত এই অদৃশ্য হবার ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছে, আমার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে নওশাদ উপস্থিত। আমি বলি, “চা খাও।” সে বলে, “কফি দাও।” কফি খেতে খেতে সে বলে, “এটা একটা প্যাটার্ন। আমার মনে হয় এরকম অন্ততঃ আরো দুটো ঘটনার রেকর্ড আছে। একটা হল ১৯৩০ সনে, বর্তমানের পশ্চিম বঙ্গে একটি ট্রেনে। আর একটা আটলান্টিকের ওপর একটি বিমানের মধ্যে।”

আমি বলি, “বলতে থাক।” নওশাদের মতামতের ওপর আমার খুব ভরসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছেলে সাংবাদিক হয়েছে অনুসন্ধানী হবার জন্য।

নওশাদ বলে, “শোন, ১৯৩০ সনে গভীর রাতে কলকাতাগামী ট্রেন খামারগাছা স্টেশনে ঢোকে। স্টেশন মাস্টার মনোহর দাস আবিষ্কার করেন দু-দুটো বগিতে যেখানে পঞ্চাশ জন লোকের থাকার কথা তারা উধাও। কিন্তু বাদবাকি বগিগুলোতে লোক যেমন থাকার তেমনই ছিল। আমি অনেক দিন ধরে এই ঘটনাটা জানতাম, কিন্তু কাল রাত পর্যন্ত একে সেরকম গুরুত্ব দিই নি। এখন শোন, দীপ্তি আহমেদ উধাও হবার পর আমি এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে কলকাতায় আমার বন্ধু সুজয়কে রাতেই ফোন করলাম। সুজয় খুবই করিৎকর্মা লোক। সুজয়কে বললাম খামারগাছায় একটা খবর করতে। খবরটা হচ্ছে ১৯৩০এর এই ঘটনাটার কোন নথি আছে কিনা। বিশ্বাস করবে না ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সুজয় ফোন করে বলে রামপ্রসাদ নামে এক লোক নাকি ছিল ওই ঘটনার সময়। রামপ্রসাদ মনোহর দাসের প্রিয়পাত্র ছিল এবং মনোহর বাবুর বিষয়ের উত্তরাধিকারী সেই হয়। সেই রামপ্রসাদের নাতনির কাছে নাকি মনোহর দাসের একটা ডায়রী আছে। সুজয় খামারগাছা থেকে ডায়রীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি দেখ।”

নওশাদ তার হাতের ঘড়িটির একটা বোতামে চাপ দেয়। ঘড়িটির একটা প্রজেকশনে আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে একশো বছর আগে মনোহর দাসের হাতের লেখা।

নওশাদ বলতে থাকে, “দেখ অমল, মনোহর দাস লিখছেন, দ্বিতীয় বগিতে ঢোকার সময় একটি সিগারেট পানরত লোক বেড়িয়ে আসে। সেই বগিতে প্রতিটি আসনই প্রায় পূর্ণ ছিল, সেখান থেকে কেউ উধাও হয় নি।”

একটু থামে নওশাদ। কপালে তার ঘাম ফুটে ওঠে। তারপর বলে, “তুমি শোন অমল, আমি জানি না ট্রেনের মানুষগুলো কেমন করে উধাও হয়েছে, কিন্তু দীপ্তি আহমেদের ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি যে এই সব জিনিস তখনই ঘটেছে যখন কোন সাক্ষী ছিল না, কোন প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ছিল না। খামারগাছার সেই সমস্ত বগি থেকে মানুষ অদৃশ্য হয়েছিল যেগুলোতে সবাই ঘুমাচ্ছিল। যেই বগিতে অন্তত একজন জেগে ছিল সেই বগির মানুষেরা ঠিকই ছিল। যেমন দ্বিতীয় বগিতে সেই সিগারেট সেবক লোকটি ঘুমায় নি, তার সিগারেট সেবন ঐ বগির লোকদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই লোকটি হয়তো কামরার সবাইকে দেখতে পাচ্ছিল। দীপ্তি আহমেদ তখনই অদৃশ্য হয়েছে যখন সে একটা নিরেট ডেস্কের পেছনে ছিল। যখন তাকে কেউ দেখোতে পাচ্ছিল না। আটলান্টিকের ওপর বিওএসি বিমানের যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাদেরকে অবলোকন করার কেউ ছিল না।”

উত্তেজনায় নওশাদ দুটি হাত কচলাতে আরম্ভ করে। আমি বুঝতে চেষ্টা করি সে কি বলতে চাইছে।

চলবে… ৪র্থ পর্ব