লিখেছেনঃ পাপীমনা

এক কথায় ধর্মের সংজ্ঞা দেয়া যায় না। কারণ বিভিন্ন সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার পদ্ধতি নানা প্রকার। ধর্ম মানব সমাজের ন্যায় অতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ধর্ম লোপ পেতে বসেনি, বরঞ্চ বহুল বিস্তার ঘটেছে। কোনো কোনো ধর্ম বহু ঈশ্বরবাদে আবার কো্নো গুলো একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। বাটন বলেন যে ফিলিপাইন দ্বীপবাসীদের পাচ সহস্রাধিক দেবতায় বিশ্বাস করতে দেখা যায়।কোন কোন ধর্ম আবার পারলৌ্কিক জীবন ও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। অনেক র্ধমে আত্মায় বিশ্বাস থাকলেও প্রভূতে বিশ্বাস নেই।

টেইলর তার primitive culture বইতে আদিম সমাজে ধর্মের উৎপত্তির কারণ ও তার বির্বতন নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেছেন। তার মতে ধর্মের আদি রুপ হলো ভূত-প্রেত বা মৃত র্পূব-পূরুষের পূজা। এরপর ঐ ভূত-প্রেত প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে আশ্রয় নেয়, এ ধারণা তাদেরকে প্রকৃতি পূজারী করে তোলে। ধর্মের বির্বতন প্রক্রিয়ায় এভাবে দেব দেবী ও র্মূতি-পূজার আর্বিভাব ঘটে। বহু ঈশ্বরবাদী র্মূতি পুজার ধর্ম পরে বির্বতিত হয়ে একেশ্বরবাদে রুপ নেয়। আদিম সমাজের লোকেরা বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও ঘটনা প্রবাহের মধ্যে র্কায কারণ সূত্র র্নিণয় করতে র্ব্যথ হয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের দৃষ্টিতে কোন কিছু অস্বাভাবিক মনে হলেই তাকে অতিপ্রাকৃত ধরে নিয়ে তাকে তারা ধর্মীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে তুষ্ট করতে চেয়েছে। তারা অতি-প্রাকৃ্তকে মনে করেছে এমন এক উচ্চতর শক্তি যা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সে  অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে আত্ননিবেদন করে স্বস্তি পায়। তাকে সমীহ করে, ভক্তি করে, পূজা করে, তোষামোদ করে তার কৃপা লাভ করার জন্য তার প্রতি আনুগত্য জানায়, তাকে তুষ্ট করতে না পারলে সে স্বস্তি পায় না। পারলৌকিক জীবনে সব দুঃখের অবসান হবে এবং সে অনন্ত সুখের অধিকারী হবে এই তার আশা ।

প্রায়ই দেখা যায়  ধর্ম বলতে এই অতি-প্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস ও এর প্রতি মানুষের ব্যবহার ,ক্রিয়াকলাপ তথা মনোভাব কে বুঝায়। এটাই র্ধমের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ।এই অতি প্রাকৃ্ত শক্তি কি? মানুষ যখন তার সীমিত জ্ঞান দিয়ে কোন কিছু ব্যাখ্যা করে উঠতে পারে না, তখন তার উপর সে অসহায়ভাবে র্নিভর করে সে কোন শক্তি? অতিপ্রাকৃত প্রত্যয়টি প্রাকৃত প্রত্যয়ের বিপরীত শব্দ। প্রাকৃত বলতে বোঝায় স্বাভাবিক, প্রাত্যহিক, স্বভাবসিদ্ধ, জাগতিক কোন কিছুকে। অতিপ্রাকৃত হলো প্রাকৃতের অতিরিক্ত বা তার চেয়ে উচ্চতর বা অধিকতর কিছু। যা স্বাভাবিক, সহজ বা প্রাত্যহিক জাগতিক বিষয় নয় এমন সবই অতিপ্রাকৃ্ত বলে বিবেচিত। কোনো বস্তুর প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়ার ও মনোভাবের উপর র্নিভর করে কোনটা তার কাছে প্রাকৃত আর কোনটাই বা অতিপ্রাকৃত। এ তার সংস্কৃতি, র্দশন ও চিন্তার পর্যায়ের উপর নির্ভরশীল। কোনটা প্রাকৃত, কোনটা অতিপ্রাকৃ্ত তা আবার নির্ভর করে একটি বিশেষ সময়ের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের উপর। কারণ আজ যা অতিপ্রাকৃত কাল তা সাংস্কৃতিক উৎর্কষ ও কলা কৌশলের উন্নতির ফলে প্রাকৃ্ত বলে বিবেচিত হতে পারে । অতিপ্রাকৃত প্রত্যয়টি আপেক্ষিক। মানুষ তার জ্ঞান দ্বারা একে উত্তরোত্তর প্রাকৃ্ত করতে সক্ষম হচ্ছে । কাল্পনিক এ রহস্যময় জগতের আবরণ উন্মোচন করতে সে প্রয়াস পাচ্ছে। পাশ্চাত্য জগতে র্পূবে যা অতিপ্রাকৃত বলে বিবেচিত হতো আজ তার অনেক কিছুই প্রাকৃ্ত বলে বিবেচিত । কোন কিছুই স্বভাবজাত ভাবে অতিপ্রাকৃত নয় । এটা র্নিভর করে ব্যক্তি কিভাবে তা দেখে তার উপর । কোনো বস্তু বা বিষয়ের প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া,মনোভাব এবং দৃষ্টিভংগীর উপর র্নিভর করে তা প্রাকৃ্ত বা অতিপ্রাকৃ্ত কিনা। ধর্মীয় বিশ্বাস তাই প্রায়ই অসাধারণে, রহস্যময় উচ্চতর কোনো শক্তিতে বা অতিপ্রাকৃ্তে বিশ্বাস। মানব মস্তিকের ক্রমবিকাশের ধারায় এক র্পবে অতিপ্রাকৃতবাদের জন্ম হয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় প্রকৃ্তিবাদও ব্যাপ্তি লাভ করেছে। নানা রহস্যকে ঘিরে মানুষের চিন্তা। যদি মানব জ্ঞানের আওতায় তথা তার নিয়ন্ত্রনে এসে যায় তবে অতিপ্রাকৃ্তবাদের শেষ দিন ঘনিয়ে আসবে । এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনও কিছু বলতে পারেন না । তবে এমনটি হতে পারে বলে অনুমান করেন । হোবেলের কথায় “Whether naturalism will entirely displace supernaturalism in future cultures can not be said, although the general trend in the evolution of culture and human thought can certainly be said to be in that direction” এবং প্রকৃতিকে জয় করার সাথে সাথে ধর্মের ভীত নড়ে যায় ।তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে,অতিপ্রাকৃ্ত জগৎ অসীম ও অনন্ত রহস্যে ঘেরা । এ রহস্য যতই উন্মোচন করা সম্ভব হচ্ছে ততই মানুষ অনন্ত রহস্যের আর্বতে ঘুরপাক খাচ্ছে । একটি রহস্য জানতে গিয়ে অন্যান্য হাজারো রহস্যের আর্বতে পড়ে যাচ্ছে মানুষ । এর শেষ আছে কি না, থাকলে তা কোথায় তা কে জানে?