অজানার দেশে চলে গেলেন বাংলা পপ গানের সম্রাট আজম খান। পপ গানের অনুরাগীরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় গুরু বলে ডাকতেন। সেই গুরু আর নেই। চলে গেছেন অচেনা কোনো অজানা ভূবনে।

ষাট এবং সত্তুরের দশক ছিল প্রথা না মানার সময়। শুরু হয়েছিল পশ্চিমে, কিন্তু জের গিয়ে আছড়ে পড়েছিল সুদূর বাংলাভূমিতেও। প্রথা না মানা এরকমই একদল দ্রোহী তরুণ বিদ্রোহ করেছিল রক্ষণশীল বাংলা গানের বিরুদ্ধে। পপ গানের উন্মাতাল অর্গল খুলে দিয়েছিলেন তাঁরা। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আজম খান। দ্রোহী ছিলেন এরা, সামাজিক প্রথা ভেঙেছেন, কিন্তু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হন নি তাঁরা কখনো। সাধারণ মানুষের নাড়ির সাথে যোগাযোগটা ছিল সবসময়ই অক্ষুন্ন।

এ কারণেই আটষট্টি সালে, মাত্র সতের আঠারো বছর বয়সে দেশের মানুষের অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের সময় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গাইতে গিয়ে বুক কাঁপেনি তাঁর। জেলায় জেলায় ঘুরতেন তাঁরা, গান গাইতেন সরকারের বিরুদ্ধে। পুলিশের তাড়া খেয়ে অসংখ্যবার দৌঁড়ে পালিয়েছেন তিনি।

গায়কের চেয়েও আজম খানের পরিচয় আমার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেই বেশি গুরুত্ববহ। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছেন তিনি। একাত্তরে বর্ষা শুরুর আগেই যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যান আগরতলায়। মেলাঘরে আরো অসংখ্য আরবান গেরিলার সাথে তিনিও ট্রেনিং নেন। তাঁর অস্ত্র শিক্ষার ট্রেনার ছিল রুমি। হ্যাঁ, বিস্ময়ের কিছু নেই। এই রুমি সেই রুমি-ই, জাহানারা ইমামের ছেলে। রুমি ছিল অস্ত্রচালনায় সবচেয়ে দক্ষ। এলএমজি, রাইফেল সবকিছু চালনাই রুমির কাছ থেকে শিখেছিলেন তিনি। আজম খানের যুদ্ধে যাবার ঘটনাটা আমি আমার লেখা বিষাদেরই জল আঁখিকোণে প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম। সেখান থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

বাংলা পপ গানের জীবিত কিংবদন্তী আজম খান। বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। সেই আজম খানকে তার বাবা-মা কীভাবে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন তা জানা যায় তার নিজের ভাষ্যে।“একাত্তরে ২৫ মার্চের পর সারা শহরে কারফিউ। আর্মিদের জ্বালায় থাকতে পারতাম না। পালিয়ে থাকতাম। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে নয়। মরলে যুদ্ধ করেই মরব। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং করব। যুদ্ধ করব। যে যার মতো চলে গেল। আমি যেদিন গেলাম, সেদিন আমার সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু শাফি আর কচি। বেলা সাড়ে ১১টা। মাকে গিয়ে বললাম, ‘মা, যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোর বাবাকে বল।’ বাবা প্রয়াত আফতাব উদ্দীন খান ছিলেন কলকাতার প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার সামনে। মাথা নিচু করে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। চিন্তা করলাম, এই বুঝি লাথি বা থাপ্পড় দেবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, যুদ্ধে যাইবা ভালো কথা। দেশ স্বাধীন না কইরা ঘরে ফিরতে পারবা না।’


মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে আজম খান কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া শুরু করেন। প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন কুমিল্লার সালদায়। যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে সেকশন কমান্ডার করে ঢাকা ও আশেপাশে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। আজম খান  যাত্রাবাড়ি-গুলশান-ডেমরা এলাকার গেরিলা অপারেশানে নের্তৃত্ব দেন।

আজম খানের উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলোর দুটো হচ্ছে অপারেশন তিতাস ও অপারেশন ইন্টারকন্টিনেন্টাল। তাঁর নেতৃত্বে গ্যাস সরবরাহ পাইপ লাইন ধ্বংস করে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন গেরিলারা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যে বোমা বিস্ফোরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগিয়েছিল, সেটার নেতৃত্বেও ছিলেন আজম খান। তাঁর দলই এই দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। আন্তর্জাতিক এ হোটেলে হামলা চালানোর কারণ ছিল, ঐ হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে দেশে যুদ্ধ চলছে।

এছাড়াও তার নের্তৃত্বে  ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে ও কালিগঞ্জের সম্মুখ সমরে পাকসেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। আরবান গেরিলাদের যে দলগুলো বিজয়ের অনেক আগেই ঢাকা প্রবেশ করেছিল তার মধ্যে অগ্রগন্য ছিল তার দলটা। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২০ নভেম্বর ঢাকায় প্রবেশ করেন আজম খান।

যুদ্ধের মধ্যেও গানকে ছাড়েন নি তিনি। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতেও সে কথা লেখা আছে। রুমি তার মাকে বলেছিল যে রাতের বেলা তারা মেলাঘরে আজম খানের উদাত্ত গলার গান শুনতো। শুধু ট্রেনিং ক্যাম্পেই নয়, সম্মুখসমরেও গানকে বিসর্জন দিতেন না তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রেও গান গাইতে গাইতেই লড়াই করতে তিনি। সহযোদ্ধারা নিষেধ করতো গান গাইতে। শত্রু সেনারা অবস্থান টের পেয়ে যাবে এই আশংকায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গান যার রক্তে, তাঁর জন্য গানের আলাদা ক্ষেত্র বলে কিছু নেই। তাই যুদ্ধের ময়দানেপ গান চলতো অবলীলায়। সহযোদ্ধারা মরণের ভয় দেখাতো তাঁকে। বলতো, ‘ওই গান থামা। পাক সেনারা শুনলে বুইঝা যাইবো তুই কোথায়। তোর মরণের ভয় নাই নাকি?’ তিনি এর উত্তরে বলতেন, ‘আরে মরবোইতো একদিন। ভয় পাওয়ার কী আছে? গান গাইয়া লই।

এই গান পাগল লোকটা মরণের সময়ও গান গেয়েছিলেন কিনা, সেটা জানার খুব ইচ্ছা আমার। নিশ্চয় গেয়েছিলেন তিনি। গান আর মানুষের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ছাড়া এই পাগলা লোকটার আর কিছু ছিল বলেতো মনে হয় না। কোন অভিমানে যে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, কে জানে?

অজানা কোনো অন্যভূবনে অনেক অনেক ভাল থাকুন আপনি আজম খান। অভিমান ভুলে গলা খুলে গান গান গভীর ভালবেসে আগের মত।

httpv://www.youtube.com/watch?v=_NddDEBrw5M&feature=related