এমন একটা লেখা কখনো লিখতে হবে ভাবি নি। কিন্তু এই তো, খট খট করে লিখতে শুরু করেই দিলাম। এক রকম বাধ্য হয়েই। লেখাটা লেখাচুরি নিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরে একদম আশেপাশেই এমন ঘটতে দেখছি। সহ ব্লগারদের লেখা চুরি হচ্ছে অহরহ। কখনো ভিক্টিম মুক্তমনার বিপ্লব পাল, কখনো সচলায়তনে শুভাশীষ দাশ, কখনো অন্য কেউ। এরা সবাই সহ ব্লগার হলেও, এরা তো ঠিক ‘আমি’ না। তাই এসব ব্যাপার দেখে ক্রুদ্ধ, বিচলিত, বিরক্ত, যাই হই না কেন সব সময়-ই এগুলো ছিলো ‘অন্যদের ব্যাপার’। তবে যে অন্যায়টা সব সময় আশেপাশে ঘটে সেটা নিশ্চিতভাবে নিজের সাথেও ঘটে শেষ মেশ।

স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্দ ম্লদিনাও এর ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ নামক বইটা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে চারিদিকে। আমিও পড়ি। আর ভালো লাগে খুব। সেই ভালো লাগাটা কিছু বন্ধুর সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই অনুবাদ করতে শুরু করি বই টা। এক সময় প্রথম অধ্যায়টা পোস্ট করি মুক্তমনায়। এখানে সবার কাছ থেকে দারুণ ফিডব্যাক পাই। তারপর একের পর এক অধ্যায় অনুবাদ করে প্রকাশ করতে থাকি নিয়মিত বিরতিতে। প্রতি পোস্ট প্রকাশ হবার পরই মনোযোগী পাঠকেরা অনেক প্রশ্ন করেন, আলোচনা করেন, অনুপ্রেরণা দেন। সব মিলিয়ে দারুণ একটা সময়ই পার করতে থাকি। এক রকম নেশায়ই পেয়ে বসে। নিজের কাজ থেকে এক মুহূর্ত বিরতি পেলেও বসে যাই অনুবাদ নিয়ে। মাঝে ভাটা পড়ে কাজে। বন্ধুরা, সহব্লগাররা, ছোটো আর বড় ভাইয়েরা তাগাদা দিতে থাকেন। এসবের মধ্য দিয়েই এক সময় অনুবাদটা শেষ হয়।

যারা কখনো অনুবাদ করেছেন, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের, তারা জেনে থাকবেন ‘পোয়েটিক ফ্রিডম’ এখানে কতটা কম। নিজ ভাষায় প্রকাশ করার সাথে সাথে, খেয়াল রাখতে হয় অর্থ ঠিক থাকছে কি না। সে জন্য প্রচুর রেফারেন্স পড়াশুনাও প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে বেশ বড়সড় এক কর্মযজ্ঞ যাকে বলে। আমার মনে হয় অনুবাদের চেয়ে নিজে কিছু লিখে ফেলাটা বেশি মেধার দাবিদার হলেও, কম শ্রম সাধ্য। তবে একটু পরিশ্রম হলেও এর বিনিময়ে পাঠকদের কাছথেকে যত শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা পেয়েছি তা সত্যিই অমূল্য আমার কাছে। সে সব কথা না হয় থাক আপাত।

তবে আজ সকালে হঠাত সহ ব্লগার আশরাফ মাহমুদের মেসেজ পেলাম ফেসবুকে। কোনো এক ব্যক্তি আমার অনুবাদটা একটা পি ডি এফ আকারে সংকলিত করেছে। তাও ভালো কথা। তবে সেই পিডি এফের প্রতি পাতায় সে অনুবাদক হিসাবে নিজের নাম NC Das লিখে রেখেছে বড় করে। এটা করেই সে থেমে থাকেনি, মুক্তমনা, সচলায়তন আর দুয়েকটা ব্লগ বাদে প্রায় গোটা দশেক ব্লগে আর বিভিন্ন সাইটে সে নিজেকে অনুবাদক দাবি করে পোস্ট দিয়েছে

তার পরেও থেমে থাকেনি, অন্য আরেকটি পোস্ট দিয়ে কীভাবে সে তার করা এই অনুবাদ প্রকাশকদের নজরে আনবে বা প্রকাশ করবে সে বিষয়ে জনসাধারণের মতামতও চেয়েছে! সামহোঅয়্যার ইন ব্লগে আমি তার পোস্ট বিষয়ে আপত্তি জানালে সেটা সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পর ফেসবুকে তার এই জালিয়াতি বিষয়ে লিঙ্ক শেয়ার দিয়ে পোস্ট দেবার পরে আরো কিছু মেজর ব্লগ সাইট (প্রথম আলো ব্লগ, আমাদের ব্লগ) থেকে সে তার পোস্ট সরিয়ে ফেলে। কিন্তু তারপরেও এখনো প্রায় ১০ টি লিঙ্ক অ্যাকটিভ আছে। মিডিয়া ফায়ারে তার বানানো পিডিএফ ও পাওয়া যাচ্ছে। কবে দেখা যাবে বাজারে কাগজের বইও পাওয়া যাবে!

এভাবেই ‘যে ঘটনা সব সময় ঘটার কথা অন্যদের সাথে’ সেটা ঘটে গেছে আমার সাথেও। আমরা অনেকেই ব্লগে বা অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের লেখালিখি করি। যেগুলোর সবার কাছে সহজ লভ্য হবার কারণে এভাবে চুরির/জালিয়াতির শিকার হতেপারে (এবং হয়) সহজেই। এখন অন্তত আমি বুঝতে পারছি যে আসলেই সময় এসে গেছে এসব নিয়ে গুছিয়ে ভাবার।

কী করা যেতে পারে এ বিষয়ে? যেসব চিন্তা মাথায় আসছে শেয়ার করি। আপনারাও যোগ করুন,

১) কাগজের মাধ্যমের প্রকাশকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা যতে পারে, যেন তারা কোনো লেখা প্রকাশের আগে অন্তত গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেন এ শিরোনামের বা এ ধরনের টেক্সট ব্যবহার করে অলরেডি কোনো লেখা অনলাইনে কোথাও আছে কি না।
২) প্রকাশক নিজেই এ ধরণের চুরির/জালিয়াতির সাথে জড়িত হলে। যে সাইটে প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো সেখান থেকে ফরমালি যোগাযোগ করা যেতে পারে। কোনো ধরনের নোটিশও দেওয়া যেতে পারে। কারণ আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থার কারণেই মূল লেখক একা এ ধরনের ‘হামলা-মামলায়’ জড়াতে চাইবেন না বেশিরভাগ সময়ই। তার উপর আমরা প্রায় কেউ-ই পেশাদার লেখক না। অবসরে ভালো লাগা থেকে লিখি। এবং একেকজন থাকি একেক দেশে।

যাই হোক। আমার অনুবাদটির জালিয়াতি যে করেছে তার পরিচয় বের করা গেছে। নাম N C Das ওরফে Niranjan Das । তার ফেসবুকপেজ ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটের তথ্য মতে সে AIUB এর ছাত্র। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এর মেম্বার। এবং ই-পৃথিবী নামক প্রযুক্তি বিষয়ক ই ম্যাগাজিনের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের মুনির হাসান, এবং ই পৃথিবীর একজন প্রতিষ্ঠাতার কাছে তার বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এর বেশি আর কী করা সম্ভব ভেবে পাচ্ছি না। তার ফোনে যোগাযোগ করলেও সে ফোন ধরছে না।

“বাংলায় দ্য গ্রান্ড ডিজাইন” লিখে গুগল করলেই তার মহান কীর্তির নমুনা পাওয়া যাবে। যেটাকে বন্ধু তানিম নাম দিয়েছে ‘দ্য গ্র্যান্ড থেফ্‌ট’। আসলে দুয়েকটা পোস্ট চুরি হলে এক রকম লাগে। আর মাসের পর মাস পরিশ্রম করে করা একটা কাজ চুরি হয়ে যেতে দেখলে লাগে অন্য আরেক রকম। সেই ‘অন্য আরেক রকম’ অনুভূতিটা বুকে পুষে রাখা ছাড়া আর কী কী করা যেতে পারে বলে মনে করেন? আপনাদের অভিমত জানতে চাচ্ছি।