(১)
সেটা ২০০৮ সালের জানুয়ারী। ওবামা বনাম হিলারি যুদ্ধ তুঙ্গে। আমি হিলারি ক্যাম্পের হয়ে কাজ করতে নামি। ওবামার চেঞ্জ ব্যাপারটা তখনই কেমন গোলমেলে মিডিয়া ম্যাজিক মনে হত। ইনসিওয়ারান্স এজেন্টদের হাতের পুতুল জো বিডেনকে ভাইস প্রেসিডেন্টিয়াল রেসের জন্যে ডাকতেই বুঝলাম- ওবামা ম্যাজিক দেখে লজ্জা পেতেন জাদু সম্রাট পি সি সরকার। কি সুন্দর সবাইকে বোঝালেন আসলেই আমি তোমাদের একজন। তারপর ইরাক, আফগানিস্তান থেকে একটাও সেনা সরল না ( দেশের সরকারগুলোই নাকি চায় না)।

ওয়াল স্ট্রীটের ডাকাতদের বিরুদ্ধে দু একবার হুঙ্কার ছারলেন। ব্যাস। সেটাই চেঞ্জ! এদিকে আমেরিকাতে রিপাবলিকান অধ্যুসিত রাজ্যগুলিতে শিক্ষকদের ছাঁটাই অব্যাহত। তাদের ট্রেড ইউনিয়ান করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। ওবামা এখনো চেঞ্জ চেঞ্জ করছেন না হয়ত লজ্জায়। চেঞ্জ ফেঞ্জের রেঞ্জ ফেলে এখন তিনি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে ড্রোন দিয়ে আরো দু একটা আল কায়দা ঘায়েল করে, পরের বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফন্দি আটছেন। বুশপোলা এত সফিস্টিকেটেড ছিল না-সে ইরাক আক্রমন করেই জনপ্রিয় হওয়া পছন্দ করেছে। চেঞ্জের রেঞ্জ ফেলে শত্রুর পেছনে কাঠি নেরে,জাতিয়তাবাদি জালে যা ওঠে আর কি। চেঞ্জ ফেঞ্জ অনেক কঠিন ব্যাপার! কে যাবে ব্যাবসায়ীদের লবির বিরুদ্ধে? যদিও সেই প্রতিশ্রুতি ছিল ষোলআনা। তার থেকে দু একটা দাড়িওয়ালা মারলেই মিলে যাবে দ্বিতীয়বারের চাবি।

২০০৯ এর বিশে জানুয়ারী ছিল ওবামার অভিষেক। এমন ভীর ছিল-শপথ গ্রহনের তিন ঘন্টা আগে পৌঁছেও ঢুকতে পারলাম না ক্যাপিটল হিলে। ক্যালিফোর্নিয়ার এক চেনা কংগ্রেসম্যানের কাছ থেকে অনেক কাঠখর পুরিয়ে এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে চেয়েছিলাম। ওবামাকে একপলক দেখার জন্যে কত আকুতি চারিদিকে।

যাইহোক মেট্রোতে ঢোকার জন্যে সেদিন লম্বা লাইন। আমার পাশে ছিল আলাবামার এক শিক্ষক। ওবামা না জিতলে নাকি সে আমেরিকা ছেরে চলেই যেত! এতই তার বিশ্বাস ওবামা এবং “চেঞ্জের” ওপরে। সবাই দারুন খুশী।

আসল সত্য এই বুশের জমানাতে আমেরিকার তখন এত বেহাল অবস্থা-চারিদিকে চাকরী নেই-অর্থনীতি কোমাতে-আমেরিকা ওবামাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। বিশ্বাস না করে কোন উপায় ছিল না। ডুবন্ত মানুষের কাছে ভেসে থাকা কাঠই পরিবর্তন। সেই খরকুটো জরিয়ে ধরেই সে ভেসে থাকতে চায়। সেটাকেই সে নৌকা বলে বিশ্বাস করতে চাইবে।

(২)
বিশে জানুয়ারী ২০০৯ থেকে বিশে মে ২০১১-ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল এবার কোলকাতায়। সেদিন কোলকাতায় ছিলাম না-কিন্ত সমস্ত টিভি চ্যানেলে খুশী খুশী যেসব মুখ ভেসে উঠল-মনে করিয়ে দিচ্ছিল ২০ শে জানুয়ারীর সেই শিক্ষকের কথা। সেই জনপ্লাবন, জনউচ্ছ্বাস-মুক্তির স্বাদ, নতুন ভোরের স্বপ্ন চারিদিকে। আমি অবশ্য ঘর পোড়া গরু-তাই তাদের উচ্ছ্বাসে গা ভাসাতে গেলেই, অজান্তেই চেপে বসেছিল পা হরকানোর ভীতি। বুশের অপশাসন থেকে সেদিন যেমন লোকে মুক্তি চেয়েছে-এদিন মুক্তি চেয়েছে সিপিএমের ৩৪ বছরের অপশাসন থেকে। তাই উচ্ছ্বাসের মাত্রা ছিল বাঁধন ছাড়া। ওবামাও যেমন একটিও ঘন্টা নষ্ট না করে প্রথম দিন থেকেই কাজে নেমে গিয়েছিলেন-মমতাও শপথ গ্রহনের পর সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন।মিডিয়া সেদিন ওবামাকে সুপ্যারম্যান সাজিয়েছিল-এখানেও মমতাকে সুপারউম্যান প্রমানের জন্যে প্রতিযোগিতাতে নেমেছে সব মিডিয়া। ওই যে বললাম ডুবন্ত মানুষ। সে বিশ্বাস করতে চাইছে ভেসে থাকা কাঠই নৌকা-মিডিয়াও সেটাই খাওয়াচ্ছে। এখানে তাও রিপাবলিকান মিডিয়া বিরোধিতা করেছে-বঙ্গে এখন সেটাও দুর্লভ। মমতা বিরোধি কেবল চ্যানেল গুলো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে! তারাও নেমেছে মমতা বন্দনাতে! নইলে বিজ্ঞাপন আসবে কোথা থেকে? যতই দেখছি-ততই অবাক। একই আবেগ, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। এখানেও সবাইকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে মমতা তোমাদের লোক! ঠিক ওবামা ক্যাম্পেনের মতন! একই ভাবে সবাই বিশ্বাস করছে একটা শব্দে “চেঞ্জ”।

(৩)
চেঞ্জ?

তৃণমূল আসলেই একটা গণপ্রতিরোধের নাম। সিপিএমের লাল ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ। ২০০৭ সালের পর থেকে এটাই তৃণমুমের মুখ। তার আগে তারা ছিল কংগ্রেসের একটা পতিত অংশ। যা কখনো বিজেপি, কখনো কংগ্রেসের লেজুর হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করত। কিন্ত সিঙ্গুরে সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা অগ্রণী হতেই-সাধারন মানুষ সিপিএমের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে শুরু করে। যেটা আগে দেখা যায় নি কখনো। সিপিএমের গুন্ডারাই নিয়ন্ত্রন করেছে রাজনীতি। কিন্ত বোষ্টনের বিদ্রোহ যেমন আমেরিকার কলোনীগুলোতে দ্রুত সাহস জুগিয়েছিল শতগুন শক্তিশালী বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে-এখানেও নন্দীগ্রামের প্রতিরোধ মানুষকে শিখিয়েছে-সিপিএমের গুন্ডা মেশিনের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।

সেই অর্থে ওবামাও ছিল কর্পরেট আমেরিকার বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর আশা। ওয়াল স্ট্রীটের চালে ঘর হারিয়েছে কোটি কোটি আমেরিকান। কর্পরেট আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভকে পুঁজি করেছেন ওবামা। অনেক রিপাবলিকানরাও তাকেই ভোট দিয়েছে। এখানেও অনেক অনেক বামপন্থীরাও আছেন মমতার পাশে। কারন “চেঞ্জ”। “চেঞ্জ” এ বিশ্বাস করলে অনেক কিছুই সম্ভব।

এই পরিবর্তন ছারা গণতন্ত্র অসম্ভব। এই পরিবর্তন ছারা যেকোন সিস্টেমই ফ্যাসিস্ট সিস্টেমেরর দিকে এগোবে। এই পরিবর্তন ছারা সামাজিক বিবর্তন আটকে যাবে। যা হয়েছে পশ্চিম বঙ্গে। ১৯৭৭ সালে ভারতের প্রথম সারির একটি রাজ্য, বর্তমানে শিক্ষা থেকে শিল্প-সব কিছুতেই পেছনের বেঞ্চে। অর্জন বলতে সাধারন জনতার হাতে ক্ষমতার স্বাদ-ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন সিপিএমের শাসনে হয়েছে। কিন্ত কোন রাজনৈতিক সিস্টেম উন্নততর উৎপাদন শক্তি না দিতে পারলে, তার মৃত্যু অবধারিত। তাই ভারতের বামশক্তিও মৃত্যু শয্যায়। উন্নততর বাম চিন্তা না এলে, ভারতের বামশক্তি কংগ্রেসের মাধ্যমেই টিকে থাকবে-বামনামধারি পার্টিগুলি সাইনবোর্ড হয়ে যাবে।

কিন্ত আসলেই চেঞ্জ আসবে কি? ৬ ই মে তপন দত্ত নামে তৃনমুলের এক যুবকর্মী খুন হয় হুগলীর বালিতে। সেই ছেলেটি জলাভূমি বাঁচাতে স্থানীয় লোকেদের নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। তার খুনের পেছনে হাত প্রোমোটারদের-এবং দেখা যাচ্ছে ছেলেটি সিপিএম তৃণমুল সব নেতৃত্বের চক্ষুশুল হয়ে উঠেছিল। শশাঙ্কের মৃত্যু সিম্বলিক-নিতান্তই সাধারন ব্যাপার যে সে নেতাদের টাকাপয়সা কামানোর অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। গত দুবছরে দলে দলে সিপিএমের গুন্ডারা তৃনমুলে যোগ দিয়েছে। আরো দেবে। এটাই বাস্তব। মমতা বা বুদ্ধ মুখোশের নাম-আসল মুখ, নেপথ্যের কুশীলবরা বদলান নি কিন্ত।

উৎপাদক এবং উৎপাদনের ব্যাবস্থার মালিকানার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন না এলে কোন পরিবর্তন বা চেঞ্জ আসা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেই অসম্ভব। তবুও মমতা যেটা পারবেন-সেটা হচ্ছে ভারতের উন্নত রাজ্যগুলি যেমন গুজরাট বা মহারাষ্ট্রের মতন রাজ্যের অর্থনীতিকে কিছুটা শক্তিশালী করতে পারেন। এর মধ্যে গুজরাত থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওখানে কোয়াপরেটিভ আন্দোলন সফল। একমাত্র গুজরাতেই আমি দেখেছি সাধারন লোকজন দলে দলে উদ্যোগী হয়ে কিছু না কিছু ব্যাবসা করার চেষ্টা করে। ফলে গুজরাতের মাথাপিছু আয় পশ্চিম বঙ্গের প্রায় চারগুণ। এবং এর জন্যে টাটা আম্বানীদের লাগে নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাবসা করার চেষ্টা এবং রাজ্য স্তরে তার জন্যে সব ধরনের সাহায্যই, তাদেরকে আজ ভারতের সেরা অর্থনৈতিক রাজ্যে পরিণত করেছে। মমতা একা খেটে সব চেঞ্চ করে দেবেন এমন ভাবনাটাই ভুল।

বাঙালীর জীবনে পরিবর্তন আনতে গেলে, প্রতিটা বাঙালীকে ব্যাবসামুখী হতে হবে। মমতা ব্যবসার বাতাবরন তৈরী করতে পারেন মাত্র। নইলে বাংলা যে তিমিরে আছে সেখানেই থাকবে। পশ্চিম বঙ্গের অর্থনীতি প্রায় ৬০% মারোয়ারীদের কন্ত্রোলে। আমাকে একজন বিখ্যাত বাঙালী ডিরেক্টর বলছিলেন, কি করে ভালো বাংলা সিনেম হবে? সব টাকাত মারোয়ারীদের হাতে-আমি তাদের কিভাবে বোঝাবো বিভূতিভূষন? বাংলায় আপনি সিনেমাই করুন, বা নিউজ পেপারই খুলুন বা নিউজ চ্যানেলই খুলুন। সব কিছুতেই হাত পাততে হয় মারোয়ারীদের কাছে। সংস্কৃতিতে উন্নত নাসিকা বাঙালীর এটাই আসল পরিচয়। এর থেকে পরিবর্তন? শোষনের হাত থেকে পরিবর্তন?

আসবে না। অত চেঞ্জ কেও চাইছে বলেও মনে হচ্ছে না। মাছ ভাত খেয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারলেই বাঙালী খুশী। চেঞ্জটাও খুশী হওয়ার জন্যেই। আসল চেঞ্জ নাই বা এল-চেঞ্জ নিয়ে দু একটি গান গাইতে পারলেই বাঙালী খুশী।