যুগের চাহিদা বা ইচ্ছার সঙ্গে শিল্প বিযুক্ত থাকতে পারে না। পিপলস থিয়েটার বা গণনাট্যকে অবশ্যই জনগণের সংগ্রামের শরিক হতে হবে। তাদের দুঃখকষ্ট, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে। খোলাখুলিভাবে বলা যায়, গণনাট্য হবে অবশ্যই জনগণের। তা যদি না হয়, তাহলে গণনাট্য কখনোই সফল হবে না। -রোমাঁ রোলাঁ

স্বদেশী আন্দোলনের আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণীর তেমন কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ বা আত্মিক সমর্থন ছিল না। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, পাবনার প্রজাবিদ্রোহ, আঞ্চলিক নানা কৃষক বিদ্রোহ, এসব সংগ্রামে বাঙালি মধ্যবিত্ত সযত্নে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আগুনের তাপ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চা করে গিয়েছে। বিস্ময়করভাবে এর ব্যতিক্রম দেখা দেয় নীল বিদ্রোহের সময়ে। নীলকরদের পীড়ন অত্যাচারে অতীষ্ট নীল চাষীদের দুঃখ-দুর্দশা বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে বিচলিত, ক্ষুব্ধ ও প্রতিকারপ্রত্যাশী করে তুলেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া চাষীরা যখন নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তখন শুধু সহানুভূতি এবং সমর্থনই নয়, তাঁদের সাথে সক্রিয়ভাবে এই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল বাঙালি লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এমনকি জমিদার সম্প্রদায়ের লোকেরাও।

অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এই সম্মিলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ঊনিশ শতকের অত্যন্ত সৃষ্টিশীল একজন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র এবং তাঁর এক অবিস্মরণীয় সৃষ্ট নাটক নীল দর্পণ। এই নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে। প্রথম প্রকাশে লেখকের কোনো নাম ছিল না গ্রন্থটিতে। মলাটে লেখকের নাম না থাকলেও, এটি কে লিখেছেন সেটি জানতে কারোরই বাকি ছিল না সেই সময়।

১৮৩০ সালে চব্বিশ পরগনায় জন্ম দীনবন্ধু মিত্রের। দরিদ্র ঘরের সন্তান তিনি। নিজের চেষ্টায় দাঁড় করিয়েছিলেন নিজেকে। পিতৃদত্ত ‘গন্ধর্বনারায়ণ’ নাম বদল করে ‘দীনবন্ধু’ নাম গ্রহণ করেন। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলার রেঁনেসার সময়ে যে সকল মহৎ সাহিত্যিক তাঁদের মেধা দিয়ে বাংলাকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

দীনবন্ধু মিত্র

ডাকবিভাগে কাজ করতেন দীনবন্ধু। নীল দর্পণ যখন ছাপা হয় তখন তিনি ঢাকা বিভাগের ইনেস্পেক্টিং পোস্টমাস্টার। সরকারি কাজে তাঁকে প্রায়শই ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো। যদিও বাংলায় নীল চাষের মূল জায়গা ছিল নদীয়া (কুষ্টিয়া তখন নদীয়ার অংশ ছিল) এবং যশোর জেলায়। তারপরেও, ঢাকা এবং ময়মনসিংহেও অনেক নীল কুঠি ছিল। সেগুলো চোখা এড়িয়ে যায় নি দীনবন্ধু মিত্রের। মেধাবী, কর্মঠ এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেনঃ

দীনবন্ধুর যেরূপ কার্যদক্ষতা এবং বহুদর্শিতা ছিল, তাহাতে তিনি যদি বাঙালি না হইতেন, তাহা হইলে মৃত্যুর অনেক দিন পূর্বেই তিনি পোস্টমাস্টার জেনারেল হইতেন, এবং কালে ডাইরেক্টর জেনারেল হইতে পারিতেন। কিন্তু যেমন শতবার ধৌত করিলে অঙ্গারের মালিন্য যায় না, তেমনি কাহারো কাহারো কাছে সহস্র দোষ থাকিলেও কৃষ্ণবর্ণের যায় না! শ্বেতবর্ণ যেমন সহস্র দোষ ঢাকিয়া রাখে, কৃষ্ণচর্মে তেমনি সহস্র গুণ ঢাকিয়া রাখে।

১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশ হবার পরের বছরেই ঢাকাতে মঞ্চস্থ হয় নীল দর্পণ। কোলকাতায় তখনও পেশাদার রঙ্গমঞ্চ তৈরি হয় নি। নীল দর্পণ ঢাকায় মঞ্চস্থ হবার পরে কোলকাতার হরকরা পত্রিকায় এ সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ঢাকাস্থ সংবাদদাতা লিখেছিলেনঃ

Our native friends entertain themselves with occasional performances and the ‘Nil Darpan’ was acted on one of these ocations.

এ কারণেই মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা সমগ্রের দ্বিতীয় পর্বের ঊনিশ শতকে ঢাকার থিয়েটার পরিচ্ছদে বলেন যে,

এতে নিশ্চিত হয়ে বলা যায় যে, ‘নীলদর্পণ’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়ে ঢাকায়ই মঞ্চস্থ হয় প্রথম। সন ১৮৬১, সংবাদটির সূত্র ধরে বলা যেতে পারে যে, নীলদর্পণের আগেও ঢাকায় অভিনয় কার্য কিছু হয়েছে। কিন্তু এ সব ছিল শখের অভিনয়।

নীল দর্পণ নাটক বাংলার পেশাদার থিয়েটার গড়ার ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছিল। এই নাটক দিয়ে প্রভাবিত হয়েই গীরিশচন্দ্র ঘোষ কোলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার গঠন করেন এবং নীল দর্পণই প্রথম বানিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয়। এই নাটকের প্রদর্শনীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও উপস্থিত ছিলেন দর্শক হিসাবে। আবেগী এবং মেজাজী লোক ছিলেন তিনি। সাহেব সুবোদের গ্রাহ্যের মধ্যেই নিতেন না। অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য এক ইংরেজ অধ্যক্ষ্যের সামনে টেবিলে পা তুলে দিয়ে কথাও বলেছিলেন একবার। কারণ, ওই অধ্যক্ষ বৃটিশ হবার গরিমায় ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে একই আচরণ করেছিলেন। নাটকের মূল চরিত্র উডের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন শক্তিমান অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। নীল চাষীদের উপর তাঁর অত্যাচারের অভিনয় দেখে বিদ্যাসাগর এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন যে, পায়ের জুতো খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন অর্ধেন্দুর গায়ে। তিনিও তাঁর অভিনয়ের পুরস্কার হিসাবে সেই জুতোকে তুলে নিয়েছিলেন স্মারক হিসাবে।

নীল দর্পণ প্রকাশের পরেই বাংলার বিখ্যাত সব সাহিত্যিকেরা এর পাশে এসে দাঁড়ান। শুধু এই নাটকের ক্ষেত্রেই নয়, নীল চাষের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা সকলেই। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমুখ। একটা মাত্র মহত্তম নাটক যে একটি বিদ্রোহের জন্য রসদ জোগাতে পারে, তা প্রমাণ করে দিয়েছিল নীল দর্পণ।

সেই সময় সবাই যে দীনবন্ধুর পক্ষ নিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবনীতে দীনবন্ধুকে পাতফোঁড় বলে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন ইংরেজের কুৎসা গাওয়ার জন্য। তাঁর ভাষায়ঃ

দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণে’ নীলকরের দৌরাত্ম্য অংশই চিত্রিত করিয়া গিয়াছেন।… দীনবন্ধুবাবু ইংরেজের ত্রুটি, ইংরেজের কুৎসা গাহিয়া গিয়াছেন। ইংরেজ মধ্যে যে দেব ভাব আছে, প্রজার প্রতি মায়া-মমতা-স্নেহ এবং ভালোবাসার ভাব আছে তাহা তিনি চক্ষে দেখিয়াও প্রকাশ করেন নাই। যে ইংরেজ জাতির নেমক-রুটি খাইয়া বহুকাল জীবিত ছিলেন,… সেই ইংরেজের কুৎসা গান করিয়া দু’শ’ বাহবা গ্রহণ করিয়াছেন।… ইহারই নাম ‘পাতফোঁড়’, যে পাতে খান, সেই পাতেই ছিদ্র করেন।

তবে এই মন্তব্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসাটা সমীচীন হবে না যে, মীর মোশাররফ হোসেন ইংরেজ দরদী ছিলেন। তাঁর অবস্থানটা ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। নদীয়ার নীলকরদের প্রধান পাণ্ডা টি আই কেনি ছিল মোশাররফের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই কেনি সাহেব মোশাররফকে বিলাতে পড়তে যাবার খরচও দিতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্থানীয় নীল বিদ্রোহের নেতা ছিল তাঁদেরই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোক। সম্পত্তি নিয়ে তাঁর পিতার সাথে এই লোকের গোলমাল লেগেছিল। ফলে, নীল বিদ্রোহ কবলিত অঞ্চলে থেকে নীলকরদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখার পরেও মীর মোশাররফ হোসেনের অবস্থান ছিল দ্বিধাময়। নদীয়ার এই কেনি সাহেব ছিলেন প্রবল অত্যাচারী লোক। এর কিছুটা ধারণা মেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক চিঠিতে। গণেন্দ্রনাথের এক চিঠির জবাবে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ

তোমার ২৭ মাঘের পত্রে নূতন প্রস্তাব হঠাৎ শুনিলাম। কেনি সাহেব ২০০০০০ টাকা দিয়া ছয় বৎসরের নিমিত্ত বিরাহিমপুর ইজারা লইবেক।… কেনি সাহেবের অধীনে অধুনা যে সকল প্রজা আছে তাহার মধ্যে অনেক প্রজা তাহার দৌরাত্ম্য জন্য তাহার এলাকা হইতে পালাইতেছে। বিরাহিমপুর তাহার হস্তগত হইলে এখানকারও অবস্থা তদ্রূপ হইবেক তাহার সন্দেহ নাই। ছয় বৎসর হস্তগত হইবার পরে এ জমিদারী প্রজাশূন্য দেখিতে হইবেক।

এই কেনি সাহেবের সাথে প্রবল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন সুন্দরপুরের জমিদার প্যারীসুন্দরী দাসী। প্রজাহিতকরণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন এই ভদ্রমহিলা। কেনির হাত থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্য তিনি বলেছিলেনঃ

আমি থাকিতে আমার প্রজার প্রতি নীলকর ইংরেজ দৌরাত্ম করিবে? আমি বাঁচিয়া থাকিতে আমার প্রজার বুনানী ধান ভাঙিয়া কেনি নীল বুনিবে, ইহা আমার প্রাণে কখনই সহ্য হইবে না। প্রজাদিগের দূরবস্থা আমি এই নারীচক্ষে কখনই দেখিতে পারিব না। যে উপায়ে হউক, প্রজা রক্ষা করিতেই হইবে। লোক, জন, টাকা, সর্দ্দার, লাঠিয়াল যাহাতে হয় তাহার দ্বারা প্রজার ধন, মান, প্রাণ, জালেমের হস্ত হইতে বাঁচাইতে হইবে।

কেনিকে শায়েস্তা করার জন্য নীল বিদ্রোহের এই নেত্রী ঘোষণা দেন এই বলে যে,

যে ব্যক্তি যে কোনো কৌশলে কেনির মাথা আমার নিকট আনিয়া দিবে, এই হাজার টাকার তোড়া আমি তাহার জন্য বাঁধিয়া রাখিলাম। এই আমার প্রতিজ্ঞা, আমার জমিদারী, বাড়ী, ঘর, নগদ টাকা, আসবাব যাহা আছে, সমুদয় কেনির কল্যাণে রাখিলাম। ধর্ম্মসাক্ষী করিয়া বলিতেছি, সুন্দরপুরের সমুদয় সম্পত্তি কেনির জন্য রহিল। অত্যাচারের কথা কহিয়া মুষ্টিভিক্ষায় জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিব। দ্বারে দ্বারে কেনির অত্যাচারের কথা কহিয়া বেড়াইব।… দুরন্ত নীলকরের হস্ত হইতে প্রজাকে রক্ষা করিতে জীবন যায় সেও আমার পণ।

প্রজাদের রক্ষার লড়াইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন প্যারীসুন্দরী। নীল চাষে অস্বীকৃতি জানানোতে কেনির লোকেরা প্যারীসুন্দরীর প্রজাদের ক্ষেতের ধান পুড়িয়ে দেয়। এর বদলা নেবার জন্য প্যারীসুন্দরী লোকজন জড়ো করে একাধিকবার কেনির নীলকুঠিতে হামলা চালান। এরকমই এক হামলা কেরির নীলকুঠি চাষীদের রোষানল থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নিহত হন একজন পুলিশ অফিসার। এই অপরাধে সরকার তাঁর জমিদারী ক্রোক করে নেয়।

ঠাকুরপুরে একটা বাংলা স্কুল চলাতেন রেভারেন্ড জেমস লং।বহুভাষাবিদ ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রাচ্য বিশারদ। বাংলা, সংস্কৃতি, ফার্সিসহ আরো অনেকগুলো প্রাচ্যদেশীয় ভাষা জানতেন তিনি। ১৮৬১ সালে দীনবন্ধুর কাছ থেকে নীল দর্পণের একটি কপি পান তিনি।পাদ্রি লং বাংলার গভর্নর জেনারেলের সেক্রেটারি এবং ইন্ডিগো কমিশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সেটন কারের নজরে আনেন। এর গুরুত্ব অনুভব করে সেটন কার কথা বলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর যে পি গ্রান্টের সাথে। নাটকটিতে কী লেখা আছে সেটি জানার জন্য ঘনিষ্ঠ কিছু লোকজনকে দেবার জন্য এর ইংরেজি অনুবাদ করা যায় কি না সে বিষয়ে আগ্রহ দেখান।


রেভারেন্ড জেমস লং

বিষয়টা পাদ্রি লং এর মাথায় গেঁথে যায়। তিনি নিজেই এর অনুবাদ করা শুরু করেন। কিন্তু কৃষকের চলতি গ্রাম্য ভাষা ছিল এই নাটকের প্রাণ। ফলে, এর অনুবাদে খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না তিনি। তাই লং সাহেব শরণাপন্ন হলেন বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই বিশেষ দখল আছে, এমন একজন দেশি ব্যক্তির। সেই ব্যক্তি মাত্র এক রাতের মধ্যে নীল দর্পণের অনুবাদ করে দেন। পাদ্রি লং তখন এই পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেন ক্যালকাটা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং এর স্বত্বাধিকারী ক্লিমেন্ট হেনরি ম্যানুয়েল এর কাছে। তিনশ টাকার বিনিময়ে পাঁচশ কপি ছাপানোর সুরাহা হয়। নীল দর্পণ Nil Darpan, The Indigo Palnting Mirrorনামে তা ছাপা হয়ে যায় অনুবাদকের নাম ছাড়াই। বইতে শুধু লেখা ছিল Transalted from the Bengali by a Native. বইটাতে পাদ্রি লং একটা ভূমিকাও জুড়ে দিয়েছিলেন।


নীল দর্পণের ইংরেজি অনুবাদ

বইগুলো হাতে পাবার পরে পাদ্রি লং সেগুলোকে বিভিন্ন গণ্যমান্য ইউরোপীয় এবং প্রভাবশালী নেটিভদের কাছে ডাকযোগে পাঠানো শুরু করেন। নীলকররা যখন এই ঘটনা জানতে পারলো তখন তাদের ক্ষিপ্ততা দেখে কে। গভর্নরের কাছে তারা জানতে চাইলো যে, কার অনুমতিতে এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে? সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো সদুত্তর না পেয়ে নীলকরেরা আদালতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। লেখক এবং প্রকাশককে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো। কিন্তু, বইয়ে অনুবাদকের নাম না থাকায় শুধু প্রকাশক হেনরি ম্যানুয়েলকে আদালতে তোলা হলো। তিনি নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করে নিলেন এবং জানালেন যে, পাদ্রি  লং এর কাছ থেকে টাকা পেয়েই তিনি এই বইটি প্রকাশ করেছেন। এরপর মামলা সরে গেল পাদ্রি লং এর দিকে। পুরো বিচার চলাকালীন সময়ে পাদ্রি লং এর কাছ থেকে নেটিভ অনুবাদকের নাম জানার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মুখ খোলাতে পারে নি আদালত। বিচার শেষে দোষী বলে আদালত সাব্যস্ত করে তাঁকে। একমাসের কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে।

হাজার চেষ্টা করেও লং সাহেবের মুখ থেকে যে নেটিভ অনুবাদকের নাম জানা সম্ভব হয় নি, তাঁর নাম অবশ্য গোপন থাকে নি। থাকার কথাও নয়। ইংরেজরা ঠিকই ধরে ফেলেছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারে নি প্রমাণ না থাকার কারণে। বাংলা এবং ইংরেজিতে ওইরকম তুখোড় দখল বাংলাদেশে মাত্র একজনেরই ছিল। বুদ্ধিমান পাঠকেরাও এতক্ষণে অনুবাদক কে ছিলেন, সেটা ধরে ফেলেছেন জানি। হ্যাঁ, নীল দর্পণের সেই অজ্ঞাতনামা নেটিভ অনুবাদক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

নীল দর্পণের নেটিভ অনুবাদকের নাম প্রকাশ্যে ফাঁস করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন যে, এই ইংরেজি অনুবাদের ফলে মাইকেল মধুসূদন গোপনে তিরস্কৃত ও অপমানিত হয়েছিলেন এবং এইজন্য শেষে তাঁকে জীবিকানির্বাহের একমাত্র উপায় সুপ্রীম কোর্টের চাকরিও ছেড়ে আসতে হয়েছিল।

কারো জন্য যদি অন্য কেউ জেল খাটার বন্দোবস্ত থাকতো, তবে সেদিন পাদ্রি লং এর জন্য বহু লোকই এক পায়ে খাড়া ছিল। তবে, সেটা হবার নয়। কাজেই হয়ও নি। এক মাসের কারাবরণ করেছিলেন পাদ্রি লং। কিন্তু এক হাজার টাকার জরিমানা তাঁকে বইতে হয় নি। বিচারকের রায় বেরুনোর পরে দেখা গেল যে, আরেক নেটিভ ভদ্রলোক অযাচিতভাবে পাদ্রি লং এর অর্থদণ্ডের সমস্ত টাকা হাসিমুখে পরিশোধ করে দিয়েছেন।

এই নেটিভ ভদ্রলোক একজন জমিদার। নাম কালিপ্রসন্ন সিংহ। হুতোম পেঁচার নকশা দিয়েই তাঁকে চিনি আমরা।