আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে ঢাকার খিলগাঁও এ।

সত্তর দশকের শেষের দিকে জিয়াউর রহমান তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পাড়া এবং মহল্লায় টেলিভিশন দান করেছিলেন। এরকমই একটা টেলিভিশন দানছত্র হিসাবে পেয়েছিল খিলগাঁও সরকারী বালক বিদ্যালয়। স্কুলের মাঠের পাশে উঁচু একটা বেদী করে তার উপরে একটা কাঠের বাক্স বসানো হয়েছিল স্থায়ীভাবে। সেই বাক্সের ভিতরে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো টেলিভিশনটাকে। সন্ধ্যার সময়ে স্কুলের পিওন চাবি দিয়ে কাঠের বাক্সের সামনের দিকটা খুলে টেলিভিশনটা চালু করে দিত। আর বিপুল সংখ্যক মানুষ সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাঝ রাত পর্যন্ত সেই টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করতো।

তিন দশক আগের সেই সময়ে টেলিভিশন ছিল বিলাস সামগ্রী, নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে উঠতে পারে নি তখনও। খিলগাঁওয়ের মত নিম্ন-মধ্যবিত্ত এলাকায় হাতে গোনা দুই একজন মানুষের বাড়িতে তখন টেলিভিশন ছিল। কাজেই, জিয়াউর রহমানের দেয়া এই টেলিভিশন যে বিপুল পরিমাণে মানুষ দেখবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

এই বিপুল সংখ্যক দর্শকের সারিতে আমিও ছিলাম নিয়মিত একজন। বাল্যকালে বাড়াবাড়ি রকমের দুরন্ত এক বাউণ্ডুলে বালক ছিলাম আমি। ঘরের বাঁধন বলতে কিছু ছিল না আমার। ঘর থেকে একবার বের হলে ফেরাটা আমার নিজের ইচ্ছাতে ঘটতো। বিকালে ফুটবল খেলা শেষে বন্ধুরা যখন ফিরে যেতো যার যার বাড়িতে। আমি তখনও মাঠের কোণায় বসে থাকতাম টেলিভিশন দেখার আশায়। এর জন্য অবশ্য প্রতিদিনই খেসারত দিতে হত। চোরের মত রাতে ঘরে ফিরে আসার পরে চোরপেটা পিটুনিই জুটতো আমার পৃষ্ঠদেশে। এই রুটিন নিয়মিতই ছিল। যিনি পেটাতেন, তিনি যেমন জানতেন যে, আমাকে প্রতিদিনই পেটাতে হবে। আমিও তেমনি জানতাম যে এই পিটুনি খাওয়াটাই আমার জন্য সরল স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই, এ নিয়ে খুব একটা মনোকষ্ট বা মাথাব্যথা কোনোটাই সেই সময়ে ছিল না আমার। ক্ষুদ্র ঋণের দাতা-গ্রহীতার মত, পিটুনিদাতা এবং পিটুনিগ্রহীতা, দুজনেই যার যার দায়িত্ব অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং সুচারুভাবেই পালন করে চলেছিলাম আমরা দীর্ঘদিন ধরে।

তো এই সময়েই বাংলাদেশ টেলিভিশনে অবিস্মরণীয় একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের বেশ কিছু ছোট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই ব্যক্তিত্ব আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন চার্লি চ্যাপলিন। সেই বাল্য বয়সে এই ছবিগুলোর মাহাত্ম বোঝার ক্ষমতা তখনও জন্মায় নি। স্রেফ হাসির ছবি হিসাবে দেখতাম সেগুলোকে। নাকের নিচে হিটলারি গোঁফওয়ালা, হাতে একটা লম্বা নমনীয় ছড়ি, ঢিলেঢালা প্যান্ট পরা, হ্যাট মাথায় দেওয়া একজন ছোটখাট মানুষ মজার মজার কাণ্ড করছে, আর আমরা দর্শকেরা হেসে কুটিকুটি হচ্ছি, এটাই এখন পর্যন্ত স্মৃতিতে গেঁথে আছে আমার। আমার এবং অন্যান্য অশিক্ষিত, অপরিশীলিত এবং অপরিস্রুত দর্শকদের মত বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মকর্তারাও মনে হয় সেগুলোকে হাসির ছবি হিসাবেই বিবেচনা করতেন। কারণ, এগুলো দেখানো হতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের দৈনিক সম্প্রচার শুরু হবার শুরুর দিকে। শিশুদের জন্য নির্ধারিত সময়ে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ওই সময়ের পরে চার্লি চ্যাপলিনের আর কোনো সিনেমা দেখা হয় নি আমার।

বছর সাতেক আগের ঘটনা। তখন আমি পড়াশোনা করছি মিশিগানের ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনা করছি বললে অবশ্য পড়াশোনাকেই শোচনীয়ভাবে অপমান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম আছে আমার। প্রতিদিন ক্লাসে যাই। এটুকুই শুধু। ক্লাস শেষ হলেই এক দৌঁড়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে মুক্তমনা না হয় ভিন্নমত নিয়ে বসি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি আগাপাশতলা। ক্লান্ত হয়ে গেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে শুভ্র-সুন্দরীদের সৌন্দর্য অবলোকন করি। না হয়তো ভিডিও-র সেকশনে গিয়ে উলটে পালটে বিভিন্ন ক্যাসেট আর ডিভিডি দেখি। এরকমই একদিন ডিভিডি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হুট করে চোখে পড়ে যায় চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড ছবিটি। বাড়িতে নিয়ে আসি ওটাকে। ওই এক ছবিও বদলে দেয় সবকিছু। বাল্যকালের মুগ্ধতাকে মসৃনভাবে ছাড়িয়ে যায় পরিণত বয়সের মুগ্ধতা। এরপর থেকে শুরু হয় চ্যাপলিনের ছবি দেখা। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে চ্যাপলিন সৃষ্ট ছোট-বড় সমস্ত ছবিগুলো দেখা হয়ে যায় আমার। চ্যাপলিন বাদে আর কোনো চলচ্চিত্র পরিচালকের ছবিসমূহ এ টু জেড এরকম গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না আমার। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে যে, এই সমস্ত ছবিগুলো আশি-নব্বই বছর আগে নির্মিত, অথচ কোনোটিকেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হয় না অপ্রয়োজনীয়, সময়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক, পিছিয়ে পড়া কিংবা দ্বন্দ্বমুখর। এমনই সাম্প্রতিক এবং আধুনিক চ্যাপলিনের সৃষ্টি। সময়কে অতিক্রম করে সর্বকালীনতাতে বিলীন হতে পেরেছে বলেই, চ্যাপলিনের অধিকাংশ সৃষ্টিই এখন ক্লাসিকের মর্যাদায় ভূষিত।

তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডে। বিশ-একুশ বছর বয়সে চলে আসেন আমেরিকায়। ১৯১৪ সালে তাঁর প্রথম ছবি মেকিং এ লিভিং মুক্তি পায়। দুনিয়ার তাবত সব বিখ্যাত লোকদের মতই, তাঁর প্রথম ছবি ফ্লপের খাতায় নাম লেখায়। এর ফলে অভিনয় জীবন বড়সড় হুমকিতে পড়ে যায় চ্যাপলিনের। তবে এই খারাপ সময় হয় স্বল্পস্থায়ী। একই বছরে মুক্তি পায় স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কিড অটো রেসেস এট ভেনিস। এই চলচ্চিত্রেই চ্যাপলিন তাঁর বিখ্যাত হতদরিদ্র ‘লিটল ট্র্যাম্প’ চরিত্রটির জন্ম দেন। এই চরিত্রটিই পরবর্তীতে চ্যাপলিনের প্রায় সব ছবিতে মূখ্য চরিত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

লিটল ট্র্যাম্প

এর পর থেকে আর চ্যাপলিনকে পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। অল্প দিনের মধ্যেই নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগের সেরা অভিনেতা এবং নির্মাতায় পরিণত হন তিনি। সেই সময় হলিউডের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতা ছিলেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একে একে নির্মাণ করতে থাকেন অসংখ্য স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। তবে, শুধু স্বল্প দৈর্ঘ্য নয়, এর পাশাপাশি পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা শুরু করেন। এগুলোর মধ্যে দ্য কিড, সিটি লাইফ, মডার্ন টাইমস এবং গ্রেট ডিক্টেটর অন্যতম। এর সবগুলোই ক্লাসিকের মধ্যে পড়ে। তবে, এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে তাঁর গোল্ডরাশ চলচ্চিত্র। এটি প্রথমবার মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৫ সালে। গোল্ড রাশ শুধুমাত্র চার্লি চ্যাপলিনেরই সেরা ছবি নয়, চলচ্চিত্র ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা ছবি এটি। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিট্যুটের জরিপ অনুযায়ী গত ১০০ বছরের সেরা ১০০ টি চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে গোল্ড রাশ।

১৮৯৭-৯৮ সালের দিকে আলাস্কা অভিমুখে স্বর্ণ অনুসন্ধানের জন্য মানুষের যে ঢল নামে তাকে উপজীব্য করেই চার্লি চ্যাপলিন তাঁর গোল্ডরাশ ছবিটি তৈরি করেন। ১৮৯৩ এবং ১৮৯৬ সালে আমেরিকার অর্থনীতি বিশালাকার দুটো ধাক্কা খায়। এর ফলে অসংখ্য লোক চাকুরি হারায়। এই সমস্ত বেকার লোকেরাই বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণের সন্ধানে ছুঁটে যেতে থাকে।

আলাস্কার গোল্ড রাশ

আমি এখানে অবশ্য গোল্ড রাশ চলচ্চিত্রটির সার্বিক আলোচনা করতে বসি নি। এই চলচ্চিত্রটি একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। চ্যাপলিনের অনন্যসাধারণ মেধা, গভীর মননশীলতা, সুউচ্চ শিল্পের কাজ, প্রাণপাত পরিশ্রম, উত্তুঙ্গ উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ দক্ষতার ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে পুরো ছবিটা জুড়েই। তবে, এই ছবিটির দুটি দৃশ্য ছাড়িয়ে গিয়েছে আর সব কিছুকেই। এরকম অদ্ভুত উদ্ভাবনী দক্ষতাময়, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন, প্রবল রসবোধসম্পন্ন এবং শিল্পের মাধুর্যময় কারুকার্যমণ্ডিত দৃশ্য খুব কম চলচ্চিত্রেই পাওয়া যায়।

এই দুটি দৃশ্যের একটি হচ্ছে জুতো খাবার দৃশ্য। ক্ষুধা-দারিদ্র নিয়েও যে তীব্র রসাত্মক দৃশ্য তৈরি করা যায় তাঁর প্রমাণ হচ্ছেন চ্যাপলিন। তীব্র তুষারপাতের মধ্যে একটা কেবিনের মধ্যে আটকে পড়া দুজন ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার জন্য অন্য কিছু না পেয়ে একজনের পায়ের একপাটি জুতো সিদ্ধ করে খাচ্ছে। করুণ কোনো দৃশ্যকে হাস্যরসাত্মক এবং ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে চ্যাপলিনের জুড়ি ছিল না। তবে, এই দৃশ্যে তিনি নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। চ্যাপলিন মনে করতেন যে, অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে হাস্যরস করাটাও এক ধরনের বিদ্রোহই। খাদ্যবিহীন অবস্থায় চ্যাপলিন জুতো খাবার মত অভাবনীয় এই ধারণাটি পেয়েছিলেন ডোনার পার্টির কাছ থেকে। ডোনার পার্টি ছিল একদল আমেরিকান পাইওনিয়ার। ১৮৪৬ সালে একটা ওয়াগন ট্রেনে করে এরা যাত্রা শুরু করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদেরকে পুরো শীতের মৌসুমটা তুষারের কবলে পড়ে কাটাতে হয় সিয়েরা নেভাডার পর্বতে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বেঁচে থাকার জন্য মানুষের মাংসও খেয়েছিল। কেউ কেউ ক্ষুধার হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য জুতো সিদ্ধ করেও খেয়েছিল।

httpv://www.youtube.com/watch?v=mtZTIwSIuGw

অন্য দৃশ্যটি একটি নাচের দৃশ্য। তবে এখানে কোনো নর্তক বা নর্তকী নেই। দুটো ফ্রেঞ্চ ব্রেড রোলকে দুটো কাটা চামচ দিয়ে বিদ্ধ করে চ্যাপলিন নিজেই এই নাচের দৃশ্যটি তৈরি করেছেন।

চ্যাপলিনের কেবিনের বাইরে নায়িকা জর্জিয়া এবং তাঁর সখিরা স্নোবল নিয়ে ছুঁড়োছুঁড়ি করছে। হৈ হুল্লোড় শুনে কেবিনের দরজা খুলে বের হয়েছে চার্লি। রমণীকুলের ছুঁড়ে দেওয়া তুষারবল এসে লাগে চ্যাপলিনের মুখে। ফায়ারউড জোগাড়ের জন্য চার্লি বের হয়ে যেতেই, চার্লির বালিশের নীচ থেকে তাঁর নিজের ছবি আবিষ্কার করে জর্জিয়া। সখিদের সাথে শলাপরাপর্শ করে চার্লির সাথে নিষ্ঠুর এক কৌতুক খেলায় মেতে উঠে সে। চার্লির কাছে ডিনারের আমন্ত্রণ জানানোর ঈঙ্গিত দেয় সে। নিউ ইয়ারস ইভে সন্ধ্যা আটটার সময় চার্লি ডিনারে আসার জন্য নিমন্ত্রণ জানায় জর্জিয়া এবং তাঁর সখিদের। এই ডিনারের পয়সা যোগানোর জন্য ভিক্ষা করা, ধার করা এবং তুষার পরিষ্কারের মত হাড়ভাঙা পরিশ্রমও করে সে। নিউ ইয়ারস ইভে তীব্র উত্তেজনা নিয়ে ডিনার তৈরি করে অপেক্ষায় থাকে চার্লি। কিন্তু হায়! সময় বয়ে যায়। সুন্দরী জর্জিয়া আর আসে না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত চার্লি ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়। স্বপ্নে দেখে জর্জিয়া আর তাঁর হাস্যমুখর সখিরা ডিনারে এসেছে। চার্লি তাঁদেরকে আমোদিত করার জন্য দুটো ফ্রেঞ্চ ব্রেড রোলকে দুটো কাটা চামচ দিয়ে বিদ্ধ করে ব্যালে নাচ দেখানো শুরু করে।

httpv://www.youtube.com/watch?v=xoKbDNY0Zwg&feature=related