তথ্য-প্রযুক্তি সর্ম্পকে যারা ওয়াকিবহাল, তারা এরই মধ্যে জেনে গেছেন, জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ভাষার ব্লগ সাইটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনটি বিভাগে বাংলাদেশের তিনজন ব্লগার বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া আরো তিনটি বিভাগে দেশের আরো তিনজন বাংলাব্লগ দ্বিতীয় স্থান জয় করেছেন। তাই এ বিজয় শুধু ব্লগারদের একক বিজয় নয়, এটি একই সঙ্গে বাংলা ব্লগেরও বিজয় বটে।

সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এক নজরে জেনে নেওয়া যাক, ব্লগ বিষয়টি আসলে কী?

এক সময় মানুষ যখন লিখতে শেখেনি, তখন ছবি এঁকে সে মনের ভাব প্রকাশ করতো। গুহাচিত্রে এর অসংখ্য নজির রয়েছে। বিবর্তনের ধারায় ভাষা ও অরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লেখার উপকরণের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মানুষ পাথর, পোড়া মাটির ফলক, চামড়া, গাছের ছাল, পাতা, কাপড় এবং সবশেষে প্যাপিরাস ও কাগজে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে; লেখা-পড়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাপ্তরিক কাজ তো বটেই।

আরো পরে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টাইপরাইটার হয়ে চলে আসে কম্পিউটার, লেখা হতে থাকে ভার্চুয়াল জগতে– আন্তর্জালে, মুঠোফোনের সংপ্তি বার্তা, এসএমএস-এও। মূল বিষয়টি কিন্তু একই থেকে যায়– ভাব প্রকাশ। আমি যা ভাবছি, তা অন্যকে জানানো, অন্যের ভাবনা জানা, মতামত, বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক। এটি যেনো অনেকটা সেই লিটল ম্যাগাজিনেরই ভার্চুয়াল সংস্করণ। প্রথাবিরোধী লেখা-লেখির এক নতুন মাধ্যম; কেউ বলেন– বিকল্প গণমাধ্যম।

প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে ব্লগ সাইটে লেখালেখির আরেকটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ব্লগে লেখা প্রকাশের পর পরই মন্তব্যর ঘরে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। সেখানেও চলে তর্ক-বিতর্ক, প্রসংশা, এমনকি লেখার তুমুল সমালোচনা ও নিন্দাও। আবার একটি লেখার বিতর্ক জন্ম দেয় আরো অনেক চিন্তাশীল লেখা।

‘ওয়েব-লগ’ কথাটি থেকে ‘ব্লগ’ কথাটির জন্ম, এর প্রথম সূচনা জর্ন বার্গার নামে একজন আমেরিকানের হাত ধরে ১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তিনিই প্রথম ‘ওয়েবলগ’ কথাটি ব্যবহার করেন, আদি ব্লগারদের তিনি একজন, প্রথম দিকের ব্লগ সাইটের উদ্যোক্তা তো বটেই। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মের দিকে পিটার নামে জনৈক ‘ওয়েবলগ’ কথাটিকে আরো সহজ করে ‘উই ব্লগ’ কথাটি ব্যবহার করেন। ক্রমে ‘উই ব্লগ’, পরে শুধু ‘ব্লগ’ কথাটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনের ভাব প্রকাশ, সৃজনশীল লেখালেখি, সামাজিক যোগাযোগ ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিস্তৃত করে। ব্লগ ধারণাটি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়তে থাকে এর লেখক-পাঠক সংখ্যা। যারা জীবনে কখনো পরীক্ষার খাতা, চাকরি জীবন বা চিঠি-পত্রের বাইরে কোনো রকম লেখালেখি করেননি, অধিকাংশ এমন মানুষও ব্লগ পড়তে পড়তে এর ভক্ত হয়ে ওঠেন, তিনি নিজেই এক সময় লিখতে শুরু করেন। পেশাদার লেখকরা তো ব্লগে আছেনই। ব্লগের এই ধারাবাহিক অগ্রগতি এখনো চলছেই।

তথ্য-প্রযুক্তিতে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে, ব্লগের ধারণাটিও আমাদের জন্য প্রায় নতুন, তাই বাংলা ব্লগ সাইটও অনেক পিছিয়ে থাকবে, এটিই যেনো ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরেও মাত্র চার বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষার সংকেতায়ন বা ইউনিকোড উদ্ভাবনের পর বাংলা ব্লগের অর্জন নেহাত সামান্য নয়।

‘বাঁধ ভাঙার আওয়াজ’ শ্লোগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা শুরু করে বাংলা ব্লগ সামহোয়ার ইনব্লগ ডটনেট। এখনো এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট। এর নিবন্ধিত সদস্য এখন আটত্রিশ হাজার। বাংলা ভাষাভাষী অধিকাংশ ব্লগারই এর সদস্য। এরপর তৈরি হয়েছে সচলায়তন, আমার ব্লগ, মুক্তমনা, পেঁচালী, নির্মানব্লগ, নাগরিকব্লগ, প্রজন্ম ফোরাম। দৈনিক পত্রিকাগুলোও ব্লগ সাইট চালু করেছে। ব্লগ সাইট নির্মাণে এ দেশের আদিবাসীরাও পিছিয়ে নেই।

‘কথা হোক ইচ্ছে মত’ শ্লোগান নিয়ে মডারেশন বিহীন ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম যাত্রা শুরুর মাত্র তিন বছরেই প্রায় ১৫ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেছে। তারাই প্রথম ব্লগ সাইটে মুক্তি দিয়েছে ‘হিল্লা’ নামক একটি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র। চলতি বছর ফেব্র“য়ারিতে এর উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আমারব্লগ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। এই ব্লগ সাইটটিসহ সচলায়তন ডটকম, মুক্তমনা ডটকম এরই মধ্যে ব্লগারদের একাধিক ইলেক্ট্রনিক বই বা ই-বুক প্রকাশ করেছে। যুক্তি, বিজ্ঞান, দর্শন, মুক্তচিন্তা, ব্লগাড্ডা — কী নেই মুক্তমনায়? মুক্তমনা মনে করে– যুক্তি আনে চেতনা, চেতনা আনে সমাজ পরিবর্তন।

আদিবাসী বাংলা ব্লগ ডাব্লিউফোর স্টাডি ডটকম ই-বুক প্রকাশের পাশাপাশি আদিবাসীদের অধিকার, সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের ওপর নানা লেখা প্রকাশ করে চলেছে। এখন তারা কাজ করছে আদিবাসী তথ্যকোষ ও সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে।

আন্তর্জালের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন পাঠককে ব্লগারদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে ব্লগগুলো গত তিনবছর ধরে একুশে বই মেলায় নির্বাচিত লেখা নিয়ে বই প্রকাশ করছে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ, এমন কী অসহায় মানুষের পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়েও দাঁড়াচ্ছেন ব্লগাররা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ব্লগাররা অনলাইন ও অফলাইনে যোগাড় করেন লাখ লাখ গণস্বার। এছাড়া তারা আয়োজন করেন নিয়মিত আড্ডা, পিকনিক ও ব্লগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস. একুশে ফেব্রয়ারিতে বন্ধু-বান্ধবসহ ব্লগাররা সপরিবারে মিলিত হন। পরিচিত হন একে অপরের সঙ্গে। মেতে ওঠেন আনন্দ-হাসি-গানে।

এ সবই হচ্ছে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বোধ এবং একটি অন্য রকম যুথবদ্ধতা– যা আগে কখনোই এ ভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে দেখা যায়নি। প্রবাসী বাঙালিরা তো অনেকই দেশচিন্তা ও একান্ত নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্লগকেই। কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যারের পর অভ্র সফটওয়্যার এবং ইউনিকোডে বাংলা প্রকাশ হওয়ার পর ব্লগেও ঘটে গেছে এমনই সব বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

এরই পথ ধরে এ বছর বাংলা ব্লগ ছিনিয়ে এনেছে ডয়েচে ভেলের সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতায় তিন-তিনটি পুরস্কার।

আমারব্লগ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ব্লগার মাহমুদুল হাসান রুবেল জানান, ডয়েচে ভেলের ব্লগ প্রতিযোগিতায় সামাজিক কর্মকাণ্ড বিভাগে সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অমি রহমান পিয়াল এবং সেরা বাংলা ব্লগ বিভাগে সাংবাদিক ও ব্লগার আরিফ জেবতিক জয়ী হয়েছেন। তারা দুজনই আমারব্লগ ডটকম-এর নিয়মিত লেখক। তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও বাংলা ভাষার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে বাংলা ব্লগ। বাংলা ভাষায় ব্লগ সাইটগুলো ক্রমেই বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠছে।

মানবাধিকার বিভাগে সেরা ব্লগ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে আদিবাসী বাংলা ব্লগ। এর নির্মাতা ও প্রধান সঞ্চালক সান্তাল আদিবাসী ছাত্র সমর মাইকেল সরেণ বলেন, আদিবাসী বাংলা ব্লগ যে বিপুল পরিমাণ ভোটে জয় লাভ করেছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বাংলা প্রিয়রা আদিবাসীদের পাশে আছেন। তারা আমাদের অন্তরের কান্নাটি শুনতে পান। আরও প্রমাণিত হয়েছে, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি পূরণ বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা সকলেই চান। এ বিজয় বাংলাদেশের, এ বিজয় আদিবাসীদের। আমি স্বপ্ন দেখি, এ রকম আরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আদিবাসীরা বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে দেশের গৌরব ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। সমর সরেণ, আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ জাতিগোষ্ঠি’ বা অন্যকোনো অভিধায় নয়, ‘আদিবাসী’ হিসেবেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করেন।

মুক্তমনা ডটকমসহ আরো কয়েকটি ব্লগে নিয়মিত লেখেন রণোদীপম বসু। তার মতে, ডয়েচে ভেলের এই পুরস্কার সাধারণ লেখক-পাঠক সবাইকে বিভিন্ন ব্লগ সর্ম্পকে আগ্রহী করে তুলবে। তিনি বলেন, এটি আসলে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক দিকেরই অগ্রযাত্রা। আমরা যারা অনলাইনে ব্লগিং করি, তারা পত্রিকায় লেখার চেয়ে খুব সহজেই ব্লগেই নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারছি। মন্তব্য-পাল্টা মন্তব্যে দেশের ও প্রবাসের ব্লগারের সঙ্গে ভাব-বিনিময় হচ্ছে। এটি পত্র-পত্রিকায় লিখে সে ভাবে সম্ভব ছিলো না। রণোদীপম বসু মনে করেন, বাংলা ব্লগ এখন এতোই শক্তিশালী একটি মাধ্যম যে পত্র-পত্রিকাতে এর প্রভাব পড়ছে। অনেক লেখাই লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রের পাতায়। আবার পত্র-পত্রিকাগুলো ব্লগ থেকে বিভিন্ন তথ্য ও লেখার প্রেরণাও পাচ্ছে।

প্রতিযোগিতায় সেরা ব্লগ বিভাগে দ্বিতীয় হয়েছেন সাবরিনা সুলতানা। চট্টগ্রামের মেয়ে সাবরিনা কৈশর থেকে মাসকিউলার ডিসট্রফি নামক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। এতে তার দুই হাতের দশটি আঙুল বাদে পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। শাররীক এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই দিনের পর দিন তিনি কি-বোর্ড চেপে লিখে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায় সম্পর্কিত অসংখ্য ব্লগ। তৈরি করছেন জনসচেতনতা।

এই লেখকের সঙ্গে আলাপকালে সাবরিনা সুলতানা বলেন, আমাকে যারা ভোট করেছেন, তারা প্রতিবন্ধী মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট করেছেন।

ডয়েচে ভেলের ব্লগ প্রতিযোগিতায় তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগে অভ্র সফটওয়্যারের প্রধান নির্মাতা মেহেদী হাসান খান এবং রিপোর্টার্স ইউদাউট বর্ডারস বিভাগে আবু সুফিয়ান দ্বিতীয় হয়েছেন। ব্লগার মেহেদী সচলায়তন ডটকম-এর পুরনো ব্লগার। পাশাপাশি তার নিজস্ব ব্লগ সাইটও রয়েছে। তথ্য-সংবাদ তথা গণমাধ্যম নিয়ে ব্লগ স্পটে অনেক দিন ধরেই ব্লগ লিখে সচেতনতা তৈরি করছেন আবু সুফিয়ান।

এই তিন জন বিজয়ী ব্লগার পিয়াল, আরিফ ও সমর এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সাবরিনা, মেহেদী ও সুফিয়ানকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। জয় হোক মুক্তচিন্তার, জয় হোক বাংলা ব্লগের!


স্ক্রিন শট: ডয়েচে ভেলের সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতা– ববস অ্যাওয়ার্ড, মুক্তমনা ডটকম, আদিবাসী বাংলা ব্লগ, লেখক।