শেফালী
এখানে এখনও আর্শ্বিন আসে। সারাদিন সাদা মেঘ নীল আকাশে নাচে। তারপর গোধুলি রাঙা হয়ে সন্ধা নামে। কিন্তু আগের মত দিনমান ঢাকীর ঢাকে আনন্দের বোল পড়েনা। আমার আর শেফালীদের বাড়িতে দুর্গার ঠেরেন (নির্মাণাধীন কাঁচা মুর্তি) দেখতে যাওয়া হয়না। এখন শরতে আমাদের গ্রামে পুজো হয়না। অর্ধেক হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামটিতে এখন মাত্র একঘর হিন্দু কায়ক্লেশে সংকুচিত জীবনযাপন করে। অথচ হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই। একে অন্যের সুখ-দুঃখের সাথী। এমনটাই দেখতে দেখতে বড় হয়েছি।

শেফালী আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু। প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময়কার বন্ধু। কমলা আর সাদায় শেফালী ফুলের মতই। একটা গোলাকৃতি মুখ। টকটকে ফর্সা। প্রতিমার মত টানা চোখ। কপালে ঢেউ খেলে খেলে নেমেছে কালো কোকড়ানো চুল। সরল আর মায়াময় চেহারা। তখনো শেফালীর একটাও দাঁত পড়েনি। আমারওনা। পূর্ণিমার পড়েছে একটা। নীচের পাটি থেকে। পূর্ণিমা শেফালীর ছোটকার মেয়ে। শেফালী ধীরেন কাকার মেয়ে। ধীরেন কাকা আব্বার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু।

আব্বার কাধেঁ চড়ে ধীরেন কাকাদের বাড়ি যাই প্রায়ই। আব্বা যাবে বুঝলেই হলো। অব্যর্থ বায়না ধরি। শেফালীর সাথে খেলতে পারবো তাহলে! কাকীমা কী ভীষন আদর করেন! ঠাকুমা পান ছেঁচে নিজে খায়, আমাদেরকেও দেয়। ওরা কত ভালো! আব্বা ঠাকুর দালানের বারান্দায় বসে ধীরেন কাকার সাথে আলাপ করে। কাকীমা মুড়ি আর পায়েশের বাটিটা জলচৌকিতে রেখে ঘোমটা টেনে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ঠাকুমা ডাকেন, ও বৌমা ওদের জল দিলেনা? দু গ্লাস জল দিয়ে যাও! কাকীমার ব্যস্ত উত্তর আসে-যাই মা!

ছোটকা মানে নরেন কাকা বেত তুলছেন। ছোট কাকীমা আর পিসিমনি পাটি বুনছেন। বেতের পিঠের পার্শ্বের দিয়ে শীতল পাটি। অবিরত হাত চলছে। আঙ্গুলের ফাঁক গলে গলে চিকন বেত ঢুকে যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে। ফুটে উঠছে নকশা। পাটি দুধরনের হয়। পিঠের পাটি আর বুকার পাটি। বেতের বাইরের মশৃন অংশ (পিঠের পার্শ্ব) থেকে পিঠের পাটি আর ভিতরের দিকের খসখসে অংশ দিয়ে বুকার পাটি। বেত গাছ কেটে ডালপালা ছেটে তারপর চিকন করে বেত তুলতে হয়। গড়ম পানিতে সেদ্ধ করে শুকিয়ে পাটি বুনতে হয়। পাটি বোনা হয়ে গেলে আবার ঝুরতে হয়। ম্যালা ঝামেলা।

ছোট কাকীমা সকালের স্নান সেরে পিঠময় চুল ছড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় বসেছেন। মিষ্টি চেহারার কাকীমা সিঁথিতে চিকন করে সিঁদুর টেনেছেন। আজ কপালে টিপ দেননি। তাতেই তার রুপে যেন বারান্দা আলোতিক হয়ে আছে। আব্বাকে দেখে হালকা ঘোমটা তুলে পাটি বোনায় মনোযোগ দিলেন। পিসিমনি আমাকে দেখে শেফালীকে ডাকলেন। ও শেফালী, দেখ কে আইছে!

আমি আর শেফালী হাত ধরাধরি করে পাশের বাড়ি হতে পূর্ণিমাকে ডেকে আনি। লেবুতলায় গিয়ে শাদা ধুলা দুহাত দিয়ে জড়ো করি। সরু সীমানা টেনে টেনে ঘর বানাই। কাঁঠাল পাতা কুঁড়িয়ে আনি। কাঞ্চন ফুলের পাপড়ি, আমরুল শাকের পাতা আর কালোমেঘা গাছের ফল তুলে আনি। আমরা রান্না করি। আবার কাঁঠাল পাতায় খাবার বেড়ে আব্বা, ধীরেন কাকা আর নরেন কাকার কাছে ছুটে যাই। খাও কাকা। খেয়ে বল রান্না কেমন হয়েছে? সবাই কাঁঠাল পাতা মুখের কাছে নিয়ে মুখ চুকচুক করে বলে বাহ! বাহ! ভীষন মজা হয়েছে তো দেখি!

আমরা আবার খেলায় ফিরে যাই।
-আচ্ছা শেফালী তোরা পানিকে জল বলিস কেনো?
-তার আমি কি জানি? মা, বাবা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, ছোটকা, ছোটমা, পিসিমনি সবাইতো বলে। পূর্ণিমাওতো বলে। তোরা জলকে পানি বলিস কেন, বল?
-আমরা যে মুসলমান, তাই।
-অ!

শেফালী, পূর্ণিমা কিংবা আমি আমরা কেউ-ই বুঝিনা হিন্দু কিংবা মুসলমান হলেই একটা জিনিষের দুইটা নাম হবে কেন?

আব্বা আর ধীরেন কাকা হাত ধরাধরি করে বসে আছেন। ’তুই চলে গেলে প্রাণ খুলে কথা বলার মত এ গাঁয়ে আর আমার কে আছে বল? তোদের এই ঘর-গেরস্থালী, শান-শওকত সব ফেলে কেন যেতে হবে? কাকাকে বুঝিয়ে বল। এখানে বছরে দুই আড়াই হাজার মন ধান, হাজার মন পাট, বেতবন, পাটির ব্যবসা তোর স্কুলের চাকরী- তোদের অবস্থাপন্ন গোছানো সংসার। ওদেশে গেলে এতসব হবে একেবারে? যদি ঠিকমত দাঁড়াতে না পারিস? পারবি সে জীবন মেনে নিতে?’

কাকা দুদিকে মাথা নাড়েন। জানিনা, জানিনারে। কি হবে কিচ্ছু জানিনা। কিন্তু বাবা পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। কোন জমি কে নিচ্ছে সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। মাত্তাপাড়ার সব জমি তালুকদাররা নিয়েছে। উত্তর পাড়ার অংশ ইন্নস সরকার আর আবু খাঁ নিয়েছে। বাড়ী ভিটাটা কুতুব আলী নিবে। সব ঠিকঠাক। টাকাপয়সা সব হাতে এসে গেলে সামনের ভাদ্দর মাসের কোন একদিন……।

ধীরেন কাকার গলা ধরে আসে। আব্বাকে দেখি বিষন্ন বসে আছেন।

ঠাকুমার মন খারাপ। কদিন ধরেই সংসারের কোন কিছুতে মন নেই। কেবলি পুরানো দিনের কথা মনে আসে। সেই কবে কোন আশ্বিনের রাতে কালিহাতী থেকে আটবছর বয়সে এ বাড়িতে এসেছিলেন! আজ প্রায় ষাট বছর ধরে এই ভিটেতে। এই তুলসী তলা, কুয়ার পাড়, নিকানো উঠান, পুঁই লতা, ওই পুকুর ঘাট, কলা ঝোপ, বাঁশবাগান, শিরিষ-কড়ই-সেগুনের গাছ, রান্নাঘর, এই ঠাকুরদালান, বারান্দা সব-সব ফেলে চলে যেতে হবে? জীবনতো প্রায় কেটেই গিয়েছে। কত মায়াময় জোছনা রাত, কত আমাবশ্যা, পুজা-পার্বণ-ঈদ, জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে, জামাইষষ্ঠী, অন্নপ্রাশন- কত উৎসব এই আঙ্গিনায়! কত স্মৃতি!কত মায়া! সব ছেড়েছুড়ে কোন অনিশ্চয়তায় এ যাত্রা?

ঠাকুমার মন বোঝেনা। কেন যাবো? কেন যেতে হবে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে? এ গায়ে তো হিন্দু মুসলমানে কোন সমস্যা নাই। সবাই মিলে মিশে থাকে। এক অপরের সুখ-দুঃখের সাথী। তবে? ঠাকুর্দা বলে-তুমি সব কথা বুঝবে না।

ঠাকুমা সত্যিই বোঝেন না। এদেশ, এ জল মাটি বাতাস, এখানে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, সংসার পেতেছি, ছেলেপুলে মানুষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যোয়ান দেওরটি প্রান দিলো। এদেশ ছেড়ে কেন যাবো? ঠাকুমার মনে হয় এর আগে প্রান পাখিটাই যদি যেতো উড়ে। ভালো হতো। এ প্রিয় পুণ্য ভুমিতেই তবে দেহাবশেষ মিশে যেতো। এভাবে শেকড় ছিন্ন করে ভিনদেশে আবার নতুন করে সংসার- এ যে মন মানতে চায়না।

অথচ সব ঠিকঠাক। জমিজমা-বাড়িভিটা কে কোনটা নিবে সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। টাকাগুলো ঠিকমত হাতে এলে সামনের ভাদ্দর মাসেই…….। ঠাকুমার ভেতরটা হু হু করে। এবাড়িতে আর পুজো হবেনা। প্রদীপ জলবেনা তুলসীতলায়।

শেফালীও বোঝে এবারের যাওয়াটা বেড়াতে যাওয়া নয়। পাকাপাকি। আর ফেরা হবেনা। খেলার সাথীদের সাথে আর দেখা হবেনা। আমাকেও জানিয়ে দেয়। মন খারাপ হয়ে যায় আমাদের দুজনের।
আব্বা উঠেন। শেফালীকে ছেড়ে আমিও আব্বার হাত ধরি। আমার প্রানের শেফালী। ওকে ছেড়ে যেতে মন চায়না। কিন্তু যেতে হয়।

কয়েকদিন পর এক সকালবেলা। ঘুম ভাঙে পাখির কিচির মিচির আওয়াজে। তখনও আলো ফোটেনি। চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দা ছেড়ে উঠোনের কোনে পেয়ারা তলায় এসে দাঁড়াই। পেয়ারা ফুলের পাপড়ি পড়ে পেয়ারাতলা একেবারে সাদা হয়ে আছে। এ দৃশ্যটা আমার ভীষণ ভাল লাগে। সামনে পুব দরজা ঘরের বারান্দায় জলচৌকিতে দাদা ফজরের নামাজ আদায় করলেন। হাতের আংগুল গুনে এখন তসবীহ পড়ছেন। চারিদিকে একটা শান্ত নিরবতা। বিবি (দাদীকে আমরা বিবি ডাকতাম) দাদার জন্য পান ছেঁচে তার হাতে দিলেন। তারপর ধীর পায়ে পায়রার খোপ আর হাঁস-মুরগীর খোয়ারের দরজা খুলে দিতে চললেন। জেঠা ফিরলেন মসজিদ থেকে। একে একে সব ঘর থেকে সবাই জাগল। সুর্যের আলো আর মানুষের কোলাহল বাড়ল। আমি মুখ-হাত ধুয়ে পড়তে বসলাম। কানে আওয়াজ এল- দাদা আব্বাকে বলছেন, ধীরেনরা তবে সত্যিই চলে যাচ্ছে? জেঠার উত্তর কানে আসে- ওরা গতকাল রাতেই গাঁ ছেড়েছে।

হাহাকার করে উঠল আমার মন। গত রাতেই চলে গেছে? শেফালীও? ঠাকুমা, ছোটকা, পিসিমনি–সবাই? সবাই চলে গেছে? আর দেখা হবেনা? কখনো না? আজ সকালে শেফালীর সাথে আমার ‘পুতুল বিয়ে’ খেলার কথা! শেফালীর মনে নেই? শেফালী চলে গেছে?

শেফালী–যে হাসলে টুপটাপ ফুল ঝরতো, গাল দুটো লাল হয়ে যেতো! পাশের বাড়ির বাবলুদা শেফালীর চুল ধরে টানলে ওর কালো মায়া ভরা চোখ দুটো জলে ভরে যেতো! শেফালী ছোট বাছুরের লাফ দেখে খিলখিল করে হাসতো! ও আমাদের বাড়ি এলে আমরা দুজন পেয়ারা তলায় দাগ টেনে এক্কাদোক্কা খেলতাম। শেফালী কখনো খারাপ কথা বলতোনা, চিমটি দিতোনা, ঝগড়া করতোনা, বড়ই নরম আর তুলতুলে শেফালী।

আহা, আজ কত কত বছর শেফালীকে দেখিনা! এখন কোথায় আছে ওরা? ধীরেন কাকা কি চাকরী পেয়েছিলেন? ঠাকুর্দা কি দাঁড়াতে পেরেছিলেন ওদেশে গিয়ে? ঠাকুমা-কাকীমাদের সংসার? পিসিমনির কি বিয়ে দিতে পেরেছিলেন?

শেফালী কি আরো পড়েছিলো? কতদুর? ওর কি সংসার হয়েছে? ছেলে-মেয়ে? আচ্ছা, ওর বর কি করে? ও কি সুখী হয়েছে? ওরা সব বেঁচে আছে তো? শেফালীর কি কখনো মনে পড়ে আমাকে? জানতে ইচ্ছে করে, ভীষন জানতে ইচ্ছে করে!

সেই কোন সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হয়েছিল। ধুর্ত বৃটিশরা তাদের নিজেদের শাসনব্যবস্থা বজায় রাখবার প্রয়াসে, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে বাঙালী জাতির মাথার মধ্যে পুঁতে দিয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষময় বীজ। ধর্ম দিয়ে তাদেরকে দুটিভাগে ভাগ করে বুঝিয়েছিল তেলে আর জলে যেমন মিশেনা, তেমনি হিন্দু আর মুসলমান কখনো মিলেমিশে থাকতে পারেনা। ধর্মান্ধ মানুষ ভুলে গেল-এতকাল তারা মিলেমিশেই ছিল। তাই জাত-পাত আর ছোঁয়াছুয়ির ব্যবধান বিশ্লষণ করে দুটি ধর্মের মানুষের মধ্যে লেগে গেল দাঙ্গা। তারই রেশ চলল যুগ থেকে যুগান্তরে। আশির দশকে এসেও সে রেশ থামেনি। দাঙগগা-হাঙ্গামা আগের মত না থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হিসেবে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্তভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়াকেই শ্রেয় বলে ভেবেছে। আর তাই শেফালীদের মত আরো কত প্রিয় মুখ এ দেশ ত্যাগ করেছে, চোখের জলে ভাসিয়েছে সকল পুরাতন স্মৃতিকথাগুলোকে।

সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছোট শিশুদের বন্ধুত্ব বোঝেনা। কোমল শিশুর মন ভাঙ্গে, ঠাকুমার সংসার ভাঙ্গে, ধীরেন কাকার স্বপ্ন ভাঙ্গে। কত বিচ্ছেদে মন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়।

পৃথিবীটা গোল। তাই ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায় পুরনো কারো সাথে। তেমনি করে আমার কি কখনো শেফালীর সাথে দেখা হবে? পুর্নিমার সাথে? দেখা হলে আমরা একে অপরকে চিনব কি? আহা, এক জীবনে এমন কত কষ্ট পেতে হয়!!