– আনন্দ।

আমি এই লেখায় আমার দুই কাছের মুক্তমনা বন্ধুর কথা বলব। ধর্মবাদী পরিবারের কোপানলে পড়ে তাদের উপর চলছে হুমকি, ধামকি, গালিগালাজ আর নির্যাতন। আমার নির্যাতিত সেই বন্ধুর নাম শাফাউল ইবনে মাসুদ (নিকনেম – ব্রাত্য সাজ)। ব্রাত্য -সাজ মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া একজন মুক্তমনা। তার পরিবারের চোখে ছেলেটির অপরাধ হলো, সে প্রচলিত চিন্তাধারার বাইরে চিন্তা করে। বিনা প্রশ্নে কিছু মেনে নেয় না। সে সমাজের আর দশটা ছেলের মত আল্লাহর নাম করে নাফরমানি করে না, নিয়মিত নামাজ পড়ে না, আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিয়ে হা করে বসে থাকে না, কোরানের মধ্য সব সমাধান খুঁজে না। সে প্রশ্ন করে। সে উত্তর চায়। যখন পায় না, তখন হতাশ হয়। অন্যদিকে তাকে জোর করে ধর্মবিশ্বাসী বানাতে চায় তার বাবা-মা।

আর আমার আরেক বন্ধু রঞ্জন, সে হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া একজন মুক্তমনা। এ লেখায় তার কথাও আসবে। সাজের ঘটনার কারণে তার জীবনও প্রায় বিপর্যস্ত করে তুলেছে সেই ধার্মিক পরিবার। রঞ্জন ছিল ব্রাত-সাজ এর প্রাইভেট টিউটর, সেটা ৫ বছর আগে। তার ফ্যমিলির অভিযোগ রঞ্জন তাকে বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী বানিয়েছে, ইন্ধন দিয়েছে ধর্ম না মানতে, ইন্ধন দিয়েছে প্রেম করতে ইত্যাদি।

সাজের এক প্রেমিকা আছে রাজশাহীতে। ভাল ছাত্রী। ঢাকায় থেকে পড়তে চায়। কিন্তু তার পরিবার সেটা দেবে না। এর মধ্যে একদিন মেয়ে রাজশাহী থেকে চলে এল ঢাকাতে । আর তারপরই মেয়ের বাবার সন্দেহ হয় সাজই বোধ হয় ফুসলিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে ঢাকায়। পুলিশের মাধ্যমে তারা সাজকে ফোন করে। মেয়ের বাবা পুলিশের মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করে যে সে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে কি না। সাজ বলে ‘আমাকে ফোন না দিয়ে মেয়েকেই বরং ফোন দিন শুনুন তার কাছে’।

পুলিশ মেয়েকে ফোন দেয়। মেয়ে বলে ‘আমি নিজেই এসেছি আমার বাবা ঢাকায় পড়াবে না, তাই জোর করে আসা’।

মেয়ের এই অকপট স্বীকারোক্তিতে পুলিশের সেই মুহুর্তে আর কিছু করনীয় থাকে নি। এই দিকে মেয়েটিও এর পরদিন ঢাকায় আইন ও শালিস কেন্দ্রের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা মেয়ের বাবাকে ফোন করে। তাদের মাধ্যমে একটা ফয়সলা গোছের কিছু হয় – মেয়ের বাবা মেয়ের আকুতি শুনে ঢাকায় মেয়েকে রেখে পড়াতে রাজী হয় শেষ পর্যন্ত।

কিন্তু ওদিকে ব্রাত্য সাজের পরিবার কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে ফেলে। এরপর শুরু হয় সাজের উপর অত্যাচার। শুধু সাজের উপরই অত্যাচার নয়, শুরু হয় সাজের প্রেমিকা এবং তার বাবাকে হুমকি দেয়া। ফোনে বলা হয় যে কোন দিন মেয়েকে উঠিয়ে নেয়া হবে। অগত্যা তাদেরকেও আইন এবং শালিস কেন্দ্রের ঠিকানা আর সবক দেয়া হয়। এতে তারা ভয় পায়। এইবার এই মেয়েকে ফোন করে আবারো হুমকি দেয়, দুদিন পর যে, ‘তোমাকে আমরা কিছু করবো না, তুমি শুধু ‘রঞ্জন’ ঠিকানা বল’ ।

মেয়ে বললো ‘রঞ্জনের ঠিকানা কেন বলবো, আর কি জন্যই বা বলবো?’ তখন ওই পাশ থেকে ওর ব্রাত্য সাজ এর মা বললো ‘রঞ্জন আমার ছেলেকে পড়িয়েছে এবং আমার ছেলে নষ্ট করেছে, তার ঠিকানা দাও এবং তার বউয়ের ঠিকানা দাও, তা না দিলে তোমাকে তো উঠিয়ে আনবোই সাথে তাদের কেও খুঁজে পাবো।‘ মেয়ে তারপরেও ঠিকানা দেয় নি, বরং বলে ‘আমাকে আর ফোনে বার বার ডিস্টার্ব করবেন না, করলে এই হুমকি আইন ও শালিস’ কেন্দ্রে বলে দিব’। তখন ব্রাত্য সাজ এর মা জবাবে বলে ‘আমাদের ছেলে যেহেতু নষ্ট হয়েছে, ইসলামের বিপথে গেছে তাই তাকে মেরে হলেও তোমাদের ঠিকানা সাজ কাছ থেকে আদায় করে নিবো, তখন দেখবো মেয়ে তুমি কত বড় বড় কথা বলতে পারিস’।

সাজের পরিবারের বড় আক্রোশ এখন রঞ্জনের উপরেই। ঘটনা মেয়ের দিক থেকে সরে এসে এইবার আসলো তাকে ‘কে’ ‘যুক্তিবাদী’ বানিয়েছে, নিশ্চই রঞ্জন, কারন সে তার গৃহ শিক্ষক ছিল এবং সেও যুক্তিবাদী, এবং ব্রাত্য সাজ তার সাথে চলাফেরা করা তার কথা শুনে। তার চেয়েও বড় কথা হল, রঞ্জন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বিয়ে করেছে একটি মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়া মেয়েকে। যদিও তারা দুজনেই ধর্মহীন নাস্তিক, এবং বিয়ে করেছে ১৮৭২ সালের ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি এক্ট অনুযায়ী ( এই এক্ট অনুযায়ী ভিন্ন ধর্মালম্বী এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের পরস্পরের মধ্যেকার সম্পর্কটি ‘দ্বৈত-বিবাহ’ আইনের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রিকৃত হয় এবং তা বাঙলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজে আইনগতভাবে নিয়োগকৃত হয়)। ব্রাত্যের অপরাধ সে তাদের বিয়েতে একজন সাক্ষী ছিল। এই হলো তাদের অভিযোগ। এখন লাগবে ‘রঞ্জন’কে। তাকে ধরে নিয়ে আসতে তার ঠিকানা জানতে যদি ব্রাত্য সাজ কে মারতেই হয় তাও করবে।

শুরু হলো রঞ্জনকে খোঁজা এবং ব্রাত্য-সাজ এর উপর শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতন করছে সাজের পরিবার এবং সেই নির্যতনে অংশ নিয়েছে তার কাছের আত্মীয় স্বজন। অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চলছে – এই খবর আসতে থাকে বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে । সাজের উপর তো নির্যাতন আছেই, সেই সাথে চলছে রঞ্জনের ফোনে অযস্র ভাষায় গালা-গালি, সেটার কিয়দ অংশ আমরা রেকর্ড করেছি । তার পরদিন ব্রাত্য-সাজ যে বাসায় তাকে আটকে রাখেছে সেই বাসার টিএন্ডটি নাম্বার থেকে ফোন যায় এক ফেসবুক ফ্রেন্ড এর কাছে যে তাকে অনেক অনেক শারীরিক অত্যাচার করা হচ্ছে এবং সেই ফ্রেন্ড বলল যে নির্যাতনের চোটে ব্রাত্য সাজ ঠিক মত কথাই বলতে পারছে না। তাকে মেরে নাকি হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। ব্রাত্য সাজ এর মা সেই মেয়েকে ফোন করে আবারো বলেছিল রঞ্জন ও তার বউ এর ঠিকানা দিতে এবং দরকার হলে বিপথগামী ছেলেকে মেরে হলেও ঠিকানা বের করবে।

আমার আরেক বন্ধু নীল ধর্মকারী ব্লগে এ নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছে, সেটি আছে এখানে। নীল লিখেছে –

ইসলাম ধর্মমতে, ইসলাম ত্যাগকারীদের হত্যা করা উচিত। একজন প্রকৃত ইসলামপ্রেমিক হত্যাই করে। এখন প্রশ্ন জাগে, সাজ-এর পরিবার তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে হত্যা করবে? একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে দু’ভাবে: ১. শারীরিকভাবে, ২. মানসিকভাবে। সাজ-এর পরিবার সাজকে শারীরিকভাবে হত্যা না করলেও তাকে মানসিকভাবে ঠিকই হত্যা করে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার মানসিক মৃত্যু অনিবার্য।

মানুষ কি আসলেই স্বাধীন? ধর্ম আর কতোদিন মানুষকে পরাধীন করে রাখবে?

এব্যাপারে আমাদের করণীয় কী হতে পারে – এ ব্যাপারে মুক্তমনার কাছে থেকে সহৃদয় সাহায্য এবং সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে।
– আনন্দ।