ন’ সাঙ যেবার এই জাগান ছাড়ি/ইদু আগং মুই জনমান ধরি/এই জাগান রইয়েদে মর মনান জুড়ি…চাকমা গান…এই জায়গা ছেড়ে আমি যাব না/এখানেই জন্ম-জন্মান্তর থেকে আমি আছি/এই জায়গা আমার মন জুড়ে রয়েছে।…

পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত বছর ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি সহিংস ঘটনার দগদগে স্মৃতি বিস্তৃত হওয়ার আগেই সম্প্রতি লংগদুতে ২০টিরও বেশী আদিবাসী পাহাড়ি ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। [লিংক]

এবার চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব বিঝু, বৈসুক, সাংগ্রাং, বৈষুর আনন্দ ফুরাতে না ফুরাতেই হামলা চালানো হয়েছে খাগড়াছড়ির রামগড়ে। জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে ১৭ এপ্রিল সেখানে নিহত হয়েছেন তিনজন বাঙালি, পাহাড়ি-বাঙালি উভয় পক্ষের হতাহত হয়েছেন অনেক, প্রায় দেড়শ’ ঘর-বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে হিংসার লেলিহান শিখায়। …

সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনে, ইন্টারনেটে ছবি ও ভিডিও ক্লিপিং দেখে চোখের পানি সত্যিই ধরে রাখা যায় না! একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে সোনা রঙা ধানের গোলা…

যারাই একটু নিজ উদ্যোগে খোঁজ খবর নিয়েছেন, তারাই জেনেছেন, রামগড় সহিংসতায় যদিও নিহত হয়েছেন বাঙালিরাই, কিন্তু তারাই সেখানের মূল হামলাকারী। সেখানে আদিবাসীরা সীমিত শক্তি নিয়ে হামলা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। শুধু তাই নয়, জমি-জমার বিরোধকে কেন্দ্র যে সহিংসতার সূত্রপাত, এই বাঙালি জনগোষ্ঠিই সেখানকার আদিবাসী মারমাদের জমির জবরদখলকারী।

বলা ভালো, এই বাঙালিরা কোনো সাধারণ বাঙালি নন–- তারা হচ্ছেন সেনা সমর্থিত সেটেলার বাঙালি। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, এই সেনা-সেটেলাররাই পাহাড়ের হর্তা-কর্তা-অধিকর্তা। তারাই সেখানের প্রধান প্রশাসন, রাষ্ট্রের ভেতর আরেক তালেবান রাষ্ট্র। …

সেনা-সেটেলার শাসনকর্তারা এর আগে পাহাড়ে একই রকমভাবে মহালছড়ি, মাইচ্ছড়ি, গুইমারায় সহিংসতার জন্ম দিয়েছন।

শান্তিচুক্তির আগে ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনী দিয়ে কসাইয়ের মতো দা দিয়ে কুপিয়ে, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝড়া করা হয়েছে শত শত নিরীহ আদিবাসী পাহাড়ি।…লোগাং, লংগদু, ন্যান্যাচর, বরকল, কাউখালি, দীঘিনাল, পানছড়িসহ একের পর এক গণহত্যায় নিভে গেছে শত শত আদিবাসীর তাজা প্রাণ। সহায় সম্বল সব কিছু ফেলে জীবন বাঁচাতে প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়িকে একযুগ শরণার্থীর গ্লানিময় জীবন বেছে নিতে হয়েছিল ত্রিপুরার আশ্রয় শিবিরে। [লিংক]

ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭৫ সালের পরে পাহাড়ে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। ওই সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার বিদ্রোহ দমনে ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি পাহাড়ে আদিবাসী ও বাঙালি জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সে লক্ষ্যে সমতলের অনেক সেটেলার পরিবারকে দুই একর আবাদি জমি ও পাঁচ একর পাহাড়ি জমি দেওয়ার কথা বলে সরকারি উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসন করা হয়।

সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের প্রথম দিকে বহু সেটেলার পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বন্দোবস্তের নিয়ম ভেঙে সেটেলারদের জমির কবুলিয়ত দেয়। এ কারণে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয়। [লিংক]

আটের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেনারেল জিয়া সামরিকায়ন করা এবং পাহাড়ে সেটেলার বাঙালি বসিয়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করার যে সূচনা ঘটিয়েছিলেন, সেই একই প্রক্রিয়া জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়ার সরকার হয়ে শান্তিচুক্তির পর শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া হয়ে আবারো শেখ হাসিনার সরকার এখনো বহাল রেখেছে। এটি হচ্ছে সেনা কর্তাদের খুশী রেখে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বা ক্ষমতায় যাওয়ার ভোটবাজীর এক বিচিত্র রাজনীতি। গণতন্ত্রের খোলসে পাহাড়ে তালেবানী বন্দুকের শাসন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।…

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির দেড় বছর পর ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাটে আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ ১৭ এপ্রিল রামগড় উপজেলার গুইমারা থানার বড়পিলাক এলাকায় সহিংস ঘটনা ঘটে।

পরিসংখ্যান বলছে, গত এক যুগে ভূমির বিরোধ নিয়ে অসংখ্য ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৩টি বড় সংঘর্ষে সাতজন আদিবাসী ও চারজন বাঙালি মারা গেছেন। এর মধ্যে দীঘিনালার বাবুছড়ায় ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর তিনজন, মহালছড়িতে ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট দুইজন, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাটে দুইজন, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে একই ঘটনার জের ধরে সংঘটিত ঘটনায় একজন মারা যান। সর্বশেষ গত রোববার রামগড় উপজেলার গুইমারায় তিনজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৭৫০ জন। দেড় হাজারের বেশি বাড়িঘরে আগুন লাগানো হয়েছে।

লক্ষনীয়, বরাবরই এসব সহিংসতায় সেনা বাহিনী হয় নেতৃত্বর ভূমিকায়, না হয় সেটেলারদের পক্ষে নেপথ্য মদদদাতার ভূমিকায় থাকে। এর প্রমান তারা আবারো দিয়েছে রামগড় সহিংসতায়ও —

পাহাড়ে সংঘর্ষ সেনা সদরের বক্তব্য
হলুদ চাষ নিয়ে গত রোববার খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বড়প্লাক এলাকার ছনখোলাপাড়ায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে তিন বাঙালি নিহত এবং অপর দু’জন মারাত্মক আহত হন। এ ছাড়া অনেক ঘর-বাড়িতে অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটে।

একটি জমিতে হলুদ চাষকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত। ওই চাষের জমি নিয়ে বাঙালি-পাহাড়ি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মালিকানা বিষয়ক বিরোধ চলছিল। তবে ভুল বোঝাবুঝির অবসানকল্পে সিন্দুকছড়ি সেনাজোন কমান্ডার গত ১৬ এপ্রিল জমির মালিক, হলুদচাষিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা ডাকে। সভায় সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে চলার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সব পক্ষ। এ ছাড়া ১৭ এপ্রিল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একটি সেনাটিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

এ সময়ও তারা কোনো ধরনের উত্তেজনা লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ গত ১৭ এপ্রিল পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের একটি দল ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালি হলুদচাষিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ঘটনার পর অনতিবিলম্বে খাগড়াছড়ি পুলিশ প্রশাসনের টহলের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে ১৭টি টহল পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে।

গত রোববার স্থানীয় সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আসহাব উদ্দিন, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, এসপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় জিওসি তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। -আইএসপিআর।
[লিংক]

এ অবস্থায় পাহাড় থেকে যতদিন সেনা-সেটেলার প্রত্যাহার, যথাযথভাবে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, আইন সংশোধন করে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে জমির বিরোধ নিস্পত্তি না হবে, ততদিন পাহাড়ে একের পর এক বাঘাইছড়ি, লংগদু বা রামগড়ের মতো সহিংস ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সর্ম্পকে সরকারগুলোর সীমাহীন অবহেলার মাশুল এখন দিতে হচ্ছে সেখানের পাহাড়ি-বাঙালি উভয়কেই, একদিন এই মাশুল দিতে হবে পুরো বাংলাদেশকেই।…

এই অন্তর্দশনের বাইরে ইউএন শান্তি মিশনে গৌরব কুড়ানো ‘দেশ প্রেমিক সেনা বাহিনী’র জন্য সাধারণের গর্বে বুক ফুলে উঠবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মতো বড়মাপের অনুষ্ঠানগুলোতে আদিবাসী নাচ-গান দেখে দেশি-বিদেশী দর্শকদের মনে হবে, এদেশের আদিবাসীরা তো ভালোই আছেন!

পুনর্লিখিত।।

ছবি: রামগড়ে আহত এক পাহাড়ি মেয়ে, সংগৃহিত/ জ্বলছে রামগড়, ১৭ এপ্রিল ২০১১, কাপেং ফাউন্ডেশন।

আরো দেখুন: ফেসবুক গ্রুপ ‘পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice’ [লিংক]