২য় পর্ব / ৩য় পর্ব / ৪র্থ পর্ব

কোরানের আয়াতের মহিমা, তাৎপর্য ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদরা যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমনি যৌক্তিক দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করে সমালোচনাও করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদের মধ্যেও ব্যাপক মত পার্থক্য দেখা যায়। মাঝে মাঝে মত পার্থক্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, রীতিমত এক পক্ষ অন্য পক্ষকে মুরতাদ পর্যন্ত ঘোষণা করে বসে। কোরানের প্রতিটি আয়াতের উপর বিশেষ করে যুক্তিবাদি মানসিকতার ব্যক্তিদের নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকতে পারে এবং সেটা বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা দেখতে বা শুনতে পাই। কোরানের উপর আমার এই পর্যন্ত যতগুলো যুক্তিবাদি মননশীল হতে প্রসুত ব্যাখ্যা পড়ার সুযোগ হয়েছে তার বাইরেও প্রায় প্রতিটি সুরার বেশ কিছু আয়াতে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার সন্দেহাতিত বা যুক্তিসংগত মনে হয়নি। কোরানের বাংলা অনুবাদ পড়ে অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। আমি জন্মসূত্রে মুসলিম হওয়া সত্তেও কোরান পর্যালোচনায় ঠিক যে কারণসমূহের জন্য আমি ধীরে ধীরে নাস্তিকে পরিনত হয়েছি মুলতঃ এটি তারই একটি ধারাবাহিক আলোচনা।

    সুরা ফাতেহার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’ আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

ইসলামী শরিয়াতে এই আয়াতটির একটি বিরাট তাৎপর্য আছে । কেউ যদি একবার আলহামদুলিল্লাহ কথাটি উচ্চারণ করেছেন, তখনই তাকে ৭০ রাকাত নফল নামাজের ছওয়াব প্রদান করা হয়। যার বাংলা- যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তালার। বুঝাই যাচ্ছে আল্লাহ এতে প্রচন্ড খুশি । কেন উনি এত খুশি হয়ে গেলেন? উনার প্রসংশা করেছি বলে? আমাদের মানব সভ্যতায় এমন কিছু সময় ছিল বা এখনো আছে বিশেষ করে রাজা বা সম্রাটদের যুগে তখন রাজার মন যোগানোর জন্য তাদের পাইক পেয়াদারা প্রতিনিয়তই প্রশংসা এবং তোষামোদ করে চলতেন। বিপক্ষ কথা বললেই গর্দান যেত । রাজ দরবারে গুণকীর্তন করার জন্য রাখা হত সভাকবি। এতে রাজারা প্রচন্ডভাবে খুশি হয়ে যেতেন। দেয়া হত পুরস্কার। এখনো অনেক চাকুরীতেই উর্ধ্বতনের প্রসংশা, তোষামোদ করে চললে প্রমোশনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হয়। যা আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি। প্রশ্ন আসে আল্লাহ এতবড় শক্তিমান হয়ে কেন পৃথিবীর নিয়মের বাইরে যেতে পারলেন না? প্রশংসা কি উনার খুব প্রয়োজন? যা উনার মনোরঞ্জন করে? যদিও দাবী করা হয় আল্লাহ প্রয়োজনের উর্ধ্বে। তবে কেন উনি প্রশংসা চান? আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, কোরান সম্পূর্ণই আল্লাহর ভাষ্য বলে দাবী করা হয়। কিন্তু উপরের আয়াতে কি বুঝা যাচ্ছে বাক্যটি উনি নিজে বলছেন? এরকম অনেক আয়াতই আছে স্বয়ং আল্লাহর ভাষ্য বলে আপনার মনে হবে না। এই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে সৃষ্টি তত্তের গ্রহণযোগ্যতা বিজ্ঞান মহলে একেবারেই নেই। সেক্ষেত্রে সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা দাবীটা একেবারেই অবান্তর। আসলে পালনকর্তা কে? স্থুল অর্থে মুলতঃ যে লালন পালন করে। জীবন বাচিয়ে রাখার অর্থে এই খাদ্য-খাদকের পৃথিবীতে এই মহান পালনকর্তার কি কোন ভূমিকা আছে?

আবার উক্ত আয়াতের অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক করা হয়েছে এইভাবেঃ সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই । আমরা এখানে অনুবাদের ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য দেখতে পাচ্ছি। এখানে মূল গরমিলটা করা হয়েছে সৃষ্টিজগত এবং জগতসমূহ শব্দটির মধ্যে। জগতসমূহ বলতে কি আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্টিকৃত জগতসমূহকে বুঝানো হয়েছে?

    দেখুন ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।

আসলে এটা কতটুকু সত্য? এই জীব জগতে আমাদের জীবন বাচিয়ে রাখার জন্য আহার করতে হয় শত শত প্রাণীকে। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বিদ্যমান। আমার জন্য তিনি দয়ালু বা মেহেরবান হলেও আমার ভোগ্য প্রাণীটির কাছে তিনি কি নিষ্ঠুর নন? আর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং চিরবঞ্চিতদের ক্ষেত্রে এই আয়াতটি কি সমানভাবে প্রযোজ্য? আল্লাহ সত্যিই দয়ালু কিনা তা আরজ আলী মাতুববরের প্রশ্ন থেকেই আমি প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলাম কোরানের বানী অখন্ডনীয় নয়। অবিশ্বাসীদের জন্য এখানে কিছুই রাখা হয়নি। তার প্রমান সুরা বাকারার প্রথম রুকূর ৭টি আয়াত।

তাছাড়া যে সুরাটি ব্যতিত (ফাতিহা) নামাজ হয়না সেই সুরাটিতে কি এমন বলা হয়েছে? আমি ব্যক্তিগতভাবে এইটুকুই বুঝতে পেরেছিঃ মানুষ হিসাবে নিজেকে অমর্যাদা করা এবং সর্বোচ্চ তোষামোদ করা, এমন একটি তথাকথিত শক্তির কাছে যা কিনা অদৃশ্য, বোধগম্যহীন, অনুভুতির বাইরে।

সূরা বাকারাটি শুরু করা হয়েছে তিনটি বর্ণ দিয়ে আলিফ্-লাম-মীম । যার কোন অনুবাদ করা হয়নি। সুতরাং তফসিরকারগণ ইচ্ছেমত অর্থ করে নিচ্ছেন। মুসলমানদের জন্য এই রকম তিনটি (কোরানের অন্যান্য জায়গায় আরো অনেক রয়েছে) অর্থহীন শব্দ কোন্ হেদায়েতে আসবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমারা বুঝি বা না বুঝি তাতে আল্লাহর কিছু যায় আসে না। কারণ ২ নং আয়াতে কি বলেছেন দেখুনঃ

ইহা সেই কিতাব; ইহাতে কোন সন্দেহ নাই, মুত্তাকীদের জন্য ইহা পথ-নির্দেশক ।

এই আয়াতের গোড়ামীটা একবার লক্ষ্য করুন। নিজে লিখে নিজেই ঘোষনা করে দিচ্ছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। প্রচুর সন্দেহ আছে বলে কি আগে থেকেই মুত্তাকীদের বলে দিচ্ছেন খবর্দার সন্দেহ করবা না। যে গ্রন্থটিকে বিশ্ব মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে দাবী করা হয়, সেখানে কিনা বলা হয়েছে এটা শুধূ মুত্তাকীদের জন্যই প্রযোজ্য। প্রশ্ন আসে, যেহেতু এটি অন্যান্য ধর্ম বা ধর্মহীনদের জন্য পথ নিদের্শক নয় সেহেতু মুত্তাকীদের অর্ন্তভুক্ত হওয়ার উপায়টা কি? কোরানের প্রয়োজনটুকু আসবে শুধুমাত্র কি মুত্তাকী হওয়ার পরে? অন্যান্য ধর্ম বা ধর্মহীনদের ইসলামের শান্তির ধর্মের দাওয়াত দেবেন কি দিয়ে? ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আখিরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসীরাই মুলতঃ সফলকাম এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে রয়েছে। কথাটা ঠিকই, আজীবন অমিমাংশিত সেই আখিরাতকে যদি বিশ্বাস না করি, তবে ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তার জন্য কি ব্যক্তি দায়ী? মানুষ হিসাবে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ ব্যতিত কোন কিছুই করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কোরানে ঈমান আনা না আনার ব্যাপার স্পষ্ট ঘোষনা থাকা সত্তেও কিভাবে মানুষ নিজের ইচ্ছেমত ঈমানদার হবে? নিচের আয়াত দুইটি (২: ৬ এবং ৭) থেকে বুঝা যাবে ঈমানদার হওয়া না হওয়ার জন্য আসলে কে দায়ীঃ

যাহারা কুফরী করিয়াছে তুমি তাহাদেরকে সতর্ক কর বা না কর, তাহাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তাহারা ঈমান আনিবে না। আল্লাহ তাহাদের হ্রদয় ও কর্ণ মোহর করিয়া দিয়েছেন, তাহাদের চক্ষুর উপর আবরণ রহিয়াছে এবং তাহাদের জন্য রহিয়াছে মহাশাস্তি।

কার সাধ্য আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত ঈমান আনে? আল্লাহর এই কাজটি বড়ই অন্যায় মনে হচ্ছে। যার হ্রদয়, কান ও চোখের মধ্যে সীল-গালা করে দিয়ে, ঈমানদার হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়ে আবার তার জন্য নিজেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন মহাশাস্তির। দেখেন আল্লাহর ন্যায় বিচারের নমুনা। নিজের সন্তাকে জন্ম দিয়েছি বলে, ভরণ-পোষণ দিচ্ছি বলে তাকে পড়া-লেখা করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে পরীক্ষায় কৃতকার্যের দাবী করা যায় না । এবং অকৃতকার্য হলে আমরা তাকে অমানবিক নির্যাতনও করতে পারি না। একজন মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তার দ্বারা এটা সম্ভব। তিনি সত্যকে মিথ্যা, ন্যায়কে অন্যায় করতে পারেন। কারণ আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান (২ : ২০)। আমি ভেবে পাই না, এত সাংঘর্ষিক আয়াতগুলো তিনি নাযিল করলেন কি করে? ১৮ নম্বর আয়াতেও একইভাবে ইসলাম ত্যাগীদের বধির, মূক, অন্ধ বলা হয়েছে। বলুন, বধির বলে শুনতে না পাওয়া বা মূক বলে বলতে না পারা বা অন্ধ বলে দেখতে না পাওয়া কি অপরাধ? এই সেই সৃষ্টিকর্তা যিনি অন্ধ বানিয়ে দেখতে নাপাওয়ার অপরাধে শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

পৃথিবী, আকাশ, বৃষ্টি এবং ফলমূল উৎপাদনের ব্যাপারে এক মহা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সুরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতে দেয়া হয়েছেঃ

যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করিয়াছেন এবং আকাশ হইতে পানি বর্ষন করিয়া তদ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং তোমরা জানিয়া-শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করাইও না।

আপনি হয়ত হাসছেন এই ভেবে যে, বিছানা কি ডিমের মত গোল হয়? অথচ দেখুন শক্তি দিয়ে এই গোল পৃথিবীকে সমতল বিছানা করে ছাড়লেন। আকাশের মহাশূন্যতাকে ছাদ বানিয়ে ফেললেন। আবার সেই ছাদকে চাকনি বানিয়ে পানি বর্ষণ করান। মারহাবা–। এমন কিছু করতে না পারলে আবার বিজ্ঞান নাকি। সৃষ্টিকতার্র বিজ্ঞান বলে কথা। পানি বর্ষণ কি শুধু ফলমূল উৎপাদন করে? অতি পানি বর্ষণ কি কখনো ফলমূলের গাছ শুদ্ধ ধ্বংস করে না? সুতরাং তোমরা জানিয়া-শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করাইও না। আসলে ধর্মবাদীরা যৌক্তিকভাবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলোকে গ্রহণ করে না বলেই ঈমানদার থাকতে পেরেছে। অন্যথায়, সমকক্ষ দাঁড় করানো তো দুরের কথা আল্লাহর এই অপবিজ্ঞানের জন্য তার অস্তিত্বই কেউ স্বীকার করত না। আবার এরকম সুরা আনয়ন করা সন্দেহবাদীদের দ্বারা কখনই সম্ভব নয় বলে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে।

২: ২৩ নম্বর আয়াতঃ আমি আমার বান্দার প্রতি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকিলে তোমরা ইহার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর এবং তোমাদের যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর।

এই কোরানের মর্যাদাটা কোথায় রাখবেন? কাব্যিক গুণাবলীর দিক দিয়ে ধরতে গেলে এরচেয়ে অনেক-অনেক উচুমানের কাব্য গ্রন্থ রচনা করা মানুষের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। কোথাও থেকে আনার দরকারই বা কি? মানুষই তো এসব পারে। দর্শন? এমন কিছু দিকদর্শন কি দিতে পেরেছে যা কোরানের আগে/পরে দার্শনিকরা বলেননি আলোচনা করেন নাই। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে এমন কোন দর্শন নেই যা কিনা প্লেটোর দর্শনের প্রভাবমুক্ত। দার্শনিকদের অর্ন্তদৃষ্টির গভীরতা এবং বিষয়বস্তুর কাছে তো কোরানের দর্শন যোগ্যতা কেবল শিশু। কোরানে বিজ্ঞানের কথা কি আর বলব, হাস্যকর অপবিজ্ঞান আর বিভ্রান্তিতে ভরা। ২২ নম্বর আয়াত বাদেও পরবর্তীতে আরো অনেক পাওয়া যাবে এব্যাপারে বলার জন্য। এসব বিষয় যদি যৌক্তিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে, কোরানে যে কত সমস্যা লুকিয়ে আছে তা দেখে রীতিমত বিভ্রান্ত হতে হয় এই ভেবে যে সৃষ্টিকর্তার মত সত্তা কেন মানুষের (কাফির) সাথে দ্বন্দ করবেন। বিশ্বাসীদের জন্য বুঝ আর যুক্তিবাদিদের জন্য বিভ্রান্তি এই জন্য যে, যদি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয় তাহলে কোরানের বানীগুলো নিয়ে অনেক অভিযোগ করা যাচ্ছে তার কাছে। অন্তত পক্ষে আল্লাহর কথা এরকম হওয়া উচিত নয়। আপনি বিভ্রান্ত হবেন না কেন? বিভ্রান্তকারী তো স্বয়ং আল্লাহ নিজেই। দেখুন ২: ২৬ নম্বর আয়াতের আংশিকঃ —- ইহা দ্বারা অনেককেই তিনি বিভ্রান্ত করেন, —–। বস্তুত তিনি পথ-পরিত্যাগকারীগণ ব্যতীত আর কাহাকেও বিভ্রান্ত করেন না। মাবুদের (?) সমীপে বলছি, আমরা তো আপনার মর্মবানী শুনেই বিভ্রান্ত হয়ে আপনার তথাকথিত সরল পথ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এই পথ-পরিত্যাগকারী বলতে সম্ভবত তৎকালীন সময়ের কাফিরদের বুঝানো হয়েছে। তারপরও কোরান তো কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য না, যার স্থায়ীত্ব কেয়ামত পর্যন্ত।

ঈমানদারদের জন্য পুরস্কার হিসেবে এমন একটি স্থানের ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন, যাকে কিনা বলা হয় জান্নাত। আল্লাহর পুরস্কার বলে কথা। কি থাকবে আল্লাহর এই জান্নাতে? প্রবাহমান নদী, ফলমুল আর পবিত্র সঙ্গিনী (২: ২৫)। এত পুরস্কার থাকতে এ ধরনের পুরস্কার কেন? তৎকালীন আরব মরুভূমিতে সুপাদেয় নদীর পানি, ফলমুল আবহাওয়া জনিত কারনেই দুস্প্রাপ্য ছিল। মুহাম্মদ প্রকান্তরে আল্লাহ হয়ত সে কথাটি মাথায় রেখেই কী রকম পুরস্কার দেয়া হবে তা নির্বাচন করেছেন। এই নদীর পানি, ফলমুল তৎকালীন আরববাসীদের কাছে লোভনীয় হলেও বর্তমান আরববাসী এবং অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের কাছে তেমন লোভনীয় নয়। সুতরাং বলা যায়, এটি আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট। পুরুষ ঈমানদারদের জন্য তিনি সঙ্গিনীর ব্যবস্থা রাখলেও স্ত্রী ঈমানদারদের জন্য কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। লিঙ্গবৈষম্য স্বয়ং আল্লাহও করেন। স্ত্রী ঈমানদারদের জন্যও যদি নারী সঙ্গিনী রাখা হয় তাহলে ভিন্ন কথা। তাহলে আল্লাহ তো দেখি ল্যাসবিয়ান পদ্ধতিকে সমর্থন করেন। যা হোক, সভ্যতার ক্রমোন্নয়নে পুরস্কার হিসাবে, উপঢৌকন হিসাবে, উপহার হিসাবে আর নারী সঙ্গিনী প্রদান অনেক যুগ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। শালীন পরিবেশে এসব কথা আর চিন্তাই করা যায় না। তাছাড়া একজন মানুষকে পুরস্কার-দ্রব্য হিসাবে ভাবতে আজকের মানুষ লজ্জাবোধ করে এবং এটি মানবতার চরম অবক্ষয়। সেখানে আল্লাহ কিভাবে এরকম কুরুচিপূর্ণ প্রলোভন দেখান?

২: ২৯ নম্বর আয়াতে যা বলা হয়েছে তা নিছক কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যৌক্তিক দৃষ্টিকোন থেকে অসম্ভব। বলা হয়েছেঃ

তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন; তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

সপ্তম আকাশের বাস্তবতা বিজ্ঞান মহলে কোন প্রকার গ্রহণ যোগ্যতা নেই। আকাশ নামের যে মহাশূণ্যতাকে আমরা দেখি তা মূলতঃ আমাদের দৃষ্টিসীমা। সে শূন্যতার আবার সাতটি স্তরকে বাস্তবতার নিরিখে বিচার নিতান্তই হাস্যকর।

সূরা বাকারার ৪ নম্বর রুকু অর্থাৎ ৩০ থেকে ৩৯ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আদম সৃষ্টি করা, ইবলিশ কর্তৃক আদমকে সেজদা না করার কারণে শয়তানে পরিনত হওয়া এবং আদম ও হাওয়ার জান্নাত হতে পদস্খলন ইত্যাদি ব্যাপারে বলা হয়েছে। এব্যাপারে আরজ আলী মাতুববরের লেখা শয়তানের জবানবন্দিই উপযুক্ত প্রতিবেদন। এর বাইরে মুলতঃ আমার বেশি কিছু বলার নেই। তবে আল্লাহ আর আদম ইবলিশকে শয়তান বানানোর জন্য যে লুকুচুরিটা খেলেছেন তা দেখার মত।

২:৪৬ নম্বর আয়াতঃ তাহারাই বিনীত যাহারা বিশ্বাস করে যে, তাহাদের প্রতিপালকের সঙ্গে নিশ্চিতভাবে তাহাদের সাক্ষাতকার ঘটিবে এবং তাহারই দিকে তাহারা ফিরিয়া যাইবে।

আল্লাহ হচ্ছে নিরাকার সত্তা। কোন বস্তু দেখার জন্য অবশ্যই তার অস্তিত্ব থাকতে হবে আকার থাকতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই নিরাকার সত্তার সাথে সাক্ষাত করার উপায়টা কি? যার কোন আকারই নেই তার সাক্ষাতের ব্যাপারটি কিভাবে সম্ভব?

পাঠকদের সময়ের দিকে চিন্তা করে আজ এখানেই ইতি টানছি। সুযোগ পেলে এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।