কঃ বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, পত্র পত্রিকায় প্রাক্তন ক্রিকেট খেলোয়াড়, ক্রিকেট বোদ্ধা, ক্রিকেট দর্শক, ক্রিকেটপ্রেমী,মডেল, অভিনেতা ধুমসে আলোচনা করছেন। সে তুলনায় এ মুহুর্তে গণমাধ্যমগুলোতে নারী ক্রিকেট দলের সদস্যদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে, যদিও ২০১০ সালে এশিয়া গেমসেও প্রমিলা ক্রিকেটাররা রূপা নিয়ে দেশে ফিরেছে। আমার প্রশ্ন, নারী ক্রিকেটারদের প্রতি এ উদাসীনতা কেন?
বাস্তবিক, ক্রিকেট নিয়ে নারীদের আলোচনাকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোক মনে করে অনধিকার চর্চা। শুধু ক্রিকেট খেলা কেন। যে কোন খেলাই বিশেষ করে বাইরের খেলা মানেই ছেলেদের— পুরুষদের খেলা।
পত্রিকায় প্রকাশ, বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকেট বিক্রিতে মেয়েদের একটা কোটা ছিল যা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ, টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়ানো কোন এক মেয়েকে প্রশ্ন করাতে সে নাকি বলেছে যে, সে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার খেলা অথবা জার্মানী ও আর্জেন্টিনার খেলা দেখার জন্য টিকেট চান। মেয়েটির এ ভাষ্য শুনে বাংলাদেশের সকল নারীদের জন্য টিকেট কেনার কোটা বন্ধ।
আমার ধারণা মেয়েটি হয়তো বা ভাই বা প্রেমিকের জন্য টিকেট নিতে এসেছিল। অথবা নিজেই ক্রিকেটীয় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আগ পাছ না ভেবে খেলা দেখার অতি আগ্রহে টিকেট কেনার লাইনে দাঁড়িয়েছিল।একটি মেয়ের এহেন উত্তরে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পালটে গেল। আর কালোবাজারে যে সব টিকেট বিক্রি হয়েছিল তা কী সব ক্রিকেট বোদ্ধারা ক্রিকেট জ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে ২শ’ টাকার টিকেট কিনে পরে ১০/২০ হাজার টাকায় বেচেছিল?

গত ১৪ মার্চ কিশোরগঞ্জে গেছি অফিসের কাজে। সিভিল সার্জন অফিসে তারই রুমে টিভিতে এক ভদ্রলোক (পরিচয় উহ্য থাক) বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডের খেলা দেখছেন অফিস সময়ে। সিভিল সার্জন তখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভায়।
তার এক নারী সহকর্মীকে বললেন, আপনি এখানে কেন? আপনি মানে মহিলারা তো আর খেলা বুঝে না। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলা।
আমি কথা না বলে পারিনি। বললাম, কীভাবে বুঝলেন যে মহিলারা ক্রিকেট খেলা বুঝে না? (অফিস সময়ে অফিসে বসে ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গটি কৌশলগত কারণেই তুললাম না।) উনি হাসির ছলে আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। আমিও গ্রহণ করে প্রশ্নোত্তর চালালাম।
পরে বললেন, এই তো আপনার মত দুয়েক পার্সেন্ট মহিলারা বুঝে।
আমি উনাকে অফিসের বাইরে গিয়ে কিছু পুরুষকে ক্রিকেট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করে সাধারণভাবে পুরুষদের ক্রিকেট খেলা নিয়ে জ্ঞান পরীক্ষা করে পরে নারীদের সম্বন্ধে ঢালাও মন্তব্য করতে বললাম।
কাজেই ক্রিকেট নিয়ে একজন নারী হয়ে লিখতে বসা অনেকের মতে স্পর্ধা বলে পরিগণিত হবে জেনে শুনেই আজকের লেখা।
নারীরা খেলাধুলায় পিছিয়ে রয়েছে বলেই জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বিলোপ সনদে ( CEDAW) পরিচ্ছেদ – ৩ এর অনুচ্ছেদ- ১০ উল্লেখ আছেঃ
‘শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে পুরুষ ও নারীর সমতার ভিত্তিতে যেসব বিষয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষসমূহ নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সেগুলো হচ্ছে-
…………………………………………………………………………………………………..
চ) খেলাধূলা ও শারীরিক শিক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণের জন্য একই সুযোগ প্রদান;’
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নারীরা বিশেষ কিছু খেলা বুঝেই না।
আমার পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য হচ্ছে যদিও ‘খেলাধূলা ও শারীরিক শিক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণের জন্য একই সুযোগ প্রদান;’ উল্লেখিত জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বিলোপ সনদে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করেছে, তবুও কেন নারী ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মত খেলায় আলোচক হিসেবে গুরুত্ব পায় না।
খঃ ক্রিকেট নিয়ে সংখ্যালঘু শব্দটি দেখে অনেকে নিশ্চয়ই আমাকে সাম্প্রদায়িক ভাবছেন! ভাবতেই পারেন। ক্রিকেটের জাতীয় দল ঘোষণা নিয়ে বাংলাদেশে অনেক গল্প, কাহিনী, নাটক,অভিনয় হয়েছে। মাশরাফিকে ও অলক কাপালীকে জাতীয় দলে না রাখা নিয়ে বিভিন্ন অনুভূতি আমরা গণমাধ্যমগুলোতে দেখেছি ও পড়েছি। মাশরাফিকে নিয়ে বেশী। খেলোয়ারের গুরুত্ব, তার দক্ষতা ও যোগ্যতা বুঝেই খবরের শিরোনাম ও অনুভূতির মাত্রার প্রকাশ। তবে অলক কাপালীকে দলে না রাখা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে অপ্রকাশিত কিছু অনুভূতির আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার এক পরিচিতজনের মন্তব্য – হিন্দু বলে অলককে দলে রাখা হয়নি।
আরেকজন, ভালই হয়েছে, আল্লাহ করে তো সব মুসলমান প্লেয়ার। আর অলক তো জাতীয় দলের বিদ্রোহী প্লেয়ার।
আমি দুটো মন্তব্যেরই কট্টর বিরুদ্ধে। কিছু বলতেই চাচ্ছিলাম না। মনটা বিষিয়ে উঠেছিল মন্তব্য দুটো শুনে। তবুও বললাম, জাতীয় দলে খেলার মত পারফরমেন্স অলক দেখাতে পারেনি বলেই নেওয়া হয়নি। আর জাতীয় দলের বিদ্রোহী প্লেয়ার শাহরিয়ার নাফিজকে কিন্তু দলে নেওয়া হয়েছে। কাজেই আপনার দুজনেই কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার খেলার দিন আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর ফোন। আপনি কোথায়?
আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কবি শামীম আজাদ সম্পাদিত ‘অগ্নি ও জলঃ রুপান্তরের গল্প ‘ বইটির প্রকাশনা উৎসবে গিয়েছি জেনে বলে, আজ তো ভারতের খেলা। আপনার তো কোথাও যাওয়ার কথা নয়।
খোঁচাটা হজম করে বললাম, বাংলাদেশ ছাড়া আর কারও খেলা দেখতে কাজের অগ্রাধিকার করি। আমার সময় বরাদ্ধে ভারতের খেলা আজ অগ্রাধিকার পায়নি। পরে উল্লেখ করলাম, অনেককে দেখছি মার্চ মাসেও পাকিস্তানীদের ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকে। আমার কিন্তু তা হজম করতে কষ্ট হয়।
তবে বলিনি যে আরও কষ্ট হয় বাংলাদেশ ভারতের খেলায় আমাকে ভারতের সমর্থক ভেবে কথা বললে।

গঃ বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতাজের গান গাওয়া নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ, কটূ মন্তব্য শুনলাম। প্রথমত, তাকে কেন ডাকা হল! দ্বিতয়ত তার গান পছন্দ নিয়ে। মমতাজের গানের সময় আমি দেখেছি খেলোয়াড় আশরাফুলকে আনন্দে ঠোঁট মেলাতে। আমার মতে মমতাজ হয়ত সংসদ সদস্য বলেই গান গাওয়ার ডাক পেয়েছেন, তবে মমতাজ কিন্তু বাংলাদেশে একটা জনগোষ্ঠীর কাছে খুবই জনপ্রিয় শিল্পী। তার রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টেছে, কিন্তু তার গান গ্রামে গঞ্জের হাটে, ঘাটে, মাঠে বাজে। কাজেই সে ও আমাদের একটা গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, আমি পছন্দ করি বা না করি।

ঘঃ ক্রিকেট নিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এগিয়েছি মানে কিন্তু আমাদের আসন সবার উপরে নয়। খেলাধুলায় কারও আসন পাকাপোক্তও নয়। তাহলে তো আর খেলা হত না। যার যার আসনের বিপরীতে পুরস্কার পেয়ে যেত। আর যারা খেলছে তারা আমাদেরই ছেলে, আমাদেরই ভাই। তাদের জয়ে যেহেতু আমরা জয়ী হই। খুশী হই। আনন্দে আপ্লুত হই। তাদের পরাজয়ে দুঃখিত হওয়াই স্বাভাবিক। একটু আধটু ক্ষুব্ধও হতে পারি, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত অবশ্যই নয়। তাদের পরাজয়ে তো সত্যিকার ক্রিকেটপ্রেমী হলে খেলোয়াড়দের পাশে থাকার কথা। প্রেরণা দেওয়ার কথা। তাদের ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার কথা। কিন্তু ৫৮ রানে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সাথে সব উইকেট খুইয়ে ম্যাচটি হারার পর আমাদের ধৈর্যের রান তো ছিল শূন্য। আমাদেরকে এ শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে হবে।