:: হাইপেশিয়া :: রুকসানা/আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট :: অ্যাডা :: তসলিমা নাসরিন :: হুমায়ুন আজাদ :: দালাইলামা :: সুরের রাণী মমতাজ ::
সগডিয়ানার পাথর দুর্গের উপর থেকে অক্সিয়ার্টেস আর তার দলবল আচমকা তীর মেরে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আক্রমণকারী আগন্তুক পশ্চিমা বীর যোদ্ধার পুরো সৈন্যদলকে। পশ্চিমা যোদ্ধা তার রাজ্যবিস্তার করতে গিয়ে বহু জাতিকে নিমিষেই ধ্বংস করে দিয়েছে, বহু জাতি নিজ থেকে এসে তার পদতলে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই পোষ না-মানা গোত্রকে কোনো ভাবেই কব্জা করা যাচ্ছে না, তুষারাবৃত খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় সুরক্ষিত দুর্গে বসে ক্ষণে ক্ষণে তারা শুধু তীর-ধনূক নিয়ে আক্রমণ করে যাচ্ছে। একপর্যায়ে সগডিয়ানানরা হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “সগডিয়ানার দুর্গ জয় করবে, সে-রকম বীরপুরুষের জন্ম এখনো এই ভূখন্ডে হয়নি, তোমাদের কারো যদি পাখা গজিয়ে থাকে, তবে উড়ে আসো।” তারপর একযোগে ঠাট্টার হাসি হেসে সগডিয়ানার বাসিন্দারা ফিরে যায় দুর্গের ভিতরদিকটায়।
রাতের অন্ধকার নেমে আসলে অক্সিয়ার্টেস আপন মনে ভেবে যায় তার নিজ দেশের কথা; সমরখন্দ, বোখারা, বলখ্, আমু দরিয়া, সির দরিয়ার তীরে গড়ে উঠা তার নিজ রাজ্যের জাতিগোষ্ঠীর কথা, প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর কথা; তার শৈশব, কৈশর, যৌবনের নানা রঙের দিনগুলোর কথা। পশ্চিমা এই যোদ্ধা অভিযান পথে সবকিছু তছনছ করে, নামকরা সব যোদ্ধাদের পরাজিত করে, আজ পদানবত করতে এসেছে সগডিয়ানা রাজ্যকে। নিজ অঞ্চল ব্যাক্ট্রিয়া থেকে দূরে সরে, স্ত্রী-কন্যা-পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপদের কালে আজ অক্সিয়ার্টেস এসে আশ্রয় নিয়েছে বহুদিনের নামকরা, নির্ভয় আশ্রয়স্থল পাশের রাজ্য সগডিয়ানার এই সুরক্ষিত দুর্গে। শুধু সগডিয়ানার ছোট্ট কিশোর ‘আফসিন’, যে এখনো জানে না যুদ্ধ কি জিনিস, মনের আনন্দে সে রাতের তারা গুণে যাচ্ছে আপন মনে, এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়-সাত।
ওদিকে, রাতের তারার আলোয় পশ্চিমা বীর যোদ্ধা তার সৈন্যদলকে উজ্জ্বীবিত করতে ঘোষণা করল- যারা এই খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুর্গে পৌঁছাতে পারবে তাদেরকে মহামূল্যবান পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। দুঃসাহসী আর পর্বতারোহণে সক্ষম সৈন্যদের মধ্য থেকে সকালের মধ্যেই খুঁটি-দড়ি নিয়ে প্রায় তিনশ জন উঠে গেলো দুর্গচূড়ায়, যদিও আরোহণের সময় ছিটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করলো ত্রিশজন। হতভম্ব অক্সিয়ার্টেস আর তার দলবলকে দেখিয়ে দেয়া হলো পাখা গজানো পশ্চিমা যোদ্ধাদের, প্রয়োজন হলে যারা উড়তেও পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমগ্র দূর্গ পশ্চিমা যোদ্ধার দখলে চলে যায়। সগডিয়ানা দুর্গে পরিভ্রমনরত বিজয়ী বীরযোদ্ধা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন অক্সিয়ার্টেসের আঙ্গিনায়। বহুদেশের বহু সুন্দরী, রূপসী দেখে অভ্যস্ত হলেও কেন জানি এই সগডিয়ানার রূপসীকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। নিজের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিনদেশি এই সাহসী যোদ্ধাকে এক নজর দেখছিলো রূপসী ‘রুকসানা’। ‘রুকসানা’ নামের অর্থ আকাশের ছোট্ট তারা, ঠিক সেরকম তারা হয়েই যেন বীর যোদ্ধার চোখে ভেসে থাকলো ‘রুকসানা’।
ওদিকে, অনেক দূর থেকে রাজ্য জয় করতে আসা যোদ্ধা বুঝতে পারে, দূরদেশের এই জনগণকে শূধু তাদের রাজ্য জয় করলেই বশে আনা যাবে না, তাদের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে হবে। তাই সসন্মানে রুকসানার পিতা অক্সিয়ার্টেসকে তার নিজ অঞ্চলসহ আরো বৃহৎ অংশের অধিপতি নিয়োগ করলো। তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে যোদ্ধা ও তার সৈন্যদল সে অঞ্চলের প্রথা অনুসরণ করে তাদের মত করে পোশাক পরিধান করতে লাগলো। উপরন্তু, অপরাপর সমস্ত সেনাপ্রধান এবং নিজদেশীয় পরিজনদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে খেয়ালী এই বীর যোদ্ধা সগডিয়ানার ছোট্ট তারা ‘রুকসানা’কে নিজের প্রথম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবার জন্য মনস্থির করে ফেললো। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী এক টুকরা রুটি তলোয়ার দিয়ে কেটে দুই টুকরা করে বর ও কনেকে খাওয়ানোর মাধ্যমে বিবাহ সুসম্পন্ন হলো; সাথে সাথে রাজার বিয়ের দিনে সেনাবাহিনীর আরো দশ হাজার সৈন্য স্থানীয় কন্যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। স্থানীয় নিয়মানু্যায়ী বাসর শয্যায় নতমুখে বসে থাকা রূপসী রুকসানাকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে বরণ করে নিলো পশ্চিমা বীর যোদ্ধা।
ছবিঃ রুকসানা (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
কিছুদিনের মধ্যেই আমুদরিয়া নদীর তীরে বেড়ে উঠা, ৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া প্রাচ্যদেশীয় মেয়ে রুকসানা বুঝতে পারে, পশ্চিমা এই বীর যোদ্ধা যে-ভালোবাসা দেখিয়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলো, সে-ভালোবাসা শুধু তার একার জন্য নয়। আক্রমণ পথে নিজের সাথে করে রাজসেবিকা করে নিয়ে এসেছে পরাজিত সম্রাটদের কন্যাদের। কিন্তু ভাগ্যাহত রুকসানা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, তার বীরপুরুষ উনত্রিশ বছর বয়স্ক স্বামীর ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আসবে সুন্দরী অপর কোনো রাজকন্যা নয়, বরং পশ্চিমা দেশিয় এক পুরুষ – ‘হেফাইশ্চিয়ান’ তার নাম। বীর যোদ্ধার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হয়ছে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে এই হেফাইশ্চিয়ান।
রুকসানা নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে যদি হেফাইশ্চিয়ান-ই থাকবে যোদ্ধার সাথে সাথে, তবে কেন তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া। অন্য আর পাঁচ-দশটা মেয়ের মত তাকেও রাজসেবিকা করে রাখলেইতো পারে। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে রুকসানা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে বীর যোদ্ধাকে। কিন্তু রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে যে যোদ্ধা আজ তার কাছে এসেছে, তাকে কি আর রাগ, ক্ষোভ, অভিমান দিয়ে জয় করা যায়? দিনের পর দিন সে যোদ্ধা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দেখেই অভ্যস্ত। একই ধারায় আত্মসমর্পিত রুকসানা বুঝতে পারলো, শুধু রাজ্যের পর রাজ্য জয় করলে হয় না, সে রাজ্য রক্ষা করার জন্য দরকার হয় ভবিষ্যত বংশধর। যে সাহস আর ক্ষিপ্রতা যোদ্ধা রুকসানা ভেতর দেখেছিলো, তাতেই তার মনে হয়েছে, তার অনাগত বীর সন্তানের মা হবার জন্য এর চেয়ে যোগ্য নারী আর কেউ হতে পারে না। সৌন্দর্য আর সাহসের সন্মিলনে যে রুকসানার সৃষ্টি, তাকে অবহেলায় ফেলে রেখে যায় সে সাধ্য কোন বীরপুরুষের। অদম্য সেই মহাপরাক্রমশালী যুদ্ধরাজ রুকসানাকে সাথে নিয়ে এবার পাড়ি জমালেন আরো পূর্বে, স্বপ্ন তার পৃথিবী জয় করবার, রাজ্য জয় করে করে সে দেখতে চায় পৃথিবীর শেষটা ঠিক কোথায়।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সৈন্যবাহিনী সাথে নিয়ে অগ্রসর হয়ে যোদ্ধা এবার উপস্থিত হয় নতুন এক রাজ্যে। নিজ জন্মভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে অনেক পূর্বের এই ভিনদেশি রাজ্যে এসে অবাক হয়ে যায় যোদ্ধা। কত ভিন্ন এই জাতি, কত অদ্ভূত তাদের আচার-আচরণ রীতি-নীতি। কিন্তু সবকিছুর চেয়ে সবচেয়ে বেশি অবাক করার বিষয় হলো এ-জাতির সাহস, দুঃসাহসী বললেও কম বলা হবে। শত শত নগর বন্দর অনায়াসে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে এসেও ব্যতিক্রমী এই রাজ্যে এসে যোদ্ধা প্রথম বুঝতে শুরু করেন সবকিছু অত সহজে অর্জন করা যায় না। যুদ্ধজীবনে বহুরকমের সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধ করে আসলেও এই প্রথম বীর যোদ্ধা তার সৈন্যদলসহ দেখতে পেলো অপরাজেয় হস্তীবাহিনী। কোথা থেকে এলো এত হাতী আর কোথা থেকে এলো এত যোদ্ধা। দিনের পর দিন যাদেরকে শুধু উপজাতীয় বর্বর গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে, অবাক যোদ্ধা আজ সে জাতির বীরত্ব আর কৌশল দেখছে। জীবনে প্রথমবারের মত ব্যতিক্রমী এ-জাতি নতুন করে তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করালো। শুধু যুদ্ধ নয়, এ-জাতির আচার-আচরণ, চাল-চলন, আকৃতি-প্রকৃতি, এ-স্থানের পর্বত, সমুদ্র, নদী সমস্ত কিছুই একের পর এক তাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। বিস্ময়াভিভূত যোদ্ধা মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইল দূরের স্থানীয় ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নিজ থেকে বলে উঠলো, ‘বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস। বিচিত্র এ-দেশের মানুষগুলো।’ অফিসার থেকে সদ্য একাংশের সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সেলুকাস উত্তর দেয়, ‘সত্যিই বিচিত্র এই দেশ আলেকজান্ডার, মাই লর্ড’।
মহাবীর আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট। জীবনের বারোটি বছর ধরে, চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে, বাইশ হাজার মাইল অতিক্রম করে আজ ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মত চিন্তা করছে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার কথা। ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ২০শে জুলাই গ্রীসের উত্তরপূর্ব প্রদেশ মেসিডোনে জন্ম নেয় আলেকজান্ডার, তার মা অলিম্পিয়াস কখনোই স্বীকার করেনি যে আলেকজান্ডার তার কাগজে কলমের বাবা বহুস্ত্রীর অধিকারী রাজা ফিলিপের সন্তান। বছরের পর বছর অলিম্পিয়াস আলেকজান্ডারকে বুঝিয়েছে সে দেবতা জিউসের সন্তান। দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র, পৌরাণিক চিন্তা-ভাবনায় বিশ্বাসী মা এবং যুদ্ধবাজ বাবার সন্তান আলেকজান্ডার ছোটবেলা থেকেই তাই বেড়ে উঠেছে একটু আলাদাভাবে। শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে পৃথিবীর মানচিত্র শিখে এসে, প্রিয় লেখক হোমারের কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমোতে যাবার আগে আলেকজান্ডার স্বপ্ন দেখতো একদিন ঠিকই সে পৌঁছে যাবে পৃথিবীর শেষ সীমানায়।
যুদ্ধে এক চোখ হারিয়ে ফেলা আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপের স্বপ্ন ছিলো একদিন গ্রিস, মেসেডোনিয়ার সীমান্ত পার হয়ে পারস্য জয় করবে। কিন্তু, কে হবে ফিলিপের উত্তরসূরী আর এত বড় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী? একদা সদ্য বিবাহ করে আসলে, বিবাহ উপলক্ষ্যে করা ফিলিপের পানাহারের আসরে নতুন রানীর বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক, সে প্রশ্ন তুলে উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে গেলে তার মুখে সুরার পাত্র থেকে সুরা ছুঁড়ে মারেন আলেকজান্ডার। উত্তপ্ত, মাতাল ফিলিপ তলোয়ার নিয়ে ছেলেকে শায়েস্তা করতে আসার সময় এক কদম এগিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়েন। সে-দিন আলেকজান্ডার বাবাকে তিরস্কার করে বলেছিলো, “যে রাজা এক কদম পার হতেই পরাস্ত হয়, সে রাজা কি করে স্বপ্ন দেখেন গ্রিস পার হয়ে পারস্য আক্রমণ করার।”
উচ্চাভিলাষী মা অলিম্পিয়াস সবময় সুযোগে থেকেছে কি করে অন্য আর সব উত্তরাধিকারীকে নিশ্চিহ্ন করে ছেলে আলেকজান্ডারকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তার বিশ্বস্ত সাতজন দেহরক্ষীদর একজন এবং পুরুষ শয্যাসঙ্গী ‘পসানিয়াস’র হাতে নিহত হন রাজা ফিলিপ। নিজের সন্মুখে বাবার এই অপমৃত্যু আলেকজান্ডার খুব সহজভাবে মেনে না নিলেওও মাত্র বিশ বছর বয়সে পিতার অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয় সম্রাট আলেকজান্ডার। মেসিডোনিয়ান অন্যসব রাজ্যের যুবরাজসহ সিংহাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সবধরণের ব্যক্তি, যারা ভবিষ্যতে সিংহাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের সবাইকে খুন করানোর মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডার তার রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। ওদিকে, মা অলিম্পিয়াস আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন ফিলিপের অন্য স্ত্রী এবং তার শিশু সন্তানকে, যার কারণে আলেকজান্ডার মায়ের উপর ক্ষিপ্তও হয়।
সিংহাসনে স্থির হয়ে বসার পর এবার বিশ্বজয়ের পালা। নিজ রাজ্যের থীবস্ এবং এথেন্স্ এর বিদ্রোহ দমন করে ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে পারস্য আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে আলেকজান্ডার এশিয়া ও ইউরোপের মিলনস্থল ‘হেলিস্পন্ট’ নামক জায়গা অতিক্রম করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ইসাস্’ এর প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধে পারস্যের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট ‘দ্যারিয়ুস’কে পরাজিত করে তার শক্তিমত্তার জানান দিলেও দ্যারিয়ুসকে আটক করতে ব্যর্থ হয় আলেকজান্ডার । এর পরের অভিযানে সবচাইতে বড় বাঁধার মুখে পতিত হন ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দ্বীপ টায়ারএ(লেবানন)। চারপাশে প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত দ্বীপে নৌ-আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে, প্রায় সাত মাস ধরে অবরুদ্ধ করে রেখে অবশেষে আলেকজান্ডার সমুদ্রের উপর দিয়ে একমাইল দীর্ঘ দ্বীপে যাওয়ার পথ তৈরী করতে সক্ষম হয়। দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিজে হাতে আসার পর আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যরা যুদ্ধ করতে সক্ষম ছয় হাজার টায়ারবাসীকে তরবারি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে, দুইহাজারজনকে সমুদ্র সৈকতে ক্রুশবিদ্ধ করে আর বাকী ত্রিশ হাজার নারী, বৃদ্ধ, শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করে অন্য রাজ্যগুলিতে।
টায়ার বিজয়ের পর আলেকজান্ডার অল্পকিছুদিনের জন্য মিশর যাত্রা করে। যাত্রাপথে জেরুজালেমসহ অন্যসব শহর তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, শুধুমাত্র পাহাড়ের উপর অবস্থিত দূর্গদিয়ে সুরক্ষিত ‘গাজা’ শহর আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু খুব সহজেই ‘গাজা’ জয় করার পর আবারো আলেকজান্ডার শহরের সমস্ত পুরুষদের হত্যা করে অন্যদের দাস হিসেবে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। ওদিকে, রাজ্য হারিয়ে অসহায় পারস্য সম্রাট দ্যারিয়ুস আবার শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ‘গগামেলা’র প্রান্তরে সেই যুদ্ধে প্রতিপক্ষের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে জেনারেল ‘পারমেনিয়ন’ ও অন্যান্য উপদেষ্টাবৃন্দ রাতের অন্ধকারে আক্রমণ চালানোর জন্য সুপারিশ করে। জবাবে আলেকজান্ডার বলে, ‘আমি আমার নিজের বিজয় নিজেই রাতের অন্ধকারে চুরি করতে চাই না।’ আরো বলে, ‘আমি যদি পারমেনিয়ন হতাম, আমি তাই করতাম; কিন্তু আমি আলেকজান্ডার।’ যুদ্ধে সময়মত জয় ছিনিয়ে নিলেও আবারো দ্যারিয়ুসকে বন্দী করতে ব্যর্থ হয় আলেকজান্ডার।
ছবিঃ আলেকজান্ডার (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
এ-পর্যায়ে আলেকজান্ডার নিজেকে এশিয়ার রাজাদের রাজা তথা শাহেনশাহ্ ঘোষণা করে। সাথে সাথে পারস্যের স্থাপনা আর সংস্কৃতি দেখে হতবাক হয়ে যায় আলেকজান্ডারবাহিনী। যুগ যুগ ধরে তারা অযথাই ধারণা করে এসেছে, এই পারস্য বর্বর আর যাযাবরদের রাজ্য। কিন্তু, সবচাইতে লাভজনকভাবে আলেকজান্ডার এই পারস্য থেকে লুট করার জন্য পেয়ে যান প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কিলোগ্রাম স্বর্ণ, যেই স্বর্ণ বহন করার জন্য তাকে নিয়োজিত করতে হয়েছে ছয় হাজার সৈন্য। এক রাতেই আলেকজান্ডার পরিণত হয় ইতিহাসের সবচাইতে ধনী ব্যক্তিতে। নতুন অর্থ, নতুন সংস্কৃতি; এবার দলবল নিয়ে পারস্যের সংস্কৃতিতে মুগ্ধ আলেকজান্ডার নিজেই সেটা চর্চা করতে শুরু করে দেয়, কিন্তু ভিনদেশীয় সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করায় তার স্বদেশিয়দের মাঝে বিরাগভাজন হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে, রাজদ্রোহিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তার উর্ধ্বতন অফিসার ‘ফিলোটাস’কে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে এবং ছেলেহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে সন্দেহ করে, অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে তার নিজের ও পিতা ফিলিপের বহুদিনের সমরসঙ্গী, ফিলোটাসের পিতা ‘পারমেনিয়ন’কে খুন করে। কিন্তু, ফিলোটাসের প্রকৃত অপরাধ ছিলো মদ্যপ অবস্থায় সে তার এক শয্যাসঙ্গীনির কাছে বড়াই করে বলে ফেলেছিলো, আলেকজান্ডারের এত রাজ্য জয়ের পেছনের একমাত্র কারণ হলো ফিলোটাস নিজে এবং তার পিতা পারমেনিয়ন। মদ্য পান করে মাতাল হয়ে থাকা আলেকজান্ডার শুধুমাত্র এক রাজগণিকার মনোরঞ্জনের অভিপ্রায়ে সেখানকার মনোরম রাজপ্রাসদে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে এবং সমস্ত শহর লুটপাট করে তছনছ করে তার সৈন্যরা, পরবর্তী সকালে প্রকৃতিস্থ আলেকজান্ডার নিজের কৃতকর্মে নিজেই ব্যথিত হয়। কিন্তু, সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে মদ্যপ আলেকজান্ডার তর্ক করতে করতে, একদা তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো ব্যক্তি ‘ক্লাইটাস’কে নিজ হাতে খুন করে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করে।
এদিকে, সম্রাট দ্যারিয়ুস পালিয়ে বাঁচলেও আলেকজান্ডার তার পিছু নেন যে-কোনো মূল্য বন্দী করার জন্য। দ্যারিয়ুসের পরিবার তথা স্ত্রী-কন্যা-পুত্র আলেকজান্ডারের কাছে বন্দী। আলেকজান্ডার হাজার হাজার সাধারণ মানুষের গলা কেটে ফেলতে দ্বিধাবোধ না করলেও রাজপরিবারের সাথে সবসময় সন্মানজনক ব্যবহার করতো। টায়ার দ্বীপে সমস্ত শহরবাসীকে ধ্বংস করে দিলেও রাজপরিবারকে ক্ষমা করে দেয় আলেকজান্ডার। দ্যারিয়ুসকে বন্দী করার ইচ্ছা তার ছিলো, কিন্তু মেরে ফেলার অভিপ্রায় তার হয়তো ছিলো না। ভাগ্যের পরিহাসে আলেকজান্ডারের বাহিনি যখন দ্যারিয়ুসের নিকট যখন পৌঁছায়, তার এক বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি ‘বেসাস’র হাতে নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়ে দ্যারিয়ুস তখন মৃতপ্রায়। মৃত্যুপথে আলেকজান্ডারের বাহিনীর কাছে পানি চেয়ে অনুরোধ করে এবং পিপাসার্ত দ্যারিয়ুস পানি পান করার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে মৃত্যুর আগে বলে যান জীবনের শেষ বাক্য- “জীবনে এই প্রথম আমি কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করলাম, যার প্রতিদান দিতে পারলাম না।” পরবর্তীতে রাজ্যহারা নিজ সম্রাটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা বেসাসকে বন্দী করে, সুবিশাল দুটি বৃক্ষেকে কাছে টেনে তার সাথে দুই হাত বেঁধে ঝুলানোর নির্দেশ দেন আলেকজান্ডার। তারপর সেই দুই বৃক্ষকে দু’দিকে ছেড়ে দিলে দ্বিখন্ডিত হয়ে মৃত্যু বরণ করে বেসাস।
ছবিঃ আলেকজান্ডারের অভিযান পথ এবং জয়কৃত রাজ্য সমূহ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
পৃথিবীর শেষ প্রান্ত জয় করার অভিপ্রায়ে আলেকজান্ডার এবার আরো পূর্বে যাত্রা শুরু করে এবং সগডিয়ান রাজ্যে স্ত্রী হিসেবে তার জীবনে আসে রুকসানা। রুকসানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণকারী আলেকজান্ডার আজ ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভাবছে, এবার কি ফেরত যাওয়া উচিৎ নিজের রাজ্যে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো, সেই মেসিডোনিয়ায়। ভারতবর্ষের স্থানীয় হিন্দু রাজা ‘পুরু’ অসীম সাহস আর বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ করে প্রায় পরাস্তই করে ফেললো আলেকজান্ডার বাহিনীকে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর করতে পারলো না। পুরু পরাজিত হলেও আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনী আর যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা বুঝে গিয়েছিলো এ জাতি কোনো সাধারণ জাতি নয়। সম্রাট পুরু প্রতিরোধের যে নিদর্শন দেখিয়েছে এর পরও অগ্রসর হওয়াটা বোকামি। পরবর্তী রাজ্য গঙ্গার অববাহিকায় গড়ে উঠা ‘নন্দ’ এবং বঙ্গের সুবিখ্যাত ‘গঙ্গারিডাই’। বঙ্গের সীমানায় এসে, কি-জানি হয়তো এ-জাতির পারিবারিক স্নেহ-মায়া-মমতার নিদর্শন দেখেই আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর বছরের পর বছর ধরে পিছনে ফেলে আসা তাদের নিজ পরিবার, স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের কথা মন পড়ে গেলো। তারা বিদ্রোহ করে বসলো, অনেক হয়েছে আর নয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আলেকজান্ডারও সিদ্ধান্ত নিলো এবং অবশেষে নির্দেশ দিলো বাড়ী ফেরার।
বাড়ী ফেরার জন্য দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে আলেকজান্ডার। উদ্দেশ্য অর্ধেক জনবল সমুদ্রপথে এবং বাকী অর্ধেক স্থলপথে অগ্রসর হবে। ফেরার পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো আক্রমণ করে সামনে এগিয়ে চলা আলেকজান্ডার এবার আক্রমণ করে মালি(মুলতান)। শহরপ্রাচীরের এক পাশে মালির সৈন্যদল আর অন্যপাশে আলেকজান্ডারের সৈন্যদল, আর প্রাচীরের উপর একা আলেকজান্ডার। হঠাৎ করে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে বিশ্বজয়ী বীর তরবারি হাতে লাফিয়ে পড়লেন বিপক্ষ দলের মাঝে। মালির সৈন্যবাহিনীর মাঝে একা আলেকজান্ডার আর সঙ্গী মাত্র তিনজন মেসিডোনিয়ান সৈন্য। উপায় না দেখে রাজাকে বাঁচানোর জন্য মেসিডোনিয়ানরা যত দ্রুত সম্ভব প্রাচীরের অন্য পাশে পৌঁছালো। কিন্তু ততক্ষণে সঙ্গী তিনজনের দুইজনের দেহ থেকে শির আলাদা হয়ে গেছে, আলেকজান্ডার আহত হয়েছে মারাত্মকভাবে।
অসুস্থ শরীর নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করে আলেকজান্ডারের প্রিয়তম ‘হেফাইশ্চিয়ান’। হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে যায় আলেকজান্ডার। কোনোভাবে ছাড়তে রাজী না হওয়ায় অন্যরা জোর করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় মৃত হেফাইশ্চিয়ানের দেহ। সবার আগে সন্দেহের তীর যায় রুকসানার দিকে। শোকে বিহবল আলেকজান্ডার রুকসানাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে প্রাণভয়ে কাতর রুকসানা তার গর্ভে আলেকজান্ডারের তিন মাস বয়সী সন্তান থাকার কথা বলে রক্ষা পান। কিন্তু, আলেকজান্ডার রুকসানাকে নির্দেশ দেয়, আর কখনো যেন সে তাকে স্পর্শ করতেও না আসে। দুইদিন ধরে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধুই চোখের পানি ফেলে আলেকজান্ডার। হাইফেশ্চিয়ানের চিকিৎসককে দেয় মৃত্যুদন্ড। পার্শ্ববর্তী শহরের সব বাসিন্দাদের হত্যা করে হেফাইশ্চিয়ানের মৃত আত্মার প্রতি উৎসর্গ করে। ব্যবিলনে তার শবদাহ করে রাজকীয় মর্যাদায়, সীমাহীন অর্থব্যয় করে। সে-দিন সমস্ত রাজ্যজুড়ে শোকদিবস পালনের নির্দেশ দেয় আলেকজান্ডার।
হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠে আলেকজান্ডারের এবার আরব আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ আর হয়ে উঠলো না। ৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন, জগতের অপরাপর সমস্ত বীর যোদ্ধা যেখানে আলেকজান্ডারের প্রাণ নিতে পারলো না, প্রায় সপ্তাহখানেক জ্বরে ভোগার পর মাত্র ৩২ বছর বয়সে ব্যবিলনের একসময়কার সম্রাট নেবুচাদ নেজার‘র প্রাসাদে প্রবল জ্বরের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করে আলেজান্ডার। মৃত্যুর আগে কে হবে তার উত্তরাধিকারী, কার কাছে যাবে রাজ্য শাসনের ভার, সেটা বার বার করে জানতে চাওয়া হয়েছিলো আলেকজান্ডারের কাছে। কিন্তু যে বীরকে শৈশবে তার শিক্ষক এরিস্টটল শিখিয়েছেন, ‘দেখ, শোন,জান, তারপর সিদ্ধান্ত নাও’, যে বীর সমস্ত জীবন শুধু শক্তিমত্তার প্রদর্শন আর পূজা করে গেছে, সে কি আর অত সহজে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে। ‘কার কাছে যাবে রাজ্য শাসনের ভার’– তার উত্তরে আলেকজান্ডার ক্ষীণস্বরে তার সেনাপতির নাম করে বলেছিলো ‘ক্রাটিরোস’। কিন্তু ক্রাটিরোসের অনুপস্থিতিতে অন্য সেনাপতিরা সেটা পরিবর্তন করে বলে বেড়ালো –‘ক্রাটিস্টোস্’। অর্থ্যাৎ, টু দ্যা স্ট্রঙ্গেস্ট, সবচাইতে শক্তিমানের কাছে যাবে রাজ্যশাসনের ভার।
মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে আলেকজান্ডারের শক্তিমান সেনাপতিরা সুবিশাল রাজ্য ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়। তলোয়ার নিয়ে একে অন্যকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে, বিবদমান পক্ষগুলো একে অপরের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেয়। কথা থাকে, রুকসানার পুত্র সন্তান হলে তার কাছে অর্পণ করা হবে রাজ্যভার। এদিকে প্রিয় রাজার মৃতদেহ নিজ মাতৃভূমিতে নিয়ে যাবার জন্য মেসিডোনিয়ানরা উঠে পড়ে লাগে, কিন্তু আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমি বলতে গেলে লাশ ছিনিয়ে মিশর নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কথা অনুযায়ী একসময় রুকসানা ও আলেকজান্ডারের পুত্রসন্তানকে কাগজে কলমে রাজা খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু আলকজান্ডারের সেনাপতি, বন্ধু, পরিবার-পরিজন যাদের নাম দেয়া হয় ‘ডায়াডকি’ তথা উত্তরসূরী, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্রে করে ইতিমধ্যেই তারা নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। একের পর এক খুন হতে থাকে সেনাপতি আর উত্তরাধিকারীগণ। অবশেষে সমস্ত রাজ্য চারভাগে ভাগ হয়- মিশর, এশিয়া মাইনর, পূর্বএশিয়া এবং মেসিডন। কিন্তু, ক্ষমতার পালাবদলে এবং নিজ পুত্রের ভবিষ্যত নিষ্কণ্টক করতে এরই মাঝে রুকসানা খুন করে আলেকজান্ডারের বিবাহিতা অন্য দুই রাণীকে। পুত্রসহ নিজে সুরক্ষিত থাকে আলেকজান্ডারের মাতা অলিম্পিয়াসের তত্ত্বাবধানে।
আলেকজান্ডারের জেনারেল এবং পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের একাংশের রাজা ‘এন্টিপেটার’, মৃত্যুকালে রাজ্যের ভার নিজ পুত্র ‘কাসান্ডার’কে না দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয়। সময়মত কাসান্ডার ঠিকই রাজ্য আক্রমণ করে নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেয় এবং যে ‘থীবস্’ নগরী ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডার তার বিশ্বজয় শুরু করেছিলো, সেই থীবস্ নগরী পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। এক পর্যায়ে, ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডার বন্দী করে আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস, স্ত্রী রুকসানা এবং পুত্র চতুর্থ আলেকজান্ডারকে। কাসান্ডার অলিম্পিয়াসকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে, কিন্তু তার সৈন্যরা সে-মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে, অলিম্পিয়াস পূর্বে যাদেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলো তাদের স্বজনদের মাধ্যমে কাসান্ডার অলিম্পিয়াসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করায়। অন্যদিকে, থ্রেস’র অ্যাম্ফিপোলিসে বন্দী থাকে রুকসানা আর আলেকজান্ডারের পুত্র সন্তান এবং ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডারের নির্দেশে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আলেকজান্ডারের শেষ বংশধর তার তের বছর বয়সী সন্তান এবং স্ত্রী রুকসানা। হাজার হাজার মাইল পূর্বে সগডিয়ানার তরুন ‘আফসিন’ রাতের বেলায় তারা গুণতে বসে। এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়; আবার গুণে, এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়; না, সপ্তম তারাটি আর নেই, হারিয়ে গেছে সগডিয়ানার আকাশ থেকে।
তথ্যসূত্র
মার্চ ০৬, ২০১১
[email protected]
** কাহিনীর বেশ কিছু অংশ নিয়ে মতবিরোধ আছে, বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্নরূপে বর্ণিত হয়েছে এই কাহিনী, আমি সূত্রগুলো যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে নিজের মত করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
ভাল লাগল লেখাটি। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু আগে শুনলেও এত বিস্তারিতভাবে এক সাথে পড়িনি কখনো।
আলেক্সান্ডার আর পুরুকে নিয়ে সেই কাহিনী কি সত্য নাকি? পুরুকে নাকি আলেক্সান্ডারের কাছে বন্দী অবস্থায় আনার পর আলেক্সান্ডার প্রশ্ন করেছিল যে তার যায়গায় সে থাকলে বন্দীকে নিয়ে কি করত? পুরু নাকি জবাব দিয়েছিল যে নিজে রাজা হয়ে আরেক রাজাকে সসম্মানের সাথেই ছেড়ে দিত। আলেক্সান্ডারও নাকি তাই করে। কেউ কেউ আবার বলে পুরুর সাথে যুদ্ধে আলেক্সান্ডার পরাজিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে অথেন্টিক ঐতিহাসিক সূত্র নাকি নেই।
আলেক্সান্ডারের বাহিনীর সাথে আসা কিছু গ্রীক নাকি পাকিস্তানে থেকে যায়, তাদের বংশধরেরাই নাকি আফ্রিদি নামে পরিচিত। পাক ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদি নাকি এই ধারার লোক, সত্য মিথ্যা জানি না অবশ্য।
আগের দিনের রাজা গজাদের খুনাখুনীর নেশা দেখলে তো এখনকার গুলোকে ফেরেশতার মতই লাগে।
@আদিল মাহমুদ,
পুরুর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাকে সুবিশাল রাজ্যের শাসনভার দিয়েছিলেন। কিন্তু, সত্যি কথা হচ্ছে এই আলেকজান্ডার সাধারণ মানুষদের গলা কাটতে একটু সংকোচ না করলেও, রাজা এবং তার পরিবারদের আক্রমণপথে প্রায় সবজায়গায় ক্ষমা করে দিয়েছে। রাজায় রাজায় মাসতুতো ভাই আর কি।
আরেকটা জিনিস না বললেই নয়, আমার মনে হয়, অন্যের বীরত্বে মুগ্ধ হবার মানুষ আলেকজান্ডার নয়, অন্যের বীরত্বে তিনি বড়জোর ক্রুদ্ধ হতে পারেন। এত দূরে, রাজ্য সামলানো সম্ভব নয় দেখেই পুরুকে দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিলেন। কই এর তেলে কই ভাজার মত ব্যাপার। ‘পুরু’ শেষ পর্যন্ত হেরেছিলো বলেই মনে হয়, তা না হলে আলেকজান্ডার বন্দী হতো। আর, ভারতীয়রা দশ-বারোটা মহাকাব্য লিখে ফেলতো।
আমি যতদূর জানি, আফ্রিদিরা তাদের অঞ্চলের আদিবাসী। অতএব, বহুকাল আগ থেকে তাদের সেখানে থাকবার কথা, আলেকজান্ডারের আক্রমনেরও আগে।
আমার এই লেখা লেখার সময় শুধু মনে হয়েছে, গ্রেট আর গ্রেট ওয়ারিয়র কখনোই এক কথা ন্য, আলেকজান্ডার গ্রেট ওয়ারিয়র হতে পারেন, কিন্তু কখনোই গ্রেট মানুষ নয়।
ভালো থাকবেন। 🙂
@মইনুল রাজু,
এসব প্রাচীন বীরদের গ্রেট মনে হয় মানূষ হিসেবে বলা হয় না, খুনাখুনীর দক্ষতার কারনেই বলা হয়।
আফ্রিদিদের ওপর সামান্য রিসার্চ করলাম। নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে উইকিতে আলেক্সান্ডারের সাথের সম্ভাব্য সূত্র পেলাম। Some historians[who?] think that Afridis are the direct descendants of the Greeks. During the time of Alexander The Great, some of his troops made this terrain their permanent abode…
আশ্চর্যের ব্যাপার হল ছেলেবেলায় এসব খুনাখুনীর কাহিনী, সিনেমা সব দারুন উপভোগ্য মনে হত। কেন কে জানে। আমাদের কাছে ভাল সিনেমার মাপকাঠি ছিল কোনটায় মারপিট বেশী 🙂 । ফাইভে পড়ার সময় হেলেন অফ ট্রয় কাহিনী পড়েছিলাম, দারুন লেগেছিল। বড়দের ভার্ষন আর পড়া হয়নি। এ নিয়েও লিখে ফেলেন আরেক খানা।
সেবার বিশ্বের বিস্ময়ে পড়েছিলাম যে আলেক্সান্ডারের সেনা দল যেসব নৌকো করে পাকিস্তানে একটি নদী পেরিয়েছিল তার একটি নাকি এখনো আছে।
নিষ্ঠুরতায় মনে হয় না চেংগিস খানকে আলেক্সান্ডার টেক্কা দিতে পারবে বলে। তৈমুর লং, নাদির শাহ এনারাও মনে হয় নেহায়েত কম যাবেন না।
@আদিল মাহমুদ,
চেংগিস খানকে ছাড়িয়ে যাওয়া মনে হয় সম্ভব না। ভাসিলি ইয়ানের ‘চেংগিস খান’ পড়েছেন কিনা জানি না। খুব সুন্দর একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম কিছুদিন আগে। এত নৃশংস মানুষ হয় না।
ভাল লাগলো!!!
@নীল,
ধন্যবাদ। 🙂
নামকরণ ছাড়া পুরোটাই চমৎকার লেগেছে ।
অযথাই ছোট করে না লেখার অনুরোধ করছি ।
ধন্যবাদ ।
@রুপম,
সত্যি বলতে কি, আমার নিজেরো নামটা পছন্দ হচ্ছে না। 😛
লেখা ছোট হোক বড় হোক দরকারী তথ্যগুলো যাতে না হারায় তার চেষ্টা করছি।
ভালো থাকুন।
মইনুল রাজু, আপনার বেশীর ভাগ লেখাই ভালো লাগে আমার। কিন্তু এই লেখাটার মাঠামুন্ডু কিন্তু বুঝলাম না। নামটা দিলেন রুকসানা কিন্তু কাজের বেলায় পুরো লেখাটা ধরে শুধু আলেক্সান্ডার নিয়েই কথা বললেন। রুকসানাকেও কিন্তু এমন কোন সাহসী বা ব্যতিক্রমী নারী বলে মনে হল না। ইতিহাসে তার মত আরও অনেক রাজপত্নী বা রাজমাতার কথা শুনেছি। প্রথমে যুদ্ধে অংশগ্রহঙ্কারী রুকসানার কথা শুনলেও পরে কিন্তু আলেক্সান্ডারের বহু নারীর একজন হয়ে ঘোরা এবং তার সন্তান জন্ম দিয়ে ধন্য হওয়া প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী নারী ছাড়া তাকে আড় কিছু বলে মনে হল না। হাইপেশিয়া এবং রুকসানাকে কোনভাবেই একই লীগের নারী বলে মেনে নিতে পারছি না।
@ফাহিম রেজা,
আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। কিন্তু আপনি হয়তো ধরে নিয়েছেন, আমি এই সিরিজে সব ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রদের নিয়ে লিখতে চাচ্ছি। আসলে সেরকম কিছু করতে যাচ্ছি না। অনেকের ভীড়ে একজনকে উপলক্ষ্য করে কিছু ইতিহাস বর্ণনা করতে চাচ্ছি। কিন্তু, সে একজন একদম সাদামাটা একটা চরিত্রও হতে পারে। ব্যক্তিত্বের বিচারে রুকসানা হাইপেশিয়ার ধারে কাছেও আসবে না। রুকসানার পরিচয় আলেকজান্ডারের মধ্য দিয়ে, হাইপেশিয়ার পরিচয় সে নিজেই।
ধন্যবাদ।
চমৎকার!!
@সৈকত চৌধুরী,
ধন্যবাদ। 🙂
ভাল লাগল!
কিছু সময়ের জন্য যেন সুদূর অতীতে চলে গিয়েছিলাম।
কোন কারণে আলেকজান্ডার রুকসানাকে সন্দেহ করলেন
বুঝতে পারলামনা।
@লাইজু নাহার,
আলেকজান্ডার রুকসানাকে যতটুকু ভালোবাসতেন বা সময় দিতেন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় দিতেন হেফাইশ্চিয়ানকে। তাছাড়া, হেফাইশ্চিয়ানের সাথে আলেকজান্ডারের সম্পর্ক রুকসানা কখনোই মেনে নেয়নি। সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক বাগ-বিতন্ডাও হয়েছে। রুকসানাসহ আরো অনেকেই চাইতেন হেফাইশ্চিয়ানের সাথে আলেকজান্ডারের বিব্রতকর সম্পর্কের অবসান হোক। হেফাইশ্চিয়ানকে চিকিৎসক যে ঔষধ খেতে দেন, তাতে বিষ মিশানো ছিলো বলে আলেকজান্ডার সন্দেহ করেন। তাই, হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় আলেকজান্ডার সবার আগে ছুটে গিয়েছিলো রুকসানার দিকে। ধারণা করা হয়, হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুর কারণেই আলেকজান্ডার সবকিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।
@মইনুল রাজু,
তাহলে কি বলা যায় আলেকজান্ডারও সমকামী ছিলেন? শুধু সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্যই কি নিজের ঔরসজাত সন্তানের জন্য রুকসানাকে বিয়ে করেছিলেন ?
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
সবকয়টা জায়গাতেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে হেফাইশ্চিয়ানের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক ছিলো। কোথাও কোথাও লিখেছে সম্ভবত তাদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু সরাসরি সমকামী ছিলো বলে কোথাও আমি দেখতে পাইনি। তবে কোথাও উল্লেখ থাক আর না থাক, দুই যোগ তিন সমান পাঁচ।
ভাল লাগল লেখাটি।
@রৌরব,
ধন্যবাদ। 🙂
অসাধারন।এতো যুদ্ধবাজের ঘটনা,সব বিদ্ঘুটে নাম ও ঘটনার পর ঘটনা পরপর সাজিয়ে লেখার কৌশল সত্যিই চমকপ্রদ ব্যাপার-স্যাপার।
পৃথিবীর দুই সেরা যুদ্ধবাজ আলেকজান্ডার ও চেংগিসখাঁন, কার থেকে কে বড় মানবাতিহাসে খুনী ছিল ?
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
মামুন ভাই, অনেক চেষ্টা করেও লেখাটি এর থেকে ছোট করতে পারলাম না।
আলেকজান্ডারের উপর স্টাডি করার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম, সে গ্রেট ওয়ারিয়র হতে পারে, কিন্তু কখনোই গ্রেট না।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
সংখ্যার দিক থেকে বোধহয় চেঙ্গিস, তবে আলেকজাণ্ডারও কম না। কেউই কম না 🙂 — আমার মতে সবচেয়ে জঘণ্য রোমানরা।