যেকোন কথা যখন বায়বীয়-বিষয়াদির ভুল ঠিক-এ গড়ায়, আমার পক্ষে যুক্তি দিয়ে সে বিষয়ে কথা বলা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। এবং আজকাল অধিকাংশ বিষয়ই গড়াচ্ছে ভুল ঠিক-এ। বাংলাদেশে হিন্দি ভাষায় গান শোনা ভুল কি ঠিক, হিন্দি সিরিয়াল দেখা ভুল কি ঠিক। তথাকথিত ‘ডিজ্যুস’ বা অপ্রমিত ভাষায় কথা বলা ভুল কি ঠিক। অপ্রমিত ভাষায় গল্প েলখা, ব্লগ লেখা, টিভি বা রেডিওতে অনুষ্ঠান করা ভুল কি ঠিক। এগুলোর উত্তর অনেকের কাছে তৎক্ষণাৎ আছে। অনেকেই জানে কি করাটা আসলে দরকার। আমার পক্ষে সেই ভুল-ঠিক বলাটা খুব কঠিন।

আমার মনে হয় না এখানে ভুল-ঠিক ধরে এগুনোটা ফলপ্রসূ। যদিও আমরা সে দৃষ্টিতেই ব্যাপারগুলোকে দেখে এসেছি। আমরা যদি আমাদের ভাষা আন্দোলনের দিকে তাকাই, সেখানে কি ভুল ঠিকের বিচার ছিল? নাকি এটাই প্রধান ছিল, মানুষের নিজস্ব চাওয়ার উপর কোন বিশেষ নির্ণীত চাওয়া চাপিয়ে দেওয়াটা সমস্যাজনক। আমার কাছে এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা। এবং ঠিক এই শিক্ষাটাই আমাদের বর্তমান ভাষাদিবসের অনুভূতিতে অনুপস্থিত। এ কয়দিনে আমার আশেপাশের মানুষের ভাষাদিবসের অনুভূতিতে যা উদ্ধার করতে পারলাম: ১) হিন্দি না বলার প্রতিজ্ঞা, ২) অপ্রমিত বাংলা না বলার প্রতিজ্ঞা, ৩) বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব উদ্ঘাটন। এ সবের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। ভাষাদিবসের অনুভূতি নিশ্চয়ই নিজের ভাষার প্রতি সচেতন হবার ধারণা দেয়। সেটা ছিল নিপীড়িতের শিক্ষা। কিন্তু এখানে কিন্তু না-নিপীড়িতেরও একটা শিক্ষাও থাকার কথা। আর তা হল অন্যের ভাষা অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা করতে শেখা। সেটায় কিছু ঘাটতি দেখেছি বটে।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হবার পেছনে আমাদের একটা গর্ব কাজ করতে দেখা যায় যে “দেখো দেখো, ওই দিনটা কিন্তু আমাদের দিন।” এই অনুভূতিটাও ওই নিপীড়িতের অনুভূতি বা নিজের ভাষার প্রতি সচেতনতার অনুভূতির কাতারে পড়ে। আমাদের মধ্যে অন্যের ভাষা চর্চার প্রতি যে শ্রদ্ধা, তাতে মোটের উপর অভাব আছে।

নিপীড়িত তার নিপীড়নের অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার পরেও নিপীড়নের একটা আতঙ্ককে ধারণ করে রাখে অনেক সময়। এটা অনেকটা তেমনটাই। অনেকটা এমন, যেন বাংলা ভাষাটা যেকোন সময়েই আবার হামলা-আক্রমণের মুখে পড়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব অনেক সময় অনুভব করতে হয় হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবির অবজ্ঞায়, যার চর্চা আমাদের হাসি ঠাট্টায়, খিস্তিতে, সাধারণ আড্ডায় আর ব্লগগুলোতে বিদ্যমান। সেগুলো নিজস্ব ভাষা সচেতনতার বেড়ে ওঠায় একটা পর্যায় পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যই অনেকে বলবেন, এবং ভুল ঠিকের তর্কের ঝামেলা এড়াতে সেগুলো নিয়েও আমি তর্ক এড়াই।

তবে ভিন্ন এবং এক অর্থে আমার কাছে আবশ্যিক চেতনাটা, অর্থাৎ অন্যের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার যে চেতনা, সেটার যে অভাব আমাদের মধ্যে বিদ্যমান, সেটার সাথে নিজের ভাষার অতিসচেতনতা মিলেমিশে কিছু নির্ণয়যোগ্য-আগ্রাসী চেতনার সৃষ্টি হয়। সেটা আমাদের ভুলে থাকতে দেয় আমাদের দেশে বিদ্যমান ভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকারের কথা। অনেকটা মুসলিমপ্রধান দেশের মুসলমান তার নিজের ধর্ম সানন্দে পালনের সুযোগ থাকার পড়েও নিজের ধর্মের প্রতি তার অতিরিক্ত অতিসচেতনতা যেভাবে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চার সুযোগ-সুবিধার অভাব বা অবহেলাকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করে। সেদিন বিপ্লব রহমানের লেখাটা পড়ে সেটা আবার খুব করে উপলব্ধি করেছি।

আরও সূক্ষ্ম বিষয় হচ্ছে অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার। আজকে নাটক, সিনেমা, গল্প, কবিতা, ব্লগে ও মুখের ভাষায় অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার অনস্বীকার্য। এটার অস্তিত্ব আছে। এবং এটা মানুষ জোর ক’রে করে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার মুখের ভাষাও প্রমিত না। আমার পাঠকদের অধিকাংশেরই তা না, আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু লেখার ভাষাটা প্রমিত রাখার একটা চল আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় আছে। ক্ষেত্রবিশেষে এটার প্রয়োজনীয়তা তর্কাতীত। কিন্তু নাটকে, গল্পে, সাধারণ আড্ডায়? চাই সে মিডিয়াতেই না হয় হলো। সেখানে মানুষ যখন জোর না করেই, স্বতস্ফূর্তভাবে অপ্রমিত ভাষায় কথা বলে, সেটাকে কি কেউ পারে আইন করে বন্ধ করে দিতে (সে চেষ্টা হয়েছে)? সেটা কি মানুষের মুখের ভাষা নয়? তবে অনেক ভাষা-সচেতন মানুষ আর তাদের সমর্থিত সরকারের এমন আচরণে আমি অবাক হই না। এই দ্বন্দ্বটা অস্বাভাবিক না আমার কাছে।

আর আরেকটা পর্যায় আছে – যারা সে অপ্রমিত ভাষায় কথা বলে তাদের প্রতি অবজ্ঞা। তাহলে তো চট্টগ্রামের মানুষকেও অবজ্ঞা করা চলে। আঞ্চলিক ভাষাকে অবজ্ঞা করার চলও একটা ছিল এককালে। অনেক সময় লেগেছে আঞ্চলিকভাষাগুলোর মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেতে। এখন শহুরে অপ্রমিত ভাষাগুলো আঞ্চলিকভাষা নয় বলে কি আরো কিছু সময় অপেক্ষা করা লাগবে সেই মুখের ভাষাগুলোকেও শ্রদ্ধা করতে শেখার? ভাষাটা একটা ভিন্ন গোষ্ঠির হলে ঠিক আছে। একটা ভিন্ন অঞ্চলের হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার গোষ্ঠিতে এসে র-কে-ড়-করা যাবে না বাপু। হাস্যকর লাগে ভাবতে যে, যেদিন আজকের শহুরে অপ্রমিত ভাষাটা কেবল শ্রদ্ধার আসন নয়, বরং প্রমিতের মর্যাদা লাভ করবে, সেদিন সেই ভাষাভাষীরা নতুন কোন ‘অপ্রমিত’ ভাষাভাষীকেই আবার একইভাবে অবজ্ঞা করবে।