স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও বাংলাদেশে ভাষাগত সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমহ তথা আদিবাসীদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের দাবি উপেক্ষিত হয়েই আসছে। ফলে দেশের ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠির ২০ লাখেরও বেশী মানুষ বংশপরম্পরায় ভুলতে বসেছেন নিজেস্ব ভাষার ঐতিহ্য, লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন, সাহিত্যকীর্তি। এমন কি আদিবাসী শিশুর নিজ মাতৃভাষায় অক্ষরজ্ঞান না থাকায় তাদের সংস্কৃতিও হচ্ছে মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ।

প্রয়োগিক ভাষা হিসেবে বাংলা ও ইংরেজী ভাষার আগ্রাসী থাবায় ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে আদিবাসীর নিজ নিজ ভাষার গৌরব।

দীর্ঘদিন পাহাড়ে, বনে-বাদাড়ে, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ঘুরে জেনেছি, এ দেশে সাধারণভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা হত-দরিদ্র প্রধান প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠিগুলোর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মনিপুরী, গারো, সাঁওতাল ও খাসিয়া) প্রত্যেকেই নিজেস্ব ভাষা ও নিজ ভাষার বর্ণলিপি অনেক সমৃদ্ধ । আবার কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠির নিজেস্ব বর্ণমালা না থাকলেও তাদের রয়েছে রোমান বর্ণমালায় ভাষা চর্চার ঐতিহ্য। কিন্তু চর্চার অভাবে এ সব বর্ণমালার সবই এখন বিলুপ্ত প্রায়।

এরফলে নতুন প্রজন্মের আদিবাসীরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নিজেস্ব ভাষায় তারা একেবারে প্রায় অজ্ঞ। অথচ মাত্র চার দশক আগেও পরিস্থিতি এতোটা বিপন্ন ছিলো না। তখন নিজ মাতৃভাষা লিখিত চর্চার পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে শিশুশিক্ষায় ভাষাটির বর্ণপরচিয়ও চলতো।

চাকমা রাজা ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায় আলাপকালে বলেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সারাদেশের শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুর ঝরে পড়ার হার অনেক বেশী। এর একটি কারণ– ভাষাগত বাধা। আদিবাসী শিশু বাসায় যে ভাষায় কথা বলছে, স্কুলে সে ভাষায় লেখাপড়া করছে না। বাংলা বুঝতে না পারার কারণে শিশুমনে পাঠ্যবই কোনো দাগ কাটছে না, স্কুলের পাঠ গ্রহণ করাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। …তাই আমরা অন্তত প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসী শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা চাই, মাতৃভাষায় বর্ণপরিচয়, ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট-খাট অংক, নিজ জাতির ও বাংলাদেশের ইতিহাস শিক্ষার পাশাপাশি যেনো আদিবাসী শিশু বাংলাতেও অন্যান্য পাঠগ্রহণ করতে পারে। এটি শিশুর মনোস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্যও জরুরি।

দেবাশীষ রায় খানিকটা দুঃখ করেই বলেন, চার-পাঁচ দশক আগেও আদিবাসী ভাষা চর্চার এতোটা বেহাল দশা ছিলো না।…আমি ছোট-বেলায় দেখেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক গুরুজনই চাকমা ভাষায় নিজেদের মধ্যে চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন। মারমা ভাষাতেও সে সময় লিখিতভাবে ব্যক্তিগত ভাববিনিময় ও লেখালেখি চলতো। কিন্তু প্রতিযোগিতার যুগে এখন ওই চর্চাটুকুর সবই হারিয়ে গেছে।…

বলা ভালো, আদিবাসীদের মধ্যে চাকমারা একটি বড় অংশ। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় সাড়ে চার লাখ চাকমা বাস করে। চাকমাদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ নিজেদের ভাষা ও বর্ণমালা তেমন একটা ব্যবহার করেন না। এমনকি চাকমা ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করেন, তারাও চাকমা বর্ণমালা ব্যবহার না করে কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক বাংলা বর্ণে লেখেন।…

পাহাড়ে চাকমা ভাষায় দুটি পত্রিকা বের হয়। একটি মাসিক, নাম আবাংপাঙ। মাঝেমধ্যে জুনিপহ্র নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও বের হয়। কিন্তু পত্রিকা দুটি বাংলা বর্ণমালায় ছাপা হয়। আবাংপাঙ-এর সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা বলেন, চাকমা বর্ণমালায় পত্রিকা বের করলে পড়ার কেউ নেই।

১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে জনসংহতি সমিতি। আঞ্চলিক দলটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, ব্যবহারিক ক্ষেত্র যদি তৈরি করা না যায়, তাহলে সে ভাষা মানুষ শিখবে কেন? এর জন্য দরকার সরকারি উদ্যোগে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা।…

এ অবস্থায় আদিবাসীরা বিপন্ন নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে তুলেছেন বর্ণমালা শিক্ষার স্কুল। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এ সব স্কুলে আদিবাসী ভাষার সঙ্গে পরিচিতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেস্ব সংস্কৃতি ও জীবনাচারও শিক্ষা দেওয়া হয়।

আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেণ জানান, উত্তরবঙ্গে সাঁওতালরা বছর দশেক আগে কয়েকটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার উদ্যোগে নিজেরাই খুলেছেন পাঁচটি ভাষা শিক্ষার স্কুল। কোনোরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এসব স্কুলে তারা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সাঁওতাল ভাষায় পাঠদান করেন। রাজশাহীর পবা ও তানোরে শিক্ষিত সাঁওতাল যুবকরা নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে প্রথমে খোলেন এ রকম দুটি স্কুল। বই-পত্রের অভাবে তারা নিজেরাই লেখেন বর্নপরিচয় মূলক পাঠ্যবই। …পরে কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা– এনজিও এই কাজে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে।

পাহাড়ের ছোট কাগজ ‘মাওরুম’ এর সম্পাদক দীপায়ন খীসা জানান, ১৩ টি পাহাড়ি জাতিসত্তার নিস্বর্গভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিসহ কয়েকটি অঞ্চলেও রয়েছে এ রকম বেসরকারি উদ্যোগ। সেখানে অবশ্য বৌদ্ধ মন্দিরে (কিয়াং) বৌদ্ধ পুরহিতরাই (ভান্তে) নিজ উদ্যোগে প্রধাণত চাকমা ও মারমা বর্ণমালা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তবে বর্ণমালার বইয়ের দুস্প্রাপ্যতা¯এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধা।

এই বাধা কাটিয়ে উঠতে কিছুদিন আগে ‘শিপচরণ সাহিত্য কেন্দ্র’ প্রকাশ করেছে চাকমা বর্ণমালার বই ‘ফুজি পর’ বা ভোরের আলো। এই বইয়ে পাহাড়ের প্রকৃতি ও পাহাড়িদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত রঙিন হাতে আঁকা ছবি এবং বর্ণমালা সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দিঘীনালার আমতলীর শান্তিপ্রিয় দেওয়ানসহ আরো কয়েকজনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে চাকমা ভাষার বর্ণমালার পরিচিতিমূলক পোস্টারও প্রকাশিত হয়েছে। সীমিত আকারে হলেও উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্রাক’ আদিবাসীদের প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্রাকের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে তাদের লেখা আদিবাসী বর্ণপরিচয়ের বইপত্র পড়ানো হচ্ছে।

পাহাড়িদের চৈত্র সংক্রান্তি এবং বর্ষবরণ উৎসব বৈসুক, সাংগ্রাই, বিঝু ও বিষুর আগে প্রতিবছর জুম এস্থেটিক কাউন্সিল– জাকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনেক বছর ধরে সংকলন, সাময়ীকি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি প্রকাশ করে আসছে। এসব প্রকাশনায় আদিবাসী বর্ণমালা ঠাঁই না পেলেও বাংলা বর্ণমালাতেই চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার সাহিত্য স্থান করে নেয়।

অন্যদিকে রাখাইন স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশ– আরএসওবি’র সাবেক সভানেত্রী কচিন ঠে জানান, আটের দশকে সরকারি উদ্যোগে কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালি ও বরগুনার রাখাইন অধ্যুষিত অঞ্চলে ১৭ টি রাখাইন ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা হলেও এখন মাত্র ছয়-সাতটি বিদ্যালয় কোনো রকমে টিকে আছে।

তিনি জানান, সে সব বিদ্যালয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত রাখাইন ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদান ও শিক্ষকের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সরকারি উদাসীনতায় পুরো উদ্যোগটিই প্রায় ভেস্তে যায়।…
[পুনর্লিখিত]

ছবি: ১। চাকমা বর্ণমালা, লেখক, ইউকিপিডিয়া।
২। পাহাড়ে আদিবাসী স্কুল, মেঘনা গুহ ঠাকুরতা।

আরো পড়ুন: ফেসবুক গ্রুপ ‘পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice’ এর নোটসমূহ।