ডারউইন দিবস উপলক্ষে কিছু লেখার যোগ্যতা বা পরিকল্পনা আমার ছিলনা। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, ফ্রেডরিক হায়েকের “আমি কেন রক্ষণশীল নই” এর একজায়গায় বিবর্তনবাদের কথা আছে। আজকে যেটুকু অনুবাদ করা হল তার মধ্যে ওই জায়গাটা আছে, কাজেই এই লেখাটিকেও ডারউইন দিবসের লেখা হিসেবে ধরে নিতে পারেন, চাইলে। :-s
আমি কেন রক্ষণশীল নই ১
আমি কেন রক্ষণশীল নই ৩
আগের পর্বের পরে…
রক্ষণশীল নিয়মনিষ্ঠ নয়, একথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে তার সুদৃঢ নৈতিক অবস্থান নেই। হিসেব করলে বরং দেখা যাবে, বহু রক্ষণশীলই কঠোর নৈতিক নিশ্চয়তার অধিকারি। “নিয়মনিষ্ঠ নয়” বলতে বোঝাচ্ছি, রক্ষণশীলের রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে কাঠামোর অভাব — এমন কাঠামো যেটির ব্যাপারে একমত হতে পারে ভিন্ন নৈতিকতার মানুষ, যেটির সাহায্যে তৈরি করা সম্ভব একটি সাধারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাতে যে যার নিজস্ব নৈতিকতাকে মেনে চলতে পারে। একমাত্র এধরণের নীতি বা কাঠামোকে মেনে চলবার মাধ্যমেই এমন সমাজ গঠন করা সম্ভব, যেখানে শান্তিরক্ষার জন্য ন্যূনতম শক্তির ব্যবহারই যথেষ্ট। আর এরকমের নীতি মেনে নেয়ার মানে অপছন্দনীয় অনেক কিছুই সহ্য করে চলার মানসিকতা অর্জন। যেমন ধরুন, রক্ষণশীলদের বহু নৈতিক অবস্থানই আমার ভাল লাগে, আবার সমাজতন্ত্রীদের বহু উদ্দেশ্যই আমার অপছন্দ, কিন্তু একজন উদারপন্থীর কাছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য তার পছন্দ না অপছন্দ সেটি অনেক পরের ব্যাপার। উদারপন্থীর মতে, এধরণের পছন্দ-অপছন্দ তাকে অন্যের উপর সেটা চাপানোর অধিকার দেয় না। হাল-ফ্যাশনের মতামতগুলির সবগুলি আমার পছন্দ নয়, এবং হয়ত এদের বিরূদ্ধে আমি ভোটও দিতে পারি, কিন্তু আমার হাতে এমন কোন সাধারণ নীতি নেই যা দিয়ে আমি ভিন্ন মতাবলম্বীদের বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে এই মতামতগুলি সমাজে নিষিদ্ধ করা উচিত। অন্যদের সাথে সফলভাবে কাজ ও বাস করতে হলে নিজের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বস্ততা যথেষ্ট নয়। এর জন্য দরকার একটি বৌদ্ধিক কাঠামো যেখানে এমনকি মৌলিক বিষয়গুলোতেও মত ও পথের অনৈক্য গ্রহণযোগ্য।
ঠিক একারণেই উদারপন্থীর কাছে নৈতিকতা বা ধর্ম জবরদস্তির বিষয় নয়। সমাজতন্ত্রী বা রক্ষণশীল এধরণের কোন সীমায় বিশ্বাস করে না। যেসব নৈতিক বিশ্বাস অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না তাদের ব্যাপারে জবরদস্তি অন্যায়, এই দৃষ্টিভঙ্গিই উদারপন্থাকে রক্ষণশীলতা ও সমাজতন্ত্র থেকে আলাদা করে বলে আমার মনে হয়। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস হারিয়ে অনেকেই কেন উদারপন্থী না হয়ে রক্ষণশীলতার সাথে আত্মিক যোগাযোগ খোঁজেন, এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এটা।
শেষ বিচারে, রক্ষণশীল অবস্থানের মূল কথা হচ্ছে, সমাজে সুস্পষ্টভাবেই অভিজাত কিছু লোক আছে যাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অবস্থান রক্ষা করে চলা উচিত। এবং নৈতিকতা ও রাজনীতিতে এদের ভূমিকাই সর্বপ্রধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। উদারপন্থী অবশ্যই স্বীকার করে যে সব মানুষ সমান নয়, কিন্তু সে স্বীকার করে না যে উন্নত লোক কারা তা নির্ধারণ করে দেয়ার অধিকার কারো আছে। রক্ষণশীল চায় প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে রক্ষা করতে, বিনিময়ে চায় কর্তৃত্ব তার পছন্দসইদের অবস্থান রক্ষা করে চলুক। উল্টোদিকে, প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতার বাহানায় এধরণের লোককে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের হাওয়া থেকে রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করে বাঁচিয়ে রাখা উচিত, উদারপন্থী এই মনোভাবের বিরোধি। যদিও সভ্যতার ইতিহাসে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উদারপন্থীর জানা আছে, তার মতে এই “অভিজাত”-দের অন্য সবার মতই স্বীয় অবস্থান রক্ষা করতে হবে নিজেদের মূল্য প্রমাণ করে।
এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হল গণতন্ত্রের প্রতি রক্ষণশীলের সাধারণ মনোভাব। আমি আগে কোথাও বলেছি যে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে আমি মনে করি পথ, গন্তব্য নয়, বা হয়ত যেসব সরকার-পদ্ধতি আমাদের জানা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর — প্রয়োজনীয় পাপ। কিন্তু রক্ষণশীলরা যখন সব সমস্যার জন্য গণতন্ত্রকে দায়ী করে, তখন তারা নিজেদের প্রতারিত করে। মূল সমস্যা হচ্ছে সীমাহীন সরকার, কারণ সীমাহীন ক্ষমতা কারোরই থাকা উচিত নয় [৮]। আধুনিক গণতন্ত্রের বিপুল শক্তি একটি ছোট অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে চলে গেলে বরং পরিস্থিতি হবে আরো অসহ্য।
এটা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর থেকেই “এখন আর সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার কি দরকার” জাতীয় ধারণাটা এসেছে। এই অর্থে গণতন্ত্র ও সীমাহীন সরকারের ধারণা পরস্পর-জড়িত। কিন্তু গণতন্ত্র নয়, সমস্যা ক্ষমতার সীমাহীনতা। অন্য যেকোন সরকার ব্যবস্থার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার মতই সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকারের ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ করা অপরিহার্য, মানুষের এটা শিখে উঠতে না পারার কোন কারণ আমি দেখিনা। যাহোক, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা পরিবর্তন ও রাজনৈতিক শিক্ষাবিস্তারের পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র অন্য সরকার পদ্ধতিগুলোর তুলনায় এতই উন্নত যে গণতন্ত্রবিরোধি রক্ষণশীলতার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। আগেই বলেছি, কে শাসন করছে তার চেয়ে মৌলিক সমস্যা হচ্ছে সরকারের কি করার অধিকার রয়েছে সেটি।
সরকারের বর্ধমান নিয়ন্ত্রণের বিরূদ্ধে রক্ষণশীলদের বিরোধিতা যে নিয়মনিষ্ঠ নয়, বরং সরকারের বিশেষ উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে গঠিত, তা প্রমাণিত হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে। রক্ষণশীলরা প্রায়শই সমষ্টিবাদী ও নিয়ন্ত্রণবাদী নীতির বিরূদ্ধে কথা বলে, এবং এ ব্যাপারে উদারপন্থীদের তারা বন্ধু হিসেবে পায়। কিন্তু এদিকে আবার রক্ষণশীলেরা সংরক্ষণবাদী এবং প্রায়ই কৃষিক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রী নীতির পক্ষপাতী। সত্যি বলতে কি, যদিও আজকে শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তা সাধারণত সমাজতান্ত্রিক মনোভাবের ফল, কৃষিক্ষেত্রে আরো অনেক আগে থেকেই একই ধরণের নিয়ন্ত্রণ রক্ষণশীলেরা আরোপ করে রেখেছে। মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতায় সমাজতন্ত্রীদের চেয়ে তারা কম যায় না [৯]।
৪।
বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে রক্ষণশীলতা ও উদারপন্থার পার্থক্য আমি আগেই আলোচনায় এনেছি, কিন্তু এ বিষয়টিতে আবার আমাকে ফিরতে হচ্ছে। কারণ রক্ষণশীলদের অবধারিত মানসিক পঙ্গুত্ব শুধু তাদেরকেই নয়, রক্ষণশীলতার সঙ্গীদেরকেও বাধাগ্রস্থ করে। রক্ষণশীলের সহজাত বিশ্বাস, সমাজে পরিবর্তনের মূলে হচ্ছে নতুন ধারণার বিকাশ। এই বিশ্বাসের বশে স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষণশীল নতুন ধারণাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, কারণ এসব আনকোরা ধারণার সাথে পাল্লা দেয়ার মত নিজস্ব বৌদ্ধিক অবস্থান তার নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে রক্ষণশীল খোঁড়া, কারণ সে তাত্বিক কথাবার্তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, এদিকে নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কোন কিছু বোঝবার মত কল্পনাশক্তিরও তার অভাব। উদারপন্থা যেখানে বুদ্ধি ও নতুন ধারণার বিপুল শক্তিতে বিশ্বাসী, রক্ষণশীল সেখানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলির খুঁটোয় বাঁধা। রক্ষণশীল যুক্তির শক্তিতে আদতেই বিশ্বাসী নয়, তার তুরুপের তাস হচ্ছে স্রেফ তালগাছীয় অবস্থান গ্রহণ করে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে বসা।
এই পার্থক্য সবচেয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞানের বিকাশের ব্যাপারে এই দুই দলের মনোভাবের ক্ষেত্রে। যদিও উদারপন্থী পরিবর্তন-মাত্রকেই প্রগতি মনে করে না, তারপরও এটা সে মানে যে জ্ঞানের বিকাশ মানবসভ্যতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জীবনের প্রভূত সমস্যার সমাধানে এই নতুন জ্ঞান কিছুটা হলেও কাজে আসবে, তাও সে আশা করে। নতুন বলেই নতুনের পূজারী নয় উদারপন্থী, কিন্তু সে জানে যে নতুনকে আহরণ ও আবিষ্কারের ক্ষমতা আমাদের সব অর্জনের প্রাণভোমরা। তাই নতুন জ্ঞানের আবাহনে তার আপত্তি নেই, সে জ্ঞানের প্রাথমিক প্রভাবগুলি তার খুব পছন্দ না হলেও।
রক্ষণশীলতার যে বৈশিষ্ট্য আমার সবচেয়ে অপছন্দ তাহল এর কুসংস্কারচ্ছন্ন পশ্চাৎমুখীতা — প্রমাণসিদ্ধ নতুন জ্ঞানও তারা বর্জন করবে যদি সেই জ্ঞানের ফলাফল গুলি তাদের নারাজ করে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাকি সবার মতই বিজ্ঞানীরাও আত্মপ্রচার বা ফ্যাশনবাজির প্রবণতা সবসময় এড়াতে পারেনা, কাজেই নতুন তত্ব-থলে থেকে জাদুকরের খরগোশের মত যাই তারা বের করে দেবে তাতেই বিশ্বাস করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু এই সতর্কতার কারণগুলি যৌক্তিক হতে হবে, এবং এসব তত্ব আমাদের কোন প্রাণপ্রিয় বিশ্বাসের আঘাত হেনে বসল, সেটা এখানে টানলে চলবেনা। উদাহরণস্বরূপ, যেসব লোক বিবর্তন তত্ব, বা জীবনের উৎপত্তির “যান্ত্রিক” তত্বগুলির বিরোধিতা করে এই তত্বগুলির নৈতিক ফলাফল বিষয়ে তাদের মস্তিষকপ্রসূত ধারণার উপর ভিত্তি করে, তাদের ব্যাপারে আমার ধৈর্য ধারণ করা মুশকিল হয়। আর যারা মনে করে কিছু কিছু ব্যাপারে প্রশ্ন করাই পাপ, তাদের কথা বাদই দিলাম। সত্যকে বর্জন করে রক্ষণশীল নিজের অবস্থানকেই দুর্বল করে মাত্র। অনেক ক্ষেত্রে নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থেকে যে আপাত-যৌক্তিক সিদ্ধান্ত টানা হয়, আসলে দেখা যায় সেসব সিদ্ধান্ত মোটেও যৌক্তিক নয়। কিন্তু নতুন আবিষ্কার আমাদের প্রচলিত বিশ্বদৃষ্টির সাথে খাপ খায় কিনা, বা খেলে কিভাবে খায়, সেটা বুঝে নেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সাথে বিজড়িত হওয়া। আর যদি এমনই দেখা যায় যে আমাদের প্রচলিত নীতিবোধ মিথ্যা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে স্রেফ সত্যকে অস্বীকার করবার মাধ্যমে পুরোনো নৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরে রাখা কতটা “নৈতিক” হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নতুন ও আপাত-অদ্ভুতের প্রতি রক্ষণশীল অবিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট তার আন্তর্জাতিকতাবাদ-বিরোধিতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে ঝোঁকবার প্রবণতা, যা বুদ্ধির লড়াইয়ে তার আরেকটা প্রধান দুর্বলতা। কারণ যে ধারণাগুলি পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে তারা কোন সীমান্ত মানে না, এটা সুস্পষ্ট, আর এই সত্যকে চাইলেই উল্টে দেয়া যায় না। কিন্তু নতুন ধারণার সাথে পরিচিত না হওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজেকে নিয়ত অপ্রস্তুত করে রাখা — যখন এই ধারণাগুলির বিরোধিতা করার প্রয়োজন পড়ে, তখন রক্ষণশীল মাকাল ফল রূপে নিজেকে আবিষ্কার করে। বৌদ্ধিক বিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া, এবং যারা এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে কেবল তারাই উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করার আশা করতে পারে। অমুক ধারণা অ-মার্কিন, বা অ-জার্মান, এটা যেমন কোন যুক্তি নয়, তেমনি কোন ভুল বা ধ্বংসাত্মক ধারণা দেশীয় মস্তক থেকে বেরোলে সেটা ভাল কিছু হয়ে যায় না।
রক্ষণশীলতা ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক নিয়ে আরো অনেক কিছু বলা চলে, কিন্তু সেটা আমি করতে চাইনা, কারণ লোকে বলতে পারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে আমার পক্ষে কোন ধরণের জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো অসম্ভব। আমি শুধু এটুকুই বলব, জাতীয়তাবাদই অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতাকে রূপান্তরিত করে সমষ্টিবাদে: “আমাদের” সম্পদ, “আমাদের” শিল্প, এধাঁচের চিন্তা থেকে “জাতীয় সম্পদ জাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হউক” এই মনোভাব দূরবর্তী নয়। তবে এ ব্যাপারে ফরাসী বিপ্লব-সম্ভূত ইউরোপীয় উদারপন্থাও খুব সুবিধার কিছু নয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এধরণের জাতীয়তাবাদ দেশপ্রেম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই জাতীয়বাদকে পরিত্যাগ করা চলে। নিজ-সমাজের কিছু ঐতিহ্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রয়েছে, এর মানে এই নয় যে নতুন ও অপরিচিতকে দূরে ঠেলে দিতে হবে।
অবিশ্বাস্য ঠেকলেও সত্যি যে রক্ষণশীলের আন্তর্জাতিকতাবাদ-বিরোধিতা আবার প্রায়ই সাম্রাজ্যবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু “অদ্ভুত”-কে দূরে ঠেলে যারা নিজেদের পথকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, তাদের মধ্যে স্বভাবতই অন্যদেরকে “সভ্যতার” আলো দেখাবার একটা প্রবণতা চলে আসবে [১০] — গায়ের জোরে তাদের মধ্যে “ভাল” সরকার পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়ে, উদারপন্থীদের মত মুক্ত ও অবাধ সংস্পর্শের মাধ্যমে নয়। এটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য যে আবারও এ বিষয়টাতে রক্ষণশীল ও সমাজতন্ত্রীরা একজোট হয়েছে উদারপন্থীদের বিরূদ্ধে। ইংল্যাণ্ডে ওয়েব দম্পতি ও সমাজতান্ত্রিক ফাবিয়ান সোসাইটি স্বঘোষিত সাম্রাজ্যবাদী। জার্মানীতে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক বিস্তার হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে, এবং দুটোই সমর্থন পেয়েছে তথাকথিত “আরামকেদারা সমাজতন্ত্রী” গোষ্ঠির কাছ থেকে। শুধু ইউরোপেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা। টেডি রুজভেল্টের সময়ই একথা বলা গিয়েছিল যে “`জিংগো`-র দল আর সমাজসংস্কারকরা এক হয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, যাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল করে একধরণের সিজারীয় সদাশয় স্বৈরাচার চালু করা। মনে হচ্ছে এই বিপদ আপাতত কেটে গেছে, কিন্তু কেবলমাত্র অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একই অবস্থানের একটি মৃদু সংস্করণ গ্রহণ করার বিনিময়ে” [১১]।
চলবে….
ফুটনোট
[৮] দেখুন মেরি গোল্ডস্টোনকে লিখিত লর্ড একটনের চিঠি (Letters of Lord Acton to Mary Gladstone, এইচ পল সম্পাদিত (লন্ডন, ১৯১৩), পৃ ৭৩): “সমস্যা এটা নয় যে কোন বিশেষ শ্রেণী শাসন কাজের অনুপযুক্ত। বরং, সব শ্রেণীই শাসন কাজের অনুপযুক্ত। স্বাধীনতার নীতি অনেক সময়ই ধর্মের ওপর ধর্মের, জাতির ওপর জাতির, শ্রেণীর ওপর শ্রেণীর রাজত্বকে উৎখাত করে থাকে”।
[৯] জে. আর. হিকস এ ব্যাপারে সঠিক ভাবেই তুলে ধরেছেন “ডিজরেইলি, মার্কস ও গোয়েবলস কর্তৃক একই ধরনের ক্যারিকেচার” অংকিত হওয়ার বিষয়টি (“The Pursuit of Economic Freedom,” What We Defend, ই. এফ. জ্যাকব সম্পাদিত [অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৪২], পৃ ৯৬)। এ ব্যাপারে রক্ষণশীলদের ভূমিকা সম্বন্ধে দেখুন আমার “Introduction to Capitalism and the Historians” (শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৫৪), পৃ ১৯ ff.
[১০] দেখুন জন স্টুয়ার্ট মিলের On Liberty, আর. বি. ম্যাককলাম সম্পাদিত (অক্সফোর্ড, ১৯৪৬), পৃ ৮৩: “আমার এমন কোন গোষ্ঠীর কথা জানা নেই যাদের অন্যদেরকে সভ্য বানানোর অধিকার আছে”।
[১১] জে. ডব্লু . বারগেস, The Reconciliation of Government with Liberty (নিউ ইয়র্ক, ১৯১৫), পৃ ৩৮০.
অনুবাদটা বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছে—এটা হয়ত এই কারণে যে আমি মূল বইটা পড়িনি।
তথাপি আপনার লেখা বেশ প্রাঞ্জল এবং চিন্তার খোরাক।
অনুবাদটা শেষ করুন।
@আবুল কাশেম,
পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ (F)
প্রথম পর্বে মূল লেখার লিংক দেয়া আছে, পড়ে নিতে পারেন। তবে অনুবাদের সমস্যার অংশগুলি ধরিয়ে দিলে ভীষণ খুশি হব, কারণ বুঝতে না পারলে আর লাভ কি হল?
@রৌরব,
আসলে, আমার বাংলায় আমার পারদর্শীতা খুব কম। চল্লিশ বছর বিদেশে থাকার ফলে বাংলা খেয়ে ফেলেছি। এখন আবার নতুন করে বাংলা শিখতে হচ্ছে। অনেক বাংলা শব্দের অর্থও ভুলে গেছি।
আপনার অনুবাদ হয়ত ঠিকই আছে—আমারই বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল এই আর কি। তবে প্রধাণ ভাব বুঝতে অসুবিধা হয় নি–শুধু খুঁটিনাটি বুঝতে একটু চিন্তা করতে হচ্ছিল
বাহ্! আবার ভালো লাগলো!
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপারটা উদারপন্থা-রক্ষণশীলতার ব্যাপারটার সাথে প্রায় উল্লম্বভাবে অবস্থান করে বলে মনে হচ্ছে। তবে একই রেখায় অবস্থান যে করে না, সেটা সহজেই বলা যায়। সেক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বাস-অবিশ্বাস বা বিজ্ঞানমনস্কতার বাইরেও এই বিশাল ডাইমেনশানটি আলোচনার দাবী রাখে। বাংলায় তেমন হয়েছে কই?
এবার পড়ার সময় রক্ষণশীল বললেই বিএনপি পড়ছিলাম। অনেককিছু মিলেছে। প্রগতিশীল শব্দটা এসেছে কম। সমাজতন্ত্রীরাও তো তত্ত্ব মতে প্রগতিশীল, তাই না?
আপনি হয়তো বিল ওরেলির নাম শুনে থাকবেন। আমেরিকার রক্ষণশীলতার মিডিয়া প্রতীক বলা চলে। ওরা মাঝে মাঝে ‘আপনি কি সাদ্দামকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে গণহত্যা চালাতে দিবেন’ বা ‘তালেবানদেরকে নারীদের উপর অত্যাচার করতে দিবেন’ এসব বলে সামাজিক উদারপন্থীদের কোণঠাসা করতে দেখা যায়। একই কাজ প্রগতিশীলরাও করে। এগুলোর উদারপন্থী উত্তর কি? এক ব্রাজিলিয়ান প্রগতিশীল আমাকে বলেছিল যে উত্তর কোরীয় মানুষদেরকে নিপীড়িত হবার হাত থেকে বাঁচানোর আমার নাকি বাধ্যবাধকতা আছে। সে বলেছিল, আমি যে এ ব্যাপারে কিছুই করছি না, এটা নাকি একটা অসৎ কর্ম। আমি বলেছিলাম, কর্মহীনতাকে যদি ‘কর্ম’ হিসেবে দেখে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায়, তাহলে মৃত্যু ছাড়া মানুষের মুক্তি নাই।
বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন খুব কঠিন প্রশ্ন।
@রূপম (ধ্রুব),
একমত।
নিশ্চয়ই, এজন্যেই লেখাটি লিখতে বসা। বাংলায় উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তেমন কিছু লেখা হয়নি, তবে বামপন্থীরা অনেক কিছু লিখেছেন।
😀
ওই শব্দটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। লিংকে আপনার পরের প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবেন।
সে আর বলতে
httpv://www.youtube.com/watch?v=UyHzhtARf8M
একমত। “বাধ্যবাধকতা” ধর্মযুদ্ধের ধারণার মত শোনায়, বিশেষত এত ব্যাপক ক্ষেত্রে।
এ ব্যাপারে কোন সাধারণ উদারপন্থী মনোভাব আছে কি না কে জানে। এই ব্যাপারটা যেহেতু অর্থনৈতিক নয়, এখানে সামাজিক ও ধ্রুপদী উদারপন্থীদের মধ্যে খুব পার্থক্য থাকার কারণ আছে কিনা নিশ্চিত নই। তালেবানের কথাই যদি ধরেন, এদের বিরূদ্ধে ওই নারী ইস্যুতেই প্রথম আন্দোলন করে কিন্তু নারীবাদীরা। কিন্তু “তালেবানদের শায়েস্তা করার চেষ্টা কর” মানেই কি “আফগানিস্তান আক্রমণ কর”?
আসলে উদারপন্থী যেহেতু আন্তর্জাতিকতাবাদী, সে অন্য দেশের মানুষের ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারেনা। কিন্তু উদাসীন না থাকা মানে কি interventionist হওয়া? সেরকম উদাহরণও আছে। এই টপিকটা ভীষণ বড়, এবং লেখবার সময় এটা নিয়ে অনেক চিন্তা করছিলাম, কিন্তু মন্তব্যটা আর বাড়াতে চাইনা। বিভিন্ন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে হয়ত আরো কথা চলে আসবে।