১৩৭৭ সালে তিউনিসিয়ান মুসলিম দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্ত্বা ইবনে খালদুন তার প্রখ্যাত গ্রন্থ “মুকাদ্দিমাহ” রচনা শুরু করেন। মুকাদ্দিমাহকে সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাসের দর্শন আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর লেখা প্রথম গ্রন্থ হিসাবে স্বিকৃতী দেন অনেকেই। ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমাহ’তে উত্থাপন করে বসেন এক বৈপ্লবিক বক্তব্য। তিনি বলেন, রাজা রাজড়ার কির্তী কলাপ বর্ণনা করাই নাকি ইতিহাসের মূল লক্ষ্য না, বরং মানবসভ্যতার বিকাশ আর পরিবর্তনের সঠিক চিত্র তুলে ধরাই ইতিহাস চর্চার আসল কাজ। খালদুনের সময়ে নতুন এবং বৈপ্লবিক এই বক্তব্য এখন এই আমাদের সময়ের স্বিকৃত সত্য। অবশ্য যেই দেশে পাঁচ বছর পর পর ঘটা করে ইতিহাস বদলের প্রতিযোগিতা হয় সেই দেশে এই সত্য অনুধাবন করা দূরুহ বটে। ইতিহাস চর্চা আমাদের দেশে পার্টি রাজনীতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, যার কাজ মানুষকে কেটে কুটে বিচ্ছিন্ন করা। কাল নিরপেক্ষ মানব জাতি দূরে থাক, এই কাটাছেড়ায় সমকালিন মানুষ হওয়াই বেজায় কঠিন।

মুসলিম দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের কর্ম না তবে নাম নিয়ে রাজনীতি করতে দেখা যায় আমাদের দেশের বিশেষ কিছু রাজনৈতিক মতাদর্শী শ্রেণীকে। নিজেদেরকে এরা বাঙলাদেশের মুসলিম জনগোষ্টির প্রতিনিধী এবং ইসলামের প্যাটেন্টধারী বলে দাবি করতে পছন্দ করে। মুসলিম গরিমা প্রকাশ এবং সেই সাথে মুসলিমরা যে জ্ঞান বিজ্ঞান বিবর্জিত কোন গোষ্ঠী না সেই বক্তব্যের প্রমান দিতেই মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম এবং তাদের বিশেষ কিছু অবদান জনসম্মক্ষে আনার প্রয়াস পায় এরা। তবে সেই সাথে সযত্নে এড়িয়ে যায় এইসব মহামানবের দর্শন চিন্তা, রক্ষনশীল ধর্মাবলম্বিদের সাথে বিরোধ এবং ফলস্বরূপ নির্যাতন, নিপিড়ন আর বঞ্চনার ইতিহাস। এরা এমন দাবিও করে যে যতদিন পর্যন্ত মুসলিম দার্শনিকরা কোরআন হাদিস এবং মৌল ধর্ম বিশ্বাস আকড়ে ধরে রেখেছে ততদিন পর্যন্ত তারা জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে, অনেকে বা আগে বেড়ে এমন দাবিও করে বসেন যে কোরআন হাদিস অধ্যায়ন করেই মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় এহেন উন্নতি সাধন করেছেন। এসব বক্তব্যে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হয় বটে, সমকালীন দুনিয়ায় বাস্তবিকই জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় তলানীতে পৌছে যাওয়া এবং আত্মপরিচয় সংকটে ভোগা বাঙালি মুসলিম জনগোষ্টির কাছে এহেন বক্তব্য রোমান্টিক আবেদনও তৈরি করতেও সক্ষম, তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এসব বক্তব্যে সত্যের লেশ মাত্র নাই এবং এই জাতীয় ইতিহাস জ্ঞান নিয়া অনুধাবন করা সম্ভব না মানব সভ্যতার বিকাশ আর পরিবর্তনের সঠিক চিত্র, সেইসাথে সম্ভব না সমকালীন বিচ্ছিন্ন মানুষ থেকে মানব জাতিতে উত্তরণ। তবে উত্তরণ না হলেও এতে অবতরণ হয় বটে। কাল নিরপেক্ষ মানব জাতির অংশ হয়ে ওঠা তো হয়ই না, হওয়া হয় না সমকালীন মানুষও, অচলায়তনে আটকে গিয়ে ১৪০০ বছর আগের একজন মানুষ হতে হয়। আরব ভুখন্ডের মুক্তচিন্তকদের নিয়ে এই মিথ্যাচার এবং রাজনৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রোপাগান্ডার জবাব দেয়ার সাথে সাথে এই অচলায়তন কিছুটা হলেও ভাঙার চেষ্টা করেছি “মুসলিম জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই” নামক বইটিতে।

মুসলিম দুনিয়ার প্রারম্ভিক কাল থেকেই নানান ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উদ্ভব এবং সেই সাথে শুরু উদারপন্থি ও যুক্তিবাদীদের সাথে কট্টরপন্থি ও রক্ষনশীলদের ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধ। এই বিরোধে উদারপন্থার জয় আর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের হাত ধরে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে শুরু ইসলামী স্বর্ণ যুগের। আবার রাজনৈতিক ও ধর্মতা্ত্ত্বিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই তার সমাপ্তি। এইসব ইতিহাস উপস্থাপনের ফাক-ফোকরে চেষ্টা করেছি মুসলিম দুনিয়ার নির্ভীক ও সংগ্রামী মুক্তচিন্তকদের লড়াইয়ের কাহিনী বয়ান করতে।

“মুসলিম জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই” বইটি প্রকাশিত হয়েছে শুদ্ধস্বর থেকে। বইটি বইমেলায় এসেছে গত ১১ফেব্রুয়ারী। আজ ১৮ফেব্রুয়ারী বিকাল ৪টায় বই মেলায় নজরুল মঞ্চে বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে আহবান জানাচ্ছি।