এক
“দশচক্রে ভগবান ভূত”। বাবার কোন একটি বইয়ে উপদেশ মূলক একটি গল্প। সবে বানান করে পড়তে শুরু করেছি। তাই কিছুই বুঝিনি। গল্পটিরও কিছুই মনে নেই। বিগত পঞ্চান্ন বছরে একবারও “দশচক্রে ভগবান ভূত” শব্দ তিনটির কথা মনে আসেনি। কিন্তু কঠিন শব্দ তিনটি মস্তিস্কের কোথাও লুকিয়ে ছিল এতদিন। আজকে মহামানব ডারউনকে স্মরণ করতে গিয়ে যথাসময়ে শব্দত্রয় বেড়িয়ে এল। এবং ক্ষণিকের মধ্যে এর বিশাল অর্থও পরিষ্কার হয়ে গেল।

সবাই বিশ্বাস করলে ভগবান অবশ্যই ভূত। এটাই সত্য। আল্লাহ্‌ও তাই, গডও তাই। বিশ্বাস করলে এরা কী না? এরা সবাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আবার চরমতম শাস্তিদাতাও। বিশ্বাসেই এদের অস্তিত্ব, বিশ্বাসেই এদের সত্যতা, বিশ্বাসেই এদের মৃত্যু। মাত্র হাজার দুই বছর আগে পৃথিবী ছিল সমতল। মানুষ জানত পৃথিবী মানেই ভারত, ভারত মানেই পৃথিবী। মধ্য প্রাচ্যও তাই জানত। তখন সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরত। তখন এটাই ছিল বিশ্বাস, এটাই ছিল ধ্রুব সত্য। সেই সৃষ্টিকর্তার একদিন খেয়াল হল। একটা কিছু বানাবেন। তিনি মাটি দিয়ে মানুষ বানালেন। তখন মানুষগুলো হাজার বছর বাঁচত। বিশ্বাসীরা ভাবত পৃথিবীর বয়স দশ হাজার বছরেরও কম। খুঁতখুঁতে স্বভাবের বিজ্ঞানীদের সন্দেহ হল। দেখালেন পৃথিবীর বয়স এত কম না। তারা প্রমাণ করলেন পৃথিবী সমতল নয়। গোলাকার। হাজার বছরের সত্য অসত্যে পরিনত হল। ভূতে বিশ্বাসীরা পৃথিবী প্রদক্ষিন করেও দেখল আসলেই পৃথিবীটা সমতল নয়। কিন্তু ভূতে বিশ্বাস গেল না। তথাকথিত অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এই দলে আছেন। তাদের কাছে এখনও পৃথিবীর বয়স দশ হাজারেরও কম।

দুই
দীর্ঘ দিনের গুষ্টিবদ্ধ বিশ্বাস একটি ভুল তথ্যকে সত্য হিসেবে জিইয়ে রাখে। হাজার বছরের বিশ্বাস কোন এক কাল্পনিক ব্যক্তির ইচ্ছাতেই মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অকাতরে দান করেন। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি সবাইকে তার কথামত চালানোর ক্ষমতা রাখেন না। তাই তিনি নিষ্ঠুরতম শাস্তি্র ভয় দেখান।

মনুষ্য জীব বড়ই অসহায়। কোন না কোন রকম আশ্রয় দরকার। প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়া দরকার। যখন তুষারপাত হয়, পর্বতবাসীরা অসহায় হয়। রূষ্ট পর্বত প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে শাস্তি দেয়। তাই তারা পর্বতের কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে। ক্যাংগারু শিশু ভয় পেয়ে মা ক্যাঙ্গারূর তলপেটের থলের মধ্যে আশ্রয় নেয়। উদ্বেগহীন প্রগাঢ় শান্তি। চার বছরের ছেলেকে রেখে আমি একা আমেরিকায় চলে আসি। ওর কাছে তখন কোন ভগবানের খবর ছিল না। আমিই ছিলাম ওর ভগবান। পৃথিবীতে সব চাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সে বুঝত না আমি কেন একটা প্লেন পাঠায়ে দিই না তাদেরকে আমেরিকাতে নিয়ে আসার জন্য। এখন সে বড় হয়েছে। আমি ছোট হয়েছি। তার ভুল ভেঙ্গেছে। এখন সে নিজেই একশ। এই একশ একদিন শূন্যে এসে দাঁড়াবে। মৃত্যু যখন হাতছানি দিবে আমার এই ছেলেই আবার অসহায় হবে। কোন মনুষ্যই তার আশ্রয় হবে না। অস্তিত্বহীন ভগবানকেই মনে হবে তার একমাত্র আশ্রয়, সত্য, বিশ্বাস, ধর্ম।

তিন
আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কেন এলাম, কোথায় যাব? অনাদিকালের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন মনুষ্যকে দুর্বল করে। তাই দরকার আশ্রয়। যখন পৃথিবীর কারো উপর ভরশা পায় না, মনুষ্য তখন অস্তিত্বহীনের কাছে নিজেকে সপে দিয়ে নিরাপদ অনুভব করে। এক বিলিয়ন মুসলমান বিশ্বাস করে – আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা। অন্য আর এক বিলিয়ন খ্রিশ্চীয়ান বিশ্বাস করছে আল্লাহ নন, গডই আসল সৃষ্টিকর্তা। আরও এক বিলিয়ন আছে, তারা জানে আল্লাহও নন, গডও নন। ভগবানই হল আসল সৃষ্টিকর্তা। মুশকিল-আশান তারই হাতে। তার ইচ্ছাতেই একদিন হঠাত করে এই ধরাধামে মূর্তিমান মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল।


The Wall Chart of World History, Third Millennium Press Limited পুস্তক থেকে আংশিক ছবি।

তথাকথিত সৃষ্টিকর্তা কল্পিত দুই উলংগ মানব-মানবীকে যীশুখ্রীষ্টের জন্মের মাত্র ৪০০৪ বছর আগে ধরাধামে ছেড়ে দেন। এরা এবং এদের বংশধরগন হাজার বছর পর্য্যন্ত জীবিত থাকতেন। কী করতেন তারা? কোন বর্ণনা নেই। কিন্তু দু-তিন হাজার বছর যাবৎ অসহায় মানব সপ্রদায় এই কাহিনীকেই বিশ্বাস করে এসেছে। এখনও করছে।

চার
পৃথিবীটা অত ছোট নয়। মাত্র দশ হাজার বছরের শিশু নয়। চ্যাটানুগা (Chattanooga) অথবা অন্য যে কোন caverns এ গেলে ব্যাপারটা অনুধাবন না করার উপায় নেই। পৃথিবীর বয়স প্রায় 4.45 বিলিয়ন বছর। ১৯৫৮ সালে On the Origin of Species গ্রন্থে চার্লস ডারইন সৃষ্টির বৈপ্লবিক সত্যতা প্রকাশ করলেন। মানুষ উড়ে এসে জুড়ে বসেনি এই পৃথিবীতে। হাজার কোটি বছরের বিবর্তনের ফল আজকের জীব জগৎ। আজকে বিজ্ঞানমনষ্ক কোন ব্যক্তির বিবর্তনবাদে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ডারউইনের এই তত্ত্ব প্রকাশের প্রায় দেড়শ বছর পরে এই সেদিন স্টিফেন হকিং “Origin of the Universe” নিয়ে বললেন, হ্যা, মহাজগৎ সৃষ্টিতে কোন ঈশ্বর নামক বস্তুর দরকার নেই।

এই পৃথিবীতে যেমন জীবনের সৃষ্টি হয়েছে মহাজগতের হাজার হাজার গ্রহেও জীবের উতপত্তি হওয়া বিচিত্র নয়। অন্য গ্রহে ভিন্ন পরিবেশে তথাকার পরিবেশ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের প্রাণী উদ্ভব হবে। তেলা পোকা আর মানুষ একই পৃথিবীতে উদ্ভব হয়েও কত ভিন্ন। সূর্যের প্রচন্ড তাপীয় পরিবেশেও যদি কোন প্রানের উদ্ভব হয় আমি বিস্মিত হব না।

পাঁচ
লেখাপড়া জানা মানুষ মাত্র দশ হাজার বছরের পৃথিবীর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত সৃষ্টিবাদে এখনও বিশ্বাস করে। খেয়াল করে ব্যাপারটা ভাবলে কেমন বিশ্রী লাগে। সৃষ্টিবাদীরা তাদের অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে সুখ-নিদ্রায় আছে। এই নিদ্রা থেকে তারা জেগে উঠতে চায় না। এদের জাগানো দরকার। মুক্তমনা আর্কাইভে বিবর্তনবাদের উপর প্রচুর তত্ত্ব ও তথ্য জমা হয়েছে। এগুলো জনমানুষের কাছে পৌছানো দরকার। ছোটদের জন্মদিনের উপহার দেওয়ার মত পুস্তিকা প্রণয়ন হতে পারে। দেশে খুঁদে বিজ্ঞানী ক্লাব গড়তে সাহায্য করা যেতে পারে। মুক্তমনা সেখানে তাত্ত্বিক এবং তথ্যগত সহায়তা করতে পারে অনায়াসে। মুক্তমনার সদস্যরা নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টে মুক্তমনা লিঙ্ক বসাতে পারেন। ছোটরা আপনা বড়দের ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালবাসে। ওখান থেকেই আগামী প্রজন্ম বিবর্তনবাদের হাতে খড়ি পেতে পারে। অনায়াসে তৈরী হতে পারে যুক্তিবাদী আর বিবর্তন বাদে বিশ্বাসী ভবিষ্যত বংশধর। পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সৃষ্টিবাদের কল্পনার জাল।

মুক্তমনা ভান্ডার তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ। বিবর্তনবাদী আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও সমৃদ্ধ করতে পারে। মুক্তমনার সে সময় এসে গেছে মনে হয়।

১০ ফেব্রুয়ারী ২০১১
টেক্সাস