প্রেমপত্র
মূল গল্প : ফনিক্স জিং
অনুবাদ : মোজাফফর হোসেন
[ফনিক্স জিং তাইওয়ানের বর্তমান সময়ের বেশ আলোচিত সাহিত্যিকদের একজন। লেখিকা তাইপে ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন। তিনি মূলত ছোটগল্প লিখে থাকেন, সমালোচনা সাহিত্যেও তাঁর বেশ দখল আছে। প্রেমপত্র গল্পটি তাঁর Bookworm as Me (Taipei, 2010) গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া।]
শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে লন্ড্রি করার সময় আমি আমার স্বামীর পকেট থেকে একটি প্রেমপত্র আবিষ্কার করলাম। পত্রটি দেখে প্রচণ্ড ব্যথিত হলাম।
পত্রটি পড়ে আমি আমার আসন্ন ভবিষ্যতের কোন কুল-কিনারা খুঁজে পেলাম না। পত্রের ভাষা ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ ও আবেগ-ঘন, যা পড়ে অতি সহজেই অনুমান করা যায় তাদের সম্পর্কের প্রৌঢ়ত্তের কথা। পত্রের কারুকার্যময় ভাষা ও ইঙ্গিত পড়ে মনে হল, লেখিকা আমার স্বামীর স্ত্রী হওয়ার জন্য আমার থেকে ঢের বেশি যোগ্যতা রাখে।
আমার আর কাজে মন বসলো না। মনে মনে পত্রটির পিছনে পড়ে রইলাম আর বাড়ির এদিকওদিক উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরাঘুরি শুরু করলাম। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো সিনেমার পর্দার মত চোখের সামনে ভেসে উঠল,¬- আমাদের বিয়ের আট বছর, আমাদের পাঁচ বছর বয়সী পুত্র, এবং আমার বাবার কাছে আমার স্বামীর কন্যা ভিক্ষা চাওয়ার সেই নাটকীয় দৃশ্যটি তো বটেই।
আমাদের বিবাহের পরবর্তী সময়ে যে যে সমস্যাগুলোর আমরা মুখোমুখি হয়েছি তার ক্রম অনুযায়ী ময়না তদন্ত শুরু করলাম। তবে তা থেকে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বের হল না। খুব সম্ভবত কারণটি হল, আমি বাইরের জগত সম্পর্কে খুব কমই অবগত।
পত্রের শেষে মহিলাটি লিখেছে, ‘আমি আমার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, বরং ভাগ্যই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে।’ সে আসলে কি বলতে চাচ্ছে? বেশ রাগান্বিত দশাই পত্রটি যথাস্থানে রেখে দিলাম। এখন আবার অন্য একটি সমস্যার জন্ম হলো- আজ রাতে কোন মুডে আমি আমার স্বামীর মুখোমুখি হবো? আমি কি তাকে জেরাই জর্জরিত করবো যার সমাপ্তি ঘটবে একটি নিশ্চিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে? নাকি না জানার ভান করে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করে গোপনে এর শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করে যাবো? এবং আমি যদি এই সমস্যার কেন্দ্রে অবতরণ করতে সক্ষম হই, তাহলেই বা আমি কি করবো?- সঙ্গে সঙ্গে ছাড়াছাড়ি? আর আমাদের সন্তান…?
অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুই ঘটেনি এমন একখান ভাব জাহির করার। তবে গোপনে আমি আমার স্বামীর চিঠির বক্সে চিরুনি অভিযান চালালাম। শেষের এই কাজটি বেশ সুফল বয়ে আনলো। সর্বশেষ প্রেমপত্রটির মাধ্যমে জানাতে পারলাম, একমাসের মধ্যে মিস ফং এর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, ফলত সে আমার স্বামীর সাথে সম্পর্কের এখানেই ইতি টানছে। যখন আমি নোটটি পড়া শেষ করলাম তখন আমার উচিৎ ছিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য বিজয়-উল্লাস করা, অথচ উল্টো আমার ভেতরটা রাগে ফেঁপে উঠল, যেটা ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েই ছাড়লো। ঐদিন আমার স্বামী অফিস থেকে ফেরা মাত্রই, হালকা নীল রঙের প্রেম পত্রের বান্ডিলটা ছুড়ে ফেলে বললাম, ‘এসব কি? ব্যাখ্যা কর।’
মিশ্র এক অনুভূতি তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। শুরুর দিকে সে ভয়ে একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর নিজেকে সামলে বললো, ‘বলো। দেখো, তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভেতর তেমন কিছুই হয়নি। তোমার বিশ্বাস না হলে আমি তোমাকে বিয়ের দাওয়াত-কার্ড দিতে পারি।’ আশ্চর্য! মানুষটা সামান্য একটা কথা দিয়ে সব ঠাণ্ডা করে দিলো। যাইহোক, অনেকদিন থেকেই আমার ভেতরে একটা ক্ষত বেড়ে উঠছিল। চিঠির ঐ ভাষা এবং ভালোবাসার আকুতি সহজে ভুলবার নয়। তাদের কাছে আমার যেন কোন অস্তিত্বই নেয়।
আমি বিষয়টি নিয়ে যত ভাবতে থাকলাম, আমার মাথা যেন তত বেশি বিগড়ে গেল। আমি বললাম, ‘আমার ওসব বিয়ের দাওয়াত পত্র-টত্র দরকার নেয়। যদি তুমি সত্যিই ঐ মহিলার সাথে ছাড়াছাড়ি করতে চাও, তাহলে যাও তার এ যাবত দেওয়া সমস্ত পত্র পুড়িয়ে ফেলো।’ আমার কথাটি শোনার পরও সে ঠাঁয় বসে রইল।
‘তুমি এখনো সময় নিচ্ছ? এখন এটা খুবই পরিষ্কার যে তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ এতদিন।’ আমি মর্মাহত হয়ে বললাম।
‘ঠিক আছে, তুমি যা বলো!’ সে মেনে নেওয়ার সুরে বলল।
খুব সম্ভবত, আমার স্বামী ভেবে থাকবে, সে যেহেতু ইতোমধ্যে তার প্রেমিকাকে হারিয়েছে, এখন আবার বউকে হারানোটা হবে বড় রকমের মুর্খামি। সে পড়ার ঘরের দিকে উঠে গেল এবং জলদিই একটি চিঠি ভর্তি ব্যাগ হাতে ফিরে আসলো।
‘সব এখানেই আছে। আমি তোমার সামনেই সব পুড়িয়ে ফেলছি।’ আমি চিঠিভর্তী একটি নাদুস-নুদুস ব্যাগ দেখে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। ব্যাগের মুখ খোলা মাত্রই ডুবন্ত বরফের ক্ষুদ্র একটি অংশের মত কিছু পত্র উঁকি দিয়ে উঠল। আমার কখনো কল্পনাতেই আসেনি তাদের ভালোবাসার ঘনত্ব এতো বেশি হতে পারে। বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিলো- আমার স্বামীর মত অগোছালো একটা মানুষ এতটা যত্ন করে চিঠিগুলো সামলে রেখেছে। অধিকাংশ সময় তার প্যান্ট, মোজা, পেপার এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো থাকে। এরপরও সে চিঠিগুলো এতো যত্ন করে সামলে রেখেছে- এটা থেকেই অনুমান করা যায় তাদের ভালোবাসার গভীরতা। সে তার দিবা-স্বপ্ন থেকে বের হওয়ার আগেই আমি চিঠির ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে বললাম, ‘এগুলো এখন পোড়ানো মানেই আবর্জনা বাড়ানো। আমি দেখছি কি করা যায়।’ আমি তখনো জানি না এগুলো রেখে দিয়ে আসলে আমি কি করতে যাচ্ছি। হতে পারে এটা একটা কিউরিসিটি মাত্র, কিংবা হিংসা।
স্বামীর গোপনসব জানার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে। যখন বাড়িতে কেউ ছিল না, আমি জানালা দরজা বন্ধ করে, অনেকটা ছিচকে চোরের মত চুপিসারে আমার স্বামীর সমস্ত চিঠি একটার পর একটা পড়লাম। চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন চাবুকের মত আমার শিরাই-উপশিরাই প্রহার করে চলে। মিস ফংকে মনে হল চিত্রকলার ওপর কলেজ-পড়ুয়া ছাত্রী। প্রতিটি চিঠিতে রঙের ব্যবহার সত্যিই মুগ্ধ করার মতন। পত্রে সে উল্লেখ করেছে, ‘আমি তোমাকে ছাড়া এক মিনিট তো দূরের কথা এক সেকেন্ডও ভাবতে পারিনা।’ এতো অসহ্য মেয়েটা,- কি করে পারলো আমার সাথে এমনটি করতে? রাগ আমার মাথায় চড়ে গেল। আমি পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করলাম। আমার স্বামীর ড্রয়ার থেকে বিয়ের কার্ডটি বের করলাম। পরের দিন ছিল বিবাহের ধার্য তারিখ। আমি চিঠিগুলো সুন্দর করে প্যাকেটজাত করলাম। ঠিকানার নিচে লিখলাম- শুভ বিবাহ উপলক্ষে মিস ফংকে আমার তরফ থেকে তার উপযুক্ত উপহার। মিস ফং, যেহেতু তুমি আমাকে শান্তিময় দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে দাও নি, আমি তোমাকে একাকী একটি সুন্দর দাম্পত্য জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে দিতে পারি না। তুমি অন্যের সুখের সংসারে আগুন লাগানোর সাহস দেখিয়েছ, সেই সাহস যদি আমিও কিঞ্চিৎ দেখাই, তুমি নিশ্চয় আমাকে দোষ দিতে পারবে না। চিঠি পোস্ট হয়ে যাওয়া মাত্রই আমার মনে হল, আমি একটু বেশিই আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। আর ভাববার অবকাশ নেয়। কপালে যা লেখা আছে এখন তাই হবে।
কিছুদিন পর, আমি চিঠির বক্সে বেশ পরিচিত রঙের একটি খাম পেলাম। চিঠি খুলে দেখলাম সেই পরিচিত সুন্দর হাতের লেখা, যদিও বেশ তড়িঘড়ি করে অযত্নে লেখা তবুও বুঝতে কোন সমস্যাই হল না।
মিসেস চ্যান্,
তুমি খুবই বোকা প্রকৃতির, যদিও সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শেষপর্যন্ত তোমার প্লান কাজে লেগেছে। আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, বেশ বর্ধিত কষ্টে বিয়েটা ঠিক করা হয়েছিল। তুমি কি একবারও ভেবে দেখলে না, আমি অন্যত্র বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যাতে করে তোমার স্বামী যেন তোমারই স্বামী থাকে? কোথায় তুমি কৃতজ্ঞতা জানাবে তা না উল্টো তোমার সাধ্যের সর্বচ্চ দিয়ে আক্রমণ করলে। আমার বিয়ের দশা তুমি যেমনটি প্রত্যাশা করেছিলে তেমনটিই হয়েছে- সব ভেস্তে গেছে। এখন আমার একাকীত্ব জীবন আবার তোমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে- তোমার বিবাহিত জীবন এখন ধ্বংসের কিনারে এসে উপস্থিত।
এখানেই চিঠিটির সমাপ্ত ঘটলো। এই সময় তার পূর্বে লেখা একটি কথার কথা মনে পড়ে গেল- ‘আমি আমার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, বরং ভাগ্যই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে।’
জটিল! তবে সেটা গল্প, অনুবাদ নাকি ঐ প্রেম-ভালোবাসা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস- সেটা বলা মুশকিল। আসলে সবই জটিল! 🙂
@শ্রাবণ আকাশ, হা হা। ধন্যবাদ দাদা।
সুন্দর ঝরঝরে অনুবাদ, ভাল লাগল পড়তে!
অনুবাদটি কি ইংরেজী থেকে?
@লাইজু নাহার, হুম আপু, ইংরেজী থেকে। আমি বাংলার বাইরে ইংরেজীটাই একটু একটু জানি। আপনার ভালোলাগলো জেনে উৎসাহিত হলাম। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
অদ্ভুত লাগল গল্পটা।হাস্যকরও।
আপনার লেখায় একটা ব্যাপার দেখলাম, নেই কে সব জায়গায় লিখেছেন নেয়!
শিরায়-উপশিরায় লিখাছেন শিরাই-উপশিরাই
গল্পে বানান ভুল কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগে তাই বললাম।কিছু মনে করবেননা। 🙂
এখানে অফ টপিক একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি “মলাট” নামের কোন লিটল ম্যাগের সাথে যুক্ত? ওখানে আপনার নামের একজন লেখকের নাম দেখেছি, তাই কৌতুহল হল।
@লীনা রহমান, মলাটের সাথে আমি ঠিক যুক্ত না। ঐ নাটকটা পাঠিয়েছিলাম, ছেপেছে..। আর বানানগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। আমার বানানে অনেক সমস্যা তাই একটু দেখিয়ে দিলে বেশ উপকৃত হয়। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
@মোজাফফর হোসেন,
অনূবাদের হাত সব সময় তোমার ভালো।এই লেখাটাও তার ব্যাতিক্রম নয়। খুব সুন্দর হয়েছে।
@আফরোজা আলম, ভালো লাগলো জেনে। ধন্যবাদ।
সুন্দর কাহিনী কিছুটা বেদনাময় আবার কিছুটা হাস্যকরও বটে।
@সুমিত দেবনাথ, বটেই। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
@মোজাফফর হোসেন,
প্রেম,ভালোবাসার রূপ,রস,গন্ধ,অনুভূতির মনে হয় কোন দেশ কালের সীমানা ও ঠিকানা নেই,সব জায়গাতেই একই রকম।ভালোবাসলে যেমন জ্বালা আবার না বাসলেও তদ্রূপ জ্বালা।
গল্পটি পড়ে ভালোই লাগল, সাথে সাথে আমার এক তাইওয়ানী বন্ধু “পাওছির” কথা মনে পড়ে গেল যে কি-না গত ২৫ বছর ইতালীতে বসবাস করে।যদিও প্রতিবছর সে ২-৩ বার তার দেশে যাতায়ত করে।তার সাথে বিষয়টি শেয়ার করার চিন্তা করছি কেমন জানে তার দেশের ঐ লেখিকাকে।
@মাহবুব সাঈদ মামুন, বলবেন নিশ্চয়। চেনবার কথা। আর গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।