বেড়ার ফাক দিয়ে রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সরফুদ্দিনের। আমেনা এইমাত্র উঠে গেল মুখ হাত ধুতে। কলের হিম শীতল পানিতে হাত মুখ ধুয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে সরফুদ্দিন দেখল আমেনা ভাত বাড়ছে, সাথে কাল রাতের বাসি তরকারি। বয়সের সাথে সাথে রক্তের তেজ কমে যাবার কারণেই হয়ত শীতের দিনে হাত পা বেশি কাঁটা দেয় বৃদ্ধ সরফুদ্দিন আর আমেনার, তার মাঝে এই ঠান্ডা ভাত তরকারী খাওয়া। তবু দিনের এই সময়টাকেই বেশি ভালবাসে বুড়ো-বুড়ি। কারণ এরপরই আমেনা বেরিয়ে পড়ে সাহেবদের বাড়ির উদ্দেশ্যে আর সরফুদ্দিন রিকশা নিয়ে। এই সময়টাতে বুড়োবুড়ি আলাপ করে অনেক। বুড়ো জেনে নেয় আজ বাজার কি হবে, আমেনা কটা নাগাদ ফিরবে কাজ শেষে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সময়টা সরফুদ্দিনের ভাল লাগার আরেকটা কারণ হল রাত জেগে ছেলে-মেয়েদের কথা মনে করে কান্নাকাটি করার পর আমেনার কষ্টটা সেদিনের মত ধুয়ে যায় বলেই হয়তো এসময় আমেনা বেশ প্রসন্ন থাকে, সরফুদ্দিনের বড় ভাল লাগে। খেয়ে দেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ে দুজনের ছোট্ট নীড়টি ছেড়ে।
গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সরফুদ্দিন। তার বয়সের আর কেউ রিকশা নেয়না এই গ্যারেজ থেকে, বয়সের কারণে এত পরিশ্রম সয়না অনেকেরই, তাছাড়া বয়স বেশি হলে আয়ও কমে যায় বলে মহাজন রিকশাও দিতে চায়না। মহাজন জালাল মিয়া সরফুদ্দিনকে সমীহ করে খুব। এজন্যই তার কাছ থেকে কিনে নেবার পরেও গ্যারেজের নাম বদলায়নি জালাল মিয়া। পাঁচ বছর আগে সরফুদ্দিন গ্যারেজ বিক্রি করেছিল ছেলে আজিমকে বিদেশে পাঠানো আর মেয়ে আরিফার বিয়ে দেবার জন্য। জালাল সরফুদ্দিনকে বলে, “পঙ্খিরাজখান আজীবন আপনেরই থাকব চাচামিয়া। পঙ্খিরাজ আপনের হাতে ছাড়া আর কারো হাতে দেখবার মন চায়না, জমা যা দেন তাতেই চলব, পোলা মনে কইরা খালি দোয়া করবেন আমারে।”
রিকশা নিয়ে মোড়ে দাড়াল সরফুদ্দিন। মোটা করে এক লোক এক গাদি গাট্টি বোচকা নিয়ে ডাকল, “এই রিকশা!” সরফুদ্দিনসহ আরো একজন এগিয়ে গেল। লোকটি সরফুদ্দিনের পাশ কাটাতে গিয়ে “তুমি বুড়া মানুষ, পারবানা টানতে” বলে উঠে গেল দূরে থাকা রিকশায়। সরফুদ্দিন বসে থাকল। এক তরুণী বের হয়ে আর কোন রিকশা না দেখে উঠে বসল সরফুদ্দিনের পঙ্খিরাজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। মেয়েটা রিকশায় বসে সরফুদ্দিনকে বলল, “এত বয়সেও রিকশা চালান কেন? আপনার কষ্ট হয়না?”
সরফুদ্দিনঃ “কষ্ট হবে কেন? হাত পা থাকতে বইসা থাকাডাই বেশি কষ্টের।”
তরুণীঃ “আপনার ছেলে-মেয়ে নেই?”
সরফুদ্দিনঃ “না।” বলে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ভাবল, আজিমের এতদিনে নিশ্চয় ছেলে-মেয়ে হয়েছে, কে জানে? পাশের বাড়ির করিম আলীর ছেলে তাজুল বোধহয় জানবে। আজিম আর তাজুল একই সাথে কাজ করে ইতালিতে। করিম আলীকে লেখা তাজুলের চিঠিতেই তিন বছর আগে খবর পেয়েছিল, আজিম বিয়ে করেছে। আরিফা গত বছর মারা গেছে। কি করে তার কাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল তা তার শ্বশুর বাড়ির কেউ বলতে পারেনা। বেচারি তো মরে বাঁচল, কিন্তু তার স্বামীর মোটর সাইকেলের আশা অপূর্ণই থেকে গেল।
এই সময় হঠাৎ মেয়েটি দেখতে পেল সরফুদ্দিনের ডান হাতের কব্জিটা নেই। এতক্ষন চাদরে ঢাকা ছিল বলে দেখতে পায়নি।
মেয়েটি কেমন ভীতু গলায় বললঃ “হাত ছাড়া রিকশা চালাতে সমস্যা হয়না? যদি এক্সিডেন্ট করেন?”
সরফুদ্দিনঃ”না, এক হাতেই ত সামলানো যায় রিকশা। আপনি তাকায়া দেখেন অন্য রিকশার দিকে।”
তবুও কেন যেন মেয়েটি নিশ্চিন্ত হতে পারলনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েটিকে নামিয়ে দিয়ে আরেক ছেলেকে চট করে নামিয়ে দিয়ে এল নীলক্ষেত। সেখান থেকে আবার বিশ্ববদ্যালয়ে নিয়ে এল দুইজনকে। এরপর আবার অপেক্ষা।
এক দল ছেলে মেয়ে হৈচৈ করতে করতে এল রিকশাগুলোর কাছে। সরফুদ্দিন “কই যাইবেন” জিজ্ঞেস করতেই এক মেয়ে “নান্নায় চলেন” বলে সরফুদ্দিনের পঙ্খিরাজে উঠতে গেল। তখনই আরেক ছেলে বলল, “ওই নাম! রিকশায় উঠার আগে একটু দেইখ্যা লইবি তো? এই বুড়া মানুষটা টানতে পারব তগো? মাশাল্লাহ যে সাইজ তগো!” একথা শুনে হাসির রোল উঠল দলটার মাঝে।
পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে বলল “আহারে লোকটা কত্ত বয়স্ক! তার উপর এক হাত নেই! কেমনে যে মানুষ এদের রিকশায় চড়ে! ইস, কি কষ্টই না হয় উনার রিকশা টানতে! কেন যে উনি রিকশা চালায়?” এরপর চলে গেল দলটা অন্য রিকশাগুলোয় চড়ে।
দুপুর হয়ে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে ভীষণ। কিন্তু সরফুদ্দিন দেখল জালাল মিয়ের জমার টাকাটা শুধু উঠেছে এতক্ষনে। তিনটার আগে রিকশা জমা দিতে হবে তাই গ্যারেজের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল অভুক্ত অবস্থাতেই। গ্যারেজে আসার পর রিকশা রাখতেই জালাল মিয়ে এগোল তার দিকে। “চাচামিয়া তাড়াতাড়ি বাড়িত যান। চাচীর কোমর ভাইঙ্গা গেছে সাহেবের বাড়ির বাথরুমে পইড়া গিয়া।”
তাড়াতাড়ি বাড়ি যেয়ে বুড়ো দেখল ব্যাথায় নীল হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শীর্ণ আমেনা বিবি। তাড়াতাড়ি গিয়ে তার হাত ধরল সরফুদ্দিন। পাশের বাড়ির আজিজা ও রহিমা বলল তারা পড়া তেল মালিশ করে দিয়েছে আমেনার কোমরে, দু’দিনেই সেরে উঠবে সে।
সরফুদ্দিন আমেনার পাশে বসে কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলিয়ে চলল জালাল মিয়াকে আজকের জমা বুঝিয়ে দিতে, কিছু বাড়তি টাকা নিয়ে গেল বাজার করবে বলে। সচরাচর বাজারটা আমেনবা বিবিই করে সকালের কাজটা থেকে ফেরার পথে। ফিরে রান্না করে, সরফুদ্দিন ফেরার পর একসাথে খেয়ে তারপর আবার যায় বিকেলের কাজটায় আর শরফুদ্দিন আবার বেরোয় রিকশা নিয়ে।
জালালকে টাকা দিতে যেতেই সে আহত কন্ঠে বলে “আরে চাচামিয়া, আপনি কি আমারে আপনের পোলা মনে করেননা? চাচীর অসুখে এহন ওষুধ পথ্য কত কিছু লাগব। আপনি লইয়া যান ট্যাকা। আমার মায়ের লাইগা দিলাম এইডা।”
সরফুদ্দিন “তাইলে বাবা তুমি নিজে হাতে তোমার মায়েরে দিও” বলে টাকাটা আলগোছে ধরিয়ে দেয় জালালের হাতে।
দুদিন কেন দু সপ্তাহ হয়ে গেল তবু আমেনার ব্যাথা সারার কোন লক্ষণ নেই। টাকা খরচ হবে বলে আমেনা রাজি না হবার পরও একরকম জোর করেই সরফুদ্দিন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল কোলে করে। ডাক্তার বলল আমেনার কোমর ভেঙ্গে গেছে। সে আর কখনো হয়ত সোজা হয়ে দাড়াতে পারবেনা।
সরফুদ্দিন তাকে কোলে করে টয়লেটে নিয়ে যায়, ঘরের কাজ, রান্না বান্না নিজেই করে। সেদিনের পর থেকে আমেনা কেমন যেন হয়ে গেছে, সারাক্ষন গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকে, সরফুদ্দিন কাজ সেরে ফিরে দেখে সে বিকৃত মুখে উঠে বসার চেষ্টা করছে। রাত জেগে শুধু কাঁদে।
একদিন বাড়ি ফিরে দেখে আমেনা নেই ঘরে। হতভম্ব হয়ে সরফুদ্দিন পাশের বাড়ির রহিমাকে ডাকতেই সে বলে আমেনা গেছে কাসেমদের সাথে। একথা শুনেই সরফুদ্দিন ক্ষোভে ভয়ে বিহবল হয়ে যায়। কাসেমদের দলের কাজ হল, শহরের বিভিন্ন স্থানে তাদের দলের মানুষদের বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভিক্ষা করতে বসানো, বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে অসুখের খবর বলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এটাই ওদের ব্যবসা।
আরিফা মারা যাওয়ার পর কাসেম এসেছিল তার কাছে। বলেছিল, “চাচাজান আর কত কষ্ট দিবেন শইলডারে আর চাচীরে? বয়স তো আর কম হইলনা কারোরই। আজিমের কোন খোঁজ নাই আইজ এত বচ্ছর। আমাগো বোইনডাও এমনে শ্যাষ হইয়া গেল পিচাশগো হাতে। তয় আপনের কোন চিন্তা নাই। আমরা তো আছি আপনাগো সন্তান হইয়া। পাশের বাসার আলিম চাচা রিকশা চালানো ছাড়নের পর তারে আর চাচীরে, বাসা বাড়ির কাজ ছাড়ার পর আলেয়া খালারে আমরা দ্যাখতাছিনা? আপনাগো দুই পেডের ভাত কি আমরা জোগাইয়া দিতে পারুমনা? আপনাগো এহন আরাম করনের বয়স। এত পরিশ্রম কি আপনাগো শইল্যে সয়?”
সরফুদ্দিন তাদেরকে ভদ্রভাবে বলল, “হাত পাও থাকতে বইসা খায়া ওগুলানেরে লজ্জা দিবার চাইনা। বাবারা তোমরা এখন যাও।”
বের হয়ে যাবার সময় উত্তর এসেছিল নিচু গলায়, “তাও যদি চাইর হাত পাও থাকত! হাহ লজ্জা! হাত পাওয়ের আবার লজ্জা! এল্লেইগাই মাইনষের ভাল করতে নাই।”
বুড়ো চলল আমেনার খোজে। দেখল মার্কেটের সামনে অধোমুখে বসে আমেনা। সরফুদ্দিনকে দেখেই তার মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কেঁদে ফেলল আমেনা। মনে হল মানুষটাকে সে আজ যেন হারিয়ে দিয়েছে। সরফুদ্দিন কিছু না বলে আমেনাকে কোলে করে নিয়ে গেল ঘরে।
আপনার লেখার হাত সত্যিই ভাল ।
এ ধরণের গল্প পড়ে চারপাশের ভূলে যাওয়া জগৎ সমন্ধে পুনরায় সচেতন হয়ে উঠি ।
অনেক ধন্যবাদ ।
@রুপম,
অনুপ্রাণিত হলাম সবার মন্তব্যেই
পিতা বা পিতামহের বয়সী রিক্সাওয়ালা বা শ্রমিককে “তুমি” এমনকি “তুই” বলে সম্বাধন করার ঐতিহ্য আমাদের দেশে। অনেক ছোটবেলায় আমার আব্বার বলা একটি কথার পর থেকে আমি তাঁদেরকে বয়স নির্বিশেষে “আপনি” বলি।
@রা নাহি দেয় রাধা, আমার পরিবারও আমাকে বাসার গার্ড, পরিচারিকা, রিক্সাওয়ালাসহ নিজের চেয়ে বড় সবাইকে আপনি বলা শিখিয়েছে। নিজের বান্ধবীকে যখন দেখি ড্রাইভারকে কথায় কথায় ছোটলোক আর তুমি বলে সম্বোধন করতে তখন বাবা-মাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে হয় মানুষকে সম্মান দিতে শেখানোর কারণে।
লেখাটা পড়ার পর থেকেই মন্তব্য করব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু নানা ঝামেলায় আর করা হয়ে উঠেনি।
আমার কাছে এ তো গল্প নয়, যেন বাংলাদেশের নিত্যনৈমন্তিক জীবনের এক চালচিত্র। স্তব্ধ হয়ে ছিলাম পড়ে অনেক্ষণ। ধন্যবাদ লীনা!
@অভিজিৎ, ধন্যবাদ দাদা
গল্পটা হৃদয়স্পর্শ করে গেলো।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন। সরফুদ্দিনের মত মানুষদের জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়াটাই যেন স্বাভাবিক!!!
@হোরাস, সেজন্যই আমি সরফুদ্দিনকে হারতে দিতে চাইনি এত বাধা-বিপত্তি, নিয়তির খেলার পরেও…
সহজ ভাবে খুব কঠিন বাস্তবতা বর্নণা করেছেন। অতি উত্তম। দুইবার পড়েছি।মন কাঁপে সেই অসহায় মানুষ গুলোর জন্য। জীবনের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে তাদেরও একটু সময় দিতে মন চায়। উত্তম লেখনী।
@সংগ্রামীমানুষ,
(Y)
আসলেই ভাল লাগছে এই লেখা এত মানুষের মন ছুয়েছে দেখে…
খুব ভালো লাগলো। আপনার লেখনীশক্তি আপনার মানবিকতাকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে, যা সচরাচর নয়। আশা করি মানুষের প্রতি সহমর্মিতা সবসময়েই আপনার লেখার আবেগের প্রেরনা হয়ে থাকবে।আপনার গল্পটা পড়ে আমার অন্যতম প্রিয় লেখক স্টেইনবেক এর কথা মনে পড়লো, স্টেইনবেকের সাহিত্যেরও মূল প্রেরনা ছিলো মানবিকতা এবং মানুষের সম্মান। এপ্রসংগে ১৯৬২ সালে স্টেইনবেকের বিখ্যাত নোবেল বক্তৃতার শেষ লাইনটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না।স্টেইনবেক বাইবেল (নিউ টেস্টামেন্ট) জন ১:১ এর “In the beginning was the Word, and the Word was with God, and the Word was God” বাক্যটিকে প্যারাফ্রেজ করে বলেছিলেন “In the end is the Word, and the Word is Man – and the Word is with Men”।
@সফিক,
(Y)
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
চমৎকার লিখেছেন, গদ্যের গতির ওপর ভালো দখল আপনার। গল্পটিও মর্মস্পর্শী (W)
@রৌরব, ধন্যবাদ।
@লীনা, ভালো লাগলো, খুবই ভালো লাগলো লেখাটা। আপনার লেখার হাত দিনে দিনে খুবই আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে। আরও লিখুন আমাদের জন্য।
@ফাহিম রেজা, অনুপ্রাণিত হলাম, সত্যি
সুন্দর বসে মুক্তমনার লেখাগুলি পড়ছিলাম। হঠাৎ আপনার লেখা চোখে পড়ল আর দিলেন মনটা খারাপ করে।:-X আপনার গল্পের মতো বাস্তব ঘটনা দেখে আপনার চোখে জল আসে, আমার চোখে জল আসে, মানবতাবাদীদের চোখে জল আসে। কিন্তু সুবিধাবাদীদের চোখে জল আসে না যারা গরীব মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায়। জন্মের পর থেকেই বোধ হয় গরিবী হঠাও! গরিবী হঠাও! শব্দ শুনে আসছি, তবু কতটুকু পরিবর্তন হচ্ছে এই গরিব লোকদের। এক শ্রেণী ফুলে ফেপে সম্পদ রাখার জায়গা পায় না। আর আরেক শ্রেণী অনাহারে মরে। এই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থা। তেলা মাথায় তেল দিতেই ব্যস্ত।
ধন্যবাদ সুন্দর গল্পটার জন্য ধন্যটাকে বাদ দিলাম না ।
আর আমার মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য। :-[
@সুমিত দেবনাথ, মন খারাপ করে দেয়া শুধু নয়, আমার উদ্দেশ্য ছিল সরফুদ্দিনের অপরাজেয় মর্যাদাবোধকে দেখানো, শত বাধার পরেও।
লীনা যে এতটা ভাল লেখতে পারে তা তো জানতাম না!!
দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবে আমি মাঝে মাঝে দিশে হারিয়ে ফেলি। এরা কি শুধুই দুর্ভোগ পোহানোর জন্যই জন্ম নিয়েছে? আমাদের সভ্যতাকে কতভাগ মানুষ উপভোগ করতে পারছে?
সেদিন দেখলাম ১০ বছরের একটা ছেলে রাস্তায় রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একা, তাই রিক্সায় উঠে বসলাম। আমার যুক্তি হল হয়ত একটু পরেই ২-৩ জন লোক ওর ঘাড়ে চেপে বসবে। কিছু দূর যাওয়ার পরই ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস নিতে শুরু করল। আমি বুঝতে পারলাম ওর দুঃখ। ১০ বছর বয়সে বাবার কোলে বসে গল্প শুনে পার করেছি। আর ও? ও কি পাপটা করেছে প্রকৃতির কাছে, সভ্যতার কাছে, মানুষ সমাজের কাছে? আমি রিক্সা থেকে নেমে ওর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ১০ টাকার দুটো নোট দিয়ে দিলাম যা তার প্রত্যাশার দ্বিগুন ছিল। সে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
কিন্তু এর অবসান কবে ও কিভাবে সম্ভব?
@সৈকত চৌধুরী,
আপনাদের বাতাস লাইগা আমার এই দশা…দোয়া রাখবেন। ;-)।
আসলে কয়েক বছর আগের এই ভাবনাটা চেপে বসেছিল মনে। তাই এই লেখা। আমি দেখাতে চেয়েছি, আমরা যাদেরকে মানুষের পর্যায়ে ফেলিনা তাদের মাঝেও মর্যাদাবোধ থাকতে পারে, আমাদের শত অবহেলা ও অসহযোগী মনোভাব, দারিদ্র্য ও সমাজের শত আঘাতেও, জীবনের মর্যাদায় অবিশ্বাসীদের শত চেষ্টা ও প্রলোভনেও কেউ কেউ অপরাজেয়।
প্রপার উদ্যোগেই এটা সম্ভব।আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতি বছর বাচ্চাদেরকে ঈদের কাপড় দেই। আমি চিন্তা করেছিলাম আমরা ঈদে কাপড় তো দেবই সাথে সাথে প্রতি মাসে ১০ টাকা করে নিয়ে তা দিয়ে প্রতি বছর একটি পরিবারকে সাহায্য করলেই তো হয়।(কেন যেন কাজটা এগোয়নি। এজন্য দায়ী আমাদের উদাসীনতা। শুরু করব। করতে হবে।) এভাবে প্রত্যেকটি দল একটি করে পরিবারের দায়িত্ব নিলে সাফল্য সম্ভব। কিন্তু আমরা এটা ভিক্ষা হিসেবে দেবনা, টাকা দেবনা,এটা দিয়ে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেব যাতে তারা ভিক্ষায় অভ্যস্ত না হয়। আমরা তাদেরকে মনিটর করব যাতে এই টাকাটা সঠিক খাতে খরচ হয়। তারা বোঝে নিজের জীবিকা কাজ করে উপার্জন করে নেয়ার সম্মান। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা নেই।বাইরের দেশে ড্রাইভারদেরকে কেউ অপমান করেনা, কিন্তু আমাদের দেশে “শালার ড্রাইভার” একটা গালির মত, অন্য ছোট পেশাগুলোও। রিকশাওয়ালা নামটা যেন অনেক ঘৃণ্য!!
@সৈকত চৌধুরী, টি।এস।সি তে খুব সুন্দর একটা পিচ্চি আছে,পলাশ। ২ বছর আগের কথা এটা, ওর যখন ৪/৫ বছর বয়স ওই পিচ্চি একদিন ভার্সিটির বাসে উঠে চকলেট বিক্রি করছিল।বলছিল, “চকলেট নেন, নইলে ২ টা টাকা দেন।” আমার পাশের এক আপু ওর গাল টিপে দিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। এরপর ওকে টাকা দিলেন এবং চকলেট নিলেন, বললেন এমনি এমনি টাকা দিলে ওর ভিক্ষার অভ্যাস হয়ে যাবে, কথাটা পলাশকে শুনিয়েই বললেন যে ওর কোন কিছুর বিউনিময়েই টাকা নেয়া উচিত!ওই আপুর দিকে শ্রদ্ধাভরে তাকিয়েছিলাম সেদিন।সত্যি তো আমরা পারি পলাশদেরকে ভিক্ষুক হয়ে ওঠা থেকে রোধ করতে, সে এখনো চকলেট ইত্যাদি বিক্রি করে,অনেকে হয়ত ওকে এমনি টাকা দেয়, কিন্তু আমি ওর কাছ থেকে চকলেট কিনব,আদর করব, কিন্তু ওকে ভিক্ষা দেবনা কিছুতেই, এটা করব পলাশকে স্নেহ করি বলেই, ওই আপুর মত 🙂
সবার মন্তব্যে অনেক অনুপ্রেরণা পেলাম 🙂
@লীনা রহমান,
এ তো গল্প নয়, জীবন গাঁথা। এমন চোখে মানুষকে দেখার চোখও যে জগতে আছে, সেটা আমাদের সৌভাগ্য। আমি যখন দেশে যাই এদের দিকে তাকিয়েই বেশির ভাগ সময় কাটে। চামার-মুচি, খামার-কুমার, রিকসাওয়ালা, জেলে-নাইয়া, নাপিত, বাইদা-বাইদানীদের পাশে তাদের মত হয়ে বসি, আলাপ করি, মাঝেমাঝে বন্ধু-বান্ধবেরা তা দেখে হাসাহাসি করে।
সুন্দর একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্যে- (F) (F) (F)
@আকাশ মালিক, এক ঈদে ফটকের এপার থেকে হাড্ডি ছুড়ে দিলে, এক রোজায় “যাকাতের’ শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে ওদের কিছু হয়না, এমনকি শীতবস্ত্র দিয়েও কাজ হয়না। ওদের কাছে এগুলোর চেয়ে টাকা বেশি দরকারি তাই ওরা এ ধরণের সহায়তার মাঝে পাওয়া জিনিসগুলো বিক্রি করে দেয় স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে! আমরা বন্ধুরা যে বাচ্চাদের ঈদের কাপড় দেই তাতেও কিছু হয়না জানি, তবু দিই কারণ জীবনে প্রথম বারের মত এই ঈদে দেখলাম কিভাবে একটা বাচ্চার চোখে পানি ও মুখে হাসি যুগপৎ দেখা যায় একটা সস্তা ফ্রক, একটা পাঞ্জাবি পেয়ে! এখানেও চলছিল বেচা কেনার ব্যাপার। এক মেয়ে তার ছোট ভাইয়ের পাঞ্জাবি খুলে আমার তাকে পাঠাচ্ছিল আমাদের কাছে আরেকটা পাঞ্জাবি নেয়ার জন্য।কিন্তু সেই পিচ্চি তার অমূল্য(!) জামা দেবেনা, তার বোন তাই তাকে মারল, তবু পিচ্চি জামা খুলবেনা! দুজনের ব্যবহারই দীনতার চিত্র স্পষ্ট করে তুলছিল ;-(
@লীনা রহমান,
তোমার গভীরভাবে দেখা ও লেখা চিন্তাশীল মননের জন্য অসংখ্য শুভেচ্ছা।
@মাহবুব সাঈদ মামুন, আপনার উপস্থিতি ও মন্তব্যের অপেক্ষা করছিলাম মনে মনে। ভাল লাগল
গল্পটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল!
সার্থক লেখক আপনি!
এই গল্প কই পান আপনি, মানে আইডিয়াগুলো কিভাবে আসে? নাকি নিজেই এদের সাথে মিশে ঘুরে ঘুরে দেখেন?
@শ্রাবণ আকাশ, এই গল্পটার সাথে আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশে আছে। তখন আমি মনে হয় কলেজে পড়ি।আমি তাড়াহুড়ায় একটা রিকশায় উঠলাম। উঠে বেশ কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম উনার একটা পা নেই, কিন্তু এক পা দিয়ে দিব্যি রিকশা চালাচ্ছিলেন। আমার গল্পের মেয়েটার মত আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এটা দেখে, যদি কোন বিপদ হয়।আরো ভেবেছিলাম উনি রিকশা কেন চালায়?না চালালেই পারে এতকষ্ট করে। কিন্তু তিনি দিব্যি আমাকে পৌছে দিয়েছিলেন। এরপর সেদিন রাতে ভাবতে ভাবতে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। উনার ভিক্ষা না করে খেটে খাওয়ার মানসিকতা তথা মর্যাদাবোধের সামনে আমার তখনকার ভাবনা অনেক ছোট লাগছিল।বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও খেয়াল করে দেখলাম আমাদের একই ভাবনা। আমি একটা রিকশায় উঠেছিলাম যে রিকশাওয়ালার কবজি ছিলনা!
আমরা উনাদেরকে কাজও করতে দেইনা, ভিক্ষা চাইলেও বলি কাজ করনা কেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের কুবের মাঝির মত আমরা এদেরকে ভাবি “গরীবের মাঝে আরো গরীব, ছোটলোকের মাঝে আরো ছোটলোক।” ওরা ভিক্ষা করলে আমাদের বিরক্তি লাগে কিন্তু দৃষ্টিকটু লাগেনা কিন্তু ওরা এত কষ্ট করেও নিজের জীবিকাটা উপার্জন করে নিলে আমাদের দৃষ্টিকটু লাগে!! আমরা খুব সহজে তাদের ছোট মানুষ ভাবতে পারি, কিন্তু মানুষ ভাবতে পারিনা।
যাহোক, তখন আমার চিন্তাটা কাউকে বলিনি,আজ প্রায় ৪ বছর পর হঠাৎ সেই চিন্তা মনে পড়ল এক বুড়ো রিকশাওয়ালাকে দেখে।পাশে থাকা বন্ধুকে বললাম, তখনই চিন্তা এল ব্লগেও এটা শেয়ার করি। এই হল আমার লেখার শানে নুযুল… 🙂
@লীনা রহমান, গ্রামের প্রাইমারী ছেড়ে গেলাম মাইলখানেক দূরের হাইস্কুলে।
স্কুলে যাওয়া-আসা করতে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই যাদের দেখতাম ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অনেকেই আমার প্রাইমারীর ক্লাসমেট!
পরের ৫টা বছর এদের ভ্যানেই চড়তে হয়েছে।
হাইস্কুলে ভর্তি হবার মত সামর্থ ছিল না। তখন হয়তো এতটা খারাপ লাগেনি। কিন্তু এখন তাদের সেই সময়ের বয়সটার কথা চিন্তা করলে শিউরে উঠি।
অনেকদিন পর দেশে গিয়ে এদের কয়েকজনকে খুঁজে পেয়েছি। সেই একই রাস্তার মোড়ে। গত ১৮-২০ বছর ধরে এরা শুধু ভ্যানই চালিয়ে এসেছে।
লীনা, ভালো লিখেছেন। হৃদয়ছোঁয়া। কিন্তু এতো গল্প নয়, দারিদ্র্যের দিনপঞ্জী! এ দিনপঞ্জী রচিত হচ্ছে রোজই আমাদের চারপাশে।
অনেকদিন পর আপনার লেখা পেলাম। কি বলি লেখা নিয়ে মনের গভীরে গেঁথে গেল।
@লীনা রহমান, এই ধরণের গল্পগুলো ( গল্প বলাটাও বোধ হয় ঠিক নয়, এগুলো তো আমাদের দেশের নিত্যদিনের বাস্তবতা) পড়লে বড্ডঅসহায় লাগে, ব্লগে বসে এগুলো নিয়ে মন্তব্য করাটাকেও হিপোক্রেসি বলে মনে হয়। তারপরও, অনেকদিন পর আপনার লেখা দেখে পড়ে ফেললাম … 🙁
@বন্যা আহমেদ, সত্যি খারাপ লাগে যখন দেখি একজন মানুষ কাজ করে খেতে চাইলে আমরা তাদেরকে করতে দেই না।অনেকেই মায়া করে বৃদ্ধদের রিকশায় ওঠেনা। কিন্তু আমাদের এই হিপোক্রেট মায়াতে কিন্তু তাদের পেট ভরেনা।আমি তাই বুড়োদের রিকশায়ও উঠি যদি দেখি উনি ভার বইতে পারবেন। কারণ উনার মর্যাদাবোধ এবং খেটে খাওয়ার ইচ্ছেকে ছোট করার কোন অধিকার আমার নেই। খামাখা আহা উহু করে আমরা একটু পর ভুলে যাব, আগুন কিন্তু জ্বলবে উনার পেটে, হয়ত এজন্যই এক সময় সে সহজ খাদ্যের আশায় ভিক্ষায় নামবে। অনেকে ভিক্ষা চাইতে আসলে আমরা বলি, কাজ করে খেতে পারেননা? কিন্তু কাজ দেই কয়জন? আমার কথা হচ্ছে আমি কাউকে ছোট মনের মানুষ হতে উৎসাহিত করব না। আমার এই চিন্তাটা বেশ অনেকদিন ধরে আছে মনে। আজ সময় পেয়ে লিখে ফেললাম। গল্পে আপনার কমেন্ট বেশ কম পাওয়া যায়। সত্যি অনুপ্রাণিত হলাম। 🙂
@লীনা রহমান,
এ তো শুধু গল্প নয়, পারিপার্শ্বিকের সরফুদ্দিন আর আমেনাদের যাপিত জীবনের গাঁথা।অহরহই দেখি, তবে আপনার মতো করে নয় নিশ্চয়ই।
যেজন্যই হয়ত লেখায় আসে না।
@লীনা রহমান, এতো কাজ থাকতে বৃদ্ধরা কেনো রিকশা চালাবে? উত্তর : নিরাবতা, এখানেই এই তথাকথিত উন্নত সভ্যতার ব্যর্থতা। আমি বৃদ্ধ রিকশাচালকদের রিকশায় না চড়লে খুব কষ্ট পাই, আবার চড়লে কষ্ট বেড়ে যায় দ্বিগুন। মানুষ হিসাবে নিজেকে খুব অসহায় আর অপরাধী মনে হয়। ধন্যবাদ গল্পটির জন্য।
@মোজাফফর হোসেন,
এটা আসলেই বড় একটা ডিলেম্মা।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য