পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ৭)

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনো এক অজানা কারণে, স্টুডেন্টদের দেখলে চেহারা কঠিন করে ফেলেন। মনে হয় যুগ যুগ ধরে তাদের মধ্যে চলে আসছে অঘোষিত শত্রুতা। ক্লাসের যে ছেলেটি দ্বিতীয় বর্ষে এসেই আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করার গৌরব অর্জন করেছে, তাকে দেখেও তাদের পাষাণ হৃদয় গলে না। তবে পলিটিক্যল ক্যাডারদের দেখলে সেই একই শিক্ষকদের আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে কি, দুষ্টু রাজনীতির নিয়ম-ই হচ্ছে অবজ্ঞা আর অসন্মান। অসন্মান করার জন্য যে পরিমাণ অসৎ-সাহস দরকার সেটা একমাত্র দুষ্টু রাজনীতি-ই দিতে পারে। সাধারণ স্টুডেন্টরা শিক্ষকদের উঠতে বসতে সালাম না দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় অথচ পলিটিক্যাল ক্যাডাররা শিক্ষকদের দূর থেকে দেখলে সিগারেট ধরায় কাছে আসলে ধোঁয়া ছাড়বে বলে। আর শিক্ষকেরাও সন্মান হারানোর ভয়ে পলিটিক্যাল ক্যাডারদের দেখলে দূর থেকে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তোলেন মধুমাখা হাসি।

কোনোক্রমে যদি স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়, বিসিএস কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সুবিধার্থে কয়টা দিন পরীক্ষা পিছানোর বা আগানোর জন্য, তখন তাদের সুপ্ত বিবেক লাফ দিয়ে জেগে উঠে। এ-হতে পারে না, এ-হবার নয় বলে একযোগে চিৎকার করে ওঠেন তারা। স্টুডেন্টদের অনুরোধ আমলে নেয়াটাকে কিছু কিছু শিক্ষক চরম অপমানজনক আর অবক্ষয় বলে মনে করে থাকেন। এদিকে, অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে আমাদের ফাইনাল একটা সাবমিশানের তারিখ পেছানো দরকার। ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা কমিটির কাছে অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হচ্ছে না। যত বেশি অনুরোধ করা হচ্ছে, তত বেশি তারা নীতির পাহাড় হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ওদিকে, বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডেকে বসে আছে। তারাও কারণে অকারণে এত বেশি ধর্মঘট ডাকে যে কেউ আর সেটাকে হিসেবের মধ্যেই ধরছে না। সে যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতির বটগাছেরা ধর্মঘটের মধ্যেও কিছুতেই আমাদের ফাইনাল সাবমিশানের তারিখ পরিবর্তন করবেন না। দরকাল হলে বাংলাদেশের রাজধানী ‘ঢাকা’র পরিবর্তে ‘চর কুক্‌ড়ি মুক্‌ড়ি’ হয়ে যাবে, তবুও ‘ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স’ এর পূর্বঘোষিত তারিখ পরিবর্তন হবে না। শিক্ষকদের অনমনীয় ভাব দেখে মনে হচ্ছে হাকিম নড়বে তবু হুকুম নড়বে না কোনক্রমেই।

ক্লাসের সব সহপাঠীরা যে কোন ধরণের ষড়যন্ত্র কিংবা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হলে অবস্থানকারী ক্লাসমেটদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সহপাঠীদের এমন দুর্দিনে হলের একজন প্রতিনিধি হয়েও কিছু করতে না পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু দেশে এখন দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকার জন্য গ্রামীণ ফোন আছে, আবার দিন বদলের জন্য বাংলালিংক আছে। অতএব, পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রধান ব্যক্তিকে ফোন দিয়ে বলা হলো, আমি অমুক সংগঠনের তমুক হল শাখার সহ-সভাপতি বলছি, আমরা একটা ধর্মঘট ডেকেছি আর আপনারা সেই সময় পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করছেন, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? স্পিকার অন করা ফোনে সবাই অবাক হয়ে শুনলাম বটবৃক্ষ কিভাবে কলাবৃক্ষে পরিণত হয়ে গেল। তার কলাবতী কন্ঠের এমন মায়াময় মধুর হাসি কোনোদিনও আমরা শুনতে পাইনি। কি কোমল কি স্নেহসুলভ সেই হাসি। পরের দিনই জরুরী মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরীক্ষার তারিখ পনের দিন পিছিয়ে দেয়া হল।

অবাক হয়ে দেখলাম, অবাক হয়ে শুনলাম। পলিটিক্যাল ক্যাডার কেউ নিজে নিজে হয় না, শুধু রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছায়ও হয় না; হয় আমার ইচ্ছায়, আপনার ইচ্ছায়, আমাদের ইচ্ছায়। আমরাই তৈরী করি পলিটিক্যাল পান্ডা। যতদিন আমাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করার জন্য আমারা তাদেরকে ব্যবহার করা বন্ধ না করব, যতদিন তাদের দেখলে হাকিমেরা হুকুম পরিবর্তন করে বাক-বাকুম করা বন্ধ না করবে, ততদিন পরিবর্তন হবে না এই দুষ্টু প্রক্রিয়ার। সমস্ত রাত্রি জেগে থেকে, বইয়ের পাতার পর পাতা অধ্যয়ণ করে, পরীক্ষার খাতায় নাম্বারের পর নাম্বার তুলে, উঠতে বসতে শিক্ষকদের সালাম দিয়ে যে শিক্ষার্থী তৈরী হল, যৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও তার কথায় পরীক্ষার তারিখ এক সেকেন্ডও পিছানো সম্ভব হয়নি। অথচ বইয়ের পাতা টিস্যু পেপার বানিয়ে, সমস্ত রাত্রি ফেন্সিডিল খেয়ে যে পলিটিক্যাল ক্যাডার তৈরী হল, তার একটা ফাঁপা বুলির ফোন কলের বদৌলতে পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো নির্বিচারে। অবাক হয়ে ভাবলাম, কেউ নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টাও করলোনা, ফোন কলটা সত্যিকার অর্থে কে করেছে।

কিন্তু দিনের পর দিন কল্পনায় যে জিনিসটাকে হাস্যকর মনে করেছি, কেন শিক্ষকেরা এমনটা করে ভেবে ক্ষোভে ফেটে পড়েছি, সে জিনিসের প্রকৃত রূপ দেখে লজ্জায় অপমানে ভেঙ্গেও পড়েছি। আমার নিজ বিভাগের প্রতিটা ফাঁকা জায়গা ফুলের টবে আর সবুজ গাছ দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। একেকটা গাছ যেন তাঁর একেকটা সন্তান। কম্পিউটার বিজ্ঞানের মত যান্ত্রিক একটা ডিপার্টমেন্টে এই সবুজ সুন্দর গাছগুলো প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দয় আমাদের। কিন্তু হঠাৎ একদিন ধর্মঘটের মাঝে ক্লাস চালানোর কারণে পলিটিক্যাল ক্যাডাররা ডিপার্টমেন্টে এসে আক্রমণ চালালো। একটা একটা করে টব ভাঙলো, উপড়ে ফেললো গাছ। চুরমার করে ফেললো সৌন্দর্য। তাদের কুৎসিত মন সৌন্দর্য সইতে পারে নি। সে-দিন ছাত্র হয়েও আমি প্রতিবাদ করতে পারি নি। শুধু বুঝেছি, অসভ্য আর অসুন্দরদের কাছে কতটা অসহায়, কতটা নিরুপায় ছাত্র-শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ আর রাষ্ট্র।

যেই বিসিএস পরীক্ষার জন্য এত পরীক্ষা পেছানো, এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যত কাছ থেকে সত্যকে দেখা যায়, ঠিক তত কাজ থেকেই দেখা যায় কি করে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে তৈরী হয় মিথ্যার পাহাড়। হলের সর্বস্তরের স্টুডেন্টদের অংশগ্রহণে বিসিএস-এর কোটা বিরোধী মিছিল হলো, প্রতিবাদ হলো। অথচ সকালে উঠে দেখতে পেলাম, দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে ছাপা হলো, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্র মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের জন্য কিছু অছাত্রকে ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের কল্যাণে প্রথম ভোরের আলোতে চোখ মেলেই মানুষ পড়ে ফেলল সেই মিথ্যাচার, জন্ম হল সর্বাধিক প্রচারিত মিথ্যার। আর হলের ফ্লোরে ফ্লোরে সেই পত্রিকা আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল ছাত্ররা। কিন্তু সেই প্রতিবাদ মিডিয়ার কাছে কিছুই না। বাংলার সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের অপব্যবহার করে ফুলে ফেঁপে উঠা এইসব মিডিয়া রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানাতে পারে। তবে আমি কখনোই বুঝতে পারি না, বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাতে ছেলে কি করে ম্যাজিস্ট্রেট হবার যোগ্যতা অর্জন করলো, কি করে সে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে কাজ করার জন্য অর্থনীতি শিখে ফেলল। মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধারা এদেশে এখনো ভিক্ষা করে কিন্তু তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে পুঁজি করে হয় নষ্ট রাজনীতি।

বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষার রাতে হলগুলোতে সবার হাতে চলে আসলো একশোটি প্রশ্ন। মোবাইল ফোনের কল্যাণে সেই প্রশ্ন চলে গেলো ঘরে ঘরে। দিন বদলের জন্য যে মোবাইল কোম্পানীগুলো এসেছে তারা দিনরাত সব বদল করে দিচ্ছে। দিবসের পর দিবস আসছে, আগে এত দিবস ছিলো না। আরো আসবে। মা দিবস, বাবা দিবস, মামা দিবস, নানা দিবস, নাতি দিবস, ফুফু দিবস। প্রতিটা দিবস মানে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা। এখন মোবাইল বন্ধ করে শুধু সকালে উঠে প্রশ্নগুলো মিলবে কি-না সেটার জন্য অপেক্ষা করা। যথারীতি সকালে গিয়ে দেখি একশ’টা প্রশ্নের মধ্যে ছিয়ানব্বইটা কমন। অন্যদিকে, যথারীতি পিএসসি চেয়ারম্যানের কঠিন বাংলায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট বল উড়িয়ে দেয়া। বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এ-দেশের মানুষগুলো। এই সত্যটুকু বোঝার জন্য এখন আর সেলুকাসের প্রয়োজন হয় না।

শতশত স্টুডেন্ট ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিলো, কিন্তু যেহেতু প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিরা নিজেরা রাতের বেলা প্রশ্ন দেখতে পারেন নি, সেহেতু পরীক্ষা বাতিল হলো না। যথাসময়ে লিখিত পরীক্ষা হলো এবং অবশেষে ভাইভা। এক-এক দিন এক-এক জন করে হলের সবাই ভাইভা দিয়ে আসছে। আর ভাইভা বোর্ডে কি প্রশ্ন করা হলো সেই গল্প করছে। ভাইভা বোর্ডে দুর্ব্যবহার করা বাঙ্গালির জাতিগত সমস্যা ও স্বভাব। তার থেকে মুক্তির উপায় নেই। কিন্তু এবারের ভাইভা বোর্ডে সার্টিফিকেট ছুড়ে মারাটা একটু বেশিই হচ্ছে। অতএব, নিজের ভাইভা এর দিন শক্ত প্যাকেটে সার্টিফিকেট নিয়ে রওয়ানা হলাম, যাতে ছঁড়ে মারলেও ছিঁড়ে না যায়। উপস্থিত হয়ে জানতে পারি, আমার বোর্ডে আছেন স্বয়ং পিএসিসি’র চেয়ারম্যান এবং একজন যুগ্মসচিব। পিএসিসি’র চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, কোন ইউনিভার্সিটি এবং কোন ডিপার্টমেন্ট। জবাব দেয়ার পর আমার মার্কশীট চেয়ে নিয়ে দেখলেন। তারপর বললনে, আমি কোনো প্রশ্ন করবো না। সচিব সাহেবকে বললেন, আপনার কোনো প্রশ্ন আছে? সচিব সাহেব অত্যন্ত নার্ভাস। কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করে সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে আমার সাবজেক্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। প্রশ্নের ধরণ দেখেই বুঝতে পারলাম, আর পাঁচ-দশটা সচিবের মত কম্পিউটার সায়েন্সের প্রাথমিক ধারণাও উনার নেই। সচিব সাহেব আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশে আবাসিক এলাকাগুলোতে ব্যবহারকারীরা গড়ে কি রকম ইন্টারনেট স্পিড পেয়ে থাকে? তার দূর্বলতা টের পেয়ে আমিও বললাম, ‘মিনিমাম পাঁচশ গিগাবাইট পার সেকেন্ড’। সচিব সাহেব অতৃপ্তির ছাপ মুখে এনে বললেন, এটা মনে হয় সঠিক ইনফরমেশান না’। নিজের উপর রাগ হলো। যেইনা ভাবলাম, শুধু শুধু এমন একটা উত্তর করা ঠিক হয়নি, অমনি সচিব সাহেব বলে উঠলেন, আমি যতদূর জানি এটা এখন পাঁচ হাজার গিগাবাইট পার সেকেন্ড

পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৯)
(চলবে…)

[email protected]
January 28, 2011