বছর ছয়েক আগে পড়েছিলাম, বাণী বসুর লেখা “মৈত্রেয় জাতক”। একবার নয়, একাধিক বার, বারবার পড়েছি। কেন? সেখানে এক ঐতিহাসিক সময়ের উন্মেষ, একটি ধর্মের উন্মেষ, একটি দর্শনের উন্মেষ, কয়েকটি ব্যক্তিত্বের উন্মেষ… শিল্পের উন্মেষ, স্থাপত্যের উন্মেষ আর সবশেষে একটি মানবিক বিপ্লবের উন্মেষ। আর এই সবকিছুর সাথেই সমান্তরালে চলেছে নারীর জীবনের স্বরূপ। আড়াই হাজার বছর আগে, যীশুর জন্মের আগে, মুহাম্মদের জন্মের আগে, বুদ্ধকালীন সময়ের চলচিত্র। নাগরিক জীবনের বাইরের চিত্র… গভীর জঙ্গলে বাস করে একদল মানুষ, কৃষ্ণবর্ণের শরীর, নগ্ন নরনারী। নাগরিকেরা তাদের মানুষ ভাবে না, তারা নিষাদ! বন্য ফল-মূল আর পশুর মাংশ তাদের আহার… রাতের বেলায় দ্রিম দ্রিম বাদ্যের শব্দ, রগগা নামের নিষাদ রমনীর বন্য হরিণীর মত প্রণয়ীর কাছে ছুটে চলা… এইসব মিলে যেন অদ্ভুত এক জগত! পোষাক নামের আচ্ছাদন যেমন তাদের স্পর্শ করেনি, তেমনি তাদের মনও সরল, অনাচ্ছাদিত। বনফুলের সাজের মতই তারা প্রকৃতির বুকের অলংকার!

জঙ্গলের বাইরে আছে নগর, সেখানে আছে যুদ্ধ, চক্রবর্তী রাজা হবার বাসনা, ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রের ঝংকার, ব্রাহ্মণের মন্ত্র, শূদ্রের জীবন, শ্রেষ্ঠীর জয়জয়াকার! আর তারই মাঝে বুদ্ধের উদ্ভব… নব ধর্মের দীক্ষা নিয়ে। বৌদ্ধ ধর্ম গৃহীরও, বৌদ্ধ ধর্ম সন্যাসীরও। বুদ্ধ সবার… তিনি দার্শনিক, বোধিপ্রাপ্ত। তাকে দেখলেই ভাবের সৃষ্টি হয়। ঈশ্বর নেই তবে অষ্টমার্গ, পঞ্চমার্গ… এইসব আছে তার অনুসারীদের জন্য। আছে বিহার, আছে ভিক্ষান্নজীবি ভিক্ষুর দল। সাধে কি বলে, উপমহাদেশের মাটিতে আধ্যত্মিকতার বীজ পোতা। এইখানে শিক্ষা নেই, তবে আধ্যাত্মিকতা ঠিকই আছে। আধ্যাত্মিক হবার জন্য এইখানে অক্ষর জ্ঞানেরও প্রয়োজন হয়না।

এইসবের মাঝে কোথায় নারী? অন্তঃপুরে, অন্দর মহলে। বাইরে বেরুতে তাদের অবগুন্ঠন লাগে না হয়তো, তবে বাঁচার অধিকার নেই কোনভাবেই। জন্ম, রূপ, যৌবন, জীবন… সবই পুরুষের জন্য। খাও, ঘুমাও, সন্তানের জন্ম দাও, গৃহপতির সেবা কর … এইটুকুই অস্তিত্ব তার। এর বাইরে যাবার দুটমাত্র পথ খোলা, অতিসুন্দরী, গুনবতী নারী হবে গণভোগ্যা গণিকা আর সংসার ত্যাগী নারী হবে ভিক্ষুনী! যে পিতা পুরুষের লালসার থাবা থেকে কন্যাকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে পান না, তিনি কন্যাকে পাঠান বাধ্য সন্যাসব্রতে… সে হয় মহান ভিক্ষুনী। ভিক্ষুনীর জীবন বেঁছে না নিলে হয়ত তার ঠাঁই মিলত গণিকালয়ে। সেখানে রাজ্য তার কোষাগারের অর্থব্যয় করে তাকে গড়ে তুলত গণসেবায়, তাতে রাজ্যের বানিজ্য শক্তিশালী হয় বটে। সে হয়ে উঠত রূপে মোহময়ী, শিল্পে শিল্পিত। সে গানের পাখি, নাচের ছন্দ, আঁকিয়ের রংতুলি, কবির কাব্য সবকিছু। সে স্বাধীন, সে স্বতন্ত্র, রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরের নারীদের চেয়ে তার জীবন অনন্য। সে হাসে গোলাপের মত, সে চৌষট্টি কলায় সুশিক্ষিতা! শিল্প সাধারনের জন্য নয়, শিল্পে অধিকার কেবল তাদের। সাথে আছে কিছু ব্যক্তিত্ব্যহীন রাজগুনগ্রাহী কবির দল। শিল্প সত্যিই এখানে রমনীয়!

আর নয় “মৈত্রেয় জাতক” এর কথা, বইটা থেকে নিলাম কেবল সেইসমাজের ছবিটা। “মৈত্রেয় জাতক” এর কথা আরো লিখতে হলে লিখতাম রাজা বিম্বিসারের কথা, গূঢ় পুরুষ অথবা তক্ষশিলার স্নাতক কূটনীতিবিদ চণকের কথা, বিদুষী নটী জিতসোমার কথা কিংবা বৌদ্ধ ইতিহাসের সুপরিচিত নাম বিশাখার কথা। আমি লিখছি নারীর কথা, শিল্পের কথা, অতীত বাস্তবতার কথা আর শুধাবো বর্তমানের কথা।

কোথায় সভ্যতা? অসভ্য নিষাদদের মাঝেও তো নারীর স্বাধীনতা ছিল, ছিল বনময় চপলা হরিণীর মত ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা, শিকার করা পশুর মাংস ভক্ষনের উৎসবে নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠার স্বাধীনতা। সেটুকুই কি দিয়েছে আমাদের সভ্যতা? রাজপথে নির্ভয়ে চলার স্বাধীনতা কি আমরা দিয়েছি তাকে? স্বাধীনতা হরণেই কি সভ্যতার মাহাত্ম্য? বুদ্ধ নারীকে সন্যাসব্রতে গ্রহন করে দিয়েছিলেন পালিয়ে বাঁচার অধিকারটুকু। জীবনের অধিকারই যেখানে নেই, অ্যাধাত্মিক মুক্তি সেখানে পালিয়ে বাঁচার পথ ছাড়া আর কিইবা দিতে পারে? নারীর নিজের ঘর নেই, তার হাতে পায়ে সংসারের শিকল বাঁধতে না পারলে একালেও বাবা-মায়ের সম্মানটুকুও তো থাকে না। আজো নারী শ্বাস নেয় অন্তঃপুরে, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ভালবাসাও নয়, কেবল সন্তান জন্মদানে। আবেগ বা ভালবাসার মত মানবিক ব্যাপারগুলোকে সমাজ শেখেনি আজও মূল্য দিতে। বহুগামিতার মত ব্যাপারগুলো সামাজিক নৈতিকতার চোখ এড়িয়ে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, কিন্তু অবগুন্ঠিত স্ত্রীর বাধ্যসেবার দাবীতে ছাড় দিতে কেউই রাজি না। শিশুকাল থেকেই কন্যাকেও গড়ে তোলা হয়, নারী মানেই পতিভক্ত, সুকন্যা, সুগৃহিণী, সুমাতা। কিন্তু যে পাত্রে কন্যাদান করে নিশ্চিন্ত হতে চান বাবা-মা, তাকে জীবনসংগী হিসেবে গ্রহণ করতে সে চায় কিনা, সে প্রশ্ন করতে ভুলে যেতেও আপত্তি নেই আমাদের সভ্যসমাজের। ব্যাপারটা শুধু একতরফাভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রেই সত্যি না, সত্যি অনেক ছেলের ক্ষেত্রেও… বিয়ের মত ব্যাপারটা গুরুজনের পছন্দে করলেই হবে, জীবন যাদের তাদের কিসের এতো মাথা ব্যথা? গুরুজনেরা যা করেন তা তো ভালোর জন্যই করেন, তাই না? বিয়ে তো বিয়েই, পাত্র-পাত্রী তপেশ-মিলি না মহেশ-মিলি, ব্যাপার না সেটা। সন্তানের জন্য সংগী বাছাই করে দেবার গুরু দ্বায়িত্ব গুরুজনেরা নিয়েই খুশি, এর সাথে জড়িত অজস্র পারিবারিক-সামাজিক অস্থিরতার খবর রাখার দ্বায়িত্ব তাদের না। বিয়েটা ইচ্ছাই হচ্ছে না অনিচ্ছাই, কন্যা কিশোরী না বালিকা এইসব কোন ব্যাপারই না। প্রশ্ন শেষপর্যন্ত একটাই, এইভাবে বেধে দেয়া যুগলেরা কজন হয়ে ওঠে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-ভালোবাসার সংগী নাকি কেবলই যৌনসংগী? যে কিশোরী বুঝতেই পারেনি, তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে, ১২ হাত লম্বা লাল টুকটুকে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে স্কুলের বই ছেড়ে, কানামাছি ছেড়ে এখন তাকে সংসারে পা রাখতে হবে, তাকে হতে হবে আরেকটা জীবনের সংগী, এই অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় মানবতা কতখানি? মানুষ কি এইভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ভালবাসা-মায়া মমতার বদলে করে যাবে কেবল সামাজিক প্রথা আর যৌনতার পূজা?

আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যকলা শিখি, নাট্যতত্ত্ব পড়ি, কিন্তু নারীকে আজো নাচানো হয়। গণিকালয়ের বন্দীশালা থেকে শিল্প মুক্তি পেলেও নারী মুক্তি পায়নি পুরুষের লালসার বৃত্ত থেকে। রাস্তার পাশের বিলবোর্ড থেকে ঘর পর্যন্ত, নারী সর্বত্রই রমনীয়। নাচের মঞ্চে নারীকেই চাই, নারী তো অপ্সরী! নৃত্য শিল্প কিনা এ বিচার পরে, নারী যে রূপসী, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিজ্ঞাপনে নারীকেই চাই, নারী যে পণ্যের উপমা। অবগুন্ঠনের আড়ালেও নারীর রূপ যৌবনেরই খেলা। যে নারী আজ পিতৃগৃহে, পতিগৃহে বা ঘরের বাইরে নাচতে রাজি না হবে, তার জন্য আজ ভিক্ষুণীর জীবনের পথটুকুও খোলা নেই। যে খাদ্যে স্বাদ আছে, তা না চেখে নষ্ট করা যায়? তাই কি হয় নাকি? মেয়েমানুষ বলে কথা! এই মেয়েমানুষেরাই বা কতটুকু চায় মানুষ হতে? জীবন যে আরো অনেক অনেক সম্ভাবনার পথ, সে কি কোনদিন তাকে জানতে দেয়া হয়? আমাদের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া আছে, তিনি কি এখন নারী সংগ্রামের অর্জন নাকি পুরুষ শাষিত সমাজের অমানবিকতার অভিযোগ-মুক্তিতে ব্যবহৃত যুক্তির হাতিয়ার?

আড়াই হাজার বছর কেন, তারও আগেও পুরুষমানুষ পুরুষমানুষই ছিল, মেয়েমানুষ মেয়েমানুষই ছিল, মানব সমাজ আসলে এমনই শ্বাপদের জঙ্গল। মেয়েমানুষ বলে যারা আজ তাচ্ছিল্যের পাত্র, বৈষম্যের শিকার, তারা কতটা ঘৃণাভরে পুরুষের দিকে আঙ্গুল তুলছে, সে পুরুষেরা বুঝলে এটাও বুঝতো, “নারী” ও “পুরুষ”, মানব প্রজাতির দুইটি ভিন্ন লিংগ নির্দেশক শব্দ নয়, মানব মর্যাদাচ্যুত দুইটি তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত শব্দ! এইসব তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত লিঙ্গবাচক শব্দের অবমাননা থেকে মানবতা মুক্তি পাবে কবে?