কলেজ স্টেশনে আমাদের দীপঙ্করদা প্রায়ই বলেন, নৃপেন, তোমার হরর ফিল্মের মত জাপানের ঘটানাটা ওদেরকেও বলো। দীপঙ্করদা আর সুচন্দ্রাদি দুজনেই রিটাইয়ার্ড। সুমেরু আর কুমেরু শিখর এবং মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ ছাড়া পৃথিবীর হেন দেশ নাই ভ্রমণ করেননি। কত বিচিত্র মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, আশ্চর্যরকম ঘটনা প্রতিটি ভ্রমণের সাথে জড়িত। দেশে ফিরে চমকপ্রদ ঘটনাগুলো বলেন। কিন্তু আমার ঘটনাটির মত কোন হরিফিক ঘটনার সংস্পর্শে আসার দূর্ভাগ্য তাঁদের এখনও হয়নি। হয়ত মনের কোনে কোথাও ভীতি জমে গেছে। কবে কোন জায়গায় ভাগ্যদেবী তাঁদের প্রতিও রুষ্ট হবেন। তাই বলেন – ঘটনাটা ওদেরকেও বলো। নিজেরও বুঝিবা নতুন করে শুনতে ইচ্ছা করে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এতবড় বিপজ্জনক ঘটনাটি ঘটে গেল তিনি কিছুই জানলেন না। সাতাশ বছরেও না। শুধু প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি বিশ মিনিটের কথা বলে গেলেন, ফিরলেন দেড়ঘন্টা পড়ে। কী ব্যাপার! আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। তখন আমার কাছে বেশী জরুরী বিষয় ছিল কেউ আমাকে চিমটি কেটে বলুক আমি তখন ফিরে এসেছি। আমি তাঁর ছোট্ট প্রশ্নটির কোন উত্তর দিতে পারিনি। আশ্চর্য মানুষ বটে! তিনি দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করলেন না। সামান্য একটু কৌতুহলও হল না।
সাতাশ বছর পরে মানুষটির কিছুই মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু দীর্ঘ বছর পরে তাঁর ছোট্ট প্রশ্নের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আসল ঘটনাটি জানলে চোখদুটো নিশ্চয় ছানাবড়া হবে। কোন দৈনিক পত্রিকার ভিতরের পাতায় জ্যোতিষী “মহাজাতকের” ছবি দেখে যাকে মনে করে সব সময় চমকে উঠতাম, ইনি সেই আল্ভী ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, আবুল বক্র আল্ভী। একই ইন্সটিটিউটের আরও দুই অধ্যাপক মাহমুদুল হক এবং জামাল সাহেব সহ তিনি তখন জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করতে গেছেন। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আপার্টমেন্টে। আমি তখন আন্তর্জাতিক গবেষক হিসেবে একটি বিশেষ প্রকল্পে আমন্ত্রিত। আমার বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিআইপি গেস্ট হাউজে। সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ থেকে মার্চ ১৯৮৪।
সুকুবা নতুন শহর। সায়েন্স সিটি নামে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়টিও নতুন। টোকিও থেকে মাত্র ৬৭ কিলোমিটার দূরে। দেশে ফেরার আগে আমার স্ত্রী, মিনু এবং চার বছরের মেয়ে, ইয়েন এসে থাকবে কিছু দিন। আমার হোস্ট শিগেরু ওশিজাকী, প্রবীণ অধ্যাপক, টোকিওর বিশেষ বিশেষ জায়গা দেখার একটা লিস্ট দিলেন – পৃথিবীর প্রথম মনোরেইল, নতুন ডিজনীল্যান্ড, পরিখাবেস্টিত সম্রাট হিরোহিতোর রাজপ্রাসাদ, টোকিও টাওয়ার, ইত্যাদি। টোকিও শহরে জাপানিজ স্টাইলের এক হোটেলের টেলিফোন নম্বরও দিলেন। মেঝেতে নরম বিছানা। ওখানেই শুতে হবে। আগেই বুকিং দিতে হবে। হোটেলের মালিক মধ্যবয়েসী লোক। পৈত্রিক ব্যবসা। স্ত্রী তাকে সাহায্য করেন। কিন্তু বিপদ হল টেলিফোনে আমরা কেউ কাউকে বুঝতে পারছি না। তাই ভাবছি বাংলাদেশ থেকে ওরা আসার আগেই একদিন সশরীরে যেয়ে কথা বলতে হবে। তখন কথা না বুঝতে পারলেও চোখের ভাষা আর হাতের ঈশারায় কাজ সারা যাবে।
পৃথিবীতে হাতে গোনা বিরাট কয়েকটি লাইব্রেরীর মধ্যে টোকিওর কিনোকানিয়া লাইব্রেরী। শিঞ্জুকো রেলস্টেশনের কাছেই। আর্টের উপর একটা বিশেষ বই আল্ভীর দরকার। সেটি ওখানেই আছে। বললেন, চলুন ঘুরে আসি ওইকএন্ডে। বড় জোড় এক ঘন্টা লাগবে তারপর এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করা। ভারী সুযোগ। সাথী পাওয়া গেল। হোটেল বুকিংএর কাজটি করে ফেলা যাবে।
১৯৮৪ এর ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ। সুকুবা থেকে শুচিউরা শহর। বাসে দশ মিনিট। ছোট রেলস্টেশন। ওখান থেকে টোকিওতে ওয়েনো জংশন স্টেশন। তারপর সাবওয়ে ধরে শিঞ্জোকো। পায়ে হেটে কিনোকানিয়া লাইব্রেরী। আরামচে পৌছে গেলাম। আল্ভী ভাই বইটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি লাইব্রেরীর বিশালত্ব অনুভব করছি। তারপর ভাবলাম, ফ্রন্টডেস্ক থেকে ডাইরেকশনটা ভাল ভাবে জেনে হোটেলের কাজটা সেরে আসি। ফ্রন্টডেস্কে কাজ করছে লম্বা সুদর্শন বিশ-পচিশ বছরের এক জাপানী ছেলে। ওবুকো লাইনে দ্বিতীয় স্টপেজে নেমে হাটা দুরত্বে হোটেল। বিশ থেকে পচিশ মিনিটের ব্যাপার।
– সিমাছেন।
ডান দিকে মাথা ঘুরিয়েই দেখি এক জাপানী মহিলা আমাদের কথাবার্তায় ঢুকে পড়েছে। বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, ক্ষীনাঙ্গীনি। পড়নে কাল স্কার্ট, গায়ে ঘন সবুজ ব্লাউজ। ঘাড় পর্য্যন্ত ছাটা পরপাটি চুল। হাওয়ায় দুলছে। চেহারাখানা ভালই বলতে হবে। খানিক পরে ছেলেটি আমার দিকে ঘুরে বলল, ভালই হল। ইনি আসানো টাকাহারা। ওখানেই যাচ্ছেন, তুমি উনার সাথেই যেতে পার।
অহেতুক ঝামেলায় পড়ার ধাঁত আছে আমার। তারপরও মনে থাকে না সতর্ক হওয়ার ব্যাপারটা। এবারই প্রথম মনের মধ্যে এক ঝিলিক ভয় অনুভব করলাম। মনে মনে বললাম, ধুর ছাই। জাপানে আবার ভয় কিসের! এ কান্ট্রি উইথ লিস্ট ক্রাইম। বললাম, দাঁড়াও। আমার বন্ধুটিকে বলে আসি। আল্ভী ভাই মনোযোগ সহকারে পড়ে চলছেন। বললাম, দেখুন তো মহিলাটি উপজাযক হয়ে সাহায্য করতে চাচ্ছে। কোন অসুবিধা হবে না তো। আল্ভী ভাই যথেষ্ট কনফিডেন্স নিয়ে বললেন, জাপানে কারও অসুবিধা হয়েছে এমন কথা শুনেছেন? যান তো, ঘুরে আসেন। ততক্ষনে আমি আমার পড়াটা শেষ করি।
আসানো পোষাকে প্রফেশনাল। কথাতেও। বাড়তি একটি কথাও নয়। কবে জাপানে এসেছি, কতদিন থাকব, এইসব কথাবার্তা বলতে বলতে পায়ে হেটে আবার শিঞ্জুকো সাবওয়ে স্টেশনে পৌছে গেলাম। আমার টিকিট আমারই কেনাটা স্বাভাবিক। অন্ততঃ জাপানে এটাই সিস্টেম। কিন্তু আসানো আমাকে টিকিট কিনতে দিল না। দুটো টিকিট কিনে নিজের পার্সে রেখে দিল। এক মিনিটের মাথায় ট্রেন এসে দাঁড়াল। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। সিট নেই। তাই দুজনেই দাঁড়িয়েই থাকলাম। ছেলেটির হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয় স্টেশনে নামার কথা। কিন্তু আসানোর নামার কোন উদ্যোগ নেই। বললাম, আমরা নামলাম না যে? আসানো বলল – এখানে না। পরে।
একটা সিট খালি হল। আসানো বসে পড়ল শক্ত হয়ে। পরের স্টেশনেও নামার কোন লক্ষণ নেই।
বললাম – কখন নামব?
উত্তর – I don’t know English.
বলে কি মহিলা? এতক্ষন ইংরেজীতে কথা বলার পর ইংরেজীতেই বলছে – I don’t know English. আমার চোখে অন্ধকার। আমি কি একাই নেমে যাব? কিন্তু ওর কাছে যে টিকিট। বলি কী করে আমি সন্দেহ করি। তোমাকে আমার ভাল ঠেকছে না। আসানো স্বেচ্ছায় সাহায্য করছে। তাকে সন্দেহ করা চলে? কিন্তু আমার যে রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। আসানো পরের স্টেশনেও নামল না। তারপরেরটা এল, চলে গেল। আমি যাচ্ছিটা কোথায়? কথা বললেই বিরক্ত হচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে ত আছেন। আমার সাথে যেন তার কোন পরিচয়ই নেই। আড়চোখে আমাকে লক্ষ্যও করছে সেটা বুঝতে পারছি। আল্ভী নিশ্চয় এতক্ষনে লাইব্রেরীর বাইরে এসে পায়চারি করছেন আর তাকিয়ে আছেন আমার জন্য। কিন্তু আমি তো জানি না আমি কোন নরকে যাচ্ছি। তাকে জানানোর কোন পথও খোলা নেই। তখন সেলফোন ছিল না যে জানাই আমার বেহাল অবস্থাটা।
আমি এখন আসানোর হাতের পুতুল। ওর ইচ্ছে না হলে আমার মুক্তি নেই। আসানো নিশ্চয় আমাকে মেরে ফেলবে না। ছেড়ে তো দেবেই। কিন্তু কখন? এর শেষ কোথায় সেটা দেখার ইচ্ছেটাও সম্বরণ করতে পারছিনা।
ছেলেটির হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয় স্টেশনে নামার কথা ছিল। স্টেশন ছয় গেল, সাত গেল। অবশেষে অস্টম স্টেশনে এসে আসানো বলল – নামো এখানে।
টোকিও শহর আর শহরতলী ছেড়ে একেবারে বাইরে চলে এসেছি। সাবওয়ে থেকে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে নাকি ঢালু বেয়ে উপরে উঠে এলাম মনে নেই। সূর্য ডুবে গেছে বেশ খানিকক্ষন আগেই। রাস্তায় আলো নেই। আশেপাশের ঘর থেকে যে আলো বাইরে পড়ছে সেই আলোতেই বুঝা যাচ্ছে টোকিও শহরের জৌলুশ এখানে নেই। দু পাশে সবই একতলা কি দুতলা বাড়ীঘর। মিনিট খানেক হেটেই আসানো ডানে মোড় নিল। গজ পঁচিশেক পরেই হাতের ডাইনে পাঁচ-ছয় তলা উঁচু দালান। এত উঁচু দালান এ অঞ্চলে মাত্র একটিই। আসানো কলিং বেল টিপল। বিশ-বাইশ বছরের ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত একটি ছেলে এসে দরজা খুলে দিল। দরজা দিয়ে ঢুকেই জুতা খুলার জন্য এক চিলতে জায়গা। তারপরই প্রায় পনের ইঞ্চি উচুতে মেঝে শুরু। দুপাশে দেওয়াল ঘেঁসে জুতা এবং চপ্পল রাখার র্যা ক। ছেলেটি এক জোড়া চপ্পল এনে আমার সামনে মেঝেতে রাখল। আমি জুতা ছেড়ে মেঝে উঠে চপ্পল পড়লাম। ছেলেটি নীচ থেকে আমার জুতা জোড়া তুলে র্যা কে রেখে দিল। সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। বামপাশটা প্রশস্ত হয় আরো ভিতরে ঢুকে গেছে। সেখানে আট কি দশ সিটের একটি ডাইনিং টেবিল পুবে-পশ্চিমে বিস্তৃত। আসানো দক্ষিনে মুখ করে বসল। আমাকে ইংগিতে তার বাম পাশে বসতে বলল। ছেলেটি দুকাপ গ্রীন টী আমাদের সামনে রেখে উধাও হয়ে গেল। আসানো বলল – খাও।
কে জানে গ্রিন টিতে কী মিশিয়ে দিয়েছে। হয়তো এটি খেলেই আমার চেতনা শক্তি চলে যাবে। সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ব। তারপর কী হবে আমি কিছুই আর জানতে পারব না। আমার ইচ্ছার মৃত্যু হয়ে গেছে। আমি শেষ। আসানোদের আসল খেলা সবে শুরু। আসানো গ্রীন টী খাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি।
আসানো আবার বলল – খাচ্ছ না কেন? খাও।
আমি ভয়ে ভয়ে জিহবার ডগায় একটু লাগিয়ে দেখলাম। শুধু গ্রীন টীই মনে হল। তবু খেতে সাহস হল না। আসানো বুঝে গেছে আমি ভয় পেয়ে গেছি। তাই আর জোড় করল না। বলল – বল, হা রে রে…
জিজ্ঞেস করলাম – কেন?
উত্তর – This is for world peace.
পাশের ঘর থেকে এক জোড়া গলায় হা রে রে… এর শব্দ শুনা যাচ্ছে। বুঝলাম – আমি একা নই। আরও একজনকে ধরে আনা হয়েছে। আমিও তখন ওর সাথে গলা মিলিয়ে বার কয়েক হা রে রে… বললাম।
আসানো খুশী হল বলে মনে হল না। বলল – চলো আমরা পেছনের ঘরে যাই।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে বিল্ডিংটির একেবারে পেছনে গেলাম। সারা পেছনটায় অনেক গুলো দরজা। তার একটা খুলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট রুম। র্যা কে ভাঁজ করা পরিষ্কার কাপড় চোপড়। একটা সাদা গাউন টেনে বের করল। বলল – তোমার সব কাপড়-চোপড় এখানে রেখে এটা পড়। আর এই বেল্ট মত এটা পেছন থেকে এনে সামনে বেঁধে ফেল। পাশের ঘরে আমিও আমার কাপড় বদলাচ্ছি। তোমার শেষ হলে বাইরে এসে দাঁড়িও।
পাশে একজনের শোয়ার মত একটা বিছানা। সেখানে আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় রেখে আসানোর নির্দেশিত কাপড় পড়ে বাইরে এসে দেখি আসানো আমার জন্য খালি পায়ে অপেক্ষা করছে। বাইরেটাতে মার্বেল পাথর বিছানো। খালি পায়ে প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। দিন কয়েক আগে পড়া বরফ গলে গেছে। তাই ঠান্ডাটা বেশী। তার উপর বাতাস। বিল্ডিংটার পাশ ঘেঁসে দক্ষিন-পশ্চিম কোনায় একটি প্রকান্ড চৌবাচ্চার উচু জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। সাজ-সজ্জায় এটিকে ছোট সুইমিং পুলও বলা যায়। দৈর্ঘ-প্রস্থে প্রায় ৬ – ৪ ফুট। এক বুক গভীর ক্লোরিনেটেড জল। স্বচ্ছ। নীচ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়।
আসানো বলল – আমরা এখানে মাথা ডুবিয়ে বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করব। চল।
আমার মনে হল, এখানে মাথা ডুবিয়ে আসানো আমাকে দম বন্ধ করে মেরে ফেলবে। আমি বললাম, এই শীতে আমি জল স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারব না। খালি পায়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। তুমি আমাকে মাফ কর। ছেড়ে দাও।
আসানো ভিতর থেকে একটা লোককে ডাকল। হিস্প্যানিকদের মত গাট্টা-গোট্টা এক জাপানী বেরিয়ে এল। হাতে একখানা সাদা টাওয়েল। আমার পায়ের নীচে বিছিয়ে দিয়ে চলে গেল। আসানো জলের দিকে এক স্টেপ নীচে। আমার ডান হাত ধরে সজোড়ে টানছে। আমিও প্রানপণে ছুটার চেষ্টা করছি।
আসানোর একার পক্ষে সম্ভব নয় আমাকে জোড় করে জলে নামায়। তাই লোকটাকে আবার ডাকল তাড়াতাড়ি আসার জন্য। ওরা দুজনে দুই হাত ধরে টেনে কুমীরের মত আমাকে জলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচার কোন পথ রইল না। এক মূহুর্ত পরে আমার কী হবে ভাবার সময় নেই। তারস্বরে কি চিৎকার করব? সর্বশেষ অস্ত্র “বাঁচাও – বাঁচাও” চিৎকার ছাড়া উপায় কী? বললাম – তোমরা জাপানীজ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। শীতে আমার সমস্যা আছে। মারাও যেতে পারি। আজ ছেড়ে দাও। সামারে আমি নিজেই আসব। অন্যথায় আমি ভীষণ জোড়ে চিৎকার করব। চিৎকার এবং ধস্তাধস্তির শব্দে আশেপাশের বাড়ী থেকে লোকজন বেরিয়ে আসবেই। এটি তোমাদের জন্য নিশ্চয়ই সুখকর হবে না।
মন্ত্রের মত আমার থ্রেট কাজে লাগল। ওরা কী বলাবলি করল, বুঝলাম না। তবে লোকটি ভেতরে চলে গেল। আসানো বিল্ডিং এর পেছনের কক্ষটায় আমাকে নিয়ে এল। ওদের কাপড় ছেড়ে নিজের কাপড় পড়ে বাইরে এলাম। ওর মুখে এখন একেবারেই কথা নেই। এত কিছুর পরেও ওর প্রশংসা করতে হয়। আমাকে সাবওয়ে স্টেশনে নিয়ে এল। টিকিট কাউন্টারটা দেখিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
অকস্মাৎ যেন ঘুম ভেঙ্গে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রক্ষা পেলাম। তাড়াতাড়ি টিকিট নিয়ে কিনুকানিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। এসে দেখি লাইব্রেরীর নীচে আল্ভী ভাই পায়চারী করছেন। শুধু বললেন – এত দেরী হল যে!
আমরা শিঞ্জুকো রেল স্টেশনের দিকে হাটতে শুরু করলাম। আসানোরা আসলে যে কী, তা রহস্যাবৃতই রয়ে গেল।
মডারেশন নিয়ে আপনার অভিযোগের লেখাটা দেখছি না। ওটা লাপাত্তা কেন? আপনি কি মুছে দিয়েছেন?
আর নৃপেনদা, এভাবে লেখা প্রকাশ করার পর আর সবাই এতোগুলো মন্তব্য করার পর এভাবে লেখা মুছে দেয়া কি সত্যই উচিৎ? এটা তো যারা আপনার লেখায় সময় নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তাদের অভিমত জানিয়েছেন, তাদের প্রতিও কিন্তু অবিচার করা হয়।
আর শুধু আপনার বিষয়ের উপরেই নয়, ব্লগার ধ্রুব (রূপম) মুক্তমনার মোবাইল এপ্লিকেশনের উপরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিডব্যাক ছিলো। তিনি বলেছিলেন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চমৎকার কাজ করছে। আমি তাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম সেখানে। আপনার এই লেখা মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে সেটা জানাও আর করা সম্ভব হচ্ছে না।
এনিওয়ে আপনার অভিরুচি – একান্তই কোন লেখা রাখবেন, আর কোন লেখা মুছবেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, মুক্তমনা ব্লগ উদার বলেই এটি আপনি করতে পারলেন, ডিলিট অপশনের উপর কড়াকড়ি আরোপ করলে এটা হত না। কড়াকড়ি করলে আবার ‘বেত নিয়ে দৌড়ানোর’ অভিযোগ আনেন।
@অভিজিৎ,
আমি ভাবলাম, আকাশ মালিকের পরামর্শটা ভাল (গতকাল রাত আনুমানিক নয়টা)। তাই মুছে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয় মনে করলাম। মুছে দিতে চেষ্টা করেও পারিনি। তাই এডমিনের সাহায্য চাইলাম। আমার নিজেরও পোষ্টটা নিয়ে বিশ্রী লাগছিল। ভোর বেলা দেখি পোষ্টটা তখনও আছে। মাথায় বুদ্ধি এল। ‘মুছো’ বাটন কাজ না করলে পুরো পেজটা ব্ল্যাঙ্ক করে রিপোষ্ট করলে পোষ্টটি চলে যাবে। তাই করলাম। তারপর দেখলাম – ট্র্যাশ বাটন। সেটাই ব্যবহার করলাম। এতে করে মন্তব্যগোলো মুছে যাবে ভাবতে পারিনি। হয়ত ধীরে সুস্থে করা উচিৎ ছিল। আমি দুঃখিত।
আপনার এই পোষ্টটি দেখে মনে হচ্ছে আর একটা ভুল করলাম। এডমিনদের ওভার-রাইট করার থাকলে করে ফেলুন দয়া করে।
রূদ্ধশ্বাসে পড়লাম। :guli:
পরীক্ষা চলছিল বলে অনেকদিন মুক্তমনায় ঢুকিনি। এখন ঢুকেই ব্যাপক চমক খাইলাম! সাইটের চেহারা দেখি অনেকটাই চেঞ্জ হয়েছে। ভালো লাগলো পরিবর্তনগুলো। নতুন স্মাইলি গুলোও দেখতে ভালো হয়েছে।
সাবলীল হাতের লেখায় একদম গল্পের মত মনে হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ চমৎকার এই অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
@সাইফুল ইসলাম,
ভাল লাগছে জেনে ভাল লাগল।
আফসোস থেকে গেল আলভী ভাইএর সাথে শেয়ার করতে পারলাম না।
নৃপেন্দ্র সরকার;
আপনার অভিজ্ঞতা খুব অভিনব। আমি এই সুন্দরী জাপানি মেয়ের একা খপ্পরে পোড়লে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতাম।
তা আপনি ঐ সুন্দরীর টেলিফোন নম্বরটা নিলেন না কেন? পরে যোগাযোগ করে দেখতে পারতেন!
@আবুল কাশেম,
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি – আবার টেলিফোন!
গল্পটি পড়ে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, বিশেষ করে গল্পের পটভূমি যখন আমার পরিচিত কিছু জায়গাকে ঘিরে। :clap
এতদিন হয়ে গেছে, খুঁটিনাটি অনেক কিছুই ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এতে আপনার দোষের কিছু অবশ্যই দেখছি না। তবে, রচনার সংগতির স্বার্থেই (এবং পণ্ডিতি করার লোভ সামলাতে না পেরে) কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দিচ্ছি। মহিলা আপনাকে ‘সিমাছেন’ নয়, ‘সুমিমাসেন’ বলেছিলেন। শিনজুকু এবং কিনোকুনিয়া অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি উচ্চারণ।
আপনার লেখার জন্য ধন্যবাদ। এখন থেকে শিনজুকু গেলে সাবধানে থাকব। :guli: এমনিতেই, আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় একটু ভয়ে ভয়ে থাকি, একবার এক জাপানিজ ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করার আগে আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পরে নিজে লাফ দিয়েছিল, ‘ভাই, মরলে মর, আমারে ক্যান?’ 😕
আগে প্রচুর জাপানী এনিমেশন বা আনিমে(anime) দেখতাম, সেগুলো দেখে মনে হয়েছিল ওদের মাথার স্ক্রুটা মনে হয় একটু ঢিলা 😛 আপনাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, আমি নিশ্চিত তারা জাপানের অসংখ্য কাল্টের মধ্যে কোন একটা হয়ত ছিল।
জাপানীরা ডাকাতী-অপহরণ করার মত হিংস্র না, খুন করার তো প্রশ্নই আসে না।
@পৃথিবী,
অবশ্যই
রোমহর্ষক ঘটনা। সেবা প্রকাশনীর রহস্য গল্পের মত। (Y)
ঘটনাটি সত্যি ভয়ের। রহস্যময় ঘটনাটির পিছনে কারনটা কি ছিল জানতে বড়ই কৌতুহল হচ্ছে। তবে কোন মন্তব্য পড়ে মনে হলোনা এই বিষয়ে কারো কিছু জানা আছে। যাই হউক রহস্য গল্প পড়ার মতো বেশ মজা পাওয়া গেলো।
@ব্রাইট স্মাইল্,
জাপানে থাকাকালীন সময়ে শুধু কিকুচীকে বলেছিলাম ঘটনাটা। বাইসাইকেলের দোকানদার। বয়স ৩৩ বছর। মেকানিক্যাল ইঞ্জীনিয়ার। চাকুরী পছন্দ নয়। বাইসাইকেল বেচা স্বাধীন ব্যবসা। ক্রেজী! প্রায় প্রতিদিনই ওর সাথে আড্ডা দিতাম। সব শুনে বলল – ওটা একটা কাল্ট হবে।
মুক্তমনার আপডেটের কাজে এ কদিন ব্যস্ত থাকায় কিছু লেখা রয়ে সয়ে পড়ার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে পস্তাইনি। মোটামুটি এই জায়গা থেকেই রক্ত হিম হয়ে যেতে শুরু করেছিল-
তারপর আপনার উপর যা ঘটল তা রীতিমতো থ্রিলারকেও হার মানায়। আপনি যেভাবে বেঁচে ফিরেছেন তা সত্যই বিস্ময়কর!
@অভিজিৎ,
সত্যি তাই। ফিরতে পারার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আপনাকে মরণপ্রান্তিক একটা ঘটনার কথা লিখেছিলাম। এটাও অনেকটা সেরকম।
আমার তো থ্রিলিং লাগছে… ইস, আমি যদি থাকতাম আপনার জায়গায়!
প্রথমে ভেবেছিলাম গল্প। বিভাগ দেখে নিশ্চিত হলাম , যদিও সত্যি ভাবতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।
@ফারুক,
আপনার মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে আপনার সত্যই ভাল লেগেছে।
কখন কোন বিপদ আসে আমরা কেউ জানি না। জাপান ভ্রমণ ভীতিপূর্ণ হবে বিধায় আমার স্ত্রীকে ঘটনাটি তখন বলিনি। বলেছিলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে।
@নৃপেন্দ্র সরকার,ভাল তো অবশ্যই লেগেছে। আপনাকে ধন্যবাদ এমন থ্রিলিং স্মৃতিচারন শেয়ার করার জন্য।
মানুষ অপহরন করে বিশ্ব শান্তির প্রতিষ্ঠার এই জাপানী উপায় খুবই আজব। ভবিষ্যতে কখনো জাপান গেলে আগে এই কথা মাথায় রাখবো।
চিনে জাপানীরা শুনি যা পায় তাই খায়…তাই এক পর্যায়ে সন্দেহ হচ্ছিল…
এই গল্পের আলভী নিশ্চয়ই ৭১ সালে রুমি-বদি গ্রুপের আলভী, যাক সে রাতে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছিল?
@আদিল মাহমুদ,
আল্ভী ভাইকে আমি আর্টস ইনস্টিউটের অধ্যাপক হিসেবেই চিনি সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে। তিনি কোন সাতে-পাঁচে থাকার মত লোক নন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
খুব বড় ভুল না হলে উনি ৭১ সালে ভালই সাতে- পাঁচে ছিলেন। ক্র্যাক প্ল্যাটুন গেরিলা দলের সদস্য ছিলেন। ওনাকে ধরে ভয়াবহ টর্চার করা হয়েছিল।
@আদিল মাহমুদ,
আমার ঐ সময়টা কেটেছে ময়মনসিংহে। ওখানে অনেক কিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত থাকতাম।
আপনার তথ্যের উপর পূর্ণ আস্থা আছে। আল্ভী ভাইকে কৌতুহলহীন স্বল্পভাষী হিসেবেই চিনতাম। মুখ থেকে কথা বেরোতোই না।
ধন্যবাদ আপনার সময়ের জন্য।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
ওনার বেঁচে আসা মোটামুটি অলৌকিক ব্যাপার। ওনাদের গ্রুপের ২/৩ জন ছাড়া আর কেউই বাঁচেনি।
ওনাদের সেলে ভরার দুদিন পর মনে হয় ওনার নাম জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন আবুল বারাক, আলভী আর বলেননি। পাকরা চিনত আলভী নামে। অনেকটা ভুলক্রমেই তাকে ছেড়ে দেয়। তবে বেদম মার খান, এখনো সেই ব্যাথা মাঝে মাঝে আসে বলে একটা লেখায় পড়েছিলাম।
জাহানারা ইমামের ৭১ এর দিনগুলিতে ওনার কথা আছে।
ভয়ংকর কাহিনী শোনালেন। আপনি যে জলজ্যান্ত ফিরে এসেছেন, এতে আপনার মত আমিও বিস্মিত 🙂
বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় মহিলাটার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে আপনি অন্যভাবে নিয়েছেন :D।
আমারো।
দাদা, পরে কি কোন খোঁজ নেননি ?
চমৎকার থ্রিলার টাইপ কাহিনি, থ্রিল, ভয়, রহস্য সবই আছে…এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম…তবে আমারো আগ্রহ হচ্ছে আসানোদের কাহিনি জানতে…
@লীনা রহমান,
আসানোদের রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি। কিকুচি নামে আমার এক বন্ধুকে ব্যাপারটি বলেছিলাম। তার আন্দাজ এটি একটি কাল্ট জাতীয় কিছু।
আপনার কোন একটা লেখা পড়ে মনে হয়েছিল আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্ত। একটা কপি আল্ভী ভাইকে দিতে পারলে বাধিত হব। তার জন্য আগাম ধন্যবাদ।
@নৃপেন্দ্র সরকার, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্সে পড়ি।এই লেখাটার কপি দেবার কথা বলছেন?
@লীনা রহমান,
হ্যাঁ।
আগাম ধন্যবাদ আবারো। (Y)
@নৃপেন্দ্র সরকার, ওনার কন্টাক্ট ন্নাম্বার পাঠিয়ে দেন ই-বার্তায়, ওনার মেইলে পাঠিয়ে দিলেই তো কাজ হয়ে যায়, যোগাযোগ আছে না উনার সাথে? নাকি চারুকলায় গিয়ে খুজে বের করতে হবে?
@লীনা রহমান,
জাপান থেকে ফেরার পরে আর কোন যোগাযোগ নেই।
দরকার নেই খুজে বের করার।
পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করা আর কি? উনারও নিশ্চয় ভাল লাগত। সেই জন্যই।
ধন্যবাদ, any way.
অনেকদিন পর আপনার সুন্দর একখানা লেখা দারুণ উপভোগ করলাম। মাঝে মাঝে এমন করে আমাদের লেখা দিয়ে আনন্দ দেবেন আশা রাখি।
@আফরোজা আলম,
মাঝখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বংগ ঘুরে এলাম। আপনাদেরকে মিস করেছি।
অনেকদিন পর একটি ভাল আখ্যান নিয়েই আসলেন দাদা। আসানোর বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থণা অভিনব এবং বিদেশীদের জন্য ভয়ংকর হলেও এটাই হয়ত তাদের জন্য স্বাভাবিক। যার জন্য আসানোর বিশ্ব শান্তি কামনা তার মৃত্যু হয়ত বা এমননি শীতের রাতে জলে ডুবে হয়েছিল। তাই তার এ অভিনব কৌশলে প্রার্থণা। কে জানে? আমি আমার কল্পনা শক্তি যথাসাধ্য প্রয়োগ করলাম আপনাকে ভীতিমুক্ত করতে।
অভিজ্ঞতাটি ভাল লাগল।
@গীতা দাস,
এরকম অভিজ্ঞতা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ধন্যবাদ ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
ইশশ! আগে জানলে ফোন নং দিয়ে রাখতাম। এইবার এলে যোগাযোগ না করলে খুব মন খারাপ হবে দাদা।
থ্রিল থ্রিল ভাবের ভ্রমণকাহিনী। সে সাথে রক্তের চাপও ছিল। জাপানী মহিলা, গ্রীন টি, বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনার নিমিত্তে পানিতে নামা এগুলোতে একটার পর একটা ভয়ের আভাস। সব মিলিয়ে চমৎকার লাগলো।