টমাস পেইনের পরে এবার ধ্রুপদী উদারপন্থার আরেকজন প্রতিনিধির লেখা উপস্থাপন করছি। ভদ্রলোকের নাম ফ্রেডরিক হায়েক। হায়েক বিংশ শতাব্দীতে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে খ্যাতিমান সমর্থকদের একজন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হলেও জনমানসে হায়েকের পরিচিতি “দাসত্বের পথ” বইটির জন্য। এ বিতর্কিত বইয়ের মূল দাবি হল কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অবধারিত ভাবে tyranny-র জন্ম দেবে।

ষাটের দশকে লেখা Why I am not a conservative প্রবন্ধটি সংক্ষিপ্ততর, ২ বা ৩ ভাগে প্রকাশ করে ফেলতে পারার কথা। প্রবন্ধের কিছু বিষয় ওই বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা যা এসময়ে প্রযোজ্য নয়, তবে তারপরও এ লেখাটি থেকে হায়েকের মূল দর্শনের একটি ভাল পরিচয় পাঠকের পাওয়ার কথা। হায়েকের এই লেখাটি শেষ হলে অন্যান্য রাজনৈতিক দর্শনের কিছু লেখাও অনুবাদের ইচ্ছা আছে।

অনুবাদের ব্যাকরণ ও ভাষা সম্বন্ধে মতামত বিশেষভাবে কাম্য।

আমি কেন রক্ষণশীল নই ২
আমি কেন রক্ষণশীল নই ৩

“স্বাধীনতার অকৃত্রিম বন্ধু সর্বকালেই সীমিত। কাজেই যখন স্বাধীনতার জয় হয়েছে, তখন তা ঘটেছে সংখ্যালঘুদের অবদানে। যেহেতু স্বাধীনতাকামীরা সংখ্যায় কম, তাই বিজয় অর্জনের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্যের শক্তির সাথে তাদের সহযোগিতা করতে হয়। এধরণের সহযোগিতা সবসময়ই বিপজ্জনক, কিছু ক্ষেত্রে সর্বনাশা, কারণ এই আপস বিপক্ষের হাতে তুলে দেয় বিরোধিতার যুক্তিযুক্ত কারণ।” — লর্ড অ্যাকটন[*]

১।
আজকের দিনে প্রগতিশীল বলে পরিচিত আন্দোলনগুলি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ক্রমশ খর্ব করার পক্ষপাতী[]। এমতাবস্থায় স্বাধীনতাপ্রেমীরা এই প্রবণতার বিরোধী হিসেবেই দাঁড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা প্রায়ই নিজেদের দেখতে পায় এমন একটি শক্তির সঙ্গী হিসেবে, যেটি কিনা মজ্জাগতভাবেই পরিবর্তন-বিরোধী। তারপরও বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে রক্ষণশীল দলগুলোকে সমর্থন করা ছাড়া অনেক সময়ই তাদের উপায় থাকেনা। ফলে স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বনকারীদরকেও অনেক সময় “রক্ষণশীল” বলে বর্ণনা করা হয়, যদিও রক্ষণশীলতা বলে যাকে সঙ্গতকারণেই ডাকা হয় তার সাথে তাদের মিল সামান্যই। সত্যিকারের রক্ষণশীল আর স্বাধীনতাবাদী “রক্ষণশীল” — এ দুই পক্ষ একটি সাধারণ শত্রুর বিরূদ্ধে এক হতে গিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কাজেই আমার নিজের স্বাধীনতা-কেন্দ্রিক অবস্থানকে সত্যিকারের রক্ষণশীলতা থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করার প্রয়োজন বোধ করছি।

সত্যিকারের রক্ষণশীলতা হচ্ছে একটি বহুবিস্তৃত, বৈধ, এবং সম্ভবত প্রয়োজনীয় প্রবণতা, যার মূল কাজ হল আকস্মিক পরিবর্তনের বিরোধিতা করা। ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকে গত দেড়শ বছরে ইউরোপের রাজনীতিতে এই প্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সমাজতন্ত্রের উত্থানের আগে পর্যন্ত রক্ষণশীলতার বিপক্ষ ছিল উদারপন্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই দ্বন্দটি ঠিক এভাবে ঘটেনি, কারণ ইউরোপে যাকে “উদারপন্থা” বলা হত এখানে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) সেটিই ছিল রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ভিত্তিভূমি, কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে লোক ঐতিহ্যকে অপরিবর্তিত রাখার পক্ষপাতী সে ইউরোপীয় অর্থে উদারপন্থী[]। ইউরোপীয় ধাঁচের খাঁটি রক্ষণশীলতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করার ফলে ইদানিং এই বিভ্রান্তি আরো জটিল রূপ ধারণ করেছে, এবং এই রক্ষণশীলতা অপরিচিত মার্কিন ভূমিতে কিছুটা অদ্ভুত একটি রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে, এর কিছুদিন আগে থেকেই মার্কিন র্যাডিকাল ও সমাজবাদীরা নিজেদের “উদারপন্থী” বলে ডাকা শুরু করেছে। এসব বিভ্রান্তি সত্বেও আমি আপাতত আমার অবস্থানকে উদারপন্থা বলব, যেটা আমার মতে খাঁটি রক্ষণশীলতা এবং সমাজতন্ত্র, দুটি থেকেই ভিন্ন। আগেই বলে নিই, এটা আমি করছি বেশ একটু দ্বিধা নিয়ে, এবং পরে আমাকে ভাবতে হবে স্বাধীনতার পার্টির আসলে কি নাম নেয়া উচিত। এই দ্বিধার একটা কারণ উদারপন্থা নিয়ে বিরাট মার্কিন বিভ্রান্তি, কিন্তু আরেকটা কারণ ইউরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যেখানে যুক্তিবাদী উদারপন্থার সবচেয়ে প্রভাবশালী রূপটি দীর্ঘদিন যাবৎই সমাজতন্ত্রের অগ্রপথিক।

আমার মতে, সত্যিকারের রক্ষণশীলতার বিরূদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিটি এরকম: তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই রক্ষণশীলতা সমাজের বর্তমান গতিপথের কোন বিকল্পের হদিস দিতে পারেনা। পরিবর্তনের বর্তমান প্রবণতার বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে ক্ষতিকর পরিবর্তনগুলিকে এটা কিছুটা ধীর করতে পারে বটে, কিন্তু ভিন্ন প্রস্তাবের অভাবে এগুলিকে বন্ধ করে দিতে পারে না। ফলে অপছন্দের পথ ধরে অনিচ্ছা সত্বেও ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে এগিয়ে যাওয়াই রক্ষণশীলতার ললাট লিখন। প্রগতিশীল ও রক্ষণশীলদের মধ্যে দড়ি টানাটানি তাই পরিবর্তনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু পথ-বদল ঘটাতে পারে না। যদিও এই “প্রগতি-গাড়ির ব্রেক”[] এর প্রয়োজন আছে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র ব্রেক হিসেবে কাজ করে যেতে নারাজ। একজন উদারপন্থীর প্রথম দায়িত্ব আমরা কত জোরে যাব বা কত দূরে যাব সেটা নির্ধারণ করা নয়, বরং আমরা কোথায় যাব সেটি বের করা। এ ব্যাপারে সমষ্টিবাদী র্যাডিকালদের সাথে রক্ষণশীলদের যতটুকু পার্থক্য, সমষ্টিবাদের সাথে উদারপন্থার পার্থক্য তার তুলনায় অনেক বেশি। রক্ষণশীলেরা এসময়ের প্রবণতাগুলোর একটি মধ্যপন্থী ও নরম রূপ ধারণ করে, তুলনায় উদারপন্থীকে হতে হবে রক্ষণশীল ও সমাজতন্ত্রীদের সাধারণ প্রবণতাগুলির সুস্পষ্ট বিরোধিতাকারী।

২।
এই তিন দলের আপেক্ষিক অবস্থান সম্বন্ধে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা বিভ্রান্তিকর। প্রচলিত ধারণায় এই অবস্থানগুলিকে একটি সরলরেখা বরাবর অবস্থিত বলে মনে করা হয়, যেখানে উদারপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক আর রক্ষণশীলদের মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করে। এই ধারণা হাস্যকর রকমের ভুল। ছবি যদি আঁকতেই হয়, সেটি হতে হবে একটি ত্রিভূজের, যার তিন কোণায় তিন দলের অবস্থান। কিন্তু যেহেতু সমাজতন্ত্রীরা তাদের কোণটির দিকে সজোরে টেনে চলেছে বাকি সবাইকে, রক্ষণশীলেরা তাদের স্বভাবমতে ধীরে ধীরে সেদিকেই এগিয়ে চলেছে, উদারপন্থী কোণের দিকে নয়। শুধু তাই নয়, আগে যেসব মতামত র্যাডিকাল ছিল, কিছুদিন পরপর তারা সেগুলিকে সম্মানীয় রক্ষণশীল অবস্থান হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছে। সমাজতন্ত্রের সাথে নিয়মিত আপস করে তাদের অবস্থানগুলিকে নিজেদের করে নিয়েছে রক্ষণশীলেরা। মধ্যপন্থার এই ওকালতকারীরা[] মনে করে সত্যের অবস্থান দুই চরমের মাঝামাঝি কোথাও অবস্থিত, কাজেই যখনই অপর পক্ষগুলির কোনটা চরমপন্থী অবস্থান ধারণ করে, তখনই এরাও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে বসে।

যে অবস্থানকে সঙ্গত ভাবেই রক্ষণশীল বলা হয়, সেটি তাই নির্ভর করে বিদ্যমান প্রবণতাগুলি কোনমুখী, তার উপর। যেহেতু ইদানিং সমাজতান্ত্রিক প্রবণতাই শক্তিশালী, কাজেই এমন মনে হতে পারে যে রক্ষণশীল ও উদারপন্থীরা মূলত এই প্রবণতাকে রোধ করার চেষ্টাতেই ব্যস্ত। কিন্তু উদারপন্থা স্থির হয়ে বসে থাকতে চায় না, সে যেতে চায় অন্য কোথাও। উদারপন্থাকে কিছুটা রক্ষণশীল শক্তি মনে করার একটা কারণ হতে পারে যে একটা সময়ে উদারপন্থা বেশ জনপ্রিয় এবং সফল একটি মতবাদ ছিল। কিন্তু তৎসত্বেও এটি পশ্চাৎমুখী কোন দর্শন নয়। উদারপন্থীরা সামাজিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির পরিবর্তন ও উন্নয়নে কখনই অনাগ্রহী ছিল না — এবং যখনই স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে রূদ্ধ হয়েছে, তখনই তারা সরকারি নীতির পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। আজকের দিনের সরকারি আচরণের কথা যদি ওঠে, তাহলে কোন উদারপন্থীই চাইবে না বিদ্যমান পরিস্থিিতকে অপরিবির্তিত রাখতে। বরং তাদের এটাই মনে হবে যে পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাতেই যেটা দরকার সেটা হল মুক্ত প্রবৃদ্ধির পথের বাধাগুলি সমূল দূরীকরণ।

আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে রক্ষা করা সম্ভব, এটা সত্যি হলেও এর মানে এই নয় যে রক্ষণশীল আর উদারপন্থীদের মধ্যে কোন পার্থক্য রইল না। উদারপন্থী এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে সমর্থন করে এরা পুরোনো বলে নয়, বা মার্কিন বলেও নয়, বরং এই কারণে যে এগুলি তার নিজের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৩.
উদারপন্থার সাথে রক্ষণশীলতার মূল পার্থক্যগুলি বর্ণনা করবার আগে একটা কথা বলা প্রয়োজন। রক্ষণশীল লেখকদের কারো কারো কাছ থেকে উদারপন্থীদের অনেক কিছু শেখবার আছে। দীর্ঘদীন ধরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলির বিষয়ে তাঁদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আলোচনাগুলি গভীর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী, যেগুলি থেকে মুক্ত সমাজ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানা সম্ভব (অন্তত অর্থনীতির বাইরের বিষয়গুলোতে)। কোলরিজ, বোনাল, দ্য মেস্ত্র, য়ুসটুস মোসের বা ডোনোসো কোরতেস এর রাজনীতি যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক না কেন — ভাষা, আইন, নৈতিকতার মত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব তাঁদের জানা ছিল, এবং এই গুরুত্ববোধ উদারপন্থীদেরও থাকলে মন্দ হয় না। কিন্তু মুক্ত, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের প্রতি রক্ষণশীলদের শ্রদ্ধা শুধু মাত্র অতীতের প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য সংরক্ষিত। আজকের দিনে একই ভাবে যেসব স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন ঘটছে — যেগুলি থেকে কিনা ভবিষ্যতের মানব-কর্মযজ্ঞের হাতিয়ার গুলি বেরিয়ে আসবে — সেগুলিকে গ্রহণ করবার ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ বেশ খানিকটাই কম।

রক্ষণশীল ও উদারপন্থী মনোভাবের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্যের সূত্র উপরের আলোচনা থেকে পাওয়া যায়। রক্ষণশীল লেখকেরা নিজেরাই স্বীকার করে থাকেন যে তাঁদের মনোভাবের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল পরিবর্তন-ভীতি, নতুনের প্রতি অবিশ্বাস স্রেফ তার নতুনত্বের কারণেই[]; তুলনায় উদারপন্থার ভিত্তি হল সাহস, এবং পরিবর্তনের পরিণতি কি হবে সেটি না জানা থাকা সত্বেও পরিবর্তনের ধারাকে নিজের গতিতে বইতে দেয়ার আত্মবিশ্বাস। রক্ষণশীলেরা যদি শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নীতির আকস্মিক পরিবর্তনের বিরোধিতা করতেন, তাহলে আপত্তির তেমন কোন কারণ ছিল না, কারণ এসব ক্ষেত্রে সতর্কতা ও ধীর পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি যথেষ্টই শক্তিশালি। সমস্যা হল, রক্ষণশীলেরা পরিবর্তন রোধ করতে বা তার গতি কমিয়ে নিজেদের দুর্বল মনের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের শক্তি ব্যবহার করতে চায়। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রক্ষণশীলেরা সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তিগুলির খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতার উপর আস্থা রাখতে পারে না, তুলনায় উদাপন্থীদের সেই আস্থা আছে যার ফলে পরিবর্তনকে সে মেনে নিতে পারে, যদিও পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজনীয় অভিযোজনের প্রক্রিয়াটি ঠিক কিভাবে ঘটবে সেটা সে তার জানা নেই। উদারপন্থী মনোভাবের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, এই বিশ্বাস যে বাজারের স্ব-নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলি নতুন পরিস্থিতির সাথে অভিযোজিত হয়, যদিও কোন বিশেষ ক্ষেত্রে ঠিক কিভাবে এটা ঘটবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। বহু লোকই বুঝতে পারে না কিভাবে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া চাহিদা ও সরবরাহ, বা আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে, আর বাজারকে কাজ করতে দেয়ার ব্যাপারে মানুষের সমূহ দ্বিধার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণই এই অজ্ঞতা। কোন উচ্চতর মহাজ্ঞানী কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণে রেখে “সুশৃঙ্খল” ভাবে বিকশিত হতে দিলে রক্ষণশীলেরা নিরাপদ বোধ করে, নচেৎ নয়।

নিয়ন্ত্রণহীন সামাজিক শক্তির ব্যাপারে রক্ষণশীলের ভয় তার অন্য দুটি বৈশিষ্টের সাথে সম্পর্কিত: কর্তৃত্বধারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অর্থনীতির বিষয়ে অজ্ঞতা। রক্ষণশীল ব্যক্তি বিমূর্ত তত্ব ও সাধারণ নিয়ম দুটির ব্যাপারেই সন্দিহান [], ফলে স্বাধীনতা ভিত্তিক সমাজ যেসব স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির ওপর নির্ভর করে সেগুলি যেমন সে বুঝতে অক্ষম, তেমনি সামাজিক কর্মসূচী নির্ধারণের কোন নৈতিক ভিত্তিও তার থাকে না। শৃঙ্খলা, রক্ষণশীলের চোখে, ক্ষমতাধরদের বিরতিহীন মনোযোগের ফল। অতএব, তাদের মতে, কর্তৃপক্ষকে বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে দিতে হবে এবং তাকে কঠোর আইনের আওতায় বেঁধে রাখা উচিত হবে না। অন্যদিকে নীতিনিষ্ঠতার প্রতি উদারপন্থী অঙ্গীকারের জন্য দরকার সামাজিক কার্যক্রমকে যে স্বতঃস্ফূর্ত শক্তিগুলি সমন্বিত করে, সেসবের ব্যাপারে জ্ঞান। কিন্তু সমাজ ও বিশেষত অর্থনীতির এই ধরণের কোন তত্ব রক্ষণশীলের হাতে নেই। সামাজিক শৃঙ্খলার একটি সাধারণ তত্ব নির্মাণে রক্ষণশীলেরা এমন ভাবেই ব্যর্থ হয়েছে যে রক্ষণশীলতার আধুনিক পূজারীরা তাত্বিক ভিত্তি গঠনের জন্য অবধারিত ভাবে এমন সব লেখকের কাছে হাত পাতেন যারা নিজেদের উদারপন্থী ভাবতেন। ম্যাকলে, টকভিল, লর্ড অ্যাকটন ও লেকি নিজেদের সঙ্গত ভাবেই উদাপন্থী ভাবতেন, এমনকি এডমুন্ড বার্ক-ও শেষ অব্দি হুইগ-ই থেকে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে কেউ রক্ষণশীলতার অপবাদ দিলে নিঃসন্দেহে শিউরে উঠতেন।

কিন্তু মূল কথাটায় ফেরত আসা যাক। এই মূল কথাটা হল, প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বের ব্যাপারে রক্ষণশীলের অবধারিত তুষ্টির মনোভাব, কাজেই রক্ষণশীলের প্রধান লক্ষ্য শক্তিকে সীমার মধ্যে রাখা নয়, বরং বৈধ কর্তৃপক্ষ যেন দুর্বল না হয়ে পড়ে সেই চেষ্টা করা। স্বাধীনতার ধারণার সাথে এই মনোভাবকে একীভূত করা কঠিন। সাধারণ ভাবে বলা যায়, দমননীতি বা স্বৈরাচারের এর ব্যবহারে রক্ষণশীলের আপত্তি নেই যতক্ষন না পর্যন্ত ওই শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে সদুদ্দেশ্যে (তার মতে)। সে মনে করে, সরকার যদি ভাল লোকেদের হাতে থাকে, তাহলে খুব বেশি আইন কানুন দিয়ে তাকে বাধাগ্রস্থ করার দরকার নেই। যেহেতু সে নিয়মনিষ্ঠ নয়, বরং সুবিধাবাদী — তার আশার ভিত্তি হচ্ছে যে ভাল ও জ্ঞানীরা শাসন করবে, শুধু উদাহরণ হিসেবে নয়, তাদেরকে দেয়া কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে[]। কাজেই, ঠিক সমাজতন্ত্রীর মত, তার চিন্তার মূল লক্ষ্য সরকারের শক্তিকে সীমাবদ্ধ রাখা নয়, বরং কে বা কারা এই শক্তির অধিকারী হবে তা নির্ধারণ করা; এবং সমাজতন্ত্রীর মতই, সে মনে করে মানুষের ওপর তার নিজের নৈতিকতা কে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তার আছে।

চলবে…

ফুটনোট
[*] উদ্ধৃতিটি অ্যাকটন রচিত স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রথম পাতা থেকে।

[] এই অবস্থা অন্তত শখানেক বছর ধরে চলছে। ১৮৫৫ সালেই জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, “আজকের দিনে সমাজ সংস্কারকদের প্রায় সব উদ্দেশ্যই স্বাধীনতা-হন্তা” (দেখুন আমার বই “J. S. Mill and Harriet Taylor” (১৯৫১), পৃ ২১৬)

[] বি. ক্রিক, “The Strange Quest for an American Conservatism”, Review of Politics, XVII (1955), পৃ ৩৬৫, এ সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে, “যে সাধারণ আমেরিকান নিজেকে `রক্ষণশীল’ বলেন, আসলে তিনি `উদারপন্থী’। সম্ভবত এই `রক্ষণশীলদের’ এহেন নাম বেছে নেয়া চালু হয়েছে New Deal এর সময় `উদারপন্থী’ নামের অপব্যবহারের সময় থেকে।”

[] এই বাক্যটি পেয়েছি R. G. Collingwood, The New Leviathan (Oxford: Oxford University Press, 1942), পৃ ২০৯ থেকে।

[] দেখুন রক্ষণশীল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান কর্তৃক এই “মধ্যপন্থা” শব্দের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যবহার; তার বিখ্যাত বইটির নাম “মধ্যপন্থা” (১৯৩৮)।

[] দেখুন, লর্ড হিউগ সেসিল এর “Conservatism” (লণ্ডন ১৯১২, পৃ ৯) “স্বাভাবিক রক্ষণশীলতা হচ্ছে…পরিবর্তন বিরোধি মনোভাব; এবং এর উৎস, অংশত, অজানার প্রতি ভয়”।

[] দেখুন কে. ফেইলিং-এর গোমর ফাঁস করা আত্ম-বর্ণনা (Sketches in Nineteenth Century Biography (লন্ডন, ১৯৩০), পৃ. ১৭৪): “সবকিছু মিলে, নতুন ধারণার প্রতি ডানপন্থার মনোভাব সুতীব্র ভীতির, কারণ, প্র্যাকটিকাল মানুষ কি সেই নয়, যে ডিজরেলির ভাষায় `পূর্বপুরুষের ভুলের চর্চাকারী’? ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে ডানপন্থীরা উন্নতিকে অন্ধভাবে প্রতিরোধ করেছে, এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধার নামে পুরোনো সংস্কারকে কে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। এদের অবস্থান নিরাপদতর, কিন্তু জটিলতর হয়, যখন আমরা এর সাথে যোগ করি এই তথ্য যে, ডানপন্থীরা অনবরত বামপন্থীদের দ্বারস্থ, উদারপন্থার ধারণাগুলির ক্রম-গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে রক্ষণশীলতা সবসময়ই অবস্থান করে সদা-অসম্পূর্ণ আপসের পরিস্থিতিতে।”

[] নিজেরই আগে লেখা কিছু কথা উদ্ধৃত করি, আশা করি পাঠক নিজগুণে ক্ষমা করবেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমি উত্থাপন করেছিলাম এই বাক্যগুলিতে: “[অ্যাডাম স্মিথ] ও তার সমসাময়িক অন্য কিছু লেখক যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে সমর্থন করেছিলেন, তার সবচেয়ে ভাল গুণ হল, এই ব্যবস্থায় মন্দ লোকেরা সবচেয়ে কম ক্ষতি করতে পারে। এই ব্যবস্থা এমন নয় যা চালানোর জন্য ভাল লোক খুঁজে বের করতে হবে, বা সব মানুষকে এখনকার চেয়ে অনেক উন্নত হতে হবে, বরং এমন ব্যবস্থা যা সব ধরণের মানুষের বৈচিত্র্য ও জটিলতাকে ব্যবহার করে, কখনও ভাল কখনও মন্দ, কখনও বুদ্ধিমান, প্রায়শই বুদ্ধিহীন” (Individualism and Economic Order [লন্ডন ও শিকাগো, ১৯৪৮], পৃ ১১)