লিখেছেনঃ মিলন আহমেদ

 

পৃথিবীর সব মানুষ যদি কানাডায় গিয়ে বাস করে তবে কানাডায় প্রতি বর্গমাইলে বসতি হবে ১৪৭২ জনকিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করছে প্রতি বর্গমাইলে ২৯৫৭ জনক্ষুধা, দারিদ্র, পুষ্টিহীনতা, রোগ-শোক, আবাসনের অভাব ইত্যাদির মূলে জনসংখ্যা সমস্যার প্রখরতা সেকথা  আমরা সবাই জানিদ্রুত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাও আমরা অনুমান করতে পারিকিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে সম্প্রতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমে গতিহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছেবিভিন্ন কারণে এই স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, তবে নারীর অধিকারহীনতা অন্যতম প্রধান কারণকাজেই একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে আনতে পুরুষের সাথে সমহারে নারীর ক্ষমতায়ন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে

 

গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা সমস্যা কতটুকু তীব্র এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনামূলক অবস্থা কেমন সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই গভীরভাবে হয়তো ভাবি নাবাংলাদেশে প্রতিদিন ৯৬৮৭ জন শিশু জন্মগ্রহন করছে এবং প্রতিদিন ৬০২৭ জন মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে ভারত বাইশগুন বড়, লোকসংখ্যা একশ একুশ কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে নয়শত বাইশ জন; চীন সাতষট্টি গুণ বড়, লোকসংখ্যা একশ পঁয়ত্রিশ কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে তিনশ চৌষট্টি জন; ফ্রান্স চার গুণ বড়, লোকসংখ্যা ছয় কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে দুইশ সত্তর জন; স্পেন সাড়ে তিন গুণ বড়, লোকসংখ্যা চার কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে দুইশ পাঁচ জন; যুক্তরাষ্ট্র পয়ঁষট্টি গুণ বড়, লোকসংখ্যা বত্রিশ কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে আটাশি জন; ব্রাজিল ষাট গুণ বড় লোকসংখ্যা ঊনিশ কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে সাতান্ন জন; রাশিয়া একশ আঠার গুণ বড়, লোকসংখ্যা আঠারো কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে আটাশ জন; সৌদি আরব পনের গুণ বড়, লোকসংখ্যা দুই কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে পঁচিশ জন: সুদান সাড়ে সতের গুণ বড়, লোকসংখ্যা তিন কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে ছাব্বিশ জন; কানাডা সত্তর গুণ বড়, লোকসংখ্যা তিন কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে আট জন, অস্ট্রেলিয়া চুয়ান্ন গুণ বড়, লোকসংখ্যা দুই কোটি, প্রতি বর্গমাইলে বাস করে সাত জনঘনত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় প্রায় চারশ গুণ এবং কানাডার তুলনায় প্রায় সাড়ে তিনশ গুণ বেশি মানুষ বাস করেপৃথিবীর সব মানুষ যদি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাস করে তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বর্গমাইলে বসতি হবে ১৫৮২ জনপৃথিবীর সব মানুষ যদি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বাস করে তবে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি বর্গমাইলে বসতি হবে ১৮৫৩ জনপৃথিবীর সব মানুষ যদি বাংলাদেশে এসে বাস করে তবে বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে বসতি হবে ১ লক্ষ ২২ হাজার ৩১২ জন

 

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জমির পরিমাণ আধা বিঘারও কমপ্রতিবছর ২% করে কৃষি জমি নষ্ট করে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট তৈরী হচ্ছেএভাবে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশপ্রতি বিঘা জমিতে এখন যে ধান হয় তার চাইতে বেশি ধান ফলালেও কিছুদিন পর বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা রূপকথার গল্পের মত মনে হবে১ কোটি ৩০ লক্ষ লোক ঢাকায় বাস করে তার মধ্যে সত্তর-আশি লক্ষ মানুষ বস্তিতে অথবা সেমি-বস্তিতে বাস করেদুঃখ-দুর্দশা, ক্ষুধা-দারিদ্র, শোষণ-বঞ্চনা আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অকাতরে সহ্য করেছেন এবং আমরাও করছিআরও কিছুদিন সহ্য করা লাগলেও হয়তো করবো, কিন্তু আমরা আশার আলো দেখতে চাইসত্যি সত্যি আশার আলো দেখতে চাই, মিথ্যে আশ্বাস শুনতে চাই নাএখন থেকে, এই মুুহুর্তে থেকে প্রকৃত সমাধানের পথ দেখতে চাইযে যেভাবেই সমাধানের কথা বলুক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের কথা সবাই এক বাক্যে বলবেন নিশ্চয়ইকিন্তু এখনও জনসংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারেএভাবে বাড়তে থাকলে আগামী পঞ্চাশ বছর পর জনসংখ্যা হবে ৩৩ কোটিজাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য মতে বর্তমানে দেশে মোট প্রজননের হার ২ দশমিক ২৫ শতাংশএই প্রজনন হার মিয়ানমারে ০দশমিক৯ থাইল্যান্ডে ০ দশমিক ৭, চীনে ০ দশমিক ৬, শ্রীলংকায় ০ দশমিক ৫, জাপানে ০বিদেশী অর্থায়নেই মূলতঃ আমাদের পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত নাসিফ সাদিক নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছিলেনএমনিতেই পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে তারপর বিদেশি সাহায্য যদি কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায় তবে অবস্থা কি দাঁড়াবে তা হয়তো অনুমান করে আমাদের আরও আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিলকিন্তু আমরা এখনো সতর্ক হইনিফলে যা হওয়ার তাই হতে যাচ্ছেভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা 

 

বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ শিশু জন্মগ্রহণ করে তা কুয়েত, কাতার, আবুধাবী, দুবাই ইত্যাদি দেশের প্রকৃত জনসংখ্যার সমানএখানে প্রতি মিনিটে ৭ জন, প্রতি ঘন্টায় ৪২০ জন, প্রতিদিনে ১০০৮০ জন, প্রতি মাসে ৩০২৪০০জন, প্রতি বছর ৩৬২৮০০জন শিশু ভুমিষ্ট হচ্ছেজাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দেওয়া তথ্যমতে ২০০১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১২কোটি ৯০ লক্ষবর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৪৪ লক্ষেঅর্থাৎ গত ৯ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৩ কোটি ৫৪ লক্ষজননিয়ন্ত্রয়নের বর্তমানে যে হালহকিত তাতে আগামী ৯ বছরে বৃদ্ধি পাবে সাড়ে চার কোটির মতএভাবে বাংলাদেশ এক গভীর অন্ধকারে তলীয়ে যাবেঅনেকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অনেকগুলো কারণকে দায়ী করেছেন তবে মুল কারণের কাছে কেহ যেতে চাচ্ছেন নামানুষ হিসাবে নারীর কোন অধিকার না থাকায় বিবাহে কন্যার মতামতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় নাসে কারণে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে ব্যাপকভাবেএদেশে কিশোরী মাতৃত্বের হার ৩৩ শতাংশ 

 

সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী ডঃ আব্দুর রাজ্জাক জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হারকে আশংকাজনক বলে উল্লেখ করেছেনএখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরী সেকথাও তিনি বলেছেনজনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা কমে যাওয়াকেই তিনি দায়ী করেছেনআমার কথা দেশটাতো আর দাতাদের নয়নিশ্চিত বিপদ থেকে দেশকে বাঁচানোর এবং জাতিকে রক্ষা করার দ্বায়িত্ব মন্ত্রীর, আমার, সকলেরবিশিষ্ট গবেষক স্মৃতি চক্রবর্তী তাঁর গবেষণায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের ধীরগতির জন্য পুরুষদের (বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণে) অনীহাকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেনগত ৮ই মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন আট-নয়টি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও একটি পুত্রের আশায় মানুষ সন্তান নিচ্ছেপ্রধানমন্ত্রী যথার্থ কথাটিই ঐ দিন বলেছেনকাজেই নারীর অধিকারহীনতা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে অন্যতম একটি অন্তরায় সেকথা স্পষ্টসুতরাং আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে পুরুষতন্ত্রকে সার-পানি দিয়ে মোটা-তাজা করব না-কি নারীদের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করবঅনেকেই অবশ্য নারীদের অধিকারহীনতা দেখতে পান নাতাদেরকে বলব কোন হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যানগিয়ে খোঁজ নিন গত একমাসে কতজন মহিলা লাইগেশনকরেছেন আর কতজন পুরুষ ভ্যাকেসটমিকরেছেনদেখবেন লাইগেশন ২০০ জন মহিলা করলেও ভ্যাকেসটমিকরা ২ জন পুরুষ খুঁজে পাবেন কিনা সন্দেহঅথচ লাইগেশন করানোই ভ্যাকেসটমির চাইতে ঝুঁকিপূর্নঅবশ্য দেশপ্রেমহীন কিছু মানুষ কোনদিনই নারীদের অধিকারহীনতা দেখতে পায়না, সতীদাহ প্রথা যখন চালু ছিল তখনও তাদের পূর্বসুরিরা নারীর অধিকারহীনতা দেখতে পেত নাতারা সর্বশক্তি দিয়ে পুরুষতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবে এবং গোটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেপরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে পুরুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, দায়ী পুরুষতন্ত্র পুরুষতন্ত্র চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে যা পুরুষেরই সৃষ্টিপুরুষতান্ত্রিক সমস্ত আইন নারীকে পীড়নের জন্যই তৈরী করা হয়েছিলওগুলোর লক্ষ্য ছিল নারীকে মানুষের স্তরে উঠতে না দেয়াওই আইনের শিকলে নারীর প্রতিদিনের জীবন এখনও শৃংখলিতকিছু প্রথা হিসাবে চালু করেছে, কিছূ আইন হিসাবে বিধিবদ্ধ করেছেএগুলো সবই নারীর জীবনকে পরিণত করেছে নরকেঅতি সম্প্রতি ব্যাপকভাবে যৌন হয়রানি বৃদ্ধিও একই কারণে ঘটছেনাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান এবং ফরিদপুরের চাঁপা রানীকে জীবন দিতে হলোপুুরুষতন্ত্র যতদিন অসূরের মত টিকে থেকে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যার অধিকারে বৈষম্য জিঁইয়ে রাখবে ততদিন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে না একথা দিবালোকের মত স্পষ্টপুত্র সন্তান না থাকায় কোন ব্যক্তির সম্পদ নিজের ঔরসজাত সন্তানেরা পাবেনা একথা কেউ মানবে? মানবে না বিধায় ডজন খানেক কন্যা সন্তানের পরও একটি পূত্রের আশায় সন্তান নিতেই থাকবেজনসংখ্যা বাড়তেই থাকবেএভাবেই পুরুষতন্ত্রের জালে আটকে যাচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন

 

ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটাকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে আর একটুও দেরি করা ঠিক হবে নাআমরা যদি একটি সুখি, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করতে চাই এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই তবে এখনই পুরুষতন্ত্রের কবর রচনা করতে হবে এবং নারীকে দিতে হবে পূর্ণ অধিকারকারণ পুরুষতান্ত্রিক ওই কূৎসিত আইনগুলো অধিষ্ঠিত থাকায় আজকে শুধু নারীরাই আক্রান্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, গোটা জাতি অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছেসুতরাং দেশ বাঁচাতে, জাতিকে পথ দেখাতে নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক  ক্ষমতায়নের কোন বিকল্প নাই

 

___________________________

 

লেখকঃ নারীবাদী কলামিস্ট, ঈশ্বরদী, পাবনা, বাংলাদেশ