পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ৫)

ঢাকা কলেজ আর নটর ডেম কলেজ, জগতে এই দুইটা কলেজকে একসাথে নিয়ে একটা জিনিসই করা সম্ভব, অবিরাম বিতর্ক। বাংলাদেশের বিশেষ কিছু জেলা আছে, যেখানে করার মত কোনও কাজ না থাকলে লোকজন নাকি বলে, ‘যেহেতু হাতে কোন কাজ নেই, যাই, জেলা শহরে গিয়ে ভাইয়ের নামে বাড়ির পাশের জায়গা নিয়ে মামলাটা করে দিয়ে আসি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদেরও হাতে কোনও কাজ না থাকলে ঢাকা কলেজ আর নটরডেম কলেজ নিয়ে বিতর্ক করতে বসে। নটরডেম কলেজ গ্রুপ বলে, ‘আরে ঢাকা কলেজেতো দূর থেকে শিক্ষকরা দেখায়, ওই যে দূরে আলমারীর ভিতর দেখছো ওটার নাম হচ্ছে টেস্টটিউব। আর নটর ডেম কলেজ কেমিস্ট্রি ল্যাব-এ আমরা লবণ মুখে দিয়ে বলে দিতে পারি সেটা কি লবণ, কোনো এক্সপেরিমেন্টও করতে হয় না।’ আর ঢাকা কলেজ বলে, ‘নটর ডেম কলেজে স্টুডেন্টরা নাকি ক্লাসে ফিডার নিয়ে যায়, তারপর তাদেরকে ক্লাস এর মাঝখানে বিশ মিনিট সময় দেয়া হয় ফিডার খাওয়ার জন্য। ফিডার খেয়ে সবাই আবার পড়তে বসে।

নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কের গণ্ডি পেরিয়ে এরপর একে একে আসে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিতর্ক। বিতর্কের শুরুতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিতর্কিত হবার যোগ্যতা হারায়। যেহেতু ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর নামই হচ্ছে কলেজ, অতএব এ-নিয়ে বিতর্ক করে শুধু শুধু সময় নষ্ট করার মানে হয় না, বিতর্কিত হবার জন্য কমপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে। সবাই জানে অত্যন্ত অযৌক্তিক এই যুক্তি, কিন্তু তারপরও মেনে নেয় অবিসংবাদিতভাবে। অতএব, রইলো বাকী দুই।

কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীকে নিয়ে মা যখন টিএসসি চত্বর দিয়ে রিক্সায় চড়ে যায়, তখন নাকি মেয়েকে সাবধান করে বলেন, ‘মাথায় ওড়না দিয়ে বসো’। মায়ের কথামত মেয়েও তড়িঘড়ি করে ওড়না দিয়ে চোখ-মুখ ঢাকতে শুরু করে। তারপর বাসায় গিয়ে মায়ের হাঁফ ছেড়ে বাঁচা, ‘উফ্! আজকে-না টিএসসি হয়ে আসলাম। কি রকম থমথমে একটা পরিবেশ। যা একটা ভয় লাগছিলো।’ সেই একই মা, বুয়েট ক্যাম্পাস দিয়ে যাবার সময় মেয়েকে বলেন, ‘ওড়নাটাকে এ-রকম বোরখা বানিয়ে বসে আছ কেনো। একটু রিল্যাক্স করে বসো।’ বাসায় গিয়ে মায়ের সে-কি আনন্দ, ‘আজকে-না বুয়েটের ক্যাম্পাস দিয়ে আসলাম। কি মিষ্টি আর লক্ষী সব ছেলে। দেখেই মায়া হয়। মন চায় নিজের ঘরের আপন ছেলে করে রাখি।’ তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করবার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত।

গল্পের এই পর্যায়ে বুয়েট গ্রুপ ব্যাপক চেষ্টা করে ভিতর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসা খুশিটাকে আটকে রাখার জন্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপতো আর মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকবে না। তারা ব্যাপারটাকে মেনে নেয়ার ভাব করে বলে, ‘এটা জগতে চরম সত্যকথাগুলোর মধ্যে একটি। পঞ্চাশোর্ধ যে-কোন মহিলাই বুয়েটের ছেলে পছন্দ করে। সমস্যা হচ্ছে ওই ভদ্রমহিলাদের আধুনিক মেয়েরা কেন জানি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের পেছনেই ছুটে। বুয়েটের স্টুডেন্ট দেখলেতো পীথাগোরাসের উপপাদ্য ছাড়া আর কিছুই মনে আসা সম্ভব না, পরবর্তীতে যেটা প্যারাসিটামল খেয়ে জোর করে ভুলতে হয়।

বস্তুত, এই সব বিতর্কে যার গলার জোর যত বেশি, তার যুক্তির জোরও তত বেশি। সবগুলো যুক্তিই হাস্যকর এবং বলতে গেলে অন্তঃসারশূণ্য, কিন্তু আড্ডা জমানোর জন্য অতুলনীয়। অন্তঃসারশূণ্য না হলে, বিতর্কের শুরুতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ বাদ পড়ে যেত না। মানুষের সবচেয়ে অসহায়তম মুহূর্তগুলোতে একজন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন একজন ডাক্তারের; তা তার প্রতিষ্ঠানের নাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোক আর ঢাকা মেডিকেল স্কুলই হোক না কেন। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। সে-জীবন যখন মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়, তখন প্রত্যক্ষভাবে সে-জীবনের সাথী হয়ে আসেন একজন ডাক্তার-ই।

এই সব বিতর্কগুলো সবচেয়ে ভালো জমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো করার সময়। ল্যাব ক্লাসগুলোতে শিক্ষক ছাড়া মোটামুটি সবাই উপস্থিত থাকে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহেনশাহ্ শিক্ষকগণ ল্যাবটা কোন বিষয়ের উপর, সেটা বলে দিয়েই অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যান। কোথাও তাদের হারিয়ে যেতে নেই মানা। বরাবরের মতই ক্লাসের প্রথম দিককার কিছু সিরিয়াস স্টুডেন্ট মাথার ঘাম গলায় গড়িয়ে নিয়ে ল্যাব প্রব্লেম সলভ্ করে। আর আমরা শাহেনশাহ্ বিতার্কিকরা সেটা কপি করে এনে ল্যাব শেষে শিক্ষককে বুঝিয়ে দিই। কারণ আমরা বুঝে গেছি প্রতিভা বলে কিছু নেই, প্রকৃত ভালো স্টুডেন্ট হচ্ছে সে, যে অন্যের থেকে কপি করে নিজের মত করে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে। ওদিকে সত্যিকার অর্থে যে ল্যাব প্রব্লেমটা সলভ্ করে, তাকে হয়তো আমাদের থেকে কপি করবার অপরাধে বিচক্ষণ ও সুবিবেচক শিক্ষক মহাশয় কখনো কখনো ল্যাব থেকে বের করে দেন। বিচিত্র এই দুনিয়াদারী, ফ্যান্টাসীতে ভরা এই কিংডম্‌।

একদিন আমাদের এইরূপ সুখের ল্যাব-এ দুঃখের আগুন নিয়ে এলো সবেমাত্র ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করা নতুন শিক্ষিকা। নতুন যোগদান করা তরুণী শিক্ষিকারা কেন যে এতটা সুন্দরী হোন সে রহস্য আমি কখনোই উদ্‌ঘাটন করতে পারিনি। নতুন ম্যাডাম দেখি আবার সবসময় ল্যাব-এ উপস্থিত থাকেন। সুন্দরী ম্যাডাম সবসময় ল্যাব-এ উপস্থিত থাকবেন সেতো বড় সৌভাগ্যের বিষয়; কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তিনি সপ্তায় সপ্তায় হোময়ার্কের প্রচলন শুরু করলেন। কোন অবস্থাতেই তাঁকে দমানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, উনার কথায় কর্ণপাত করে আমাদের বহু বছরের সাধনার ফসল, পুরোনো ফাঁকিবাজ উপাধিটা বিসর্জন দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে মাস শেষে ম্যাডাম আমাদের হোমওয়ার্ক এর গ্রেডিং করে একে একে ডেকে পাঠালেন। আমাকে ডেকে সামনে বসিয়ে পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম সোমবার জমা দিতে, কিন্তু তুমি জমা দিয়েছে মঙ্গলবার, সেই জন্য তোমাকে আমি শূন্য দিয়েছি।’ জগতে কেউ যে এত সুন্দর রোমান্টিক সুর নিয়ে শূন্য দিতে পারেন, এটা আমার জানা ছিলো না। মনে হচ্ছিলো, তিনি কোন কবিতার লাইন আবৃত্তি করে শুনাতে আমাকে ডেকে বলছেন, আমি একটি কবিতা বলব, আমার কবিতার নাম তোমায় দিলাম শূন্য। আমি খুশি মনে উনার দেয়া শূন্য নাম্বার বুকে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

বেরিয়ে আসতে না আসতেই দেখি আরেক ভদ্রমহিলা ডিপার্টমেন্টে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এসেছেন আমাদের একজন বান্ধবীর সাথে পরিচিত হতে। আমাকে বলছেন অমুক নামের মেয়েকে চিনি না-কি। আসলে উনি এসেছেন উনার ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে। এই এক অসহনীয় মাত্রার যন্ত্রণা। বাঙ্গালী মায়েদের ছেলের বউয়ের চাহিদা মেটানোর জন্য কত মেয়েকে কত জায়গায় যে অপমান হতে হয়, সেটা মেয়ে হয়েও বাঙ্গালী মায়েরা বুঝেন না। তারা মেয়ে চান, ছেলের বউ চান। ছেলে লম্বা-ফর্সা হলে লম্বা-ফর্সা মেয়ে চান; কারণ তা না হলে জুটিটা একদমই মানাবে না। ছেলে খাটো-কালো হলেও লম্বা-ফর্সা মেয়ে চান; কারণ তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম খাটো হবে, কালো হবে। মোট কথা যে-কোনো অজুহাতে তারা লম্বা-ফর্সা মেয়ে চান। তাই যুগে-যুগে কালে-কালে মায়েরা দেখতে আসেন, মেয়ে দেখতে আসেন; দেখতে আসেন সুপার শপ্‌-এ, কলেজে-স্কুলে, দেখতে আসেন বাস টার্মিনালে, নদীর ঘাটে, বাসার ছাদে, থিয়েটারে; তারা মেয়ে দেখতে আসেন, দেখতে আসেন কত লম্বা আর কত ফর্সা সেই মেয়ে।

পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৭)

(চলবে…)

[email protected]
Dec 28, 2010