আপনার উর্বর মস্তিষ্কের রঙিন কল্পণায়ও কি কখনও – একটি বারও মনে হয়েছে, আকাশের বুকে হাজারো লক্ষ কোটি গ্রহ-তারা-নিহারীকা আর গ্রহানুপুঞ্জ নিয়ে তৈরী এই যে আমাদের এত পরিচিত বিশাল মহাবিশ্ব, এর বাইরেও এমনি ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে?  আপনার আমার কাছে তা যতই অবিশ্বাস্য ঠেকুক না কেন, পদার্থবিজ্ঞানীরা কিন্তু খুব গুরুত্ব দিয়ে এই সম্ভাবনার ব্যাপারটি ভাবছিলেন অনেকদিন ধরেই,এবং অতি  সম্প্রতি দাবী করা হয়েছে এর কিছু পরীক্ষালব্ধ প্রমাণেরও হদিস পেতে শুরু করেছেন তারা (দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে)।  কিন্তু সেখানে যাবার আগে চলুন আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নেই  মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাটি আসলে কি বলছে, কীভাবেই বা এই প্রায় ‘সাই-ফাই’ ধারণাটি কাঠকোট্টা বিজ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো।

multiverse

 
 
মাল্টিভার্স কী?
 
অনন্ত মহাবিশ্বের ধারনা কিন্তু অনেক পুরোন। সেই যে প্রাচীন দার্শনিক  জিওর্দানো ব্রুনো  (১৫৪৮-১৬০০)র কথা আমরা জানি, যিনি কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করতে গিয়ে চার্চের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, আর যাকে এই বাইবেলবিরোধী তত্ত্ব সমর্থনের অপরাধে ঈশ্বরপুত্রের দল জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো, তিনি ১৫৮৪ সালে একটি  ভয়ঙ্কর এক বই লিখেছিলেন De l’Infinito Universo et Mondi নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়াবে – ‘অনন্ত মহাবিশ্ব এবং বহু বিশ্ব নিয়ে’ সেখানে তিনি অনন্ত মহাবিশ্ব থাকার জোরালো সম্ভাবনার  ব্যাপারটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন  পৃথিবী তো সৌরজগতের কেন্দ্র নয়ই, এমনকি এই মহাবিশ্বের সংখ্যাও একটি নয়, বরং এর সংখ্যা হতে পারে অনন্ত অসীম। ব্রুনো আরো বললেন, এই মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। আবার, সেরকম প্রাণওয়ালা একাধিক গ্রহ থাকতে পারে অন্য মহাবিশ্বেও।
 
ব্রুনোর এ ধারনাগুলো সে সময়ের তুলনায় ছিলো ভীষণ বিপ্লবী, এমনকি আজকের প্রেক্ষাপটেও তা কম কী? অতিমাত্রায় আজগুবিও হয়তো বলবেন কেউ কেউ। কিন্তু তারপরেও ব্রুণোর কথার গুরুত্ব কিছু কিছু দার্শনিকেরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যেমন, জার্মান দার্শনিক এর্নস্ট ক্যাসিরের ব্রুনোর অনন্ত মহাবিশ্বের চিন্তাধারাকে ‘চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির’ প্রথম সোপান উল্লেখ করে লেখেন[1] –

ব্রুনোর অসীম মহাবিশ্বের এই মতবাদটি … মানুষের চিন্তার দাসত্ব থেকে সচেতনভাবে মুক্তির সর্বপ্রথম সোপান। মানুষকে আর  সসীম মহাবিশ্বের সঙ্কীর্ণ চৌহদ্দির কারাগারে বন্দী আসামীর মতো জীবন কাটিয়ে যেতে হবে না,সে হবে সত্যিকারের মুক্ত বিহংগ; সে ভেঙ্গেচুরে ফেলবে কাল্পণিক যত দেওয়াল –  যা মিথ্যে অধিবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে তার অস্তিত্বকে বন্দি করে রেখেছিলো এক স্বর্গীয় গোলকের অভ্যন্তরে। অনন্ত অসীম মহাবিশ্বের ধারণা মানুষকে দেয় মানুষ হিসেবে সত্যিকার মুক্তির আস্বাদন, সে মানুষের জন্য নির্ধারণ করে না কোন কৃত্রিম দেওয়ালের সীমা পরিসীমা,বরং মানব যুক্তির জন্য হয়ে উঠে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা। মানব বুদ্ধিবৃত্তি নিজের অসীমত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে উঠে অসীম মহাবিশ্বের  মায়াবী ক্ষমতায়’ (Infinite worlds of Giordano Bruno by Antoinette Mann Patterson, 1970)।

এর্নস্ট ক্যাসিরের মতো দার্শনিকেরা গুরুত্ব বুঝলে কী হবে, চার্চের মাথায় যেন বাজ পড়লো।এমনিতেই কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করা নিয়ে ব্রুনোর উপর চার্চ মহাখাপ্পা ছিলেন। তারা ভাবতেন, এই পৃথিবীটা একটা বিশিষ্ট গ্রহ যা ঈশ্বরের তৈরি এক বিশেষ সৃষ্টি। পৃথিবীটা বিশিষ্ট গ্রহ বলেই পৃথিবীকে স্থির রেখে এর চারদিকে সমস্ত গ্রহ, তারাকামণ্ডলী সহ সকল মহাজাগতিক বস্তুকণাকে এর চারিদিকে ঘুরার কথা সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে বাইবেলে। কাজেই কোপার্নিকাসের তত্ত্ব ছিলো তাদের চোখে সাক্ষাৎ ব্লাস্ফেমি, কারণ তার সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বে আস্থা রাখলে পৃথিবীর বিশিষ্টতা নিমেষেই ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়।আর এর মধ্যে অসীম মহাবিশ্ব আমদানী করলে তো পোয়াবারো – মানবজাতি আর তার পুরোধা চার্চের ভূমিকাও গৌণ হয়ে যাবে। অসীম মহাবিশ্বে কি অগনিত মানব জাতি থাকবে, আর তাদের জন্য অগনিত পোপ, কিংবা অগনিত যীশু? ছি ছি রাম রাম…মাথা খারাপ নাকি? দে শালারে পুড়াইয়া …
 
ঈশ্বরপুত্রদের তাণ্ডবে ব্রুনোর নশ্বর দেহ পুড়ে ছাই গয়ে গেলো। দিনটি ছিলো  ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ।
 

 চিত্রঃ ইতালির ক্যাম্পো ডি ফিওরির ঠিক যে জায়গাটায় জিওর্দানো ব্রুনোকে ১৬০০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, ঠিক সে জায়গায় আজ ব্রুনোর একটি দীর্ঘ ব্রোঞ্জমূর্তি আছে। মুক্তচিন্তার শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে মূর্তিটি পরবর্তীতে নির্মাণ করেছিলেন ইতালির স্থাপত্যশিল্পী এতোরি ফেরারি। গতবছর (২০০৯) ইতালি ভ্রমণের সময় আমার তোলা ব্রুনোর দুটো ছবি। 

চার্চ হয়তো ভেবেছিলো গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে রেখে কিংবা ব্রুনোকে পুড়িয়ে দিয়েই পৃথিবীর ঘূর্ণন থামাবেন তারা। আর পুড়ানোর সাথে সাথেই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাও  বোধ হয় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে! কিন্তু চার্চের হয়তো জানার বাকি ছিলো যে,  ব্যক্তিকে পোড়ানো যায়, কিন্তু তার মতবাদকে নয়। ব্রুনোর  অনন্ত মহাবিশ্বের মতবাদ  আবারো ফিরে  এসেছে বিজ্ঞানে মূলতঃ আধুনিক কোয়াণ্টাম পর্দার্থবিদ এবং জ্যোতির্পদার্থবিদদের হাত দিয়ে। আধুনিক পদার্থবিদের কিছু গবেষক অনেকদিন ধরেই আলামত পাচ্ছিলেন যে, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব -এটি কোন অনন্য বা ইউনিক কিছু নয়, বরং এমনি ধরনের হাজারো মহাবিশ্ব হয়ত ছড়িয়ে আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা একদমই ওয়াকিবহাল নই। বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর আশির দশকে ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক গণিতগুলো সমাধান করতে গিয়েই এই অদ্ভুতুরে ব্যাপারটা বেরিয়ে আসছিলো ক্রমশ। যারা সে সময় এ নিয়ে গবেষণা করছিলেন – আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন এবং আদ্রে লিন্ডে খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন মহাজাগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না[2]। এ ব্যাপারটাকেই বিজ্ঞানীরা আজ ‘চিরন্তন স্ফীতি’ (Eternal Inflation) নামে অভিহিত করছেন। অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা মূলতঃ এই চিরন্তন স্ফীতিতত্ত্বেরই স্বাভাবিক একটি গাণিতিক পরিনতি। তাই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাটি কোন ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথা নয়, নয় কোন স্টারট্রেক মুভি বা আসিমভের সায়েন্সফিকশন। অতি সংক্ষেপে অনন্ত মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ধারণাটি এরকম:
 
আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়ত বাস্তবে ঘটেছেও। এই একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে ট্রিয়ন আর পরবর্তীতে মূলতঃ আদ্রে লিন্ডে এবং আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়ত আমরা অবস্থান করছি অন্য গুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে।
 
 
 

icaotic_inflation_linde 

চিত্র: আঁদ্রে লিন্ডের দেওয়া তত্ত্ব – কেওটিক ইনফ্লেশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রসারিত বুদ্বুদ এবং প্রতিটি সম্প্রসারিত বদ্বুদই আবার জন্ম দিয়েছে এক একটি ‘বিগ-ব্যাং’-এর। আর সেই এক একটি বিগ-ব্যাং পরিশেষে জন্ম দিয়েছে এক একটি পকেট মহাবিশ্বের। আমরা এ ধরনেরই একটি পকেট মহাবিশ্বে বাস করছি।
 

আসলে নব্বইয়ের দশকে দেশকাল (spacetime)কীভাবে ‘ফ্লাকচুয়েট’ করে এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কতিপয় বিজ্ঞানী (যেমন, এডওয়ার্ড ফার্হি, এলেন গুথ এবং জেমাল গুভেন প্রমুখ) দেখলেন দেশকালকে কেবল আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী ইচ্ছেমত বাঁকানো কিংবা প্রসারিত করাই যাচ্ছে না, সেই সাথে একে টুকরো করে ভেঙ্গেচুরেও ফেলাও সম্ভব। কখনো সখনো বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে খুব ক্ষুদ্র স্থান বা দেশ জন্ম নিতে পারে। এটিই সেই ‘শিশু মহাবিশ্বের’ উৎপত্তির ধারণা, যেটি নিয়ে স্টিফেন হকিং একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৪ সালে  – ‘কৃষ্ণগব্বর এবং শিশু মহাবিশ্ব’ নামে[3]।
     
সম্প্রতি ক্যালিফোর্ণিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ শন ক্যারলের একটি  সুলিখিত বই পড়লাম ‘ফ্রম ইটারনিটি টু হেয়ার’ নামে[4]। কিভাবে ডি-সিটার স্পেস থেকে (যে স্থানে খুব স্বল্প পরিমান ধনাত্মক ভ্যাকুয়াম এনার্জি লুকিয়ে থাকে) ফলস ভ্যাকুয়াম বুদ্বুদের মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্বের জন্ম হতে পারে, তা শন ক্যারল ব্যাখ্যা করেছেন তার বইয়ে। সেই সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সদ্যজাত মহাবিশ্বকে জনপ্রিয় মিডিয়ায় ‘শিশু মহাবিশ্ব’ নামে অভিহিত করলেও মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে শিশু বিচ্ছিন্ন হবার পর অভিভাবকের সাথে সেই শিশু মহাবিশ্বের কোন সম্পর্কই থাকে না। কাজেই মানুষের জৈবিক সন্তানের সাথে সাদৃশ্য করার চেষ্টা হলেও বেবি ইউনিভার্সের সাথে বায়োলজিকাল চাইল্ডের পার্থক্য রয়েছে। খুব বেশী গাণিতিক জটিলতায় না ঢুকে নীচের ছবির মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্ব উৎপত্তি  ব্যাখ্যা করা হল –

sean_carroll_baby_universe 

চিত্রঃ ডিসিটার স্পেসে কোয়ান্টাম দোদুল্যময়তার ফলে অসদ বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্ব  উদ্ভবের প্রক্রিয়া, এবং পুরো প্রক্রিয়াটি অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে চালিত হয়ে তৈরি করতে পারে প্রায় অসীম সংখ্যক মহাবিশ্বের (শন ক্যারলের ‘ফ্রম ইটারনিটি টু হেয়ার’ গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত)।

 
সম্প্রতি স্ট্রিং তত্ত্বিকরা তাদের বিখ্যাত এমতত্ত্বের মেলবন্ধনের মাধ্যমে এ বিষয়ে আরো বেশকিছু দূর অগ্রসর হয়েছেন। তাদের গণনা থেকে দেখা গেছে, কোয়ানটাম দোদুল্যময়তার মাধ্যমে এমনকি ১০৫০০ টির মতো ভ্যাকুয়াম স্তরের (vacuum state) উদ্ভব ঘটতে পারে, এবং এ স্তরগুলো থেকে জন্ম নিতে পারে আলাদা আলাদা মহাবিশ্ব, যে সমস্ত মহাবিশ্বে একেক ধরণের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কার্যকরী হতে পারে। এ ব্যাপারটিই পরিস্কার করেছেন স্টিফেন হকিং তার  সাম্প্রতিক ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ গ্রন্থে (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ১১৮)-

‘এম তত্ত্বের নিয়মগুলো তাই ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ধারণাকে সম্ভাব্য করে তুলে। মহাবিশ্বগুলোর প্রকৃতি কীরকম হবে তা নির্ভর করবে অন্তঃস্থানের (internal space) বক্রতার প্রকৃতির উপর। কাজেই, এম তত্ত্ব থেকে পাওয়া সমাধান অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তার সংখ্যা হতে পারে এমনকি  ১০৫০০ টিও। এর মানে হল, আমাদের চারপাশে  ১০৫০০ টির মতো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, এবং প্রতিটির উপর কাজ করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন  প্রাকৃতিক সূত্র।’

  
ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বনাম মাল্টিভার্স
 
১৮৩৭ সালে ইংরেজ সাহিত্যিক রবার্ট  সৌথি বাচ্চাদের জন্য একটি রূপকথার গল্প লেখেন – ‘গোল্ডিলক্স এবং তিন ভালুকের গল্প’  শিরোনামে। সেই গল্পে গোল্ডিলক্স নামের এক কিশোরী বনের মধ্যে পথ হারিয়ে এক ভালুক-দম্পতির বাসা খুঁজে পায়।  ক্ষুধার্ত কিশোরীটি  বাবা ভালুকের খাবার খেয়ে দেখলো সেটি খুব গরম -মুখে দিলেই মুখ পুড়ে যায়। মা ভালুকের খাবারটি খেয়ে  গোল্ডিলক্স দেখলো সেটি আবার খুব ঠান্ডা। আর বাচ্চা ভালুকের খাবারটা চেখে দেখে সেটা সেটা না-গরম -না ঠান্ডা – একদম ঠিক ঠাক তাপমাত্রার, এবং সুস্বাদু। ঠিক একইভাবে বসার চেয়ার আর শোয়ার বিছানাটা পরীক্ষা করতে গিয়েও  দেখে  বাবা ভালুকের চেয়ারটা বেশি বড়, আর বিছানাটা খুব শক্ত,  মা-ভালুকের চেয়ারটা খুব ছোট, আর বিছানাটা অনেক বেশি নরম। কিন্তু বাচ্চা-ভালুকের বিছানা আর চেয়ার তার খাবারের মতোই নিখুঁত –   চেয়ারটা মাপমত, মানে না বড় না ছোট, আর বিছানাটা না-নরম-না-শক্ত, বড়ই আরামের। অর্থাৎ বাচ্চা-ভালুকের জিনিসগুলো একদম গোল্ডিলক্সের মনমতো করেই যেন তৈরি; আর গোল্ডিলক্সের পছন্দ সেটাই।
 
অনেক দার্শনিক বলেন, আমাদের মহাবিশ্বটাও নাকি  ঠিক গোল্ডিলক্সের মতো আমাদের জন্য ‘জাস্ট রাইট’। আর এটি এমনি এমনি হয়নি, এর পেছনে কোন বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বার সূক্ষ পরিকল্পনা এবং ডিজাইনের আলামত আছে। মাইকেল বিহে, ঊইলিয়াম ডেম্বস্কি, জর্জ এলিস, জন ডি. ব্যরো এবং ফ্রাঙ্ক জে. টিপলার প্রমুখ এ ধারণাগুলোর ধারক এবং সমর্থক। এঁদের যুক্তি হল, আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড এমন কিছু চলক বা ভ্যারিয়েবলের সূক্ষ্ণ সমন্বয়ের (ফাইন টিউনিং) সাহায্যে তৈরী হয়েছে যে এর একচুল হের ফের হলে আর আমাদের এ পৃথিবীতে কখনই প্রাণ সৃষ্টি হত না। তাঁদের বক্তব্য হল, আমাদের মহাবিশ্বে গ্র্যাভিটেশনাল অথবা কসমলজিকাল ধ্রুবকগুলোর মান এমন কেন, কিংবা মহাবিশ্বের চেহারাটাই বা এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য সর্বোপরি মানুষের আবির্ভাবের জন্য এই মৌলিক ধ্রুবক আর চলকগুলোর মান ঠিক এমনই হওয়া দরকার ছিল – সে জন্যই ওগুলো ওরকম। দৈবক্রমে ওগুলো ঘটে নি, ররং এর পেছনে হয়ত এক বুদ্ধিদীপ্ত সত্ত্বার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত রক্ষণশীল পদার্থবিজ্ঞানী হিউ রস, যিনি মনে করেন বিগ ব্যাং তত্ত্বের জনক হচ্ছে বাইবেল – তিনি  তার ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ক্রিয়েটর এণ্ড দি কসমস’ নামক এক ছদ্মবিজ্ঞান্ময় গ্রন্থে দাবী করেছেন মহাজগতের প্রায় ছাব্বিশটি প্যারামিটার নাকি সূক্ষ্ণভাবে সমন্বিত, একচুল এদিক ওদিক হলে আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটতো না, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে এরকম জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আর হিউ রসের মতে এটি যীশু খ্রীস্টে বিশ্বাসী হবার জন্য ‘বাস্তব প্রমাণ’।
 
মূলধারার বিজ্ঞানীরা অবশ্য হিউরস কথিত  ছাব্বিশটি প্যারামিটারকে মোটেই গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন না; তারা এটিকে বরং রক্ষণশীল প্রোপাগাণ্ডাই মনে করেন। তারপরেও অনেকে বলেন, ছাব্বিশটি না হোক, অন্ততঃ ছয়টি প্যারামিটার আছে যেগুলো মহাবিশ্বের বুকে আমাদের অস্তিত্বের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ । বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং  কেম্ব্রিজের রয়েল সসাইটির রিসার্চ প্রফেসর মার্টিন রীস ২০০০ সালে একটি বই লিখেছেন এ নিয়ে -‘কেবল ছয়টি সংখ্যা’ (Just Six Numbers) শিরোনামে[5]।  মার্টিন রীসের  বই এবং অন্যান্য প্রামাণিক গবেষণাপত্র থেকে হদিস পাওয়া যে প্যারামিটারগুলোকে সূক্ষ্ণসমন্বয়ের জন্য জরুরী বলে মনে করা হয় সেগুলো হল –  

প্যারামিটার সর্বোচ্চ বিচ্যুতি
ইলেক্ট্রন ও প্রটোনের অনুপাত ১০৩৭ ভাগের ১ ভাগ
তড়িচ্চুম্বকীয় বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের অনুপাত ১০৪০ ভাগের ১ ভাগ
মহাবিশ্বের প্রসারণের হার ১০৫৫ ভাগের ১ ভাগ
মহাবিশ্বের ঘনত্ব ১০৫৯ ভাগের ১ ভাগ
মহাজাগতিক ধ্রুবক ১০১২০ ভাগের ১ ভাগ

এর বাইরে জাগতিক মাত্রার সংখ্যা ৩ হওয়াটাও এক ধরণের সূক্ষ্ণ সমন্বয় বলে অধ্যাপক রীস মনে করেন। 
 
সংশয়বাদী পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্য বহুভাবেই দেখিয়েছেন যে, এই ছয়টি প্যারামিটারের এ ধরণের মান গ্রহণ করার পেছনে কোন সূক্ষ সমন্বয় নেই,বরং জানা পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যেই এর এগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব[6]।  
 
এ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। আমরা সবাই জানি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে একটি ধ্রুবক আছে, যাকে আমরা  বলি মহাকর্ষ ধ্রুবক, G । নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে দেখা যায় যে দুটি বস্তুকণার মধ্যে আকর্ষণ বলের পরিমাণ নির্ধারিত হবে ঐ মহাধ্রুবকের সংখ্যাবাচক মান দ্বারা। যদি ধ্রুবকটির মান এখন যা আছে তা না হয়ে অন্যরকম হত তাহলে দুটি কণিকার মধ্যে আকর্ষণ বলের পরিমাণও বদলে যেত। সাদা চোখে ব্যাপারটি সামান্য মনে হতে পারে। আকর্ষণ বলের তারতম্য ঘটলে এমন কি এসে যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে এটি সামান্য নয়- এর একটি সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উপর। তাঁরা বলেন যে ঐ মহাকর্ষ ধ্রুবকের বর্তমান মান আসলে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে। ধ্রুবকটির মান একটু অন্যরকম হলে তারকাদের মধ্যে হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে হিলিয়াম উৎপাদনের মাত্রাকে বদলে দিত। হাইড্রোজেন-হিলিয়ামের পর্যাপ্ততা শুধু এই মহাকর্ষ ধ্রুবকের উপরই অবশ্য নয়, মহাকর্ষ ও দুর্বল নিউক্লিয় বলের মধ্যকার শক্তির ভারসাম্যের উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেমন, তাঁরা দেখিয়েছেন যে দুর্বল নিউক্লিয় বলের শক্তি যদি সামান্য একটু বেশি হত, এই মহাবিশ্ব পুরোটাই অর্থাৎ শতকরা একশ ভাগ হাইড্রোজেন পরমাণুতে পূর্ণ থাকত, কারণ ডিউটোরিয়াম (এটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মামাতো ভাই, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘আইসোটোপ’) হিলিয়ামে পরিণত হবার আগেই সমস্ত নিউট্রন নিঃশেষ হয়ে যেত। আবার এর উল্টোটি ঘটলে, অর্থাৎ দুর্বল নিউক্লিয় বলের শক্তিমত্তা আর একটু কম হলে সারা মহাবিশ্বে কেবল থাকত শতকরা একশ ভাগ হিলিয়াম। কারণ সে ক্ষেত্রে নিউট্রন নিঃশেষিত না হয়ে তা উৎপন্ন প্রটোনের সাথে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন তৈরীতে বাঁধা দিত। কাজেই এ ধরণের দুই চরম অবস্থার যে কোন একটি ঘটলে মহাবিশ্বে কোন নক্ষত্ররাজী তৈরি হওয়ার মত অবস্থা কখন সৃষ্টি হত না, ঘটত না আমাদের এই মলয়শীতলা ধরণীতে ‘কার্বন-ভিত্তিক’ প্রাণের নান্দনিক বিকাশ। আবার, বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে ইলেকট্রনের ভর নিউট্রন ও প্রটোনের ভরের পার্থক্যের চেয়ে কিছুটা কম। তারা মনে করেন যে এর ফলে একটি মুক্ত নিউট্রন সহজেই প্রোটন, ইলেকট্রন ও প্রতি-নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হতে পেরেছে। যদি ইলেকট্রনের ভর সামান্য বেশি হত, নিউট্রন তাহলে সুস্থিত হয়ে যেত, আর সৃষ্টির  প্রারম্ভে উৎপাদিত সকল প্রটোন ও ইলেকট্রন মিলে-মিশে নিউট্রনে পরিণত হত। এর ফলে যা ঘটত সেটি আমাদের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ কিছু নয়। এমনতর পরিস্থিতিতে খুব কম পরিমাণ হাইড্রোজেন টিকে থাকত, আর তাহলে নক্ষত্রের জন্য পর্যাপ্ত জালানী অবশিষ্ট থাকত না। জন ডি. ব্যরো এবং ফ্রাঙ্ক জে. টিপলার এ ধরণের রহস্যময় নানা  যোগাযোগ তুলে ধরে একটি বই লিখেছিলেন ১৯৮৬ সালে, নাম ‘The Anthropic Cosmological Principle’। তাঁদের বক্তব্য হল, আমাদের মহাবিশ্বে গ্র্যাভিটেশনাল কিংবা অন্য মহাজাগতিক ধ্রুবকসমূহের মান এমন কেন, কিংবা মহাবিশ্বের চেহারাটাই বা এমন কেন হয়েছে এর উত্তর পেতে হলে অনুসন্ধান করতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের আবির্ভাবের মধ্যে। প্রাণের বিকাশ ও সর্বোপরি বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের অভ্যুদয়ের জন্য এসব মৌলিক ধ্রুবকও পরিবর্ত্য রাশিগুলির মান ঠিক এমনই হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল, আর সেজন্যই ধ্রুবকগুলির মান এ রকম হয়েছে। হঠাৎ করে বা দৈবক্রমে এটি ঘটে নি, বরং এর পেছনে বিধাতা পুরুষের একটি সুস্পষ্ট  ইচ্ছা নিহিত ছিল। 

life_exist_limited_reg
চিত্র:  অনেক বিজ্ঞানী বলেন খুব সীমিত পরিসরে (গোল্ডিলক্স এলাকা) জীবনের বিকাশ ঘটেছে; এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে।

মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্রে রেখে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের নিয়ম-নীতিগুলোকে ব্যাখ্যা করবার এই যুক্তিকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রোপিক আর্গুমেন্ট’ বা ‘নরত্ববাচক যুক্তি’। আমি আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটির শেষ অধ্যায়ে এ সমস্ত যুক্তির কয়েকটি বৈজ্ঞানিক খণ্ডন উল্লেখ করেছি। যেমন, আমি আমার বইয়ে দেখিয়েছি মহাজাগতিক ধ্রুবক আর পরিবর্ত্য রাশিগুলির মান পরিবর্তন করে বিজ্ঞানীরা (যেমন, ভিক্টর স্টেঙ্গরের ’মাঙ্কি গড’ কম্পিউটার প্রোগ্রাম[7]) সিমুলেশন করে  আমাদের মহাবিশ্বের মত আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারেন, যেখানে প্রাণের উদ্ভবের মত পরিবেশের সৃষ্টি হতে পারে; এবং এ জন্য ‘ফাইন টিউনিংয়ের’ কোন প্রয়োজন নেই। এছাড়াও আমার বইয়ে আমি ফিজিকাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের উল্লেখ করেছি যেখানে বিজ্ঞানী অ্যান্থনি অ্যাগুরি (Anthony Aguirre) স্বতন্ত্রভাবে দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের ছয়টি প্যারামিটার বা পরিবর্ত্যরাশিগুলো বিভিন্নভাবে অদলবদল করে নীহারীকা, তারা এবং পরিশেষে কোন একটি গ্রহে বুদ্ধিদীপ্ত জীবন গঠনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব[8]।  এখানে সেগুলো নিয়ে পুনর্বার আলোচনায় যাবার খুব বেশী ইচ্ছে নেই। এ প্রবন্ধে আমি দেখাবো যে, এতো ধরণের জটিলতায় ( এন্থনি এগুরি সহ বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সমাধান, যা আমি আমার আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইয়ে সমাধান হিসেবে হাজির করেছি) না গিয়েও মাল্টিভার্স তত্ত্বের মাধ্যমেও এই রহস্যময় ‘ফাইন টিউনিং’-এর আরো একটি সহজ সমাধান আমরা পেতে পারি।

many_lifes
চিত্র:  মালটিভার্স হাইপোথিসিস অ্যান্থ্রোপিক এবং ফাইন টিউনিং আর্গুমেন্টগুলোর একটি সহজ সমাধান দেয়।

 
আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি সাদা মাঠা কথায় মাল্টিভার্স তত্ত্ব বলছে যে, হাজারো-লক্ষ-কোটি মহাবিশ্বের ভীরে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। স্রেফ সম্ভাবনার নিরিখেই একটি মহাবিশ্বে চলকগুলোর মান এমনিতেই অমন সূক্ষভাবে সমন্বিত হতে পারে, অন্যগুলোতে হয়ত হয়নি। আমাদের মহাবিশ্বে চলকগুলো কোন একভাবে সমন্বিত হতে পেরেছে বলেই এতে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে; এতে এত আশ্চর্য হবার কিছু নেই! অধ্যাপক মার্টিন রীস সেটিই খুব চমৎকারভাবে একটি উপমার মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন[9] :
 

‘অসংখ্য মহাবিশ্বের ভীরে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। অন্য মহাবিশ্বে বিজ্ঞানের সূত্র আর চলকগুলো হয়ত একেবারেই অন্যরকম হবে।… কাজেই ঘড়ির কারিগরের সাদৃশ্য এখানে একেবারেই অচল। তার বদলে বরং আমাদের বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডকে অনেকটা পরিত্যক্ত সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দোকানের মজুদ যদি বিশাল হয় তবে দোকানের কোন একটি জামা আপনার গায়ে ঠিকমত লেগে গেলে আপনি নিশ্চয় তাতে বিস্মিত হবেন না! ঠিক একইভাবে আমাদের মহাবিশ্ব যদি ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি হয়ে থাকে, দোকানের একটি জামার মতই সূক্ষ-সমন্বয় দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই’।

 
সম্প্রতি স্টিফেন হকিংও তার গ্র্যাণ্ড ডিজাইন বইয়ের ‘আপাত অলৌকিকতা’ অধ্যায়ে একই ধরণের মতামত ব্যক্ত করেছেন[10]। তিনি তার বইয়ে বলেন (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ১৬৪)–
 

‘মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর এতোসব যাবতীয় সূক্ষ-সমন্বয় দেখে অনেকেই ভাবতে বাধ্য হয়েছিলেন এটি বোধ হয় কোন গ্র্যাণ্ড ডিজাইনারের গ্র্যাণ্ড ডিজাইন। কিন্তু এটি কোন বৈজ্ঞানিক উত্তর হল না। আমরা বরং বৈজ্ঞানিকভাবে দেখেছি আমাদের এই মহাবিশ্ব অসংখ্য অগণিত মহাবিশ্বরই একটি – যার প্রতিটিতে কাজ করবে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সূত্রাবলী। এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা সূক্ষ্ণ-সমন্বয়ের অলৌকিকতাকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়নি, বরং এটা ‘নো বাউন্ডারি কন্ডিশন’[11] এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যান্য আধুনিক তত্ত্বেরই সফল অনুসিদ্ধান্ত।…ঠিক যেভাবে ডারউইন এবং ওয়ালেস ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন – জীবজগতের আপাত অলৌকিক ডিজাইনের মতো ব্যাপারগুলো যেমনি উদ্ভুত হতে পারে কোন ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই, ঠিক তেমনি অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা প্রাকৃতিক সূত্রগুলোর সূক্ষ্ণসমন্বয়কে ব্যাখ্যা করতে পারে কোন পরম করুণাময় কোন সত্ত্বার উপস্থিতি ছাড়াই’’।

  
অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব যাকে এতদিন প্রকৃতির পুরো অংশ বলে ভেবে নেওয়া হত, আসলে হয়ত এটি এক বিশাল কোন মহাজাগতিক দানবের (অমনিভার্স) খুব ক্ষুদ্র অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের অবস্থাটা এতোদিন ছিল সেই বহুল প্রচলিত ‘অন্ধের হস্তি দর্শন’ গল্পের অন্ধ লোকটির মত – হাতীর কান ছুঁয়েই যে ভেবে নিয়েছিলো ওইটাই বুঝি হাতীর পুরো দেহটা!
 
এখানেই কিন্তু গল্প শেষ নয়। এই মালটিভার্স থিওরীর বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে আবার ইদানিং উঠে এসেছে আরো এক ডিগ্রী মজাদার তত্ত্ব – সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্স। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আছে সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে , নাম ইরন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাশাপাশি সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং বৈজ্ঞানিক সাময়িকীগুলোতেও ঠাঁই করে নিয়েছে। যেমন, সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডেটচস ১৯৯৭ সালে একটি বই লিখেছেন The Fabric of Reality: The Science of Parallel Universes – And Its Implications নামে। একই দৃষ্টিকোন থেকে পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকু ২০০৬ সালে বই লিখেছেন ‘সমান্তরাল বিশ্ব’ নামে[12] । ২০০৩ সালের মে মাসের সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সঙ্খ্যায় ম্যাক্স টেগমার্ক Parallel Universes :pdf: নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন[13]। লেখাটিতে টেগমার্ক তিনটি মডেলের সাহায্যে অত্যন্ত বিস্তৃত ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ এর ধারণাকে পাঠকদের মাঝে তুলে ধরেন । প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্ব বলছে যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ কোটি মহাবিশ্বের মধ্যে কোন কোনটি যে আকার, আয়তন আর বৈশিষ্ট্যে একদম ঠিক ঠিক আমাদের মহাবিশ্বের মতই হবে না, এমন তো কোন গ্যারান্টি নেই। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও সেই মহাবিশ্বে একই রকমভাবে কাজ করার কথা। ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের জানা গনিতের সম্ভাবনার নিরিখেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব থেকে পায় (১০১০)২৮ মিটার দূরে আপনারই এক ‘আইডেন্টিকাল টুইন’ হয়ত কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোন দিন জানতেও পারবেন না!
 

parallel_universe_identical_twin

চিত্র:  বিজ্ঞানী ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের জানা গনিতের সম্ভাবনার নিরিখেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব থেকে পায় (১০১০)১১৮ মিটার দূরে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অবিকল দেখতে সমান্তরাল একটি মহাবিশ্ব থাকতে পারে যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই একই ধরণের প্রাকৃতিক সূত্র কাজ করছে, এমনকি সেখানে হয়ত আপনারই একজন নকল প্রতিরূপ  কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোন দিন জানতেও পারবেন না!
 

বেশ বুঝতে পারছি মাল্টিভার্সের ধারণাই হয়ত পাঠকদের অনেকে হজম করতে পারছেন না, তার উপর আবার প্যারালাল ইনিভার্স, আইডেন্টিকাল টুইন – হেন তেন চলে আসায় নিশ্চয় মাথা তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, উপরের ধারণা, কিংবা তত্ত্বগুলো যতই আজগুবি মনে হোক না কেন ওগুলো নির্মাণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের কোন নিয়ম নীতি লংঘন করেননি। তারপরেও সমান্তরাল মহাবিশ্ব এখনো সাই-ফাই, বড়জোর গাণিতিক সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবের পর্যায়েই রয়েছে, তারচেয়ে প্রচলিত মাল্টিভার্সের ধারণাগুলো বরং অনেক বাস্তবতা হয়ে উঠছে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে। কিন্তু  সেখানে যাবার আগে  আমাদের একটু অক্কামের ক্ষুর সম্বন্ধে দু’চার কথা জানা প্রয়োজন।
 
 
 
মাল্টিভার্সের ধারণা কি অক্কামের ক্ষুরের লংঘন?
 
দর্শনশাস্ত্রে ‘অক্কামের ক্ষুর’ নামে একটি সূত্র প্রচলিত আছে। এ নিয়ে আমি একটা পোস্ট লিখেছিলাম এখানে। সোজা বাংলায় এই সূত্রটি বলে – অনর্থক বাহুল্য সর্বদাই বর্জনীয়। আইডির সমর্থক অধ্যাপক জর্জ এলিস অক্কামের ক্ষুরকে ব্যবহার করেছেন মাল্টিভার্সের ধারণার বিরুদ্ধে, বলেছেন এই তত্ত্ব অক্কামের ক্ষুরের সুস্পষ্ট লংঘন। তাঁর যুক্তি হল, একটা মহাবিশ্ব দিয়েই যখন সমস্যা সমাধান করা যায়, হাজার কোটি মহাবিশ্ব টেনে এনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আসলে বাতুলতা মাত্র, অনর্থক অপচয়। কিন্তু এ যুক্তিও ধোপে টেকেনি। যেমন, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিকটর স্টেঙ্গর তার ‘টাইমলেস রিয়ালিটি’ এবং ‘হ্যাজ সায়েন্স ফাউন্ড গড’ বইয়ে এই যুক্তি খন্ডন করে বলেন,

পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্বগুলোর কোনটাই অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে বাতিল করে দেয় না। বরং যেখানে লিন্ডের তত্ত্ব কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করছে, সেখানে কেউ যদি অযথা বাড়তি একটি প্রকল্প আরোপ করে বলেন আমাদের এই মহাবিশ্ব ছাড়া আর কোন মহাবিশ্ব নেই, কিংবা কখনই তৈরী হওয়া সম্ভবপর নয়, তবে সেটাই বরং হবে অক্কামের ক্ষুরের লংঘন।

অধ্যাপক স্টেঙ্গরের মতে, লিন্ডের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা সমাধানের ভুল ধরিয়ে দিয়ে নিজের সজ্ঞাত ধারণাটি -‘একটি মহাবিশ্বই টিকে থাকতে পারবে’ – প্রামাণ করার দায়িত্ব থাকছে কিন্তু ওই দাবীদারদের ঘারেই -যারা একটিমাত্র মহাবিশ্বের ধারণায় আস্থাশীল । এখন পর্যন্ত কেউই সে ধরণের কোন ‘স্পেশাল নিয়ম’ হাজির করতে পারেননি যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে কেবল একটি মহাবিশ্বই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, অন্যগুলো বাতিল হয়ে যাবে।
 
বিজ্ঞানী ম্যাক্স টেগমার্কও তার সায়েন্টিফিক আমেরিকানের প্রবন্ধে অক্কামের ক্ষুরকে খণ্ডন করে লেখেন, একটিমাত্র মহাবিশ্বের চেয়ে অনন্ত মহাবিশ্বই বরং অপেক্ষাকৃত ‘সিম্পলার সলিউশন’ হাজির করেছে।তাই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা অক্কামের ক্ষুরের কোন লংঘন নয়।  
 
 
কানাডার প্রিমিয়ার ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক লি স্মোলিন একটু অন্যভাবে সমস্যাটা নিয়ে ভাবছিলেন। কেন আমাদের মহাবিশ্বই টিকে রইল, অন্যগুলো রইলোনা – এ প্রশ্নটির সমাধান দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন,  বায়োলজি বা জীববিদ্যা হয়ত এক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারে। জীববিজ্ঞানে এ ধরনের ঘটনার হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কড মাছ মিলিয়ন মিলিয়ন ডিম পাড়ে, তার মধ্যে খুব কমই শেষ পর্যন্ত নিষিক্ত হয়, আর নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয়া অধিকাংশ পোনাই আবার বিভিন্ন কারণে মারা যায়, কিংবা অন্য মাছদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় খুব কম পোনাই টিকে থাকে আর তারপর পূর্ণাংগ মাছে পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের নিরানব্বই শতাংশই প্রথম মাসে কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, আর বাকি যা বেঁচে থাকে তারও নব্বই ভাগ প্রথম বছরেই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ সহ প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রাণীরই কোটি কোটি স্পার্মের প্রয়োজন হয় কেবল এটি নিশ্চিত করতে যে এদের মধ্যে একটি মাত্র স্পার্মই বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ডিম্বানুকে নিষিক্ত করবে আর শেষপর্যন্ত পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখবে। অর্থাৎ প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। এ ব্যাপারটিকেই চলতি কথায় যোগ্যতমের বিজয় বা ‘সার্ভাইবাল অব ফিটেস্ট’ বলা হয়। ডারউইন প্রকৃতির এই নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ যার মাধ্যমে তিনি জীবজগতের বিবর্তনকে সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন।
 
লি স্মোলিন ভাবলেন, জীবজগতের বিবর্তনের নিয়মের মত ‘কিছু একটা’ সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের বিবর্তনের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে কিনা। ইনফ্লেশনের ফলশ্রুতিতে মহাবিশ্বের ইতিহাসে যে অগুনতি সিঙ্গুলারিটি তৈরী হয়েছিলো, এমনও তো হতে পারে যে, এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্রই টিকে রইল, যেভাবে মানবদেহে নিষেক ঘটানোর অভিপ্রায়ে মিলিয়ন শুক্রানুর মধ্যে টিকে রয় একটিমাত্র স্পার্ম বা শুক্রাণু। তাহলে কি যোগ্যতম শুক্রাণুর মত কোন এক যোগ্যতম অদ্বৈতবিন্দু  থেকেই ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে আমাদের এই পরিচিত মহাবিশ্ব? কে জানে, হতেও তো পারে! তাই যদি হয়, তবে ‘ফাইন-টিউনিং’ আর ‘অ্যান্থ্রোপিক আর্গুমেন্ট’-এর জন্য অতিপ্রাকৃত স্বর্গীয় সমাধান খুঁজে আর লাভ নেই। কারণ ডারউইনীয় বিবর্তনবাদী ধারণা বলছে হয়ত এ প্রকারণগুলোই আমাদের মহাবিশ্বকে অন্যগুলো থেকে অধিকতর ‘যোগ্যতম’ হিসেবে আলাদা করে দিয়েছিলো! তাই এটি টিকে গেছে।
 
অনন্ত মহাবিশ্বের সমস্যা সমাধানে লি স্মোলিনের এই বিবর্তনবাদী দর্শন খুব আকর্ষনীয় সমাধান দিলেও এটি জ্যোতির্পদার্থবিদদের কাছ থেকে কখনই তেমন সমর্থন পায়নি। এর কারণ মুলতঃ দুটি। অধিকাংশ পদার্থবিদদের সবাই পদার্থবিদ্যার জানা নিয়ম নীতির মধ্যে থেকেই এই রহস্যের সমাধান চান- হঠাৎ করেই এক ভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক নিয়মের মাধ্যমে একধরনের ‘গোঁজামিল’ দেওয়া ব্যাখ্যা নয়; আর তাছাড়া লি স্মোলিন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলছেন তার কোন গানিতিক মডেল উপহার দিতে পারেন নি যা পদার্থবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার এক অন্যতম পূর্বশর্ত।
 
আর তারচেয়েও বড় কথা হল বিজ্ঞানীরা মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পেতে শুরু করেছেন সম্প্রতি।
 
এলো মাল্টিভার্সের প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ
 
মাল্টিভার্সের ধারণা বিজ্ঞানীরা হাজির করার পর থেকেই একে বিভিন্ন সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত মাল্টিভাস নামের এই বিপ্লবাত্মক ধারণার প্রতি সমালোচনার তীর ছুঁড়ে  বলা হত- এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা সঠিক নাকি ভুল – তা এই মুহূর্তে পরীক্ষা করে বলবার কোন উপায় নেই। কার্ল পপার ‘ফলসিফায়েবিলিটি’র যে বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিসেবে নির্ধারিত করে রেখেছেন, তার আওতায় কিন্তু মাল্টিভার্স পড়তো না বলে ভাবা হতো। সমালোচকরা বলতেন, গাণিতিক বিমূর্ততায় ঠাসা মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা যতটুকু না বাস্তবতার কাছাকাছি, তার চাইতে ঢের বেশী কাছাকাছি অধিপদার্থবিদ্যার (মেটা ফিজিক্স)। কাজেই এটি বিজ্ঞান হয় কি করে?

মাল্টিভার্সের সমর্থকরা ফলসিফায়াবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতার খুব ভাল জবাব দিতে না পারলেও সে সময় মিন মিন করে বলতেন,   ওই অধিপদার্থবিদ্যা আর পদার্থবিদ্যার মাঝখানের সীমারেখাটা যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হয়ে আসছে। অতীতে আমরা দেখেছি পর্যবেক্ষনবিরোধী বহু তত্ত্বই – যেমন গোলাকার পৃথিবীর ধারণা, অদৃশ্য বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র, উচ্চ গতিতে ভ্রমণকালে সময় শ্লথতা, কোয়ান্টাম উপরিপাতন, স্থান-কালের বক্রতা, কৃষ্ণগহবর ইত্যাদি সবকিছুই শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের অংশ হয়ে গেছে। অনন্ত মহাবিশ্বকেই বা  আমরা তালিকায় রাখতে পারবো না কেন?
 
এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। মাল্টিভার্সের সমর্থকদের আর মিন মিন করে জবাব দিতে হচ্ছে না। কারণ তত্ত্বকথার পাশাপাশি তারা পরীক্ষালব্ধ প্রমাণও হাজির করতে পারছেন। তাই মাল্টিভার্স আর ধারণা কিংবা ‘স্পেকুলেশন’-এর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ক্রমশঃ হয়ে উঠেছে  শক্তপোক্ত বিজ্ঞান!
 
বছর কয়েক আগে স্ফীতি তত্ত্বের জনক এলেন গুথ এবিসি নিউজ রিপোর্টারের কাছ থেকে অদ্ভুত এক ফোন কল পেলেন। রিপোর্টার তাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আমাদের মহাবিশ্ব যদি ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদের একটি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য মহাবিশ্বের ( মহাবিশ্বগুলোকে বাতাসে ভেসে বেরানো অসংখ্য সাবানের বুদ্বুদের মতো কল্পনা করুন) কোন একটির সাথে টক্কর লেগে ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা কতটুকু? গুথের হাতে তাৎক্ষণিক কোন হিসেব ছিলো না। তবে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এর একটি সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, এবং বলা বাহুল্য, তার উত্তরটি তেমন কোন নাটকীয় কিছু ছিলো না। কিন্তু এবিসির অনুষ্ঠান শেষ হবার পর গুথ প্রশ্নটি নিয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা শুরু করলেন। সত্যিই তো এরকম টক্কর লাগলে কী হবে? সেটা কি আমাদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে আসবে? আমাদের পর্যবেক্ষণে কী সেটা ধরা পড়বে? তিনি ব্যাপারটি সমাধানের জন্য তার দুই দিকপাল বন্ধু আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন এবং জমি গ্যারিগার সাথে  মিলে এক গবেষণাদল তৈরি করলেন[14]।  
 
তারা হিসেব করে দেখলেন এধরণের সংঘর্ষ হবার এবং সেই সংঘর্ষে আমাদের মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু ধ্বংস না হলেও ছোটখাট ঠোকাঠুকি কি হতে পারে, যাতে মহাবিশ্বের জীবন সংশয় হয়তো ঘটবে না, কিন্তু  মহাবিশ্বের গায়ে তৈরি করবে বেদনার রক্তিম কিছু ক্ষত?
 
এই ব্যাপারটিই বেরিয়ে এলো লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক স্টিফেন ফিনী আর তার দলবলের অনুসন্ধানী গবেষণা থেকে।তারা জানতেন, যে এ ধরণের ‘ক্ষত’ আবিস্কার করার একমাত্র জায়গা হচ্ছে নাসার উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ এনিসোট্রপি প্রোব ডেটা যাকে প্রচলিতভাবে অভিহিত করা হয়  WMAP ডেটা হিসেবে।জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিবিরণ পরিমাপের জন্য এই WMAP ডেটা ব্যবহার করে থাকেন। মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব প্রসারণের ফলে ধীরে ধীরে যে শীতল হয়ে পরম শূন্যের প্রায় ৩ ডিগ্রী উপরে এসে পৌঁছেছে, সেটা এই WMAP ডেটায় ধরা পড়েছিল, এবং এটিই ছিলো  মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং-এর প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ, এর জন্য পেনজিয়াস এবং উইলসন একসময় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই WMAP ডেটাকে এখন গুপ্ত পদার্থ ও গুপ্ত শক্তি  সনাক্তকরণ, মহাবিশ্বের স্ফিতির নিখুঁত হার নির্ণয় সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার  কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি নাসা তার বিগত সাত বছরের  WMAP ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেই ফলাফলের উপরেই চোখ রাখলেন স্টিফেন ফিনী। তারা জানতেন  অতীতে যদি মহাজাগতিক বুদ্বুদ্বীয় কোন সংঘর্ষ ঘটে থাকে, তবে তার প্রভাব WMAP ডেটায় পড়বে। কারণ এ ধরণের সংঘর্ষ ‘আন্তঃ বুদ্বুদীয় মহাজগতে এক ধরণের বিষমসাত্ত্বিক বিকৃতি (inhomogeneities in the inner-bubble cosmology) তৈরি করবে, যা  মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিবিরণে ধরা পড়তে বাধ্য। স্টিফেন ফিনী এবং তার দল ‘মডুলার এজ ডিটেকশন এলগোরিদমের’ সাহায্যে WMAP ডেটায় সংঘর্ষের ক্ষতস্থানগুলো নির্ণয় করলেন। তারা দেখলেন অন্ততঃ চারটি জায়গায় এরকম সংঘর্ষের আলামত পাওয়া যাচ্ছে; তার মানে অতীতে অন্ততঃ চার বার আমাদের মহাবিশ্বের সাথে খুব ছোট স্কেলে হলেও অন্য মহাবিশ্বের বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ ঘটেছিলো। স্টিফেন ফিনীর সম্পূর্ণ পেপারটি মুক্তমনা পাঠকদের জন্য দেয়া হল এখানে :pdf: (কৃতজ্ঞতা সংসপ্তক)।
  
 

bubblecollis-feeney-experiment    
চিত্রঃ  মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিবিরণের উপাত্তে খুঁজে পাওয়া চক্রাকার ক্ষত – বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ এর আলামত।স্টিফেন ফিনীর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে জানা যাচ্ছে, অতীতে অন্ততঃ চার বার আমাদের মহাবিশ্বের সাথে খুব ছোট স্কেলে অন্য মহাবিশ্বের বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ ঘটেছিলো। আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও অন্য অনেক মহাবিশ্ব থাকার প্রথম পরোক্ষ প্রমাণ বলে একে অভিহিত করা হচ্ছে।

 

একটি ব্যাপার বলা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা এখনো কিন্তু এই ফলফলকে সংশয়ের চোখেই দেখছেন, এবং স্টিফেন ফিনী নিজেও এটি ভাল করে জানেন। তিনি নিজেই সেটি স্বীকার করে বলেন,

মহাজাগতিক বিকিরণের মতো এতো বড় উপাত্ত-সমাবেশে এ ধরণের ছোটখাট ভিন্নতা থাকাটা আর সেটা খুঁজে পাওয়াটা অস্বাভিক কিছু নয়। নিঃসন্দেহে আমাদের এই গবেষণা এ ব্যাপারে প্রথম পরীক্ষামুলক পদক্ষেপ, কিন্তু এখনো নিশ্চিত কোন প্রমাণ নয় যদিও।

আমাদেরও কিন্তু এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে।  তারপরেও আমি বলব, যদিও আমার মতে স্টিফেন ফিনীর এই পরীক্ষার ফলাফল এখনো চূড়ান্ত নিশ্চয়তাপ্রদানকারী কিছু নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের জগতে এটি একটি আশাবাদী ঘটনা।  আর দর্শনগত দিক থেকে তো ব্যাপারটির গুরুত্ব অসীম। মাল্টিভার্স হাইপথিসিস – যাকে অনেকেই এতোদিন ভ্রু কুঁচকে বিজ্ঞানের বাইরে ঠেলে দিতে চাইতেন, এ ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো একে বিজ্ঞানের জগতে প্রথমবারের মতো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দিলো শক্তিশালীভাবে। এই ধরণের গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসছে যে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও অসংখ্য মহাবিশ্ব হয়তো ছড়িয়ে আছে, যেগুলোর কোনটির সাথে হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের সংঘর্ষ সংগঠিত হয়েছিলো  সুদূর অতীতে। আর বিজ্ঞানীরা কেবল এই ফলাফলের উপরেই নির্ভর করে বসে নেই, আমরা জানি, তারা ভবিষ্যতে আরো অনেক পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাকে সঠিকভাবে পরীক্ষা করার জন্য। এমনি একটি ভবিষ্যৎ পরীক্ষা হচ্ছে লিসা স্যাটেলাইটের (Laser Interferometer Space Antenna, সংক্ষেপে LISA) উৎক্ষেপণ। বিজ্ঞানীরা এর জন্য এখনই উদগ্রীব হয়ে বসে রয়েছেন।  ২০১১ সালের জন্য তফসিল করে রাখা লিসা আমাদের শক-তরংগ শনাক্তকরণের মাধ্যমে  আরো নিশ্চিতভাবে জানাতে পারবে সত্যিই বহির্বিশ্বে আরো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা, আর সত্যই অতীতে আমাদের সাথে লেগেছিলো নাকি কারো বুদ্বুদীয় টক্কর। যদি লিসা আমাদের অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করতে পারে, তবে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, কারণ এই ফলাফল দিবে অনন্ত মহাবিশ্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যা সূচনা করবে আরেকটি কোপার্নিকাসীয় বিপ্লবের।
 
লাস্যময়ী লিসার জন্য অপেক্ষাকালীন সময়গুলোতে আসুন আমরা মাল্টিভার্স নিয়ে মিচিও কাকুর চমৎকার একটি আলোচনা শুনি ইউটিউব থেকে।
 
httpv://www.youtube.com/watch?v=39qmbl7mpJQ

তথ্যসূত্র
[1] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পুনর্মূদ্রণ ২০০৬)
[2] বিস্তারিত তথ্যের জন্য The Inflationary Universe: The Quest for a New Theory of Cosmic Origins, Alan H. Guth, Perseus Books Group (March 1, 1998) দেখুন।
[3] Stephen W. Hawking, Black Holes and Baby Universes and Other Essays, Bantam; First Bantam trade paper edition edition, 1994
[4] Sean Carroll, From Eternity to Here: The Quest for the Ultimate Theory of Time, Plume, 2010
[5] Martin Rees, Just Six Numbers: The Deep Forces That Shape The Universe, Basic Books, 2000
[6] এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন অধ্যাপক ভিকটর স্টেঙ্গরের ‘দ্য নিউ এথিজম’ (The New Atheism: Taking a Stand for Science and Reason, Prometheus Books, 2009) বইয়ের ‘দ্য ডিজাইন ডিলুশন’ অধ্যায়টি।
[7] Victor Stenger, “Natural Explanations for the Anthropic Coincidences.” Philo 3(2000): 50-67.
[8] Anthony Aguirre, “The Cold Big-Bang Cosmology as a Counter-example to Several Anthropic Arguments”, Journal of Physical Rev, D64:083508, 2001.
[9] Martin J. Rees, Other Universes – A Scientific Perspective,
[10] Stephen Hawking, The Grand Design, Bantam;, 2010
[11] এখানে স্টিফেন হকিং  তার ১৯৮৩ সালের হকিং-হার্টলে মডেলের  নো-বাউন্ডারি কন্ডিশনের কথা উল্লেখ করেছেন, যে মডেলে তারা সিংগুলারিটিকে বাতিল করেছেন এবং দেখিয়েছেন কোয়ান্টাম প্রভাব গোনায় ধরলে মহাবিশ্বের কোন আদি বিন্দু থাকার দরকার নেই।
[12] Michio Kaku, Parallel Worlds: A Journey Through Creation, Higher Dimensions, and the Future of the Cosmos, Anchor, 2006
[13] Max Tegmark, “Parallel Universes”, Scientific American, May 2003
[14] Zeeya Merali, Will Our Universe Collide With a Neighboring One?, Discover, October 2009 issue; published online November 4, 2009