cholesh-richil
মিস্টার মিনিস্টার শাজাহান খান,

সম্প্রতি আপনি জাতিকে ওয়াজ নসিহত করে বলেছেন, ‘এনকাউন্টারে’ সন্ত্রাসী মরলে নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না! মাননীয় নৌ পরিবহন মন্ত্রী, আপনি আরো দাবি করেছেন, বর্তমানে ‘এনকাউন্টারের’ কারণেই নাকি চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বন্ধ রয়েছে!

আপনাকে সাধুবাদ জানাই, বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে আপনি নতুন কোনো কথা বলেননি বলে। ক্রসফায়ার (পড়ুন, খরচ ফায়ার)/এনকাউন্টারের পক্ষে এমন ফতোয়া ক্ষমতাসীন প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী
লীগের অনেক রথি-মহারথি নেতা-নেত্রীই অনেকদিন ধরে বলে আসছেন।

তবে আপনি এইসব মহান উক্তি যখন করছেন, তখন ইউকিলিকস ড়্যাব (ড়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান নয়, পড়ুন, রক্ষী বাহিনী এগেইন ব্যাক) নিয়ে আপনাদের গর্বের বেলুনটি লিক করে দিয়েছে। বেয়াড়া ইউকিলিকসকে উদ্ধৃত করে দি
গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, গণতন্ত্রের মহাপ্রভু ব্রিটিশ সরকার স্বয়ং নাকি খুনি এই সরকারি বাহিনীটিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে! আর প্রতিষ্ঠার পরে গত ছয় বছরে ড়্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নাকি মারা গেছে হাজার খানেক লোক।

ইতিহাস স্বাক্ষী, পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ সিকদারকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও আপনাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান (‘বঙ্গবন্ধু’ বলবো কী?) সংসদে দম্ভ করে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? এরও আগে তিনি কমিউনিস্ট ভূতের আতংকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে! মাননীয় মন্ত্রী, সে দিনও আপনারা ভুলে গিয়েছিলেন, নকশাল কারো গায়ে
লেখা থাকে না।

মি. মিনিস্টার,

আপনি যখন আমাদের ওইভাবে পাপ-পূণ্যের পার্থক্য জলের মতো পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তখন মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ বলছে, মূলত: ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এ ধরনের বক্তব্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিএনপি সরকারের মহান কীর্তি ড়্যাব নিজেরাই পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ ওই বিশেষ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর থেকে গত বছর আগস্ট পর্যন্ত ৪৭২টি ঘটনায় ৫৭৭ জন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে।

মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুর, আপনার সরকারের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ ধরে আমরা শিগগিরই ডিজিটাল ক্রসফায়ার/ এনকাউন্টারও উপহার পাবো, আমরা কী এমনটাই আশা করবো?

মি. মিনিস্টার,

কিছুদিন আগে মহান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এ হেন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মরক্ষার সময় নাকি এসব ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার-এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

অথচ দেখুন, আপনাদের ক্রসফায়ার/ এনকাউন্টারের গল্পগুলো কি পুরনো ও স্যাঁতসেঁতে:

অমুক সন্ত্রাসীকে এতো-শত অস্ত্র-শস্ত্রসহ ড়্যাব/ পুলিশ সদস্যরা গ্রেপ্তারের পর তাহাকে লাইয়া অস্ত্রভান্ডার উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রাত এতোটার দিকে রওনা হইলে তমুক জায়গায় তাহার অপরাপর সন্ত্রাসী সহযোগিরা উহাকে ছিনাইয়া লইবার জন্য আগে হইতে ওত পাতিয়া থাকে। তাহারা আসামী ছিনাইয়া লইবার নিমিত্তে উপর্যুপরি এলোপাতারি গুলি ছুঁড়িতে থাকে। ড়্যাব/ পুলিশ সদস্যরাও আত্নরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুঁড়িতে থাকে। উভয় পক্ষের ১০/১৫/২০/২৫/৩০ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর সন্ত্রীরা রণে ভঙ্গ দিয়া পলাইয়া যায়। পরে ড়্যাব/ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পরিত্যাক্ত অবস্থায়
বিপুল পরিমান অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও গুলির খোসা উদ্ধার করে। এদিকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী অমুক ড়্যাব/ পুলিশের ক্রসফায়ারে/ এনকাউন্টারে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তাহার বিরুদ্ধে অমুক-তমুক থানায় হত্যা, ধর্ষণ, খুন-জখম-ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্রের বিষয় এতো-এতো মামলা রহিয়াছে। …

মি. মিনিস্টার,

ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার-এর ইতিহাস অবশ্য খুব বেশী পুরনো নয়। এর সূত্রপাত ওপারে ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেসের আমলে, সাতের দশকে নকশালি উৎপাতের সময়। নকশাল গ্রেফতার করতে করতে ইন্দিরা সরকার জেলাখানা ভর্তি করে ফেলার পরেও নকশালি বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার চালু করেন; সেখানেও তার নেপথ্যের গল্পটি পূর্বোক্ত ( দেখুন, হাজার চুরাশীর মা–মহাশ্বেতা দেবী)।

এপারে এটি আমদানী করেন আওয়ামী লীগের প্রধান কাণ্ডারী, শেখ মুজিবুর রহমান (ভাগ্যিস, ১৯৭৫ এ আত্নস্বীকৃত খুনী কর্নেল ফারুক-রশিদ গং স্বপরিবারে মুজিব হত্যার কাণ্ডটিকে হত্যা বলেই ঘোষণা করেছিলেন, ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার নয়।)। সে হিসেবে সিরাজ সিকদার ক্রসফায়ার/এনকাউন্টারের শিকার প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিও বটে।

এর পরের সরকারগুলো ওই ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার-এরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে মাত্র। মাঝখানে বিএনপি সরকার গুলি খরচ না করে ড়্যাব-পুলিশ-বিডিয়ারের যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ (দিল সাফ?) নামক বিশেষ অপারেশন চালু করে। সে সময় আসামীরা যৌথ বাহিনীর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই হৃদরোগে মারা যেতে শুরু করেন, মোটেই অতিরিক্ত পিটুনিতে নয়! এক-এগারোর পর সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলও মারা পড়েন ওই দিল-সাফাই কর্মসূচিতে।

মি. মিনিস্টার,

খুন-সন্ত্রাস-রাহাজানি ও ঘুষ গ্রহণে অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আপনাদের গদির রক্ষার ঠেঙারে বাহিনী ড়্যাব ও পুলিশ এগিয়ে — এটি এখন প্রকাশ্য। দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা, আদালত পাড়ায় শিশু তানিয়া ধর্ষণ, ড্রাইভার জালাল ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রুবেল হত্যা একেকটি উদাহরণ মাত্র। আর দেখুন, সরকারি হিসেবেই গত বছর মাত্র দেড়মাসে চরমপন্থীদের বিচরণক্ষেত্র বলে পরিচিত কুষ্টিয়ায় ২৬ জন এনকাউন্টার/ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন!

তাই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রাচীন শাসক যখন সক্রেটিসকে হেমলকে খুন করেন, আগুনে পুড়িয়ে মারেন ব্রুনোকে বা নির্বাসনে দেন গ্যালিলিওকে– তখন তাদেরকেই অনেক বেশী গণতন্ত্রী বলে মনে হয়। তারা আর যা-ই করুক
আপনাদের মতো ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাইকারি বিক্রেতা সেজে মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বৈরাগীকে (৫৮) ক্রসফায়ার করার পর আবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফনের ভণ্ডামীটুকু অন্তত করেনি (দেখুন,
‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সত্কার, দৈনিক প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর, ২০০৯)!

মি. মিনিস্টার,

আপনারা যদি ‘সন্ত্রাসী’ নির্মূলে শেষ পর্যন্ত যদি ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার বহালই রাখতে চান, তাহলে বিনীত অনুরোধ, আপনারা বরং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী ড়্যাব/পুলিশ দিয়েই সন্ত্রাসী নির্মূল শুরু করুন, এদেরকে দিয়েই শুরু করুন ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার। প্রয়োজনে এ জন্য না হয় তৈরি করুন আরেকটি বিশেষ খুনি বাহিনী। পরে না হয় তাদের নির্মূলে আবারো নতুন কোনো বাহিনী তৈরি করা যাবে! তারপর আবার…


পুনর্লিখিত।

ছবি: যৌথবাহিনীর হেফাজতে নিহত গারো আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল, ড়্যাব ইন অ্যাকশন, ফাইল ফটো।

পড়ুন: WikiLeaks cables: Bangladeshi ‘death squad’ trained by UK government, guardian.co.uk