ইরাণের বিশ্ববরেণ্য পরিচালক জাফর পানাহিকে ছ বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হল। সাথে সাথে আগামী ২০ বছর তিনি কোন সিনেমা বানাতে পারবেন না। পারবেন না লিখতে , পারবেন না ইন্টারভিঊ দিতে।
পানাহির সাথে আমার পরিচয় দুটো সিনেমা দিয়েঃ সার্কল আর অফসাইড। দুটিই নারীবাদি নিওরিয়াল সিনেমা। মোল্লাতন্ত্রের শরিয়া আইনে ইরাণে মহিলাদের দুরাবস্থার বাস্তব চিত্র। সেদেশের মায়েরদের অধিকার নেই সস্তানের ওপর। তিন তালাকের জেরে যেকোন মাকে সন্তান ছেরে চলে যেতে হয়। সেই ধরনের বর্বর শরিয়া আইন ইরানে- যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেলে আছেন ইরানের ৬৪ জন নারীবাদি নেত্রী। কিছুদিন আগেও মোল্লা এবং তাদের স্যাঙাত আহমেদাঞ্জিদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে উত্তাল হয়েছে ইরাণ। সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করেছে ইরানের পুলিশ। গ্রেফতার হয়েছে হাজার হাজার বিরোধি, নিহত শতাধিক।
একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার পানাহির মতন একজন মানবিকতাবাদিকে জেলে পুরবে এটাই স্বাভাবিক। গান্ধী অনেকদিন আগেই বলে গেছেন, স্বৈরতন্ত্রে একমাত্র জেল হাজতেই মানুষ পাওয়া যায়। স্বৈরতান্ত্রিক একটা সিস্টেম নিজেকে বাঁচাতে পানাহির মতন স্বাধীন চিন্তার অধিকারী মানুষদের খুন করবে-জেলে দেবে। আশ্চর্য্য হবার কি আছে! এটাইত পৃথিবীর ইতিহাস।
ক্ষমতাসীন হায়নাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তাদের আঁচড় লাগবেই।
এই নিয়ে আমি ব্লগ লিখছি না। প্রতিবাদও করছি না। পানাহির বিরুদ্ধে অভিযোগ হাস্যকর। সরকার বিরোধি ফিল্ম বানাচ্ছিলেন! স্বৈরতন্ত্রের কার্যকলাপ হাস্যকরই হয়। লিউ জিয়াবোকে আটকাতে চীনের কার্যকলাপও আমরা দেখেছি। সেই নিয়েও আমি চিন্তিত না।
আমি এই ব্লগ লিখছি কিছু বাঙালী বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে। যারা আহমেদাঞ্জী এবং ইরানের সমর্থক।
ইরানের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের ওপর যখন গতবছর অত্যাচার শুরু হল-আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম কিছু বাঙালী বামপন্থী-এটাকে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার চক্রান্ত বলে চালানোর চেষ্টা করছে।
একজন মা তার সন্তানের ওপর নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে-এবং সেই আন্দোলন যদি বাঙালী বামপন্থীরা সিয়ার আন্দোলন বলে মনে করে, আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি, কেন বাংলার বামপন্থী আন্দোলন আজকে সম্পূর্ন জনবিচ্ছিন্ন। আমেরিকার বিরোধিতা করেছে মানে, তাকে বামপন্থীদের সমর্থন করতে হবে-এই ধরনের ছাগলামি করতে করতে বাঙালী বামপন্থীরা আস্তে আস্তে লুপ্তপ্রায় প্রানীতে পরিণত হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো বা হুগো শাভেজ, আহমেদেনিঞ্জাকে সমর্থন করছেন-তাই বাঙালী বামপন্থীরা ইরাণের মোল্লাতন্ত্রের সমর্থক হয়ে যায়। কি হাস্যকর! আহমেদনিঞ্জা একটি কাঠমোল্লা সে হিসাব মাথায় থাকে না। মাথায় থাকে না ইরানে মায়েরদের অধিকার নেই সন্তানের ওপর।
ক্ষমতা লাভের জন্যে সব দেশেই শাসক শ্রেনী মানবিকতাবাদিদের পেছনে লাগবে। চীনের আসল মুখ আমরা দেখলাম। ইরানের দেখলাম। ওয়াকিলিকসের সুবাদে আমেরিকার শাসক শ্রেনীদের মুখোস ও খসে গেল। এবং আমরা নিশ্চয় চাইব না এদের যেসব ক্লোন আমাদের ভারতে আছে -যেমন কমিনিউস্ট বা ধর্মীয় জাতিয়তাবাদি পার্টিগুলি একটুও ক্ষমতার কাছাকাছি যাক। ধর্ম, জাতিয়তাবাদ বা গরীবদের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু ক্ষমতা দখলের জন্যে “মিডিয়া ম্যাজিক”। আহমেদাঞ্জি এই তিনটি জিনিস নিয়েই যৌন সুরসুড়ি দেন। ধর্ম আর জাতিয়তাবাদ ত ছিলই-তার সাথে তিনি জুরেছিলেন ইসলামিক বামপন্থা। তেলের টাকায় সরকারি খরচ বাড়িয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তেলের দাম কমে যেতেই, সব ম্যাজিক শেষ-বেকারত্বের তীব্র বৃদ্ধি এবং জনগণের বিক্ষোভের শুরু। হুগো শাভেজ ও সেই এক পথের পথিক-তেল বেচে ওয়েল ফেয়ার স্টেট বানাতে গেছেন। আর তেলের দাম কমতেই, তার সব পরিকল্পনা বাতিল। এর বিপরীতে অবস্থান কাতারের প্রিন্স ওয়ালেদের। যিনি তেলের টাকায় কাতারে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প গড়ছেন দোহাতে-মোদ্দা কথা তেলের টাকা বিকিয়ে না দিয়ে, সেই টাকায় দেশকে শিল্প উন্নত করা উচিত। যারে আরো চাকরী সৃষ্টি হয় এবং দেশের অর্থনীতি তেল নির্ভর না হয়। আহমেদেনিঞ্জা এবং শাভেজ দুজনেই পপুলিস্ট-তেলের টাকা দেদার সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ারে বিলিয়ে এখন তেলের দাম বসে যেতেই, দেশকে সমস্যার মুখে ফেলেছেন। এই দেশগুলিতে বেকারত্ব বাড়ছে সাংঘাতিক ভাবে। ফলে জনগণ বিক্ষুব্ধ। তবুও শাভেজের জনপ্রিয়তা আছে-কিন্ত ইরানে গনতন্ত্র নেই। ফলে জনগনের বিক্ষোভ যাবে কোথায়?
ফলে ইরানে আরো বেকারত্ব বাড়বে এবং মোল্লাতন্ত্রের আরো উৎপাত আমরা দেখব। এবং সেই মোল্লাদের সমর্থক বাঙালী বামপন্থীদের আরো অনেক সার্কাসও দেখার জন্যেও তৈরী হৌন।
বিপ্লব দা, প্রতিবাদের এমন নিরপেক্ষতায় চাই। শত্রুর শত্রু বন্ধু, এর চেয়ে ভয়াবহ ধারণা কমই আছে।
চরম বাম ও ডান দুই দলেরই সমস্যা একই; মুক্ত চিন্তা বা মুক্তবুদ্ধিকে ভয় পাওয়া। কোথায় কি লেখা আছে বা কোন তত্ত্বে কে কবে কি বলে গেছে সেই দিয়ে চোখ কান বুঁজে সমাজ চালানোর হাস্যকর চেষ্টা। আর কেউ সেসব নিয়ে প্রশ্ন করলেই তার উপর খড়ঘহস্ত হওয়া।
ইরানে যেভাবে পাথড় ছুড়ে হত্যা করা বা প্রকাশ্যে মহিলা- পুরুষদেরকে হাজার হাজার লোকের সামনে টেনে হিচড়ে নিয়ে ফাঁসি দেয় এবং তা দেখে ভয়ে চুপ না থেকে জোড়ে জোড়ে আল্লার পক্ষে স্লোগান দেয়, তা অত্যন্ত কুৎসিত ,বিভৎস এবং ভয়ংকর। যারা এসব দৃশ্য সব সময় দেখে তারাও বিভৎস না হয়ে পারেনা। জাফর পানাহির মত লোকদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবাদ ইরানিরা না করারই কথা।
ইসলাম আর গনতন্ত্র কখনোই পাশাপাশি থাকতে পারেনা। বেকারত্ব , অর্থনৈতিক মন্দা থাকলে বিক্ষোব হবে , বিপ্লব হবে। আর বিপ্লব নতুন কোন মুক্তি নিয়ে আসবে কিন্তু ইসলামি পতাকার নিচে থেকে নতুন বিপ্লব আরেকটি আহমেদনিঞ্জাই আনবে।
ইরানের মতো অপার সম্ভাবনার একটি দেশ কিভাবে যে মৌলবাদী শাসনের শেকলে বছরের পর বছর কাটিয়ে যাচ্ছে তা দেখতেও খারাপ লাগে। সভ্যতার ধারাবাহিকতায় ইরানের সমকক্ষ কেবলমাত্র ভারত আর চীন। পশ্চীমের একাডেমিয়া এবং গবেষনায় একমাত্র যে দুটি মুসলিম দেশের উল্লেখকরার মতো উপস্থিতি দেখা যায়, তারা হলো ইরান আর তুরস্ক। বিশ্বব্যাপী এরজাৎস কালচারের ঢেউ এর মধ্যে যেসব সংষ্কৃতি এখনো নিজস্ব পাওয়ারহাউস স্ট্যাটাস ধরে রেখেছে, ইরান তাদের অন্যতম।
অনেক ইরানীর সাথে কথা বলে আমার এই ধারনাই আরো শক্ত হয়েছে যে মৌলবাদী শাসনের মতো জাতীয় মানসের জন্যে হীনকর আর কিছু নেই। সেটা হোক ডানপন্থী, বামপন্থী অথবা ধর্মীয় মৌলবাদ। এদের একটিকে বিরোধীতা করতে যেয়ে অন্য আরেকটিকে আলিংগন করলে সাময়িক রাজনোৈতিক সুবিধা হতে পারে কিন্তু অন্যদিকে দীর্ঘকালীন আদর্শিক দীনতার পথ প্রশস্থ হয়।
@ বিপ্লব,
এই বামপন্থীদের ইরানের মোল্লাদের পক্ষে দাঁড়ানোটা শুধু হাস্যকরই নয়, এটা দিয়ে আসলে তাদের দেউলিয়াত্বই প্রমাণিত হয়। এই ইরানের মোল্লারাই কয়েক দশক আগে কমিউনিষ্টদের কিভাবে কচুকাটা করেছিল তা কী সবাই ভুলে গেল? তবে বামপন্থীদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চরম রক্ষণশীল রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর প্রশংসা করাটাকেও আমার কাছে একই রকম ভুল বলেই মনে হয়।
@বন্যা আহমেদ,
আমি রাজতন্ত্রের প্রশংসা করছি না। হয়ত লাইনটা লেখা উচিত ছিল। আমি প্রিন্স ওয়ালেদের স্ট্রাটেজির প্রশংসা করছি-তেলের টাকা কাতার শিক্ষা এবং উচ্চ প্রযুক্তির জন্যে ব্যায় করছে। কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ব্যাতিক্রম হিসাবে উঠে আসছে। কাতার তেলের ্টাকায় তাদের ছাত্রদের চীন, ভারত এবং আমেরিকাতে পাঠাচ্ছে পড়াতে-ফিরে আসার পর তাদের টাকা দিচ্ছে, উচ্চ প্রযুক্তির কোম্পানী খুলতে।
প্রিন্স ওয়ালেড হার্ভাডএর এম বি এ। উনি এটা বোঝেন, তেল শেষ হ লে সব শেষ এবং তেলের টাকায় একটা জাতিকে শিক্ষা এবং বিজ্ঞানে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। উনি যেভাবে তেলের টাকা জাতীয় স্বার্থে বিনিয়োগ করেছে্ন সেটা করলে ইরান বা ভেনেজুয়েলাতে সমস্যা থাকত না।
@বিপ্লব পাল,
ইরানী ছবি যে কয়টা দেখেছি প্রায় গুলোই শিশু মনস্তত্ত্ব, তাদের জীবনযাপন,আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, পাখি প্রেম ইত্যাদি। সার্কেল ও অফসাইড এর ব্যতিক্রম।
অনেক অনেক ধন্যবাদ বিষয়টির অবতারণা করার জন্য। জাফর পানাহির জন্য রইল সহমর্মিতা। তার বন্দিত্বের প্রতিবাদ করছি ও শীঘ্রই তার মুক্তি কামনা করছি।
@বিপ্লব পাল, হার্ভাডকে অনেকেই সরাসরি “নাস্তিক”দের পাঠাগারে ফেলে দিচ্ছেন। সুতরাং সেখান থেকে বের হয়ে কেউ মসজিদ-মাদ্রাসা না খুলে বিজ্ঞানের নামে কোম্পানী খুলবে আর বিশ্বাসের ভিত্তি নষ্ট করবে- এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে বলেই এরা অনেকের “শত্রু”।
দীর্ঘশ্বাস! :deadrose:
:deadrose: দুঃখজনক।
@লেখক, “হরি বোল”!!!
একেই বোলে “গোলে হরিবোল” ডাক! হা হা হা!
হাস্যকরই বটে। আসলে শত্রুর শত্রু কাঠমোল্লা তখন বামপন্থীদের বন্ধু হয়ে যায় আর কি!
@ব্রাইট স্মাইল্, একমত
@ব্রাইট স্মাইল্, শত্রুর শত্রু বন্ধু হলে সমস্যা কি? বিভেদের জায়গাটা পরিষ্কার থাকলেই তো হল; এ কি কুম্ভকর্ণ যুক্তি!!!
@তনুশ্রী রয়,
খাঁটি বন্ধুত্ব হলে সমস্যা নাই, কিন্তু উদ্দেশ্যমুলক বন্ধুত্ব হলে সমস্যা আছে বৈকি।