পুরনো দিনের কাহিনি

আকাশ মালিক

আজ ০৪-১২-২০১০ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকার একটি সংবাদ ছিল ‘পীরের উদ্ভট চিকিৎসা কেড়ে নিল ছাত্রীর প্রাণ’। সদ্য এইচ এস সি পাশ, পীরের হাতের ঔষধ খেয়ে, জিনে ধরা সিলেটের এক কিশোর তরুণীর মৃত্যুর খবর পড়ে, বহু দিনের পুরনো একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন ছোট ছিলাম, মাদ্রাসায় পড়তাম। টুকটাক যাদু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্র শিখেছি, দু-এক যায়গায় সাক্সেসফুল তায়-তদবিরও করেছি। ইংল্যান্ড থেকে আমার এক চাচাতো ভাই হারুন রশিদ পাঁচ বৎসর পর আজ বাড়ি এসেছেন। তার চোখে ঘরের ভিতরে দিনের বেলাও ঝাপসা অন্ধকার লাগে, মানুষগুলো দেখতে ছোটছোট লাগে, খানা-পিনায় সব বালিবালি লাগে, গ্লাস-বাটি ময়লা ময়লা লাগে, রাস্তাঘাট ভুলে গেছেন, বিশেষ করে নৌকায় উঠলে মাথা ঘুরায়, সুতরাং আমি তার সার্বক্ষণিক বডিগার্ড। গায়ে শ্যামবর্ণের কোন লক্ষণই নেই, একেবারে ছায়ায় ঢাকা ঘাসের মত সাদা দবদবে চেহারা। কাপড়ে চোপড়ে স্বর্গীয় সুবাস, স্পেশিয়েলি তার আফটারশেইভ আর সিগারেটে। বাপরে বাপ, এমন বড় সোনালী আর লাল রঙে মিশেল করা সিগারেটের প্যাকেট আমি জীবনেও দেখি নাই। এমনিতেই লম্বা সিগারেট, এর মাঝে তার পাছায় তুলা লাগানো। রশিদ ভাই লম্বা সিগারেটের অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটুকু ফেলে দিতেন। এই ফেলে দেয়ারও আলাদা একটা স্টাইল ছিল। ক্যারম খেলার স্ট্রাইক মারার মত বুড়ি আঙ্গুল আর শাহাদত আঙ্গুলের মাঝখানে সিগারেট রেখে এমন ভাবে ছোঁড়ে মারতেন যে, সিগারেট বিশ হাত দূরে গিয়ে পড়তো। মনে মনে ভাবতাম, বিলেত বোধ হয় বেহেস্তের কাছাকাছি কোথাও অবস্থিত। রশিদ ভাই আই এ পাশ, উচ্চতায় সাত ফুট না হলেও সাড়ে ছয় ফুট অবশ্যই হবেন। সদাহাস্য, বলিষ্ট দেহের আর সুন্দর চেহারার মানুষ। দু একটা সিগারেট যে তার চুরি করি নাই, এ কথা বললে বড় সাইজের গোনাহ হবে।

একমাস পরে আজ রশিদ ভাইয়ের বিবাহের দিন। ভাবী হাজেরা খাতুন আমার এক সময়ের পুতুল খেলা, এক্কা-দুক্কা খেলা, চীনা বরতনের ভাঙ্গা টুকরা দিয়ে খেলা, ছনের খড়ে, বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে লুকোচুরি খেলার সাথী। আমাদের বাড়ি থেকে তিন বাড়ি উত্তরে তাদের বাড়ি। বিয়ের সময় হাজেরার বয়স ছিল নয় বৎসর আর ভাইয়ের বয়স ২৫। ভাবী, ভাইয়ের আপন মামাতো বোন। গত একমাস যাবত হাজেরা কেন তার ফুফুর বাড়ি আসলোনা, তা বুঝতে পারলাম তার বিয়ের পরে। আকদের আসরে আমি মৌলভী সাহেবের পাশেই ছিলাম। একসময় তিনি যখন প্রশ্ন করলেন, ‘মোছাম্মাত হাজেরা খাতুন সা’বালেগা না লা’বালেগা’? একজন উত্তর দিলেন, ‘কন্যা লা-বালেগা’। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব একটা স্পষ্ট ছিলনা। মাদ্রাসায়ও এই বালেগ-না’বালেগ, হায়েজ-নেফাস, বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাঝেমাঝে আমাকে নিয়ে হুজুর বড় বিপদে পড়ে যেতেন। একদিন তো হুজুর মধ্যপথে জামাত (ক্লাশ) বাদ দিতেই বাধ্য হয়েছিলেন। ফার্সী ভাষায় লেখা কিতাব, সঙ্গমের মাসায়েল পড়ানো হবে। বিষয়- ‘সঙ্গম উপুড় হয়ে, না চিৎ হয়ে, সম্মুখ থেকে, না পেছন থেকে হবে’ এ নিয়ে শরিয়তের বিধান কী, তা শেখানো হচ্ছে। সঙ্গে আছে নারী পুরুষের বীর্যের স্পিড, ঘনত্ব, আয়তন, দৈর্ঘ, প্রস্থ, আরো আছে লুঙ্গি, বিছানা-চাদর ভেজা-ভেজির ব্যাপার স্যাপার। ফার্সীতে ( مقاربت از جلو یا پشت ) আমি از جلو এর অর্থ ‘সম্মুখ থেকে’ یا پشت এর অর্থ ‘অথবা পেছন থেকে’ বুঝি কিন্তু مقاربت এর অর্থ কিছুতেই বুঝিনা। এ নিয়ে জামাতের ভেতরে তুমুল অট্টহাসি শুরু হয়ে যায়। হুজুর নিজেও আর হাসি বন্ধ করতে পারছেন না। এক পর্যাযে ক্লাশ কেনসেল। এর পরে বেশ কিছুদিন আমি জামাতে ঢুকলেই বয়স্ক ছাত্ররা ঐ শব্দ দুটি নিয়ে পুশতু-পুশতু (পেছন-পেছন) বলে হাসাহাসি করতো, এমনকি হুজুরও ক্লাশে ঢুকেই প্রথমে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাতেন, আমি বড়ই লজ্জা পেতাম।

বিয়ের আসরে মৌলভি সাহেব রশিদ ভাইকে লক্ষ্য করে দুইবার বললেন, জোরে কবুল বলুন, আমরা শুনছিনা। তৃতীয়বারে বরের সমবয়সী তার এক বন্ধু বললেন ‘দামান্দ কবুল বলেছেন, আপনারা সবাই বলুন আলহামদুলিল্লাহ’। কেউ শুনেছিল কি না জানিনা, অন্তত আমি কিছু শুনি নাই। সবাই হাত উঠালেন, মৌলভি সাহেব লম্বা একটা দোয়া করলেন। আল্লাহ যেন এই স্বামী-স্ত্রীকে আদম-হাওয়া, ইউসুফ-জুলেখা, আইয়ুব-রহিমা, ইব্রাহিম-হাজেরার জুড়ি বানায়। হাজেরা খাতুনের ঘরে যেন ইসমাইলের মত ঈমানদার সন্তান হয় ইত্যাদি। সবাই আমিন বললেন, বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।

বাসর ঘরে ঘোমটা পরা, পালংকের উপর চোখ বুঁজে বসা হাজেরাকে দেখলাম। বড় অপরিচিত মনে হল। রশিদ ভাই ঘরে ঢুকলেন, ভাবীকে নিচে নামানো হল, স্বামীর সামনে মাথা নত করে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হবে। দাঁড়ানো অবস্থায় হাজেরাকে দেখে মনে হল, নয় বৎসরে হাজেরা যত লম্বা হয়নি, একমাসে তার চেয়ে বেশী হয়েছে।

রশিদ ভাই এই বিয়েতে মোটেই রাজী ছিলেন না। প্রথম থেকেই তার আপত্তি ছিল কন্যার বয়সের উপর। তারপর তিনি বলতেন, আপন মামাতো, খালাতো, চাচাতো ভাই-বোন, নিজের সহোদর ভাই বোনের মত, এবং নিকটতম সম্পর্কের সাথে বিয়ে, সাস্থ্য ও আগন্তক শিশুর জন্যে ক্ষতিকর। কে শুনে, কে বিশ্বাস করে তার কথা? বড় চাচা, মেজো চাচা, চাচী, মামী বাড়িশুদ্ধ মানুষ জড়ো হলেন, লম্বা লম্বা ওয়াজ নসিহত করা হল। মা-বাবার পছন্দের উলটা গেলে, অবাধ্য হয়ে মরলে বেহেস্ত নসিব হয়না, সংসারে বরকত আসেনা, আরো কত কী বলা হল, ছোটরা তার অনেক কিছুই বুঝলোনা। রশিদ ভাই নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। বাড়িতে পাঞ্জেগানা মসজিদ আছে। সাধারণত নামাজের জামাত শুরু হওয়ার আগে রশিদ ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করা হয়, তিনি নামাজী মানুষ। বিয়ের পরের দিন আজ ফজরের জামাতে কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করলোনা। আমি বিষয়টা তুলায় মুরুব্বি একজন বললেন, তার নাকি শরীর ভাল নয়। নামাজ শেষে আমি রশিদ ভাইয়ের উঠোনে পায়চারি করছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ভোর বেলা নাইটগাউন পরা অবস্থায় রশিদ ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে একা বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। আমাকে দেখেই হঠাৎ হু-হু করে কান্না শুরু করে দেন। আমি ভয়ে ভয়ে পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করি- ‘কী হয়েছে, আপনি কাঁদছেন কেন’? আমার হাতে ধরে অবুঝ অসহায় বালকের মত হাউমাউ করে বলতে থাকেন, ‘ আমি কেন দেশে আসলাম, আমি কেন দেশে আসলাম, হায় আল্লাহ, এ আমার কোন পাপের শাস্তিগো’। আওয়াজ শুনে চাচী বেরিয়ে আসলেন। ধীরেধীরে বাড়ির নারী-পুরুষ প্রায় সবাই উঠোনে এসে জড়ো হলেন। রশিদ ভাই বলতে থাকেন- ‘আমার মেয়ের বয়সি একটা বাচ্ছাকে আমার কাছে বিয়ে দিয়ে তোমাদের স্বার্থটা কী হলো? কী অপরাধ করেছে এই বাচ্ছা মেয়েটা, কী ক্ষতি করেছি আমি তোমাদের’? সবাই অবাক বাকরুদ্ধ, কারো মুখে কোন কথা নেই। বড়দের মুখ থেকে হুশ-হুশ, ফিশ-ফিশ শব্দ শুনা গেল, উপস্থিত ছোটদেরকে সরিয়ে দেয়া হল। অল্পক্ষণ পরে পাশের গ্রামের মহিলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শুক্লা রাণীকে ডেকে আনা হলো। কার কী রোগ হল, কার জন্যে ডাক্তার ডাকা হল বুঝা গেলনা।

পরের দিন বড়িতে একটা থমথমে ভাব দেখা গেল। হঠাৎ করেই যেন অসময়ে বিয়ে বাড়ির সকল কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল। হাজেরা ভাবীর ঘরে ছোটদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হল। এখন পর্যন্ত ভাবীর সাথে আমার কোন কথা হয়নি, চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি তাকে দেখার সুযোগও হয়নি। তৃতীয় দিনে ভাবী প্রথম নাইওর গেলেন তার বাপের বাড়ী। রশিদ ভাই আগের মত আমাকে ডেকে নেন না, আসলে কারো সাথে কোন কথাই বলেন না। প্রায়ই পুকুর পাড়ে পাকা ঘাটের সিড়িতে উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে তার সাথে বাড়ির বড়দের জরুরী মিটিং হয়। কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় হাজেরা ভাবীকে তার স্বামীর বাড়ি নিয়ে আসা হল, কিছুদিন আগেও যে বাড়িটি ছিল তার ফুফুর বাড়ি। ভাবীর আসার সংবাদ শুনে আমি মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ জীবনে তো আমার দোয়া কোনদিন কবুল করোনি, আমার নয়, বিয়ের আসরে তোমার ঐ নেককার বান্দাদের দোয়া তুমি ফেলে দিতে পারোনা, তাদের খাতিরে এই নবদম্পতি এই দুটো মানুষকে তুমি চির সূখী করে দাও। ভাবী বাড়ি আসলেন, সব কিছু যেন স্বাভাবিক, কারো চেহারায় কোন উৎকন্ঠার আলামত নেই।

এই বাড়ির সবকিছু, এই গাছ-বিছালি, পুকুর, এই রান্নাঘর, এই বারান্দা হাজেরার খুবই পরিচিত। হাজেরার স্বামীর ঘরের পেছনে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট্ট এক টুকরো উঠোন। উঠোনের প্রান্থে কয়েকটা সুপারি গাছ, বড় বড় দুটো নারিকেল গাছ। বাড়ির প্রবীণ মহিলারা প্রায় সন্ধ্যায়ই এখানে জড়ো হয়ে, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা, বিষয়াদী নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। ঠিক মাঝখানে আছে এঁটেল মাটির তৈরী বড় একটি উনুন। নিপুণ কারিগরি দক্ষতায় তৈরী উনুনে একসাথে দুটো হাঁড়ি বসে। তিনটা সুপারি গাছে ঝুলে আছে আরেক সুনিপুণ কারিগর বাবুই পাখিদের কমপক্ষে পনরোটা বাসা। নারিকেল গাছে কয়েকটা সাড়স পাখির ঘন ঘন আনাগোনায় অনুমান করা যায়, তাদের মাথায় বাসা বুনার পরিকল্পনা আছে।

চাচী ভাবীর আপন ফুফু হলেও এখন তিনি শাশুড়ী। একমাস আগের বালিকা হাজেরা আর বালিকা নয়, রিতিমত এক গৃহবধু। আজ মাদ্রাসা থেকে এসেই আমি মনে মনে প্লান করে রেখেছি, আছরের নামাজের পরে হাজেরাকে দেখতে যাবো। চিন্তা করছি ভাবী ডাকবো, না হাজেরাই ডাকবো। যা’ই ডাকিনা কেন, কানে কানে বলে আসব যে, আমি রশিদ ভাইয়ের কিছু সিগারেট চুরি করেছি। সেখানে গিয়ে দেখি ঘরে কেউ নেই। রশিদ ভাই বাজারে গেছেন এখনও ফিরেন নি। পেছনে গিয়ে দেখি চাচী সেই ছোট্ট উঠোনে রোমেনা আপা আর হাজেরাকে নিয়ে বসেছেন, রান্না বান্নার সকল সরঞ্জাম সামনে নিয়ে। চাচী আজ সন্ধ্যায় নতুন বৌমাকে রান্না শেখাবেন। রোমেনা আপা রশিদ ভাইয়ের ছোট বোন হলেও বয়সে আমার কিছুটা বড়। আমাকে দেখেই বললেন-
– মোল্লা মানুষ, এখানে কী?
– হাজেরাকে তো ভালভাবে দেখা হয়নি আপা।
– হাজেরা কী, ভাবী বলো, ভাবী। আর এমনিতে দেখা যাবেনা, পয়সা লাগবে, সালামি।
– আচ্ছা, ঠিক আছে ভাবীই ডাকবো। কিন্তু মোল্লা মানুষ পয়সা পাবো কই, সালামি তো আনি নাই।
– আচ্ছা ঠিক আছে, এক কাজ করো। খুব তো পিরাকি শিখেছ, এখানে দাঁড়িয়ে এবার তুমি জোরে-জোরে সুরে-সুরে একটা কেরাত শুনাও। তোমার কেরাত শুনে এই গ্রামে কোন জিন-ভুত থাকলে তারা যেন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর আমার ভাবীকে দেখে তুমি নজর দিতে পারবেনা।
– আমি নজর দেবো কি আপা? হাজেরা ভাবীর উপর যদি কারো নজর পড়ে তো পড়বে আল্লাহর। আল্লাহ এমন সুন্দর করে আরো একটা মানুষ সৃষ্টি হয়তো করেতেই পারবেনা।

আশ্চর্য আমরা এতক্ষণ কথা বলছি হাজেরা ভাবী কোন কথা বলেন না। কোন সাড়াশব্দ, নড়াচড়া নেই। লক্ষ্য করলাম, সেই নারিকেল গাছের উপরে তার চক্ষু নিষ্পলক স্থির আটকে আছে। চাচী বললেন- বৌমা, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো, মাগরিবের সময় হয়ে গেছে মাথায় কাপড় তোল। হাজেরা আপন মনে হাসছে, বড়বড় চক্ষুদ্বয় ঠিক আগেরই মত নারিকেল গাছের উপরে। রোমেনা আপা বললেন- ‘ও ভাবী তুমি শুনছো, মা কী বললেন’? হাজেরা বিকট এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, হাসি আর বন্ধ করেনা। নারিকেল গাছের আগা থেকে চক্ষুও ফেরায়না। চাচী মারাত্বক একটা কিছু টের পেলেন। তিনি যেইমাত্র হাজেরার মাথায় ঘোমটা টানতে উদ্যত হলেন, অমনি সে দুই হাতে ঝাপ্টা মেরে নিজের বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলতে চাইলো। চাচী বললেন- তোমরা ধরাধরি করে তাড়াতাড়ি বৌমাকে ঘরে নিয়ে এসো, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোরবানির গরু যেমন গলায় ছুরি লাগানোর মুহুর্তে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে, হাজেরা ঠিক সে ভাবেই হাত-পা ছুঁড়তে থাকলো। অনেক ধস্তাধস্তি করে আমরা তাকে বিছানায় নিয়ে আসতে সক্ষম হলাম। হাজেরা তখনো হাসছে আর হাত পা শক্ত করে লাথি ঘুসি মারছে। চাচী বারবার আমাকে বলছেন- ‘ও বাবা কিছু একটা করো, তোমার কিছু জানা থাকলে পড়ো’। ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। রোমেনা আপা বিরক্তির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘কোন ঘোড়ার ডিম এতদিন মাদ্রাসায় পড়লে, কিছুই করতে পারছোনা’? সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর কোনদিন পিরাকির নামে ভন্ডামী করবো না। কিছুক্ষণ পর হাজেরা শান্ত হয়ে গেল। এবার তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। চাচী ভেজা তোয়াল দিয়ে তার মুখ, মাথা মুছে দিচ্ছেন। ধীরেধীরে হাজেরার হাত-পা নরম হয়ে আসলো, আস্তে আস্তে সে ঘুমিয়ে পড়লো। অল্পক্ষণ পরেই চোখ মেলে তাকিয়ে আমাদেরকে দেখে মাথায় ঘোমটা টানার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলোনা। রোমেনা আপাকে লক্ষ্য করে বললো-‘ আপা আমার হাত-পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে, আমার শরীরে এত ব্যথা হচ্ছে কেন’? আমার বুক ফেটে কান্না আসার উপক্রম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। এশার নামাজের সময় রশিদ ভাই বাড়ি এসে সব শুনলেন। তার সামনেই মধ্যরাতে আবার হুলুস্তুল শুরু হলো। সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন হাজেরা আর স্বাভাবিক নয়, সে জিনের কন্ট্রোলে চলে গেছে। পুরো তিন সপ্তাহ ধরে দেশের নামীদামী বড়বড় পীর-ফকির আসলেন। কেউ বললেন বাটিচালান, কেউ বলেলেন যাদু কেউ বললেন বাণ। আলেম-ওলামা আসলেন, হিসার করলেন, ইস্তেখারা করলেন, সপ্নযোগে জিনের সন্ধান নিলেন, বিচিত্র ধরণের হাজার প্রকার তথ্য-তত্ত্ব, তাবিজ-কবচ, ঔষধ-পথ্য দিলেন, হাজেরার কোন পরিবর্তন নেই। দিনদিন হাজেরার অবস্থার অবনতি হতে থাকলো। একদিন তার বাবা এসে হাজেরাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। এর পর হাজেরা আমাদের বাড়িতে আর কোনদিন ফিরে আসেনি।
হাজেরা চলে যাওয়ার পরের দিন রশিদ ভাই তার আত্মীয়দের ডেকে জড় করলেন, হাতে একটুকরো কাগজ। বললেন-‘ এভাবে একটা কচি মেয়েকে শাস্তি দেয়ার কোন মা’নে হয়না, আমি হাজেরাকে মুক্তি দিতে চাই। যেহেতু এখানে হাজেরার কোন দোষ নেই, আমি তার কাবিনের ৬ কেদার জমি (বর্তমান মূল্য ৬ কোটি টাকা) ১০ বরি সোনা, সকল প্রকার অলংকার ও বস্ত্রাদি এবং ডাক্তারি ঔষধ-পথ্য করানোর জন্যে ৫০হাজার টাকা দিয়ে এই তালাক নামায় দস্তখত করলাম’। বাড়ি ভরা মানুষ কেউ একটু টু শব্দও করলেন না। মসজিদের ইমাম সাহেব বিড়বিড় করে বলেছিলেন- ‘পাগল অবস্তায় বিবি তালাক হয়না’। কেউ তার কথায় কর্ণপাত করলোনা, মাথা নীচু করে, মলিন চেহারায়, সবাই ধীরেধীরে স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন।
এক সপ্তাহ পরে হাজেরার বাবা আমাদের বাড়ি আসলেন, বোনকে দেখার জন্যে নয়, ভাগিনাকে দু কথা শুনানোর জন্যে। বললেন-‘ আমি তো বাবা তোমার ধনের কাঙ্গাল ছিলাম না, আমার নিরপরাধ মেয়েটাকে তুমি ছেড়ে দিলে। তালাকের সংবাদ শুনে মেয়েটি প্রচুর কেঁদেছে। একসপ্তাহ হলো তার মধ্যে তো কোন অস্বাভাবিক আচরণ দেখলাম না। কোন প্রকার ডাক্তার কবিরাজও দেখালাম না। একটা সুস্থ সবল মেয়েকে তুমি এভাবে ছেড়ে দিলে’? রশিদ ভাইকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি তরতর করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।

যেহেতু এটা কোন গপ্ল নয়, সত্য কাহিনি তাই পাঠকের জন্যে ঘটনার শেষ পরিণতি গলায় আটকিয়ে রেখে লাভ নেই। এর ৭ বৎসর পরে ঠিক রশিদ ভাইয়ের মতই শিক্ষিত প্রবাসী এক হৃদয়বান ব্যক্তির সাথে হাজেরার বিয়ে হয়, এবং ৫ সন্তানের জননী হাজেরা সুখেই বিলেতের কোন একটি অঞ্চলে বসবাস করছেন।

এখানে আছে সিলেটের অভাগিনী রিফাতের কাহিনি। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে রিফাত, হাজেরাদের এই দুর্গতি কি কোনদিনই শেষ হবার নয়? জিন-ভুতেরা কেন বারেবারে শুধু মেয়েদেরকেই আক্রমণ করে? সমাজ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানে কি এর কোন ব্যাখ্যা নেই? কামনা করি এমন কাহিনি যেন আর কাউকে কোনদিন নতুন করে লিখতে না হয়।