টাকা ধার

 

(১)

 

কাঁচুমাচু করে বড় সাহেবের রুমে ঢোকে পিওন দুলাল মিয়া। ঢুকেই লম্বা করে একটা সালাম দেয়। স্লামালেকুম স্যার।

 

লম্বা ডেস্কের উপরে ঝুঁকে পড়ে  একটা ফাইল দেখছিলেন আমজাদ আলী সাহেব। মাথা না তুলেই সালামের জবাব দেন তিনি। ওয়ালাইকুম সালাম

 

বড় স্যারকে তার দিকে তাকাতে না দেখে ডেস্ক পরিষ্কার করার ন্যাকড়াটা হাতে তুলে নেয় দুলাল মিয়া। তারপর অযথাই ধুলোহীন টেবিলটাকে পরিষ্কার করতে থাকে। সকালবেলাতে একবার পরিষ্কার করে গেছে আমজাদ সাহেবের টেবিলটা সে। বড় স্যারের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অকারণেই খুশখুশ করে কেশে উঠে। কাশির আওয়াজেই হয়তো মাথা তুলে তাকায় আমজাদ আলী সাহেব। জিজ্ঞাসু চোখে তাকান দুলাল মিয়ার দিকে।

 

দুলাল, কিছু বলবা?

 

বড় স্যারকে তার দিকে তাকাতে দেখেই সামনের দিকে ঝুকে কুঁজো হয়ে যায় দুলাল মিয়া। ন্যাকড়া ধরা হাতটা চলে গিয়েছে শরীরের পিছনে। অন্য হাত দিয়ে খামোখাই মাথা চুলকাতে থাকে সে।

 

স্যার একশটা টাকার খুব দরকার ছিল।

 

চশমার ফাঁক দিয়ে স্থির চোখে দুলালের দিকে তাকিয়ে থাকেন আমজাদ সাহেব। কিছু বলেন না।

 

সামনের সপ্তাহে বেতন পেলেই শোধ দিয়ে দেব স্যার। মাসের শেষতো। সে কারণে হাতটা একটু টান, স্যার। হড়হড় করে বলে উঠে দুলাল মিয়া।

 

মাসের শেষতো আমারও। হাত টানাটানি আমারও চলছে। ছেলেটা আমেরিকায় পড়ে। ওর পিছনে জন্য মাসে কত টাকা পাঠাতে হয় জানো? গম্ভীর স্বরে বলেন আমজাদ সাহেব।

 

স্যার, ছোট ছেলেটার অসুখ করছে। তিনদিন ধরে জ্বর। ওরে ডাক্তার দেখানো লাগবো। আরো অনেকের কাছেই গেছি। কেউই দেয় নাই। সবারই নাকি টানাটানি চলতেছে। আপনি স্যার মা-বাপ। আপনি না দিলে যে ছেলেটারে ডাক্তার দেখাতে পারবো না

 

তোমারেতো এর আগেও একবার একশ টাকা দিছিলাম। বলছিলা যে পরের মাসের বেতন পেলেই ফেরত দিবা। সেই টাকা পেতে আমার সময় লাগছে ছয়মাস। এইবারতো মনে হয় ছয়বছর লাগাবা ফেরত দিতে। তাই না? রসিকতার সুরে বলেন আমজাদ আলী সাহেব।

 

ভুল হয়ে গেছিলো স্যার। আপনার পায়ে পড়ি। মাফ করে দেন। এমন ভুল আর হবে না। বেতন পাওয়ার সাথে সাথে আপনার টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবো। আল্লাহর কসম, স্যার।

 

আল্লাহর কসমতো আগেরবারও কাটছিলা। কিন্তু…………।

 

শুধু আল্লাহর কসম না স্যার। আমার অসুস্থ ছেলেটারও নামে কসম কাটছি। এক তারিখে সত্যি সত্যি ফেরত দিয়ে দেবো।

 

প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুলাল মিয়ার করুণ চেহারা দেখে আমজাদ আলীর মনে ক্ষীণ একটু দয়া জাগ্রত হয়। তিনি মানিব্যাগ একশ টাকার একটা মলিন নোট বের করেন।

 

ছেলের নামে কসম কাটছো। মনে থাকে যেন। ইঁদুরের লেজের মত করে ধরে টাকাটা দুলালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন।

 

টাকাটা ভাজ করে সযত্নে পকেটে পুরে দুলাল মিয়া। তারপর ধরা গলায় বলে,

 

মনে থাকবে, স্যার।

 

(২)

 

ম্যানেজারের রুমের বাইরে একটা কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছে মোহসিন। তাদের ছোট্ট এই মফস্বল শহরের চৌরাস্তার একমাত্র হার্ডওয়ার দোকানের মালিক সে। অবশ্য একা মালিক নয়। তার আবাল্যবন্ধু শওকতও তার সাথে এই ব্যবসার শরীক রয়েছে। কিছুদিন ধরেই ব্যবসার অবস্থা বেশি ভাল না। পুঁজির টানাটানি চলছে। তার বা শওকত কারোর পক্ষেই ব্যবসাতে আর টাকা ঢালার মত অবস্থা নেই। ইসলামি ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব সন্ধ্যায় তাদের সাথে পাড়ার ক্লাবে মাঝে মাঝে ক্যারম খেলতে আসেন। একদিন তিনিই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ব্যাংকের যে লোন প্রোগ্রাম আছে সেখান থেকে লোন নিতে। সেই ভরসাতেই ব্যাংকে এসেছে সে। কিন্তু আসার পরেই এক জুনিয়র অফিসার এখানে বসিয়ে রেখেছে ম্যানেজার স্যার ব্যস্ত বলে।

 

টানা দেড় ঘন্টা ধরে বসে রয়েছে সে। জানে না যে ইচ্ছা করেই তাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছে ম্যানেজার সাহেব। নয়া দিগন্তের সর্বশেষ পাতাতা পড়া শেষ হতে বেল বাজিয়ে পিওনকে ডাকেন ম্যানেজার সাহেব। মোহসিনকে ভিতরে পাঠাতে বলেন।

 

সালাম দিয়ে ম্যানেজারের রুমে ঢোকে মোহসিন।

 

সামনে রাখা খোলা ফাইল থেকে চোখ তুলে পালটা সালাম দেয় ম্যানেজার সাহেব। তারপর ঠান্ডাস্বরে বলেন।

 

বসুন।

 

ম্যানেজারের শীতল আচরণে কিছুটা ভড়কে যায় মোহসিন। তাড়াহুড়ো করে একটা চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে প্রায় উল্টেই ফেলেছিল সে। ম্যানেজার স্যার সবসময় তুমি তুমি করে বলেন। এখন কি কারণে আপনি করে বলছেন বুঝতে পারছে না সে।

 

মোহসিন বসতে আনুষ্ঠানিক স্বরে তিনি বলেন, আপনার জন্য কী করতে পারি?

 

একটা লোনের জন্য এসেছিলাম স্যার।

 

কিসের লোন? ফ্রিজ নাকি টিভির জন্য?

 

না স্যার ওগুলো নয়। বিজিনেস লোনের জন্য এসেছিলাম।

 

কিসের ব্যবসা করেন আপনি?

 

একটা হার্ডওয়ারের দোকান আছে শহরের চৌরাস্তায়। ওর জন্যই লোন চাচ্ছি, স্যার।

 

বেশ বেশ। তা কত টাকা চাচ্ছেন?

 

পাঁচ হাজার টাকা, স্যার।

 

পাঁআআআচ হাজার? আচ্ছা, ঠিক আছে, পাবেন হয়তো। কিন্তু ব্যবসায়ের মালিকানা প্রমাণ করতে হবে। ট্যাক্সের কাগজপত্র লাগবে। আর বেচা-বিক্রির সব রিসিট দাখিল করতে হবে দরখাস্তের সাথে। কোনো দেনা পাওনা থাকলে সেটাও ডিক্লেয়ার করতে হবে।

 

আল্লাহর রহমতে কোনো দেনা নেই স্যার। বিক্রির সব রিসিটও দাখিল করতে পারবো। ইনকাম ট্যাক্স নিয়মিতই দেই।

 

গুড গুড। ব্যবসাতেতো আপনার একজন পার্টনার আছে। তাই না?

 

মোহসিনকে মাথা নাড়তে দেখে বলেন, তাকেও সই করতে হবে দলিলের কাগজপত্রে।

 

ঠিক আছে।

 

আপনার স্ত্রীকেও সই করতে হবে।

 

আচ্ছা, করবে।

 

আপনার মাকেও সই করতে হবে।

 

মাকেও করতে হবে? বুড়ো মানুষ স্যার।প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে মোহসিন।

 

হ্যা, তাকেও করতে হবে। নইলে লোন পাবেন না। শীতল গলায় বলেন ম্যানেজার সাহেব।  

ঠিক আছে, করবে স্যার, মা-ও সই করবে। তাড়াতাড়ি বলে উঠে মোহসিন। টাকাটা খুবই প্রয়োজন তার।

 

আর, আরেকটা কথা। চশমার ফাঁক দিয়ে কঠিন চোখে মোহসিনের দিকে তাকান ম্যানেজার সাহেব। আপনাকে কখনো মসজিদে দেখি না। এখন থেকে যেন নিয়মিত দেখতে পাই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সব মুসলমানদের জন্য ফরজ। আপনার বন্ধুকেও বলবেন কথাটা।

 

(৩)

 

গেলমান এফ রহমানকে তার চেম্বারে ঢুকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে দ্রুতগতিতে দরজার কাছে চলে আসেন সোনালি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি।

 

গুড আফটারনুন স্যার। আপনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। জেনারেল ম্যানেজার সাহেব আমাকে বলেছেন যে আপনি আজকে আসবেন।

 

প্রেসিডেন্টের বাড়িয়ে ধরা হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নেন গেলমান রহমান। মিহি কণ্ঠে বলেন কেমন আছেন প্রেসিডেন্ট সাহেব? কেমন চলছে সব?

 

আপনাদের দোয়ায় সবকিছুই ভাল চলছে স্যার।

 

গেলমান রহমানকে ভিতরে নিয়ে আসেন তিনি।

 

স্যার আমার চেয়ারটাতে বসেন। এই চেয়ারটা বড় আর আরামদায়ক।

 

আরে না না, আমি এখানেই ঠিক আছি। প্রেসিডেন্টের টেবিলের সামনের দিকের একটা চেয়ারে বসতে বসতে উদারস্বরে বলেন।

 

কী খাবেন স্যার? ঠাণ্ডা না গরম? টেবিলের উপরে রাখা ইন্টারকমের বোতামের উপর হাত রেখে ব্জিজ্ঞাসা করেন।

 

কিছু খাবো না প্রেসিডেন্ট সাহেব। আজকে সময় নেই। আমি এসেছি শুধু ওই পঞ্চাশ কোটি টাকার লোনের বিষয়টা ফায়সালা করতে।

 

আপনি যে দয়া করে এসেছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ আমরা। গদগদ ভাবে বলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব।

 

মাত্র পঞ্চাশ কোটিতেই কি আপনার হবে স্যার? আপনি যদি একশ কোটি নিতেন তবে আমরা আরো খুশি হতাম।

 

‘নাহ, আপাতত পঞ্চাশ কোটিতেই হয়ে যাবে। পরে প্রয়োজন হলে না হয় আবার আসবো আপনাদের কাছে।’

 

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আসবেন, স্যার। আপনাদের খেদমতের জন্যইতো আমরা আছি।

 

‘কোনো সিকিউরিটি বা গ্যারান্টি জাতীয় কিছু কি দিতে হবে নাকি?’

 

কী যে বলেন স্যার? আপনার চেয়ে বড় সিকিউরিটি আর কি আছে এই দেশে? কিছুই লাগবে না আপনার জন্য।

 

কোথায় কোথায় সই করতে হবে বলেন, করে দিয়ে যাই। অমায়িকভাবে বলেন গেলমান রহমান।

 

কোথাও সই করা লাগবে না স্যার আপনাকে। আমার অফিসের লোকেরাই ওগুলো দেখাশোনা করবে।

 

থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ প্রেসিডেন্ট সাহেব। ইউ আর রিয়েলি এক্সট্রিমলি কাইন্ড। এখন তাহলে আমি উঠি। এদিকে এসেছি যখন জোহরের নামাজটা বায়তুল মোকাররম মসজিদেই পড়ে যাই। গেলমান এফ রহমান তাঁর সাদা দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন।

 

বিনাক্লেশে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই পঞ্চাশ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে যায়।

 

_______________________________________________

(স্টিফেন লিককের ছোটগল্প হাউ টু বরো মানি-র ছায়া অবলম্বনে রচিত)