পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ২)

দিনাজপুরে লিচুর ফলন ভালো না হওয়ায়, ফজলুল হক হলের সামনে দুই দুইটা গাড়ীর কাচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। বিদ্যা-শিক্ষা-সভ্যতা মানুষের বন্য স্বভাবটাকে কিছুটা হয়তো দমিয়ে রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু সহজাতভাবে মানুষের প্রবৃত্তি হচ্ছে ধ্বংস করা। দিনাজপুরের মেধাবী ছাত্রী জলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে রোকেয়া হলে থাকছে। পারিবারিকভাবে তাদের রয়েছে লিচুর আড়ত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসা। কিন্তু এবার লিচুর ফলন ভালো হয়নি, কিছুক্ষণ আগে বাসায় কথা বলার পর জেনেছে। পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত এবং স্বভাবতই জলিরও মন খারাপ। মন খারাপ থাকার কারণে, কি না কি বলতে বলতে এক পর্যায়ে পাভেলের সাথে কথা কাটাকাটি করে ফেললো জলি। পাভেল ফজলুল হক হলে থাকছে। পাভেলের সাথে জলির সু-সম্পর্ক বিদ্যমান এ-কথা বলে দেবার প্রয়োজন থাকলেও, বাংলার প্রেমিকদের মন খারাপের দায়ভার যে নিরপরাধ সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়, সেটা হয়তো বলে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। রাত এগারোটা, রুম থেকে স্ট্যাম্প নিয়ে বের হয় পাভেল। তারপর নীচ থেকে চিৎকার করে ডাক দেয়, গাড়ী ভাঙ্গতে কে কে যাবি? গাড়ীগুলোর অপরাধ হচ্ছে, এত রাতে তারা হলের পাশের রাস্তা দিয়ে, এত জোরে শব্দ করে চলছে? এতে করে স্টুডেন্টদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অতএব, একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে, এর একটা বিহিত করা পবিত্র কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। চরম সত্যটুকু হচ্ছে, পাভেলদের ডাকে সাড়া দিয়ে গাড়ি ভাঙ্গার লোকের অভাব হয়নি কখনো, হই-হই রই-রই করে রড স্ট্যাম্প নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের অসতর্ক আচরণের ফল হিসেবে, সোডিয়াম বাতির তীব্র আলোকে চকচক করতে থাকে, এ-দিক সে-দিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, কাচের ভাঙ্গা টুকরোগুলি। তাদেরই-বা দোষ কি, দোষতো সব দিনাজপুরের লিচুর।

কোন এক দুরন্ত বিকেলে, সূর্য যখন তার তীব্র আলো কমিয়ে দিয়ে, শহীদুল্লাহ হল অতিক্রম করে, ঢাকা মেডিকেলের পিছন দিকটায় গিয়ে সবেমাত্র অস্ত যেতে শুরু করেছে, ঠিক তখনটাতে বিকেল বেলার আয়েশি ঘুম ভেঙ্গে শুনি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছি। ঘুমাতে গেলাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী হয়ে, ঘুম থেকে উঠে শুনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তার সাথে সাথে, এতদিন ধরে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটার সায়েন্সের পার্থক্য নিয়ে যে পরিমাণ মাথার ঘাম ঝরাতে হয়েছে সেটা থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম একেবারে নিয়ম-নীতি করে। বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এই দেশের নিয়মগুলি। হাইকোর্টের উকিল থেকে প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সবার প্রশ্ন ওই একটাই, ইঞ্জিনিয়ারিং আর সায়েন্সের পার্থক্যটা কি এবং কোনটা খারাপ? বিচিত্র এই দেশের মানুষগুলি মিল খুঁজতে পছন্দ করে না, সাদৃশ্য খুঁজতে পছন্দ করে না; পছন্দ করে অমিল আর সাতন্ত্র্য খুঁজতে। অতএব, যে-দেশে যে-আচার। হওয়ার মধ্যে যেটা প্রমাণিত হলো, যাহাই কম্পিউটার সায়েন্স তাহাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। পাবলিক এবার শান্তিতে থাকুক। আসলে অনেক আলাপ আলোচনা করে আমাদের চেয়ারম্যান স্যারকে এটা বুঝানো সম্ভব হলো যে, শুধু সাবজেক্ট এর নামের মধ্যে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং শব্দ না থাকার কারণে টনে টনে প্রিন্সটন আর মণে মণে কার্নেগি মেলনের স্কলারশিপ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের এই পরিমাণ দুঃখের কাহিনী শুনে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। অতএব, যারপরনাই চেষ্টা করে, এদিক-ওদিক ম্যানেজ করে, বিভাগের নাম পরিবর্তন করার শ্রমসাধ্য কাজটি করে ফেললেন। কিন্তু বিচিত্র এই দেশে, যেখানে কাজের মূল্যায়ন কাজ দিয়ে হয়না, কাজের মূল্যায়ন হয় নাম দিয়ে, স্টিকার দিয়ে; সেখানে এরকম একটি স্টিকার পাওয়ার আনন্দে আমরা সীমাহীন আনন্দিত এবং বিনিময়ে চেয়ারম্যান স্যারকেও কিছু একটা উপহার দিয়ে খুশি করানো আমাদের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে হতে লাগলো। কিন্তু কিছু একটা উপলক্ষ্য-তো লাগবে। এদিক-ওদিক অনেক কিছু চিন্তা ভাবনার পর, অবশেষে উপলক্ষ্য হয়ে আসলো ক্রিকেট। চেয়ারম্যান স্যারেরের সেই ক্রিকেটিয় উপহার নিয়ে বলার আগে আমাদের ক্রিকেটময় জীবন সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা বিশাল অংশ অধিকার করে ফেলেছে এই সর্বনাশী খেলাটা। সর্বনাশীই-বা বলছি কেন, দিনের সত্তরভাগ সময়ইতো এই ক্রিকেট খেলে, আড্ডা মেরে, ঘুরে-ফিরে কাটিয়ে দিচ্ছি আর বাকী তিরিশভাগ সময় লেখাপড়া করে নষ্ট করছি। মাইনর পরিমাণে মেজর ক্লাশ আর মেজর পরিমাণে মাইনর ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে এক এক করে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ার প্রায় সবগুলি মাঠেই খেলতে শুরু করলাম। এমনকি, ফুলার রোডের আবাসিক এলকায়, হিমবাহের মত গম্ভীর সব প্রফেসরদের নাকের ডগায় অবস্থিত, শান্ত-শিষ্ট ব্যাডমিন্টন কোর্টগুলিও আমাদের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। এগারো জনের ক্রিকেট টিম আমাদের। তার মধ্যে নয়জন প্লেয়ার। বাকী দুইজনের একজন ক্যাপ্টেন, অন্যজন মালিক। মালিক মানে একটা যুতসই রকমের ব্যাটের মালিক। তাকে দলে রাখতে হয় তার ওই ব্যাটখানার জন্য। একাদশে জায়গা না হলে, সে তার ব্যাট দিয়ে কাউকে খেলতে দিবে না। অন্যদিকে, আমাদের ক্যাপ্টেন- বোলিং, ব্যাটিং এবং ফিল্ডিংয়ে শুধু দুর্বল, অন্য আর সবকিছুতে ভালো। তার ব্যাটিং গড় শূণ্য দশমিক কিছু একটা। অন্য আর সবকিছু ভালো হবার নমুনা হিসেবে বলা যেতে পারে, যখন সে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়ায়, এক পর্যায়ে কানে কানে এসে বলে যাবে, এই ওভারের তিন নাম্বার বলটা নো-বল দেব, ডাউন-দ্যা-উইকেটে এসে মারতে হবে। সে বলত আমি ব্যাটস্‌ম্যান হিসেবে রান না করতে পারলেও, আম্পায়ার হিসেবে বিশ রান করে দেব। ইচ্ছে মত নো-বল দিয়ে, পরিষ্কার রান আউটেও হিমালয়ের মত অনড় থেকে অতিরিক্ত বিশ রান সে সত্যিই যোগ করে দেয়। কখনো কখনো আবার দেখা যায়, সমস্ত মাঠের খেলোয়াড়দের দাঁড় করিয়ে রেখে, হঠাৎ করে আম্পায়ারিং ছেড়ে মাঠ থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে স্কোরারের কাছে চলে আসছে, তারপর ফিসফিস করে স্কোরারের কানে কানে বলছে, রানের সাথে ঠিকমত পানি মিশাচ্ছোতো? এরকম একজন গুণবান ছেলে হবার কারণে দলে জায়গা পেতে তার কখনো সমস্যা হয় নি।

সে যাই হোক, আমরা চাইলাম এই ক্রিকেটটাকে ব্যবহার করে চেয়ারম্যান স্যারের জন্য কিছু একটা করতে। স্যারকে গিয়ে সবাই একযোগে বললাম, দেশে যদি প্রধানমন্ত্রী কাপ, প্রেসিডেন্ট কাপ হতে পারে, তাহলে কেন চেয়ারম্যান কাপ হতে পারবে না? এটা সময়ের দাবী। আমাদের অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপোযোগী প্রশ্ন শুনে চেয়ারম্যান স্যার আর হাসি লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। স্যারের সে হাসির খেসারত হিসেবে পরবর্তী একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে, পাস হয়ে গেলো ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট আর পরিকল্পনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালের কম্পিউটার সায়েন্স এবং বর্তমানের ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউওটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রস্তুত হতে থাকলো তাদের ইতিহাসের সর্বপ্রথম চেয়ারম্যান কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য। পরবর্তীতে বছরের পর বছর জুড়ে হয়তো চলতে থাকবে এ টুর্নামেন্ট, কিন্তু তখন কেউ আর ফিরেও দেখবেনা ইতিহাসের দিকে। আজ আমাদের পদচারণায় মুখরিত যে মাঠ-প্রান্তর-কক্ষ, কালকের বর্ষার বৃষ্টি ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে আমাদের সর্বশেষ পদধূলিটুকুও। সেদিন এখানেই তৈরি হবে নতুন এক বর্তমানের। তবুও আমাদের সকল গান, সকল কবিতা ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের উত্তরসুরীদের জন্য, যেমনটা আমরাও অনুসরণ করে এসেছি আমাদের পূর্বসুরীদের।

কিন্তু তাই বলে সকল পূর্বসুরীদের অনুসরন করতে হয় না। শহীদুল্লাহ হলের এক্সটেনশান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে রুমের হিসেব নিচ্ছে মহানায়কেরা। কোন রুম থেকে কে কে মিছিলে আসলো। একজন একজন করে নিচে নেমে জড়ো হচ্ছে প্রথম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। কারো দুইদিন পর পরীক্ষা, কারো-বা গায়ে খানিকটা জ্বর। কিন্তু এটা অজুহাত হিসেবে যথেষ্ট না, তাদেরকেও যেতে হবে মিছিলে, মহাসমাবেশে। পরের দিন পত্রিকার পাতায় বিশাল করে রঙিন ছবিসহ খবর আসবে, মহাসমাবেশে ভাষণ দিয়ে ভাসিয়ে ফেলেছেন মহানেতারা। কিন্তু তারা কি জানেন, সাধারণ মানুষকে, সাধারণ ছাত্রদেরকে কতটা মহাযন্ত্রণা দেবার বিনিময়ে তাদের আদরের সোনার ছেলেরা ময়দানে এনে জড়ো করেছেন এ-সমস্ত জনসমাবেশের জনগণদের। জানেন না, জানার প্রয়োজনও মনে করেন না। প্রয়োজন মনে করলে সেটা আর রাজনীতি হতো না।

প্রথম যে-দিন হলে উঠি, সে-দিন থেকে আমার নিজ এলাকার সিনিয়র ভাই, যথাসম্ভব আন্তরিকতা আর যত্ন দিয়ে আমাকে দিনের পর দিন নিজের রুমে থাকতে দিচ্ছেন। প্রতিটা জিনিস নিজ হাতে দেখিয়ে, শিখিয়ে দিচ্ছেন। তার আন্তরিকতা আর যত্নের কোন অভাব নেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি তাকে কখনো হাত তুলে সালাম দেয়নি, প্রয়োজনও মনে করিনি। অথচ, হলের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি তাদেরকে দিনে যতবার দেখছি, পারলে দুই হাত তুলে সালাম দিচ্ছি। কিন্তু সালাম কার পাবার কথা, শ্রদ্ধা কার পাবার কথা? আমার সেই সিনিয়র ভাইয়ের, না-কি হলের ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্্‌ সেক্রেটারির? না, যে-দিন আমি এই চরম সত্য বুঝতে পেরেছি, উপলব্ধি করতে পেরেছি, সে-দিন থেকে হলের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিকে সালাম দেয়া বন্ধ করে দেয়নি। তুমি যদি একই প্রতিষ্ঠানে পড়ে, একই কেন্টিনের ভাত খেয়ে রাজনীতি বুঝে থাকো, তাহলে আমিও তোমার থেকে কম রাজনীতি বুঝিনা। দুর্ব্যবহারের বিনিময়ে আদায় করে নেয়া সালাম তুমি নিবে, নাও; কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জীবনের বাকীটা সময়, যখন তোমার দিকে আমি দয়া আর করুণার দৃষ্টিতে তাকাবো, তোমার দুর্ব্যবহার আর অনাচারের কথা চিন্তা করে বড়জোর তোমাকে ক্ষমা করে দেব, তখন আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেও, যত্ন করে হলে রাখা আমার সেই সিনিয়র ভাইকে বসার জন্য চেয়ার ছেড়ে দেব। নোংরা রাজনৈতিক পরিবেশের মাঝে বড় হওয়া এই নোংরা আমি, নোংরা হাসিতে আড়াল করে পরের দিন থেকে আরো লম্বা করে নোংরা সালাম দিতে থাকি। শ্রুতিমধুর শব্দের ছদ্মবেশে ঢেকে দিয়ে হয়তো একেই আমরা বলি রাজনীতি!

পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৪)

(চলবে…)

[email protected]
Nov 25, 2010