পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ১)

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরপরই অসংখ্যবার ‘কোন সাবজেক্টে ভর্তি হলাম এবং কেন ভর্তি হলাম’ জাতীয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সাবজেক্টের নাম ‘কম্পিউটার বিজ্ঞান’ শুনেই সাধারণ মানুষজন বেজায় নাখোশ হয়ে যাচ্ছে। তাদের নাখোশ হবার কারণটাও সহজেই অনুমেয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোনো সাবজেক্টের নাম শুনেই তারা তৃপ্তিময় দয়ার হাসি হাসতে থাকেন, তাদের দয়ার শরীর থেকে দয়া তখন গ’লে গ’লে পড়ে। সেই সাবজেক্টে দেশে কোনো চাকুরী না থাকায়, পাশ করবার পরপরই যে পরিমাণ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেটা ভেবে দুশ্চিন্তার তাদের অন্ত থাকে না। কিন্তু এই ১৯৯৯ সালেও বাংলাদেশে ‘কম্পিউটার বিজ্ঞান’ তুলনামূলকভাবে নতুন সাবজেক্ট হবার কারণে তারা কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না, এটা আসলে কি জিনিস, কি হবে এটা দিয়ে। কিন্তু তাই বলে থেমে যাবার পাত্রও তারা নন। অহরহ অনুরোধ নিয়ে আসছেন, প্রিন্টার নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা একটু ঠিক করে দিতে হবে। আমি প্রিন্টার ঠিক করতে পারি না শুনেই আকাশ থেকে প’ড়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি না কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়।’ তবে যেটা বুঝাতে গিয়ে রীতিমত আমার কান্না পেতে লাগল, সেটা হচ্ছে- ফকিরাপুল এলাকায় মাত্র এক হাজার টাকায় যে কম্পিউটার শেখানো হয়, তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার শেখার পার্থক্য কি? কেউ কেউ আবার সরস মন্তব্য করলো, ‘আরে, একটাতে আট মাস লাগে, আরেকটাতে আট বছর লাগে, আর কোনো পার্থক্য নেই।’

এর মাঝখানে ব্যতিক্রম হয়ে ধরা দিলেন পূর্বপরিচিত এক উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। এই লোকটি আমাকে ব্যাপক পরিমাণ উৎসাহ দিয়ে বলে যেতে লাগলেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই না আমি নিয়েছি। উল্লেক্ষ্য, কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি হবার জন্য মেডিকেল ভর্তি বাতিল করবার কারণে কাছের মানুষজনের কাছ থেকে আমাকে যারপরনাই কটু কথা শুনতে হচ্ছে। এর মাঝে এই ভদ্রলোক যেন আশীর্বাদ হয়ে নাজিল হলেন। কিন্তু তাতে কি, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। শেষের দিকে এসে তিনি এমন একটা কথা বললেন, তাতে আমার আশ্রয় পাবার সর্বশেষ স্থানটুকুও কলঙ্কিত হয়ে গেলো। তিনি অত্যন্ত আস্থার সাথে আমাকে বললেন, ‘তোমরা কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়লেই সমাজের এই দুষ্টুলোকগুলোকে সামলানো যাবে।’ কোন দুষ্টুলোকের কথা বলছেন সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরে। চরম নাটকীয় ভঙ্গিতে তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘মতিঝিল এলাকায় সেদিন দেখলাম, কম্পিউটারের দোকান থেকে মালিক বাইরে যাবার সাথে সাথে কর্মচারীটা কী-বোর্ডের মধ্যে ইঞ্জেকশান দিয়ে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তোমরাই এগুলো ঠেকাতে পারবে।’ আমি কিছুক্ষণ তাজ্জব হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, তারপর বললাম, ‘কী-বোর্ডে ইঞ্জেকশান ঠেকানোর জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে হবে কেন, লম্বা চওড়া দেখে একটা পাহারাদার বসিয়ে রাখলেইতো হয়? ’

সে যাই হোক। ভর্তি যখন হয়েই পড়েছি জগতের নির্মম নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষাতো দিতেই হবে। জীবনে বসন্তও আসে, আবার পরীক্ষাও আসে। কিন্তু তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে-তারিখ দিয়েছে, সে-তারিখে পরীক্ষা দিলেতো সমাজে আর মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। একটা স্ট্যাটাস আছে না! অতএব, আন্দোলন। মানি না, মানবো না। অমুক তারিখ পরীক্ষা হ’লে, জ্বলবে আগুন কার্জন হলে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে চোরের উপর বাটপারি বলেও একটা কথা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও যে-দিন থেকে পরীক্ষার তারিখ দেবার সিদ্ধান্ত নেন, সেটা না ব’লে দু’সপ্তাহ আগের একটা তারিখ ঘোষণা করেন; যাতে করে ছাত্ররা পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলন করলে পরীক্ষার তারিখ দু’সপ্তাহ অনায়াসে পিছিয়ে দিতে পারেন। সাপও মরলো লাঠিও ভাঙ্গলো না। সে-যাই হোক, অন্য সব ডিপার্টমেন্টের সবার সাথে সাথে আমি আর আমার রুমমেট গেলাম আন্দোলনে। বিজ্ঞান অনুষদের ডীন বললেন, ‘সব ডিপার্টমেন্ট থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি আসো।’ তিনি তাদের নাম আর রোল নম্বর কাগজে লিখছেন। আমাদের বুঝতে বাকী থাকলো না, আগামীকালই ডিপার্টমেন্টে নামগুলো পাঠিয়ে দেবেন, তারপর বুঝতে হবে কত ধানে কত চাল। আমরা দুজন গিয়ে সুন্দর করে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর দু’জন, যাদের কর্মকান্ডে সমস্ত ক্লাস অতিষ্ঠ, তাদের নাম আর রোল নম্বর নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়ে চলে আসলাম। পরবর্তী দিন ও-’দুজনকে চেয়ারম্যান স্যার ডেকে নিয়ে কি করেছিলো সেটা বলে আর পাপের পরিমাণ বাড়াতে চাই না। অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হলে বলতে পারি, দুজনের বারোটা বাজিয়ে, ক্লাসের অন্য আর সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলাম।

লিখিত পরীক্ষার পর বাকী আর পাঁচ-সাতটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একটা দিন আসে। কোন এক অজানা কারণে যে-দিন শিক্ষকেরা অতিরিক্ত রকমের মুখ টান টান করে রাখেন। যেন এই খানিকক্ষণ আগে তাদেরকে জানানো হয়েছে যে, আগামীকালের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সে-দিন তারা সবাই যেন বাংলা সিনেমার ‘চৌধুরী সাহেব’। দেখে মনে হয়, সমস্ত ‘গরীব কিন্তু ছোটলোক নয়’ স্টুডেন্টদের সাথে কয়েকপুরুষ ধরে চলে আসছে তাদের পারিবারিক বিদ্বেষ। সেই রাগে শুধু আজকের দিনটাতেই যেন শিক্ষকদের পায়ের তালু থেকে মাথার চুল পর্যন্ত কাঁপছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত ‘ভাইভা’ পরীক্ষার কথা বলছি। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তিনশত চৌষট্টি দিন ধরে এই একটা দিনের হুমকিই দিয়ে যায়, ‘ভাইভাতে দেখে নেয়া হবে। দেখে নেবার জন্য আর কোন অস্ত্র সমাজ তাদেরকে দেয়নি।’ কিন্তু তাতে কি! অপব্যবহারের জন্য অস্ত্র একটা হলেই যথেষ্ট। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা বিনয়ের সাথে ক্ষমতার ব্যবহার করেন। শিক্ষকেরাও মানুষ। ঠিক এখানটাতে আমি বিস্তারিত না বলে রেখে দিলাম। কারণ, এমন শিক্ষকও আছেন, যাদের দেখলে শত শত স্টুডেন্ট শ্রদ্ধায় মাথা নত করে ফেলে, যাঁদের বিনয়ী ও সত্যিকারের অভিভাবকসুলভ আচরণের কারণে শিক্ষক সমাজ এখনো শিক্ষক সমাজ। কত ছাত্র-ছাত্রীর জীবন নির্মিত হয়েছে তাঁদের দিক-নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে। তাঁদের সন্মানার্থে এই বিষয়টি আর না বাড়িয়ে এখানেই শেষ করলাম।

হঠাৎ একদিন। সত্যি বলতে গেলে, একদমই হঠাৎ একদিন দেখি, তুই তুই করে আন্তরিকতার সহিত নাম ধরে ডাকা আমার বন্ধুটি তুমিতে চলে গেলো, তুমি তুমি করে রাশভারী কণ্ঠে ডাকতে শুরু করলো। কিছুই বুঝতে পারছি না। নীলক্ষেতের মোড় থেকে রিক্সা ভাড়া করে সাথে উঠতে বললো। রিক্সাওয়ালার সাথে দামাদামী করলো। রিক্সাওয়ালা দশ টাকার কমে যাবে না। সে আরো এককাঠি সরস হয়ে বললো, বিশ টাকা দেবে। হল গেটে আসার সাথে সাথে রিক্সাওয়ালাকে মাত্র দুইটা টাকা আর সাথে লেখার অযোগ্য এমন কিছু বাক্য শুনিয়ে দিল, রিক্সাওয়ালা কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলো। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, এই পরশু দিনও ঠিক মত নিজের শার্টটা পরতে না-পারা আমার বন্ধুটার হলোটা কি? হল গেইট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে দেখি, জুনিয়ররা মায়া মাখানো ভঙ্গিতে জড়সড় হয়ে কাচুমাচু করে তাকে সালাম দিচ্ছে। আমার আর বুঝতে বাকী থাকলো না, আমার বন্ধুকে এখন আর কেন্টিনে খেয়ে টাকা দিতে হবে না; চায়ের দোকানে দোকানদার তাকে চা দেবে, সাথে সালামও দেবে, কিন্তু ভুলেও টাকা নেবে না। অথচ আমি চা চাইলে বলবে, একটু পরে আসেন। আমার বন্ধু এখন মহামান্য নেতা, লিডার। সে এখন অসাধারণ ছাত্র, আর আমি সাধারণ ছাত্র।

ভারাক্রান্ত আর অনিশ্চিত মন নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে চলি। মন, বিচিত্র সে-জিনিস কখন যে ভালো হবে আর কখন যে খারাপ হবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারবে না। মিনিটের মধ্যেই বিচিত্র এই মন অসম্ভব রকমের ভালো হয়ে গেলো। আমারই আরেক বন্ধু, হসপিটালে যাচ্ছে। অসহায় কোন মহিলা, ঢাকা শহরে যার হয়তো পরিচিত একটা লোকও নেই, কেউ হয়তো তাকে বলে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবাসিক হলে গিয়ে খোঁজ করে দেখতে পারে। তার ছোট্ট মেয়েটা হসপিটালের ফ্লোরে শুয়ে আছে। রক্ত দরকার। আমি দেখেছি আমার বন্ধু নিজের পকেটের টাকা খরচ করে চলে যাচ্ছে হসপিটালে রক্ত দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়, এ-এক অদ্ভুত জগৎ, আজব জায়গা, সত্যিকারের ফ্যান্টাসী কিংডম। একই দিনে এক বন্ধুকে দেখেছি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টেনে নিয়ে আসা রিক্সাওয়ালার রক্ত চুষে খেতে; ঠিক অন্য বন্ধুকে আবার দেখেছি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টিউশনি করে আনা টাকায় নিজে রিক্সা ভাড়া দিয়ে, অসহায় কারো জন্য নিজের শরীরের রক্ত দিতে হসপিটালে যেতে। দুঃখ পাওয়ার মত কারণ এখানে যেমন আছে, সুখি হওয়ার মত কারণও কম নেই। জীবনে নিম্ন রুচিবোধসম্পন্ন মানুষের আচরণে যেমনটা ছোট হয়ে গেছি, বিবেকবান মানুষের মহানুভবতায় আবার প্রাণবন্তও হয়ে গেছি। কখনো রোদ, কখনো মেঘ, কখনো-বা বৃষ্টি; এর নামই বুঝি জীবন!

পরবর্তী পর্ব (পর্ব ৩)
(চলবে…)
[email protected]
Nov 19, 2010